প্রতিক্রিয়া- ‘পুলিশ থাকতে র্যাব কেন?’ by আবুল কাশেম
গত ২৮ মে প্রথম আলোয় প্রকাশিত মশিউল
আলমের নিবন্ধ ‘পুলিশ থাকতে র্যাব কেন’ অনেকাংশে জনৈক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল
(অব.) চৌধুরী ফজলুল বারীর বাংলাদেশের আমেরিকান দূতাবাসের কর্মকর্তাদের
কাছে দেওয়া বক্তব্যকে উপজীব্য করেই লেখা হয়েছে বলে প্রতীয়মান। এ ছাড়া,
মতামতে লেখকের নিজস্ব কিছু বক্তব্যও রয়েছে। ফজলুল বারী পুলিশ বিষয়ে
বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কোনো ব্যক্তি নন। পুলিশ বিষয়ে তাঁর গবেষণাধর্মী কোনো
প্রবন্ধ বা লেখা দেখতে পাওয়া যায় না। তবে লেখক প্রথম আলোর মতো একটি
জনপ্রিয় ও মর্যাদাবান পত্রিকায় ফজলুল বারীর বক্তব্য উপস্থাপন করার কারণে এ
বিষয়ে তথ্যভিত্তিক, বস্তুনিষ্ঠ ও নির্মোহ আলোচনা বিভ্রািন্ত নিরসনে সহায়ক
হবে বলে অনুমিত হয়।
র্যাব মূলত বাংলাদেশ পুলিশেরই সাংগঠনিক কাঠামোভুক্ত একটি স্বতন্ত্র ইউনিট এবং এটি গঠনের জন্য কোনো নতুন আইন না করে, বরং দি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৯ কিছুটা সংশোধন করে দি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ২০০৩-এর আওতায় বিদ্যমান আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের মতো আইজিপির অধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন র্যাব গঠন করা হয়। উল্লিখিত আইনের ধারা ৫ অনুযায়ী, এপিবিএন ও র্যাব সরকারের তদারকিভুক্ত এবং আইজিপি কর্তৃক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত একটি ফোর্স। ২০০৪ সালের ২৮ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত র্যাব গঠনসংক্রান্ত সভায় র্যাবের মহাপরিচালক আইজিপির সরাসরি কমান্ড ও কন্ট্রোলে দায়িত্ব পালন করবেন মর্মে সিদ্ধান্ত হয়। র্যাবের সৃজিত পদগুলোর বেতন স্কেল অসামরিক তথা পুলিশের পদের বেতন স্কেলের ভিত্তিতে সৃজিত হয়েছে, সামরিক বাহিনীর বেতনকাঠামোর ভিত্তিতে নয়। র্যাব বাংলাদেশ পুলিশের একটি বিশেষায়িত ইউনিট। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে অধিকতর জোরদার ও কার্যকর করার লক্ষ্যে বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য পুলিশের অধীনে বিভিন্ন বিশেষায়িত ইউনিট গড়ে তোলা হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
পুলিশের ব্যর্থতার কারণে র্যাব সৃজিত হয়েছে মর্মে যে কথা বলা হচ্ছে, তা যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক। যদি আট থেকে দশ হাজার লোক দিয়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষা সম্ভব হয় তাহলে ব্যর্থ পুলিশের খাতে ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যয় কেন? ব্যর্থ বাহিনী হিসেবে পুলিশকে নিয়ম অনুযায়ী বিলুপ্ত করে দেওয়াই উচিত ছিল। র্যাবে সামরিক ও অন্যান্য বাহিনী থেকে আগত প্রায় ৫৬ ভাগ সদস্য বা কর্মকর্তাদের আইনি জ্ঞান কাঙ্ক্ষিত মানের হওয়ার কথা নয়। কারণ, তাঁরা সমরসংক্রান্ত বিদ্যা শিখেছেন। পুলিশি কার্যক্রমে প্রয়োজন হয় এরূপ আইন যথা: ফৌজদাির কার্যবিধি, দণ্ডবিধি পিআরবি এবং অন্যান্য আইন সামরিক একাডেমিতে বিস্তারিতভাবে শেখানো হয়, এমন তথ্য আমরা এখনো পাইনি।
সৃষ্টির পর এ পর্যন্ত র্যাবের অধিনায়ক পর্যায়ের (লে. কর্নেল বা সমমান) কর্মকর্তাদের মধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। এঁরা কেউই পুলিশ কর্মকর্তা নন। এ ছাড়া যাঁদের বিরুদ্ধে বর্তমানে অপহরণ, গুম প্রভৃতির মতো মারাত্মক অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে তাঁদের সিংহভাগই (প্রায় ৮০ ভাগ) পুলিশ কর্মকর্তা নন। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়, অপরাধ বা দুর্নীতি শুধু পুলিশে নয়, অন্যত্রও রয়েছে এবং সময়ে সময়ে তা মারাত্মক রূপ ধারণ করে। আর বাংলাদেশ পুলিশ যদি সরকার কর্তৃক রাজনৈতিকীকরণের শিকার হয়, সে ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক গঠিত র্যাব রাজনৈতিকীকরণের শিকার হবে না কেন? র্যাবকে ৭০ ভাগ ভাতা, উন্নততর যানবাহন, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সরকারই দিয়েছে এবং পুলিশের অন্য ইউনিটের তুলনায় দৃষ্টিকটুভাবেই বেশি দিয়েছে। হিসাবে দেখা গেছে, পুলিশের অন্যান্য ইউনিটে কর্মরত ২ দশমিক ৫ জন সদস্যের জন্য সরকারের যে ব্যয় হয় তা ব্যয় হয় র্যাবে কর্মরত একজন সদস্যের জন্য। সরকার পুলিশকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করবে আর র্যাবকে শুধু জনস্বার্থে ব্যবহার করবে, এ রকম চিন্তা বাংলাদেশের বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক আবহে মোটেই বাস্তবসম্মত নয়।
ফজলুল বারী কর্তৃক ‘পুলিশের ঘুষ, দুর্নীতি’র বিষয়ে মার্কিন দূতাবাসে প্রদত্ত বক্তব্য, যথা: ‘দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ এবং ভয়ংকর অপরাধীদের হাত থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে র্যাব প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে’, ‘পুলিশের প্রশিক্ষণের অভাব’, ‘জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তারা নিজ নিজ কার্যালয়ে বসে থাকতেই পছন্দ করেন’ প্রভৃতি মন্তব্য অজ্ঞতাপ্রসূত, অগভীর এবং তথ্য-উপাত্ত দ্বারা সমর্থিত নয়।
র্যাবের রাজনৈতিকীকরণের বিষয়ে ফজলুল বারীর বক্তব্য ‘সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক কারণে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিকে লক্ষ্যবস্তু করার নির্দেশ র্যাবকে দেওয়া হয়, তাহলে র্যাব সে অবৈধ নির্দেশ পালন করবে না’ বাস্তবতার নিরিখে অতি বাগাড়ম্বরপূর্ণ ও বাস্তবতাবিবর্জিত বলেই প্রতীয়মান। তদুপরি ফজলুল বারীর বক্তব্য ‘নৈতিক কারণে’ তিনি ‘রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারবেন না’ যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক। ফজলুল বারী র্যাব-১-এর অধিনায়ক থাকাকালে আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যার প্রধান সাক্ষী র্যাব-১-এর হেফাজতে মারা যান। এ জন্য গাজীপুরে মিছিলও হয়েছিল। পরে জানা যায়, মৃত্যুর কারণ ছিল ‘হার্ট অ্যাটাক’। ২০০৫ সালে ফজলুল বারীর পদিব ছিল কর্নেল। সরকাির চাকিররত অবস্থায় সরকারের অনুমতি ব্যতিরেকে একজন বিদেিশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সরকারের নেতিবাচক দিক তুলে ধরে আলোচনা করা নীতি-নৈতিকতা ও চাকরিবিধির পরিপন্থী ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর দ্বারা তিনি সেনাবাহিনীতে কৃত শপথ ভঙ্গ করেছেন। এহেন ব্যক্তি বিশ্বাসযোগ্য নন।
লেখক বলেছেন, ‘পুলিশি সমস্যাগুলো র্যাবে আরও বেশি মাত্রায় সংক্রমিত হলে র্যাব হয়ে উঠবে পুলিশের থেকেও বেশি বিপজ্জনক’ এবং ‘সেই সংক্রমণ থেকে র্যাবকে রক্ষা করার দায়িত্ব প্রধানত সরকারের, তবে র্যাবের নিজেরও সে ব্যাপারে আরও সজাগ হওয়া উচিত।’ উত্তম পরামর্শ বটে। প্রশ্ন হলো, ১০ হাজার জনবলসমৃদ্ধ র্যাবকে ‘সংক্রমণ’ থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব যদি ‘প্রধানত’ সরকারের হয়, প্রায় এক লাখ ৫৫ হাজার জনবলসমৃদ্ধ পুলিশ বাহিনী—যাদের কর্মকাণ্ডের ওপর দেশের আইনশৃঙ্খলা ও জনগণের শািন্ত ও নিরাপত্তা বহুলাংশে নির্ভর করে—তাদের ‘সংক্রমণ’ থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব কার? যদি সরকারেরই হয় এবং তারা তা করে, তাহলে ভিন্ন পেশা, ভিন্ন পেশাগত জ্ঞান, ভিন্ন মানসিক পরিকাঠামো, ভিন্ন সার্ভিস কালচার ও পরিবেশসমৃদ্ধ চার-পাঁচিট বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত ও দুই-তিন বছরের জন্য অতিথি হিসেবে আগত কর্মকর্তা-সদস্যদের নিয়ে মুখর এ র্যাবের উপযোগিতা কোথায়?
‘ক্রসফায়ারে’ দুর্বৃত্ত বা সন্ত্রাসী খুন করার জন্য বড় কোনো প্রশিক্ষণ বা অস্ত্রবল ও িক্ষপ্রতার প্রয়োজন নেই। পদ্ধতিগত ও সাবস্ট্যানটিভ আইন সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা নিয়ে সাক্ষ্য আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে আসামিকে গ্রেপ্তার ও আদালতে তার অপরাধ প্রমাণের জ্ঞাননির্ভর, জটিল ও সময়সাপেক্ষ পথকে পাশ কাটিয়ে ‘ক্রসফায়ার’ দ্বারা তথাকথিত সন্ত্রাসী খুন করা অনেক গুণ সহজ। যার কাজ তাকে দিয়ে না করিয়ে এবং পুলিশকে দুর্নীতিমুক্ত ও দক্ষ করে গড়ে তোলার পরিবর্তে ‘চৌকস ও িক্ষপ্র’ সামরিক বাহিনীর সদস্যকে নিত্যকার পুলিশি কাজে নিয়োজিত করার নজির বিশ্বের কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। উল্লেখ্য, যাদের ‘ক্রসফায়ার’ দিয়ে ‘আমজনতার আস্থা’ অর্জন করা হয়েছে তাদের সবাই বা বেশির ভাগই পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের হাতে বিভিন্ন সময়ে আটক হয়েছিল।
অপহরণ, গুম, ক্রসফায়ার বা কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ের (লেখকের ভাষায়) সর্বশেষ সংস্করণ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের ঘটনাকে প্রতীকী হিসেবে ধরে নিয়ে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের সমীপে এ আরজ রাখা যায় যে ‘কোথাও বোধ হয় একটু ভুল হয়েছে’। সাত খুন, মতান্তরে ১১ খুন, যদি একটি মাত্র বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়, তাহলে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে পরিচালিত এলিট ফোর্সের ভালো ‘প্রশিক্ষণ’, ভালো অস্ত্র ও িক্ষপ্রতা নিয়ে আমজনতার খুিশ থাকাই বিধেয় হবে। তবে ঘটনাটি যদি হিমশৈলের ক্ষুদ্র উপরি অংশ হয়, তাহলে সাধুদের সাবধান হওয়ার সময় বোধ হয় দ্রুতই পার হয়ে যাচ্ছে৷
আবুল কাশেম: অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার
No comments