কুর্মিটোলা ক্যাম্পের কয়লা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
তখন বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায়। জামায়াতে ইসলামী একটি পাকিস্তানপন্থী দল। তাদের সময় বিদ্যুতের বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। তখন চৈত্র-বৈশাখ মাস। কয়েক দিন বিদ্যুৎ না থাকায় অতি গরমে ক্যাম্পের জনা দুই মানুষ মারা যান। কাগজে খবর দেখে আমি ক্যাম্পের সামনে রাস্তায় মাদুর বিছিয়ে বসে ‘সত্যাগ্রহ’ করি। আমার হাতে একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল: ক্যাম্পে বিদ্যুৎ-সংযোগ না দেওয়া পর্যন্ত অবস্থান ধর্মঘট চলবে। সেদিন আমার কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করতে সেখানে গিয়ে বসেছিলেন জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর (বর্তমানে সংস্কৃতিমন্ত্রী), সিপিবির নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস, গ্রিন ভয়েসের আলমগীর কবিরসহ নাগরিক উদ্যোগ, বাপা প্রভৃতি সংগঠনের কর্মীরা। বিকেলে সরকারি লোকেরা এসে বিদ্যুৎ-সংযোগ পুনঃস্থাপন করলে কর্মসূচি শেষ করি।
জেনেভা ক্যাম্পের যারা বাসিন্দা তারা কারা? তাদের প্রাথমিক পরিচয় ছিল আটকে পড়া পাকিস্তানি। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা তাদের সেই পরিচয়েই জানেন। বাঙালিরা তাদের নাম দিয়েছে বিহারি। একাত্তরের আগে আমরা সবাই ছিলাম নাগরিকত্বে পাকিস্তানি, জাতিতে কেউ ছিলাম বাঙালি, কেউ গারো, কেউ চাকমা, কেউ বিহারি প্রভৃতি। সাতচল্লিশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় পূর্ব বাংলা থেকে লাখ লাখ হিন্দু তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে চলে যায়, ভারত থেকে বাঙালি ও অবাঙালি মুসলমানরা পূর্ব পাকিস্তানে আসে বা পশ্চিম পাকিস্তানে যায়। ভারত থেকে উর্দুভাষী যারা আসে, তাদের গয়রহ নাম দেওয়া হয় বিহারি। যদিও তারা সবাই বিহারি নয়, বিহারের অধিবাসীও ছিল না। বিহারি একটি জাতিসত্তা। তারা সবাই মুসলমানও নয়, উর্দুভাষীও নয়। ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ, সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ, লালু প্রসাদ যাদব বিহারি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে যেসব বাঙালি মুসলমান পূর্ব বাংলায় আসে, তারা এখানকার বাঙালিদের সঙ্গে মিশে যায়। উর্দুভাষীরা তাদের ভাষা ও জাতিসত্তার কারণে সেভাবে মিশতে পারেনি। তাদের ডাকনাম হয়ে যায় বিহারি, যদিও তাদের অনেকে এসেছে উত্তর প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ থেকে।
কোন রাজনীতির শিকার হয়ে বাংলাদেশের হিন্দুরা ভারতে চলে যায় এবং ভারতের মুসলমানরা মোহাজের হয়ে পাকিস্তানে আসে, সে এক দীর্ঘ ও বেদনাবিধুর ইতিহাস। এখানে এসে পাকিস্তানকেই উর্দুভাষীরা তাদের দেশ হিসেবে ভাবতে থাকে, যদিও পাকিস্তান তাদের তার নাগরিক হিসেবে স্বীকার করেনি। এ কথা অনেকেই জানেন না, উর্দুভাষী ভারতীয়দের পাকিস্তান সরকার জাতীয়তায় ‘পাকিস্তানি’ বলে স্বীকৃতি না দিয়ে কাগজপত্রে তাদের লিখত Domiciled—স্থায়ীভাবে নির্বাসিত, যার অর্থ পূর্ব পাকিস্তান তাদের বাসস্থান, তবে তারা পাকিস্তানি নাগরিক নয়। চব্বিশ বছর পরে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়, অল্প ব্যতিক্রম বাদে উর্দুভাষীরা পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। তাদের কেউ কেউ পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকার আলবদরদের সঙ্গে গণহত্যায় সহযোগিতা করে। স্বাধীনতার পরে অনেকেই উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভয়ে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার অপশন দেয় বা ইচ্ছা প্রকাশ করে। পাকিস্তান সরকার তাদের গ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ করায় তারা আটকে পড়ে। ১৯৪৭-এর পর থেকে তারা রাষ্ট্রহীন মানুষ: তাদের বাসস্থান আছে—দেশ নেই।
গত শনিবার পল্লবীর কুর্মিটোলা উর্দুভাষীদের ক্যাম্পে যে ১০ জন আগুনে পুড়ে কয়লা হয়েছে, কালশী কবরস্থানে রোববার মধ্যরাতে যাদের কবরস্থ করা হয়েছে, ফেরেশতারা যখন তাদের জিজ্ঞেস করবেন—তোমাদের দেশ কী? শিশুদের কয়লাগুলো থাকবে নিরুত্তর। ৪০ বছর বয়সী বেবী আকতার বলবেন, আমাদের কোনো দেশ নেই, আমার বাবা-মারও দেশ ছিল না, পৃথিবী নামক গ্রহে আমরা বাস করতাম ৮ ফুট বাই ৮ ফুট ঘরে ১০ জন। ওই ৬৪ বর্গফুট জায়গাও আমাদের নয়—পরের জায়গা পরের জমি।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ যাঁরা মাঝে মাঝেই চুটিয়ে বাজান, তাঁরা মনোযোগ দিয়ে শোনেননি ওতে তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে কী বলেছেন। তাঁর ওই ভাষণে একটি কথা আছে: ‘এই বাংলায়—বাঙালি, অবাঙালি যারা আছে, তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আমাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক বলে যাঁরা নিজেদের দাবি করেন, তাঁরা বদনামের পরোয়া করেন না। তাঁরা হিন্দুদের জোতজমি দখল করতে দ্বিধা করেন না, উর্দুভাষীদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল করতে সংকোচ বোধ করেন না। তাঁদের কাছে ধর্মীয়, ভাষাগত ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা নিরাপদ নয়। এমনকি ঘরের মধ্যে তালা লাগিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারতেও তাঁদের বুক কাঁপে না। তাঁদের জমি চাই। সে জমি নদীর তীর হতে পারে, পাহাড়ের পাদদেশ হতে পারে, বনভূমি হতে পারে, হিন্দুদের হতে পারে, বৌদ্ধদের হতে পারে, বিহারির হতে পারে, সাঁওতাল-হাজং-চাকমাদের হতে পারে।
স্বাধীনতার আগে একবার আতাউর রহমান খান, বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ নেতার সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও ত্রাণকাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ১৯৬৯-এর শেষ দিকে মোহাম্মদপুরে বাঙালি-অবাঙালির মধ্যে গোলযোগ বাধে। সেটা থামাতে তাঁরা সেখানে যান এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় কয়েকটি দিন বিরামহীন কাজ করেন। আমাদের মতো তরুণেরা তাঁদের সঙ্গে ছিল।
বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে একদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তলব আসে। সেখানে গেলে একজন কর্মকর্তা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের কামরায় নিয়ে যান। মন্ত্রী বললেন, ‘সিবিএস-এর (কলাম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সিস্টেম) একদল সাংবাদিক এসেছেন। তাঁরা আটকে পড়া পাকিস্তানিদের সম্পর্কে প্রতিবেদন করবেন। কী করতে কী করেন, আমাদের একজন লোকও তাঁদের সঙ্গে থাকা দরকার।’ মন্ত্রী বলেন, ‘আমার সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিল। আমি বলেছি আমাদের একজনকে তাঁদের সঙ্গে নিতে। আপনি তাঁদের সঙ্গে গেলে ভালো হয়।’ তখন ঢাকার অদূরে মুড়াপাড়ায় ছিল আটকে পড়া উর্দুভাষীদের সবচেয়ে বড় ক্যাম্প। আমি তাঁদের সঙ্গে তিন দিন মুড়াপাড়ায় ছিলাম। সে এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা। জাতিসংঘ তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছিল। দুবেলা তাদের জন্য প্রতিদিন ১১০ মণ চাল বরাদ্দ করা হতো। স্থানীয় নেতা-কর্মীরা তার বারো আনাই বিক্রি করে দিতেন। প্রতিদিন হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুকে এক হাতা পরিমাণ ভাত দেওয়া হতো। সিবিএসের সাংবাদিক একজনকে বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘এই যে দুপুরে একবার সামান্য ভাত খান, এতে কি আপনাদের চলে।’ তার জবাব ছিল, ‘এর বেশি আমাদের দরকার হয় না, আমরা যথেষ্ট পানি খাই।’ শুনে আমার চোখে পানি আসে।
মুড়াপাড়া ক্যাম্পের পরিস্থিতি ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানালে তাঁরা সেখানকার অবস্থা দেখতে এবং দুর্নীতি বন্ধ করতে ঢাকার কমিশনারকে পাঠান। খুব যে কাজের কাজ কিছু হয়েছিল মনে হয় না।
কোনো জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ঢালাও অপবাদ দেওয়া অপরাধ। সব উর্দুভাষীই বাঙালিবিরোধী নয়। একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের ওপরে একজন উর্দু কবি একটি দীর্ঘ চমৎকার কবিতা লিখেছেন। আমাদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন কবি নওশাদ নূরী। কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি খুব পছন্দ করতেন, বঙ্গবন্ধুও তাঁকে ভালোবাসতেন। ছয় দফা সম্পর্কে তাঁর একটি কবিতার দুটি পঙ্ক্তি মনে আছে:
হামারি নাজাত, তুম্হারি নাজাত,
ছে নোকাত, ছে নোকাত।
[আমার মুক্তি, তোমার মুক্তি,
ছয় দফা, ছয় দফা।]
১৯৮৫-তে বিশ্ববিখ্যাত জার্মান ঔপন্যাসিক গুন্টার গ্রাস এসেছিলেন ঢাকায়। কয়েক দিন ছিলেন। শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, রশীদ করীমসহ অনেক কবি-লেখকের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হয়। আমার সঙ্গেও জার্মান রাষ্ট্রদূত ও গ্যেটে ইনস্টিটিউটের পরিচালকের বাসভবনে তাঁর কথা হয়। তিনি উর্দুভাষীদের ক্যাম্প ঘুরে দেখেন। তিনি জানতে চান, তাদের জীবন নিয়ে বাংলা ভাষায় কোনো উপন্যাস রচিত হয়েছে কি না? তাদের দুর্দশা ঘোচাতে বাঙালি কবি-লেখকেরা কী করেছেন ১৫ বছরে। আমরা ছিলাম লা-জওয়াব।
শনিবার ১০ জন কয়লা হওয়ার কথা শুনে সন্ধ্যায় আমি মেডিকেল হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে যাই। রায়হানা নামের এক নারীর ৩০ শতাংশ পুড়ে গেছে। দেখলাম তিনি অচেতন। হাসপাতালে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও গিয়েছিলেন। শুনলাম, তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ১০
জন যে মারা গেছে তা ‘নিছক দুর্ঘটনা’—শুনে বড় কষ্ট পাই।
রোববার আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে কয়েকজন—পঙ্কজ ভট্টাচার্য, রোবায়েত ফেরদৌস, প্রকৌশলী সরকার আমিন, আদিবাসী নেতা দীপায়ন খীসা ও আমি উর্দুভাষীদের বস্তিগুলোতে যাই। পুলিশের সঙ্গে কথা বলি, ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের সঙ্গেও কথা বলি। পুলিশের গুলিতে নিহত আজাদের মায়ের সঙ্গেও দেখা করি। বেশিক্ষণ তাঁর বিলাপ শোনা সম্ভব হয়নি।
বাজি পোড়ানোর জন্য ১০ জন পুড়ে মরতে পারে না। কে বা কারা ঘটনা ঘটিয়েছে, কেন ঘটিয়েছে, তা যতই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হোক, তা অতি পরিষ্কার। আমরা এমন এক রাষ্ট্রের নাগরিক, যেখানে ক্ষমতাবান একজনের সঙ্গে আগের দিন ‘কথা-কাটাকাটি’ হলে পরদিন ১০ জন পুড়ে কয়লা হয়। কোনো জায়গা থেকে বিদ্যুৎ টেনে নেওয়া স্রেফ চুরি। কলিম ছলিম বৈদ্যনাথ অবৈধ সংযোগ নিলে দণ্ডনীয় অপরাধ। সাংসদ ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা নিলেও তা অবশ্যই চুরি ও অপরাধ।
পুলিশের বেতন-ভাতা সরকারি দল ও তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতারা দেন না। প্রত্যেক সাধারণ নাগরিকের ট্যাক্সের টাকা থেকে দেওয়া হয়। সেখানকার লোকেরা আমাদের বলেছেন, সব পুলিশ সদস্য খারাপ আচরণ করেন না। কিন্তু কারও কারও কথাবার্তা, ব্যবহার অবর্ণনীয় ইতরসুলভ। ক্যাম্পের বিক্ষুব্ধ মেয়েদের কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, তুই বস্তির বিহারি মাউরািন না। টানাহেঁচড়ায় অনেক যুবতীর কামিজ ছিঁড়ে গেছে। দেড় বছরের শিশু পুড়ে কয়লা হয়েছে। নিহত নারীর একজন ছিলেন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা, আর একজন সাত মাসের। পৃথিবীতে আসার আগেই ভ্রূণ পুড়ে মরল।
যে আড়াই-তিন লাখ উর্দুভাষী বাংলাদেশে বাস করছে, তাদের অধিকাংশেরই জন্ম স্বাধীনতার পরে। ঘরে তারা উর্দু বললেও বাংলা ভাষাতেই কথা বলে। তাদের ছেলেমেয়ে বাংলা স্কুলে পড়ে। এক রিট করে তারা ভোটাধিকার পেয়েছে। অর্থনীতিতে তারা অবদান রাখছে। তারা দক্ষ কারিগর। বেনারসি শাড়ি শিল্পী, গাড়ি মেরামতসহ নানা রকম হাতের কাজে রয়েছে তাদের দক্ষতা। অতি অল্প কেউ ছাড়া এখন আর উর্দুভাষীরা পাকিস্তানে যেতে উৎসাহী নয়। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে লাখ আড়াই মানুষের পুনর্বাসন কি এতই কঠিন?
সারা দেশে প্রায় ৫০টি ক্যাম্পে উর্দুভাষীরা মানবেতরভাবে বেঁচে আছে ৪২ বছর। এখন থেকে পুড়িয়ে মারার পালা। ঢাকার ক্যাম্পগুলো থেকে তাদের তাড়াতে পারলে দশম সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ওই সব জমিতে জনপ্রতিনিধির নেতৃত্বে নিির্মত হবে আলিশান অ্যাপার্টমেন্ট অথবা সুপার মার্কেট। সেখানে ফ্ল্যাট ও দোকান পাবে ক্যাডাররা। চলবে চুটিয়ে চাঁদাবাজি।
নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা মনে করেন দেশটা তাঁদের বাপের। অথবা নিজেদের তালুক। এখানে ধর্মীয়, জাতিগত, ভাষাগত সংখ্যালঘুরা তাদের খাস তালুকের নিষ্কর প্রজা। কালশীর কবরস্থানের কয়লাগুলোর প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নেই—তারা শুধু অভিশাপ দিতে পারে। অতীতে সাধারণ মানুষের অভিশাপে বিশাল সাম্রাজ্য পর্যন্ত ধ্বংস হয়েছে—বাংলাদেশ তো ছোট দেশ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
জেনেভা ক্যাম্পের যারা বাসিন্দা তারা কারা? তাদের প্রাথমিক পরিচয় ছিল আটকে পড়া পাকিস্তানি। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা তাদের সেই পরিচয়েই জানেন। বাঙালিরা তাদের নাম দিয়েছে বিহারি। একাত্তরের আগে আমরা সবাই ছিলাম নাগরিকত্বে পাকিস্তানি, জাতিতে কেউ ছিলাম বাঙালি, কেউ গারো, কেউ চাকমা, কেউ বিহারি প্রভৃতি। সাতচল্লিশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় পূর্ব বাংলা থেকে লাখ লাখ হিন্দু তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে চলে যায়, ভারত থেকে বাঙালি ও অবাঙালি মুসলমানরা পূর্ব পাকিস্তানে আসে বা পশ্চিম পাকিস্তানে যায়। ভারত থেকে উর্দুভাষী যারা আসে, তাদের গয়রহ নাম দেওয়া হয় বিহারি। যদিও তারা সবাই বিহারি নয়, বিহারের অধিবাসীও ছিল না। বিহারি একটি জাতিসত্তা। তারা সবাই মুসলমানও নয়, উর্দুভাষীও নয়। ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ, সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ, লালু প্রসাদ যাদব বিহারি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে যেসব বাঙালি মুসলমান পূর্ব বাংলায় আসে, তারা এখানকার বাঙালিদের সঙ্গে মিশে যায়। উর্দুভাষীরা তাদের ভাষা ও জাতিসত্তার কারণে সেভাবে মিশতে পারেনি। তাদের ডাকনাম হয়ে যায় বিহারি, যদিও তাদের অনেকে এসেছে উত্তর প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ থেকে।
কোন রাজনীতির শিকার হয়ে বাংলাদেশের হিন্দুরা ভারতে চলে যায় এবং ভারতের মুসলমানরা মোহাজের হয়ে পাকিস্তানে আসে, সে এক দীর্ঘ ও বেদনাবিধুর ইতিহাস। এখানে এসে পাকিস্তানকেই উর্দুভাষীরা তাদের দেশ হিসেবে ভাবতে থাকে, যদিও পাকিস্তান তাদের তার নাগরিক হিসেবে স্বীকার করেনি। এ কথা অনেকেই জানেন না, উর্দুভাষী ভারতীয়দের পাকিস্তান সরকার জাতীয়তায় ‘পাকিস্তানি’ বলে স্বীকৃতি না দিয়ে কাগজপত্রে তাদের লিখত Domiciled—স্থায়ীভাবে নির্বাসিত, যার অর্থ পূর্ব পাকিস্তান তাদের বাসস্থান, তবে তারা পাকিস্তানি নাগরিক নয়। চব্বিশ বছর পরে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়, অল্প ব্যতিক্রম বাদে উর্দুভাষীরা পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। তাদের কেউ কেউ পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকার আলবদরদের সঙ্গে গণহত্যায় সহযোগিতা করে। স্বাধীনতার পরে অনেকেই উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভয়ে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার অপশন দেয় বা ইচ্ছা প্রকাশ করে। পাকিস্তান সরকার তাদের গ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ করায় তারা আটকে পড়ে। ১৯৪৭-এর পর থেকে তারা রাষ্ট্রহীন মানুষ: তাদের বাসস্থান আছে—দেশ নেই।
গত শনিবার পল্লবীর কুর্মিটোলা উর্দুভাষীদের ক্যাম্পে যে ১০ জন আগুনে পুড়ে কয়লা হয়েছে, কালশী কবরস্থানে রোববার মধ্যরাতে যাদের কবরস্থ করা হয়েছে, ফেরেশতারা যখন তাদের জিজ্ঞেস করবেন—তোমাদের দেশ কী? শিশুদের কয়লাগুলো থাকবে নিরুত্তর। ৪০ বছর বয়সী বেবী আকতার বলবেন, আমাদের কোনো দেশ নেই, আমার বাবা-মারও দেশ ছিল না, পৃথিবী নামক গ্রহে আমরা বাস করতাম ৮ ফুট বাই ৮ ফুট ঘরে ১০ জন। ওই ৬৪ বর্গফুট জায়গাও আমাদের নয়—পরের জায়গা পরের জমি।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ যাঁরা মাঝে মাঝেই চুটিয়ে বাজান, তাঁরা মনোযোগ দিয়ে শোনেননি ওতে তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে কী বলেছেন। তাঁর ওই ভাষণে একটি কথা আছে: ‘এই বাংলায়—বাঙালি, অবাঙালি যারা আছে, তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আমাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক বলে যাঁরা নিজেদের দাবি করেন, তাঁরা বদনামের পরোয়া করেন না। তাঁরা হিন্দুদের জোতজমি দখল করতে দ্বিধা করেন না, উর্দুভাষীদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল করতে সংকোচ বোধ করেন না। তাঁদের কাছে ধর্মীয়, ভাষাগত ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা নিরাপদ নয়। এমনকি ঘরের মধ্যে তালা লাগিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারতেও তাঁদের বুক কাঁপে না। তাঁদের জমি চাই। সে জমি নদীর তীর হতে পারে, পাহাড়ের পাদদেশ হতে পারে, বনভূমি হতে পারে, হিন্দুদের হতে পারে, বৌদ্ধদের হতে পারে, বিহারির হতে পারে, সাঁওতাল-হাজং-চাকমাদের হতে পারে।
স্বাধীনতার আগে একবার আতাউর রহমান খান, বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ নেতার সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও ত্রাণকাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ১৯৬৯-এর শেষ দিকে মোহাম্মদপুরে বাঙালি-অবাঙালির মধ্যে গোলযোগ বাধে। সেটা থামাতে তাঁরা সেখানে যান এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় কয়েকটি দিন বিরামহীন কাজ করেন। আমাদের মতো তরুণেরা তাঁদের সঙ্গে ছিল।
বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে একদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তলব আসে। সেখানে গেলে একজন কর্মকর্তা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের কামরায় নিয়ে যান। মন্ত্রী বললেন, ‘সিবিএস-এর (কলাম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সিস্টেম) একদল সাংবাদিক এসেছেন। তাঁরা আটকে পড়া পাকিস্তানিদের সম্পর্কে প্রতিবেদন করবেন। কী করতে কী করেন, আমাদের একজন লোকও তাঁদের সঙ্গে থাকা দরকার।’ মন্ত্রী বলেন, ‘আমার সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিল। আমি বলেছি আমাদের একজনকে তাঁদের সঙ্গে নিতে। আপনি তাঁদের সঙ্গে গেলে ভালো হয়।’ তখন ঢাকার অদূরে মুড়াপাড়ায় ছিল আটকে পড়া উর্দুভাষীদের সবচেয়ে বড় ক্যাম্প। আমি তাঁদের সঙ্গে তিন দিন মুড়াপাড়ায় ছিলাম। সে এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা। জাতিসংঘ তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছিল। দুবেলা তাদের জন্য প্রতিদিন ১১০ মণ চাল বরাদ্দ করা হতো। স্থানীয় নেতা-কর্মীরা তার বারো আনাই বিক্রি করে দিতেন। প্রতিদিন হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুকে এক হাতা পরিমাণ ভাত দেওয়া হতো। সিবিএসের সাংবাদিক একজনকে বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘এই যে দুপুরে একবার সামান্য ভাত খান, এতে কি আপনাদের চলে।’ তার জবাব ছিল, ‘এর বেশি আমাদের দরকার হয় না, আমরা যথেষ্ট পানি খাই।’ শুনে আমার চোখে পানি আসে।
মুড়াপাড়া ক্যাম্পের পরিস্থিতি ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানালে তাঁরা সেখানকার অবস্থা দেখতে এবং দুর্নীতি বন্ধ করতে ঢাকার কমিশনারকে পাঠান। খুব যে কাজের কাজ কিছু হয়েছিল মনে হয় না।
কোনো জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ঢালাও অপবাদ দেওয়া অপরাধ। সব উর্দুভাষীই বাঙালিবিরোধী নয়। একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের ওপরে একজন উর্দু কবি একটি দীর্ঘ চমৎকার কবিতা লিখেছেন। আমাদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন কবি নওশাদ নূরী। কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি খুব পছন্দ করতেন, বঙ্গবন্ধুও তাঁকে ভালোবাসতেন। ছয় দফা সম্পর্কে তাঁর একটি কবিতার দুটি পঙ্ক্তি মনে আছে:
হামারি নাজাত, তুম্হারি নাজাত,
ছে নোকাত, ছে নোকাত।
[আমার মুক্তি, তোমার মুক্তি,
ছয় দফা, ছয় দফা।]
১৯৮৫-তে বিশ্ববিখ্যাত জার্মান ঔপন্যাসিক গুন্টার গ্রাস এসেছিলেন ঢাকায়। কয়েক দিন ছিলেন। শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, রশীদ করীমসহ অনেক কবি-লেখকের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হয়। আমার সঙ্গেও জার্মান রাষ্ট্রদূত ও গ্যেটে ইনস্টিটিউটের পরিচালকের বাসভবনে তাঁর কথা হয়। তিনি উর্দুভাষীদের ক্যাম্প ঘুরে দেখেন। তিনি জানতে চান, তাদের জীবন নিয়ে বাংলা ভাষায় কোনো উপন্যাস রচিত হয়েছে কি না? তাদের দুর্দশা ঘোচাতে বাঙালি কবি-লেখকেরা কী করেছেন ১৫ বছরে। আমরা ছিলাম লা-জওয়াব।
শনিবার ১০ জন কয়লা হওয়ার কথা শুনে সন্ধ্যায় আমি মেডিকেল হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে যাই। রায়হানা নামের এক নারীর ৩০ শতাংশ পুড়ে গেছে। দেখলাম তিনি অচেতন। হাসপাতালে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও গিয়েছিলেন। শুনলাম, তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ১০
জন যে মারা গেছে তা ‘নিছক দুর্ঘটনা’—শুনে বড় কষ্ট পাই।
রোববার আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে কয়েকজন—পঙ্কজ ভট্টাচার্য, রোবায়েত ফেরদৌস, প্রকৌশলী সরকার আমিন, আদিবাসী নেতা দীপায়ন খীসা ও আমি উর্দুভাষীদের বস্তিগুলোতে যাই। পুলিশের সঙ্গে কথা বলি, ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের সঙ্গেও কথা বলি। পুলিশের গুলিতে নিহত আজাদের মায়ের সঙ্গেও দেখা করি। বেশিক্ষণ তাঁর বিলাপ শোনা সম্ভব হয়নি।
বাজি পোড়ানোর জন্য ১০ জন পুড়ে মরতে পারে না। কে বা কারা ঘটনা ঘটিয়েছে, কেন ঘটিয়েছে, তা যতই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হোক, তা অতি পরিষ্কার। আমরা এমন এক রাষ্ট্রের নাগরিক, যেখানে ক্ষমতাবান একজনের সঙ্গে আগের দিন ‘কথা-কাটাকাটি’ হলে পরদিন ১০ জন পুড়ে কয়লা হয়। কোনো জায়গা থেকে বিদ্যুৎ টেনে নেওয়া স্রেফ চুরি। কলিম ছলিম বৈদ্যনাথ অবৈধ সংযোগ নিলে দণ্ডনীয় অপরাধ। সাংসদ ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা নিলেও তা অবশ্যই চুরি ও অপরাধ।
পুলিশের বেতন-ভাতা সরকারি দল ও তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতারা দেন না। প্রত্যেক সাধারণ নাগরিকের ট্যাক্সের টাকা থেকে দেওয়া হয়। সেখানকার লোকেরা আমাদের বলেছেন, সব পুলিশ সদস্য খারাপ আচরণ করেন না। কিন্তু কারও কারও কথাবার্তা, ব্যবহার অবর্ণনীয় ইতরসুলভ। ক্যাম্পের বিক্ষুব্ধ মেয়েদের কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, তুই বস্তির বিহারি মাউরািন না। টানাহেঁচড়ায় অনেক যুবতীর কামিজ ছিঁড়ে গেছে। দেড় বছরের শিশু পুড়ে কয়লা হয়েছে। নিহত নারীর একজন ছিলেন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা, আর একজন সাত মাসের। পৃথিবীতে আসার আগেই ভ্রূণ পুড়ে মরল।
যে আড়াই-তিন লাখ উর্দুভাষী বাংলাদেশে বাস করছে, তাদের অধিকাংশেরই জন্ম স্বাধীনতার পরে। ঘরে তারা উর্দু বললেও বাংলা ভাষাতেই কথা বলে। তাদের ছেলেমেয়ে বাংলা স্কুলে পড়ে। এক রিট করে তারা ভোটাধিকার পেয়েছে। অর্থনীতিতে তারা অবদান রাখছে। তারা দক্ষ কারিগর। বেনারসি শাড়ি শিল্পী, গাড়ি মেরামতসহ নানা রকম হাতের কাজে রয়েছে তাদের দক্ষতা। অতি অল্প কেউ ছাড়া এখন আর উর্দুভাষীরা পাকিস্তানে যেতে উৎসাহী নয়। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে লাখ আড়াই মানুষের পুনর্বাসন কি এতই কঠিন?
সারা দেশে প্রায় ৫০টি ক্যাম্পে উর্দুভাষীরা মানবেতরভাবে বেঁচে আছে ৪২ বছর। এখন থেকে পুড়িয়ে মারার পালা। ঢাকার ক্যাম্পগুলো থেকে তাদের তাড়াতে পারলে দশম সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ওই সব জমিতে জনপ্রতিনিধির নেতৃত্বে নিির্মত হবে আলিশান অ্যাপার্টমেন্ট অথবা সুপার মার্কেট। সেখানে ফ্ল্যাট ও দোকান পাবে ক্যাডাররা। চলবে চুটিয়ে চাঁদাবাজি।
নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা মনে করেন দেশটা তাঁদের বাপের। অথবা নিজেদের তালুক। এখানে ধর্মীয়, জাতিগত, ভাষাগত সংখ্যালঘুরা তাদের খাস তালুকের নিষ্কর প্রজা। কালশীর কবরস্থানের কয়লাগুলোর প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নেই—তারা শুধু অভিশাপ দিতে পারে। অতীতে সাধারণ মানুষের অভিশাপে বিশাল সাম্রাজ্য পর্যন্ত ধ্বংস হয়েছে—বাংলাদেশ তো ছোট দেশ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments