আমৃত্যু জীবন–সন্ধানী by সাজ্জাদ শরিফ
সরদার ফজলুল করিম চলে গেলেন৷ এমন এক
ব্যক্তিকে আমরা হারালাম, যাঁর ভেতরে উচ্চতম মানবীয় আদর্শের এক সুষম
সমন্বয় ঘটেছিল৷ মানবমুখী রাজনীতি, মৌলিক বিদ্যার চর্চা আর প্রবল এক নীতি ও
শ্রেয়োবোধ একাকার হয়ে ছিল তাঁর জীবনে৷ আমাদের ইতিহাসের অন্ধিসন্ধির মধ্য
দিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন সরদার ফজলুল করিম৷ আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, ১৯৪০-এর
দশক থেকে বাংলার ইতিহাসের মধ্যে ভূমিকা রাখতে রাখতে তিনি অনন্য হয়ে
উঠেছিলেন, ক্রমাগত৷ তাঁর এ ভূমিকার এক প্রান্ত যদি হয় সমাজ-রাজনীতির
ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ এলাকা, আরেক প্রান্ত তাহলে জ্ঞানচর্চার দর্শনস্নিগ্ধ চরাচর৷ এ
দুই বিপরীতকে সরদার ফজলুল করিম তাঁর নিজের জীবনে এক মোহনায় একত্র করেছেন৷
তাঁর ভেতর দিয়ে এ সময়পর্বে বাংলাদেশের সাবালক হয়ে ওঠার একাধিক স্তরকেও,
ভিন্ন এক অর্থে, বুঝে নেওয়া যায়৷
সরদার ফজলুল করিম জন্মেছিলেন ১৯২৫ সালে, বরিশালের উজিরপুরে৷ তাঁর জন্ম আর বেড়ে ওঠা, সে সময়ের পূর্ব বাংলার অধিকাংশ বাঙালি সন্তানের মতোই, এক কৃষক পরিবারে৷ সরদারের কৃষিমগ্ন বাবা-মা নেহাত অনুর্বর মাটিতে তাঁকে রোপণ করেননি৷ সাফল্যের সঙ্গে তিনি জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৪০ সালে৷ এরপর চলে আসেন ঢাকায়; ছাত্রত্ব বরণ করেন ঢাকা কলেজের৷ আইএ পরীক্ষায় ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় হন পুরো ঢাকা বোর্ডে৷ কিন্তু এরই মধ্যে উঠতি ঢাকার প্রাণচাঞ্চল্যের নানা সংঘর্ষে আগুনের ফুলকি জ্বলে উঠেছে তাঁর মনে৷ কেবল ছাত্রত্বের ঘেরাটোপে আর আটকে থাকার অবকাশ তাঁর কোথায়! সেখান থেকে তত দিনে তিনি ছিটকে পড়েছেন বিপুল জনসমাজের মধ্যে, নিজের নাড়ি বেঁধে নিয়েছেন জনতার জাগ্রত প্রাণের সঙ্গে৷
তরুণ কথাশিল্পী সোমেন চন্দের মৃত্যুর পর প্রগতি লেখক সংঘের সঙ্গে তাঁর যোগ হয়ে ওঠে নিবিড়৷ সরদার ফজলুল করিমের দীক্ষা ও প্রবেশ ঘটে বামপন্থায়৷ ১৯৪৫ সালে যোগ দেন নেত্রকোনার সর্বভারতীয় কৃষকসম্মেলনে৷ তুমুল এই রাজনৈতিক তৎপরতার মধ্যেও জ্ঞানতৃষ্ণা তাঁর অবসিত হয়ে যায়নি৷ এতসবের ভেতরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্র হিসেবে মনের আরেক প্রবণতা তিনি বিকশিত করে চলেছেন৷ ১৯৪৫ সালে বিএ-তে এবং ১৯৪৬ সালে এমএ-তে তাঁর প্রথম শ্রেণি এই নিবিষ্টতার সাক্ষ্য দেবে৷ ছাত্রপর্যায় শেষে তিনি যুক্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়৷ যুক্ত হলেন বটে, কিন্তু ইতিহাসের জঙ্গমতা আন্দোলিত করে তুলল তাঁর জীবন৷
ব্রিটিশ শাসনের সেই শেষ পর্যায়ে বাংলা তখন উত্তাল৷ উপনিবেশের সূত্রে পৃথিবীর অভিঘাত আছড়ে পড়ছে তাঁর ওপরে৷ অন্যদিকে এ ভূখণ্ডের মানুষও তখন দমকে দমকে ফেটে পড়ছে ব্রিটিশ তাড়ানোর আন্দোলনে, স্বাধীকার অর্জনের লড়াইয়ে৷ তরঙ্গের পর তরঙ্গ তুলে পেরিয়ে যাচ্ছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, ফ্যাসিবিরোধী লেখক সংঘের আন্দোলন, দেশভাগ আর তেভাগা৷ এসব ঘটনার মধ্যে তৈরি হয়ে উঠেছিলেন সরদার ফজলুল করিম নামের মানুষটি৷
পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর নতুন এক পর্বে ঢোকে এ ভূখণ্ডের ইতিহাসনিয়তি; সরদার ফজলুল করিমেরও৷ এ সময়পর্বে মণি সিংহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সত্যেন সেনের মতো ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তাঁর আন্তরিক সংযোগ ঘটে৷ এই মানসিক যোগ তিনি লালন করে গেছেন আজীবন৷ বামপন্থী রাজনীতি পাকিস্তান সরকারের চক্ষুশূল হয়ে উঠলে কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে চাকরি ছাড়ার
নির্দেশ দেয়৷ এক কথায় তিনি ছেড়ে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি; চলে যান আত্মগোপনে৷ ১৯৪৯ সালে পুলিশ গ্রেপ্তার করার পর শুরু হয় তাঁর বন্দিজীবন৷ টানা ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবন কাটে কারাযবনিকার অন্তরালে৷ জেল থেকে তিনি বেরিয়ে আসেন সরাসরি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য হয়ে৷
পুরো পাকিস্তানপর্বে, পদে পদে, সরকারের লাঞ্ছনা সইতে হয় তাঁকে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি তিনি আর ফিরে পাননি৷ তার চেয়েও যা দুঃসহ, বারবার তাঁকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হতে হয়৷ ২৪ বছরের পাকিস্তানপর্বের ১১টি বছর জেলের ভেতরে কাটিয়েছেন সরদার ফজলুল করিম৷ জেল থেকে বেরিয়ে এসে, একাত্তরের ডিসেম্বরে, সদ্যঃপ্রসূত বাংলাদেশের চেহারাটি তিনি প্রত্যক্ষ করেন৷
কৃষকতার পটভূমি থেকে যে লোকটি একদিন উঠে দাঁড়িয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন, এসব ঘটনা তাঁর মনে অফুরান বীজ ছড়িয়ে যাবে, তাতে আর সন্দেহ কী! সহজাতভাবেই সরদার ফজলুল করিমের ছিল একটি লোকায়তিক মন৷ ইতিহাসের নানা ঝাপটে বিচিত্র মানুষের অভিজ্ঞতার স্রোত ঢুকেছে তাঁর ভেতরে৷ দর্শনমগ্ন স্বভাব সেগুলোকেই আবার করে তুলেছে বহুস্তর৷ নিরক্ত নিরঞ্জন জ্ঞান মানুষের অভিজ্ঞতার যোগে তাঁর মধ্যে সপ্রাণ হয়ে উঠেছে৷ তাঁর চেতনার সজীবতার মূলে আছে মানবিকতার এই পটভূমি৷ তাঁর ইতিহাসচর্চা থেকে দর্শনগ্রন্থের অনুবাদ, স্মৃতিকথা থেকে সাহিত্যকর্ম—সবকিছুতেই দেখা যাবে এর প্রকাশ৷
সরদার ফজলুল করিম লিখেছেন বিচিত্র বিষয়ে৷ এ দেশের বিভিন্ন ইতিহাসসন্ধি, চল্লিশের দশকের ঢাকা, বাঙালি মধ্যবিত্তের বিকাশ, সাহিত্যিক প্রসঙ্গ, কোষগ্রন্থ, দর্শন, মার্ক্সবাদ—এসব বিষয়ে পরিব্যাপ্ত তাঁর লেখালেখি৷ লিখতেন তিনি সহজ-সরল আটপৌরে ভাষায়, কিন্তু খুব সহজেই স্পর্শ করতেন পাঠকের মন, স্বাভাবিক আর স্বতঃস্ফূর্ত এক দার্শনিকতা সঞ্চারিত করে দিতেন অবলীলায়৷ তাঁর এই সহজ আন্তরিক মনের পরিচয় ছড়িয়ে আছে নানা কথা, নানা কথার পরের কথা, নূহের কিশতি, রুমীর আম্মা ও অন্যান্য প্রবন্ধ ইত্যাদি বইয়ে৷ সব মিলিয়ে ২০-২২টি বইয়ের মধ্যে ছড়িয়ে আছে তাঁর বিচিত্র দিকে উৎসুক মনের পরিচয়৷ এর মধ্যে আছে চিরায়ত দর্শনেরও অনুবাদ৷ তাঁর প্রাঞ্জল অনুবাদে প্লেটোর সংলাপ, প্লেটোর রিপাবলিক, অ্যারিস্টটলের পলিটিকস, এঙ্গেলসের অ্যান্টিডুরিং, রুশোর সোশ্যাল কনট্রাক্ট আমাদের অনুবাদ সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ হয়ে রয়েছে৷
তবু এই ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ জীবন আর নিবিষ্ট জ্ঞানচর্চাই সরদার ফজলুল করিমের আসল পরিচয় ছিল না৷ তাঁর আসল পরিচয় আদর্শের সঙ্গে জীবনের সেতুবন্ধে, ভাবনা আর কর্মের অভিন্নতায়৷ অকপট এক জীবন যাপন করে এসেছেন তিনি আমৃত্যু৷ চিন্তার সঙ্গে কাজের, উচ্চারণের সঙ্গে যাপনের সুষম ঐক্যই তাঁর পরিচয়৷ তাঁর চরিত্র আর নৈতিকতার শক্তির উৎসও ছিল এখানেই৷ আদর্শ-উত্তর এই গোলমেলে সময়ে তিনি ছিলেন এক বিরল ব্যতিক্রম৷ জীবনের শেষ পর্যায়ে পার্টির সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ সংযোগ আর তেমন ছিল না, কিন্তু বামপন্থার সঙ্গে তাঁর মনের সেই যোগ কখনো ছিন্ন হয়নি৷ মানুষের সার্বিক মুক্তির স্বপ্ন তিনি আমৃত্যু দেখেছেন, আর তা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পথেই৷
প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তে এসে এক দুর্ঘটনায় তিনি আহত হয়ে তাঁর শরীরের সচলতা সীমিত হয়ে পড়ে৷ একটি লাঠিতে ভর দিয়ে মন্থরভাবে চলতে-ফিরতে হতো তাঁকে৷ কিন্তু সেই ভাঙা শরীর তাঁর জীবনস্পৃহার ওপর সামান্য ছায়াসম্পাতও করতে পারেনি৷ মৃত্যুর আগের কয়েক বছর তাঁর শরীর ও মনের সচলতা প্রায় চলে যায়৷
কিন্তু শেষ জীবনেও যখন তিনি সামান্য সচল ছিলেন, সবাই জানত, লাঠিতে ভর দিয়ে চলা ওই ক্ষীণকায় মানুষটি পরিপূর্ণ হয়ে আছেন অমিয় প্রাণশক্তি আর শুদ্ধ চরিত্রগুণে৷
সাজ্জাদ শরিফ: কবি, সাংবাদিক৷
সরদার ফজলুল করিম জন্মেছিলেন ১৯২৫ সালে, বরিশালের উজিরপুরে৷ তাঁর জন্ম আর বেড়ে ওঠা, সে সময়ের পূর্ব বাংলার অধিকাংশ বাঙালি সন্তানের মতোই, এক কৃষক পরিবারে৷ সরদারের কৃষিমগ্ন বাবা-মা নেহাত অনুর্বর মাটিতে তাঁকে রোপণ করেননি৷ সাফল্যের সঙ্গে তিনি জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৪০ সালে৷ এরপর চলে আসেন ঢাকায়; ছাত্রত্ব বরণ করেন ঢাকা কলেজের৷ আইএ পরীক্ষায় ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় হন পুরো ঢাকা বোর্ডে৷ কিন্তু এরই মধ্যে উঠতি ঢাকার প্রাণচাঞ্চল্যের নানা সংঘর্ষে আগুনের ফুলকি জ্বলে উঠেছে তাঁর মনে৷ কেবল ছাত্রত্বের ঘেরাটোপে আর আটকে থাকার অবকাশ তাঁর কোথায়! সেখান থেকে তত দিনে তিনি ছিটকে পড়েছেন বিপুল জনসমাজের মধ্যে, নিজের নাড়ি বেঁধে নিয়েছেন জনতার জাগ্রত প্রাণের সঙ্গে৷
তরুণ কথাশিল্পী সোমেন চন্দের মৃত্যুর পর প্রগতি লেখক সংঘের সঙ্গে তাঁর যোগ হয়ে ওঠে নিবিড়৷ সরদার ফজলুল করিমের দীক্ষা ও প্রবেশ ঘটে বামপন্থায়৷ ১৯৪৫ সালে যোগ দেন নেত্রকোনার সর্বভারতীয় কৃষকসম্মেলনে৷ তুমুল এই রাজনৈতিক তৎপরতার মধ্যেও জ্ঞানতৃষ্ণা তাঁর অবসিত হয়ে যায়নি৷ এতসবের ভেতরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্র হিসেবে মনের আরেক প্রবণতা তিনি বিকশিত করে চলেছেন৷ ১৯৪৫ সালে বিএ-তে এবং ১৯৪৬ সালে এমএ-তে তাঁর প্রথম শ্রেণি এই নিবিষ্টতার সাক্ষ্য দেবে৷ ছাত্রপর্যায় শেষে তিনি যুক্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়৷ যুক্ত হলেন বটে, কিন্তু ইতিহাসের জঙ্গমতা আন্দোলিত করে তুলল তাঁর জীবন৷
ব্রিটিশ শাসনের সেই শেষ পর্যায়ে বাংলা তখন উত্তাল৷ উপনিবেশের সূত্রে পৃথিবীর অভিঘাত আছড়ে পড়ছে তাঁর ওপরে৷ অন্যদিকে এ ভূখণ্ডের মানুষও তখন দমকে দমকে ফেটে পড়ছে ব্রিটিশ তাড়ানোর আন্দোলনে, স্বাধীকার অর্জনের লড়াইয়ে৷ তরঙ্গের পর তরঙ্গ তুলে পেরিয়ে যাচ্ছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, ফ্যাসিবিরোধী লেখক সংঘের আন্দোলন, দেশভাগ আর তেভাগা৷ এসব ঘটনার মধ্যে তৈরি হয়ে উঠেছিলেন সরদার ফজলুল করিম নামের মানুষটি৷
পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর নতুন এক পর্বে ঢোকে এ ভূখণ্ডের ইতিহাসনিয়তি; সরদার ফজলুল করিমেরও৷ এ সময়পর্বে মণি সিংহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সত্যেন সেনের মতো ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তাঁর আন্তরিক সংযোগ ঘটে৷ এই মানসিক যোগ তিনি লালন করে গেছেন আজীবন৷ বামপন্থী রাজনীতি পাকিস্তান সরকারের চক্ষুশূল হয়ে উঠলে কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে চাকরি ছাড়ার
নির্দেশ দেয়৷ এক কথায় তিনি ছেড়ে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি; চলে যান আত্মগোপনে৷ ১৯৪৯ সালে পুলিশ গ্রেপ্তার করার পর শুরু হয় তাঁর বন্দিজীবন৷ টানা ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবন কাটে কারাযবনিকার অন্তরালে৷ জেল থেকে তিনি বেরিয়ে আসেন সরাসরি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য হয়ে৷
পুরো পাকিস্তানপর্বে, পদে পদে, সরকারের লাঞ্ছনা সইতে হয় তাঁকে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি তিনি আর ফিরে পাননি৷ তার চেয়েও যা দুঃসহ, বারবার তাঁকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হতে হয়৷ ২৪ বছরের পাকিস্তানপর্বের ১১টি বছর জেলের ভেতরে কাটিয়েছেন সরদার ফজলুল করিম৷ জেল থেকে বেরিয়ে এসে, একাত্তরের ডিসেম্বরে, সদ্যঃপ্রসূত বাংলাদেশের চেহারাটি তিনি প্রত্যক্ষ করেন৷
কৃষকতার পটভূমি থেকে যে লোকটি একদিন উঠে দাঁড়িয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন, এসব ঘটনা তাঁর মনে অফুরান বীজ ছড়িয়ে যাবে, তাতে আর সন্দেহ কী! সহজাতভাবেই সরদার ফজলুল করিমের ছিল একটি লোকায়তিক মন৷ ইতিহাসের নানা ঝাপটে বিচিত্র মানুষের অভিজ্ঞতার স্রোত ঢুকেছে তাঁর ভেতরে৷ দর্শনমগ্ন স্বভাব সেগুলোকেই আবার করে তুলেছে বহুস্তর৷ নিরক্ত নিরঞ্জন জ্ঞান মানুষের অভিজ্ঞতার যোগে তাঁর মধ্যে সপ্রাণ হয়ে উঠেছে৷ তাঁর চেতনার সজীবতার মূলে আছে মানবিকতার এই পটভূমি৷ তাঁর ইতিহাসচর্চা থেকে দর্শনগ্রন্থের অনুবাদ, স্মৃতিকথা থেকে সাহিত্যকর্ম—সবকিছুতেই দেখা যাবে এর প্রকাশ৷
সরদার ফজলুল করিম লিখেছেন বিচিত্র বিষয়ে৷ এ দেশের বিভিন্ন ইতিহাসসন্ধি, চল্লিশের দশকের ঢাকা, বাঙালি মধ্যবিত্তের বিকাশ, সাহিত্যিক প্রসঙ্গ, কোষগ্রন্থ, দর্শন, মার্ক্সবাদ—এসব বিষয়ে পরিব্যাপ্ত তাঁর লেখালেখি৷ লিখতেন তিনি সহজ-সরল আটপৌরে ভাষায়, কিন্তু খুব সহজেই স্পর্শ করতেন পাঠকের মন, স্বাভাবিক আর স্বতঃস্ফূর্ত এক দার্শনিকতা সঞ্চারিত করে দিতেন অবলীলায়৷ তাঁর এই সহজ আন্তরিক মনের পরিচয় ছড়িয়ে আছে নানা কথা, নানা কথার পরের কথা, নূহের কিশতি, রুমীর আম্মা ও অন্যান্য প্রবন্ধ ইত্যাদি বইয়ে৷ সব মিলিয়ে ২০-২২টি বইয়ের মধ্যে ছড়িয়ে আছে তাঁর বিচিত্র দিকে উৎসুক মনের পরিচয়৷ এর মধ্যে আছে চিরায়ত দর্শনেরও অনুবাদ৷ তাঁর প্রাঞ্জল অনুবাদে প্লেটোর সংলাপ, প্লেটোর রিপাবলিক, অ্যারিস্টটলের পলিটিকস, এঙ্গেলসের অ্যান্টিডুরিং, রুশোর সোশ্যাল কনট্রাক্ট আমাদের অনুবাদ সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ হয়ে রয়েছে৷
তবু এই ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ জীবন আর নিবিষ্ট জ্ঞানচর্চাই সরদার ফজলুল করিমের আসল পরিচয় ছিল না৷ তাঁর আসল পরিচয় আদর্শের সঙ্গে জীবনের সেতুবন্ধে, ভাবনা আর কর্মের অভিন্নতায়৷ অকপট এক জীবন যাপন করে এসেছেন তিনি আমৃত্যু৷ চিন্তার সঙ্গে কাজের, উচ্চারণের সঙ্গে যাপনের সুষম ঐক্যই তাঁর পরিচয়৷ তাঁর চরিত্র আর নৈতিকতার শক্তির উৎসও ছিল এখানেই৷ আদর্শ-উত্তর এই গোলমেলে সময়ে তিনি ছিলেন এক বিরল ব্যতিক্রম৷ জীবনের শেষ পর্যায়ে পার্টির সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ সংযোগ আর তেমন ছিল না, কিন্তু বামপন্থার সঙ্গে তাঁর মনের সেই যোগ কখনো ছিন্ন হয়নি৷ মানুষের সার্বিক মুক্তির স্বপ্ন তিনি আমৃত্যু দেখেছেন, আর তা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পথেই৷
প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তে এসে এক দুর্ঘটনায় তিনি আহত হয়ে তাঁর শরীরের সচলতা সীমিত হয়ে পড়ে৷ একটি লাঠিতে ভর দিয়ে মন্থরভাবে চলতে-ফিরতে হতো তাঁকে৷ কিন্তু সেই ভাঙা শরীর তাঁর জীবনস্পৃহার ওপর সামান্য ছায়াসম্পাতও করতে পারেনি৷ মৃত্যুর আগের কয়েক বছর তাঁর শরীর ও মনের সচলতা প্রায় চলে যায়৷
কিন্তু শেষ জীবনেও যখন তিনি সামান্য সচল ছিলেন, সবাই জানত, লাঠিতে ভর দিয়ে চলা ওই ক্ষীণকায় মানুষটি পরিপূর্ণ হয়ে আছেন অমিয় প্রাণশক্তি আর শুদ্ধ চরিত্রগুণে৷
সাজ্জাদ শরিফ: কবি, সাংবাদিক৷
No comments