মিথ্যা তথ্যে শিক্ষকরা গিলে খেয়েছেন ৪৬২ কোটি টাকা by শামীমুল হক

মিথ্যা তথ্য দিয়ে তেত্রিশ বছরে ৪৬২ কোটি ৪২ লাখ ৭২ হাজার ২০ টাকা অতিরিক্ত বেতন-ভাতা নিয়েছেন ৪৮,১৩০ জন শিক্ষক। কেউ কেউ ৬ বছরের স্থলে টাইম স্কেল নিয়েছেন ৮ বছরের, কেউবা স্কেল বেশি দেখিয়ে, কেউবা স্টাফিং বেতন দেখিয়ে এসব টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর তদন্ত করে বিশাল এ অনিয়ম উদঘাটন করেছে।
১৯৮১ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তদন্ত করে নিরীক্ষা অধিদপ্তর তাদের প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ের অডিট ও আইন সেলে পাঠিয়েছে। এতে তারা অনিয়ম ও বিধিবহির্ভূতভাবে উত্তোলিত সরকারি বেতন-ভাতা বাবদ বিশাল এ টাকা প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ে সরকারি কোষাগারে ফেরত নেয়ার সুপারিশ করেছে। ওদিকে শিক্ষকদের বিশাল অঙ্কের এ টাকা গিলে খাওয়া নিয়ে তোলপাড় চলছে মন্ত্রণালয়ে। নড়েচড়ে বসেছে মন্ত্রণালয়ের অডিট ও আইন সেল। তারা সংশ্লিষ্ট কলেজ, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদরাসাগুলোতে চিঠি দিয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কোন কোন কলেজে সহকারী অধ্যাপক রয়েছেন ৭ জন। অথচ তারা ৮ জন সহকারী অধ্যাপক দেখিয়ে অতিরিক্ত বেতন-ভাতা উত্তোলন করে তা আত্মসাৎ করেছেন। আবার কোন প্রতিষ্ঠান টাইম স্কেল নিয়েছে ৬ বছরের স্থলে ৮ বছর। শিক্ষকরা প্রাপ্যতার অতিরিক্ত এ টাকা হরিলুট করেছে মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৮৭টি প্রতিষ্ঠানে তারা পরিদর্শন করেন। এর মধ্যে ৩৪৬টি পরিদর্শন প্রতিবেদন পাঠায় অডিট ও আইন সেলে। যাতে বলা হয়েছে, এ দু’মাসে ২৩ কোটি ৯৬ লাখ ৪১ হাজার ৮৪৮ টাকা প্রাপ্যতার অতিরিক্ত নিয়েছে শিক্ষকরা। ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে হরিলুট হয় ১৫ কোটি, ৬৫ হাজার ৭০৩ টাকা। ২০১১-২০১২ অর্থবছরে নেয়া হয় ৫ কোটি ৪৮ লাখ ৬৮ হাজার ৪৭ টাকা। ২০১০-২০১১ অর্থবছরে শিক্ষকরা গিলে খায় ৭ কোটি ৬২ লাখ ৬১ হাজার ২০০ টাকা। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে নেয়া হয় ১৮ কোটি ৯ লাখ ৪৬ হাজার ২৬৩ টাকা। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে শিক্ষকরা অতিরিক্ত নেন ৩৫ কোটি ৩১ লাখ ৭৭ হাজার ৮৪৪ টাকা। ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে ৫৩ কোটি ৯১ লাখ ৯৮ হাজার ৯১৬ টাকা অতিরিক্ত নেয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকরা। ২০০৬-২০০৭ অর্থবছরে নেয়া হয় ৫৭ কোটি ১৩ লাখ ৪৭ হাজার ৮১৬ টাকা। ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে লুটে নেয়া হয় ২৫ কোটি ২৪ লাখ ২ হাজার ৯৩২ টাকা। ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে নেয়া হয় ৩০ কোটি ২২ লাখ ৭৫ হাজার ৪৩০ টাকা। ২০০৩-২০০৪ অর্থবছরে শিক্ষকরা হাতিয়ে নিয়েছেন ৩১ কোটি ৪১ লাখ ৩৮৩২ টাকা। ২০০২-২০০৩ অর্থবছরে শিক্ষকরা গিলে খান ১৬ কোটি ১৯ লাখ ৯৩ হাজার ৪৮১ টাকা। ২০০১-২০০২ অর্থবছরে লুটপাট হয় ৯ কোটি ৬২ লাখ ৬৭ হাজার ৫০৫ টাকা। ২০০০-২০০১ অর্থবছরে ৪ কোটি ২০ লাখ ৪ হাজার ২১১ টাকা অতিরিক্ত বেতন-ভাতা নেন শিক্ষকরা। ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে ৫ কোটি ৪৮ লাখ ১৯ হাজার ২৪৭ টকা, ১৯৯৮-১৯৯৯ অর্থবছরে প্রাপ্যতার অতিরিক্ত নেয়া হয় ৪ কোটি ৪০ লাখ ৬৫ হাজার ৯৪৭ টাকা। ১৯৯৭-১৯৯৮ অর্থবছরে নেয়া হয় ১৭ কোটি ৭৭ লাখ ১৩ হাজার ৫৩৪ টাকা। ১৯৯৬-১৯৯৭ অর্থবছরে নেয়া হয় ১৫ কোটি ৫৯ লাখ ১৮ হাজার ৯১৮ টাকা। ১৯৯৫-১৯৯৬ অর্থবছরে শিক্ষকরা অতিরিক্ত নেন ১১ কোটি ৮২ লাখ ৫৩ হাজার ১৫৩ টাকা। ১৯৯৪-১৯৯৫ অর্থবছরে নেয়া হয় ৬ কোটি ১৫ লাখ ৩২ হাজার ৩৫৫ টাকা। ১৯৯৩-১৯৯৪ অর্থবছরে মিথ্যা তথ্য দিয়ে শিক্ষকরা তুলে নেন ১ কোটি ৮১ লাখ ১৪ হাজার ৭৭৯ টাকা। ১৯৯২-১৯৯৩ অর্থবছরে নেয়া হয় ৮৬ লাখ ২৯ হাজার ৬৪০ টাকা। ১৯৯১-১৯৯২ অর্থবছরে শিক্ষকরা তুলে নেন ১ কোটি ৭৯ লাখ ৫১ হাজার ৬০১ টাকা। ১৯৯০-১৯৯১ অর্থবছরে ৫৫ লাখ ৬৫ হাজার ৩৭০ টাকা প্রাপ্যতার অতিরিক্ত তুলে নেন  শিক্ষকরা। ১৯৮৯-১৯৯০ অর্থবছরে তুলে নেয়া হয় ২৩ কোটি ৩১ লাখ ৮৯ হাজার ৩১২ টাকা। ১৯৮৮-১৯৮৯ অর্থবছরে শিক্ষকরা তুলে নেন ১৫ কোটি ৬২ লাখ ৭১ হাজার ৮৬৫ টাকা। ১৯৮৭-১৯৮৮ অর্থবছরে লুটে নেয়া হয়  ৫ কোটি ৫৬ লাখ ৫২০ টাকা। ১৯৮৬-১৯৮৭ অর্থবছরে হরিলুট হয় ৫ কোটি ৮৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮৬১ টাকা। ১৯৮৫-১৯৮৬ অর্থবছরে শিক্ষকরা প্রাপ্যতার অতিরিক্ত তুলে নেন ৫ কোটি ৯৬ লাখ ২১ হাজার ৮৬১ টাকা। ১৯৮৪-১৯৮৫ অর্থবছরে লুটে নেয়া হয় ২ কোটি ২০ লাখ ৫৫ হাজার ৫৯১ টাকা। ১৯৮৩-১৯৮৪ অর্থবছরে নেয়া হয় ২ কোটি ১০ লাখ ৩ হাজার ৩০০ টাকা। ১৯৮২-১৯৮৩ অর্থবছরে অতিরিক্ত তুলে নেয়া হয় ১ কোটি ৩৪ লাখ ২৮ হাজার ৮৫ টাকা। ১৯৮১-১৯৮২ অর্থবছরে নেয়া হয় ১০ লাখ ৮৮ হাজার ৫৩ টাকা। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর এসব ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের অডিট ও আইন সেলে বিশাল এ অঙ্কের টাকা প্রাপ্যতার অতিরিক্ত নেয়ার তথ্য জানিয়ে প্রতিবেদন পাঠায়। প্রতিবেদনে তেত্রিশ বছরে ৪৬২ কোটি ৪২ লাখ ৭২ হাজার ২০ টাকা সরকারি বেতন-ভাতা বাবদ বিধিবহির্ভূতভাবে উত্তোলন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে। একইসঙ্গে এসব টাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে ফেরতের সুপারিশ করা হয়। সূত্র জানিয়েছে, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের চলমন প্রক্রিয়া এটি। তারা দেশের ৩০ হাজার প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে সরকারের কত টাকা অতিরিক্ত নেয়া হয়েছে তা বের করবে। পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের অডিট ও আইন সেলে প্রতিবেদন আকারে পাঠাবে। অডিট ও আইন সেল এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।

No comments

Powered by Blogger.