গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে করণীয় খতিয়ে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র by কাউসার মুমিন

গণতন্ত্রের পক্ষে দুর্বার গণআন্দোলনই বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে পারে। গণতন্ত্রের দাবিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব বেশি অস্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ বিষয়ে ভারত তার অবস্থান পরিবর্তন করবে বলে মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ভারতের প্রেসক্রিপশন মোতাবেক চলে না। বাংলাদেশের ৫ই জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা বর্তমান সরকারের প্রতি চীন ও রাশিয়ার নিঃশর্ত সমর্থন দেশটিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে ‘জটিল করে তুলেছে’ বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান ‘হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’-এর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র রিসার্চ ফেলো লিসা কার্টিজ। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র  দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক, ভারতের সামপ্রতিক বাংলাদেশ নীতি এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে এ প্রতিনিধির কাছে লিখিত বার্তায় তিনি এসব মন্তব্য করেন।

উল্লেখ্য, এর আগে বাংলাদেশের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনোত্তর এক সাক্ষাৎকারে লিসা কার্টিস মানবজমিনকে বলেন, ‘বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা বর্তমান একদলীয় সরকার দেশটিতে একনায়কতান্ত্রিক শাসন কায়েম করলে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে মার্কিন সহায়তা ঝুঁকির মুখে পড়বে।’
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার দৃশ্যত ভিন্নমাত্রার সম্পর্ক বিষয়ে লিসা বলেন, ‘৫ই জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন সত্ত্বেও রাশিয়া ও চীন শেখ হাসিনা সরকারের পাশে দাঁড়াবে- এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কেননা, এই দেশ দু’টির নিজেদেরই গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য কিংবা শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ভিত্তি নেই। তাই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অধিকার কিংবা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা খুব কমই উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের চেয়ে এই দেশটিতে কিভাবে আরও বেশি সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি করা যাবে সেদিকেই মস্কো ও পেইচিংয়ের মনোযোগ বেশি।’
বাংলাদেশে ভারতের ভূমিকা এবং বাংলাদেশের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনী ফলাফল বিষয়ে ভারত, চীন ও রাশিয়ার সহাবস্থান বিষয়ে লিসা কার্টিস বলেন, ভারতে যদিও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ গতিশীল এবং দেশটি তার গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করে থাকে, কিন্তু নিজ দেশের গণ্ডির বাইরে গণতন্ত্র উত্তরণে নয়া দিল্লিকে কখনও বড় রকমের ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি। এর ফলে নিজ নিজ ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থে এই দেশ তিনটির (ভারত, চীন ও রাশিয়া) প্রত্যেকেই বাংলাদেশের বিগত নির্বাচনকে স্বীকৃতি দিয়ে অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে এবং এভাবে তাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন সমর্থনের জোরে বাংলাদেশের বর্তমান একদলীয় সরকার ক্রমবর্ধমান হারে স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠছে।
লিসা কার্টিস বলেন, শেখ হাসিনা সরকারকে চীন, রাশিয়া ও ভারতের এই নিঃশর্ত সমর্থন বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে পশ্চিমা দেশগুলোর বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলেছে। এ অবস্থায় বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতার জন্য হাসিনা সরকারকে চাপ দেয়ার বিষয়টি এখন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অপেক্ষাকৃত কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় গণতন্ত্রের দাবিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব বেশি অস্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ বিষয়ে ভারত তার অবস্থান পরিবর্তন করবে বলে মনে হয় না।’
‘আপনি ইতিপূর্বে বলেছিলেন যে, ৫ই জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা বাংলাদেশের বর্তমান একদলীয় সরকারের একনায়কতান্ত্রিক শাসন দেশটিতে মার্কিন সহায়তা ঝুঁকির মুখে ফেলবে’- এমন প্রশ্নের জবাবে লিসা বলেন, ‘বাংলাদেশের মোট রপ্তানির শতকরা ৪০ ভাগ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যায়। তাই যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ উভয়ের স্বার্থেই একটি আন্তরিক সম্পর্ক জরুরি। যুক্তরাষ্ট্র  মনে করে, তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়া কিংবা দেশটির ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মেরুকরণে খুব বেশি পরিবর্তন আনতে পারবে না কিংবা কার্যকর কোন প্রভাব ফেলবে না। তাই দেশটিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংরক্ষণে কিভাবে বর্তমান সরকারকে উৎসাহিত করা যায় এবং এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আর কি কি করার আছে তা এখন খতিয়ে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র।’ বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে লিসা কার্টিস আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি মনে করি সমমনা পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে এবং এর বাইরে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো এশীয় গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে মিলে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সমন্বিত উদ্যোগ শুরু জরুরি।’
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে লিসা খুব জোর দিয়ে বলেন, ‘এটা খুবই স্বাভাবিক যে এ বছরের বাকি সময়টাতে বাংলাদেশ ব্যাপক আন্তর্জাতিক নজরদারিতে থাকবে। এর কারণ বাংলাদেশের সামপ্রতিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়, বরং দেশটির গণতান্ত্রিক বিচ্যুতি। কেননা গণতন্ত্রের পথ থকে সরে যাওয়ায় দেশটির বিগত কয়েক দশকের অর্থনৈতিক অর্জন আজ হুমকির মুখে।’ যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ নীতি বিষয়ে ভারতের ভূমিকা প্রসঙ্গে লিসা কারটিস আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র তার বাংলাদেশ নীতিতে ভারতের প্রেসক্রিপশনের ওপর নির্ভর করছে না। মার্কিন কর্মকর্তারা গভীরভাবে বিশ্বাস করেন, ভারতের বর্তমান বাংলাদেশ নীতি খুবই ক্ষুদ্রদৃষ্টিসম্পন্ন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষার প্রয়োজনের মতো বৃহত্তর প্রেক্ষাপটের গুরুত্ব হয়তো ভারত বুঝতে পারছে না, নতুবা এদিকে তাদের মনোযোগ নেই। লিসা বলেন, যে কোন পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশে একটি দীর্ঘমেয়াদি একনায়কতান্ত্রিক শাসন শেষ পর্যন্ত এ অঞ্চলে ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধেই যাবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত বর্তমান বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে একই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে না, এটা সত্য। তবে বাংলাদেশ বিষয়ে তার অবস্থান পাল্টাতে বা একটি নির্দিষ্ট অবস্থান নিতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে চাপ দিতে পারে কিংবা দেবে বলে মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্র শুধু এইটুকুই করতে পারে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে শেখ হাসিনা সরকারের একনায়কতান্ত্রিক শাসন চলতে দিলে এর দীর্ঘমেয়াদি, অনাকাঙ্ক্ষিত, নেতিবাচক ফলাফল ও জটিলতার বিষয়গুলো জোর দিয়ে বলতে পারে।’ পরিশেষে লিসা কার্টিস বলেন, ‘একটি নির্দলীয় টেকনোক্রেট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র  যদি পশ্চিমের গণতান্ত্রিক দুনিয়া, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও কোরিয়াকে নিয়ে একযোগে কাজ করে তবেই ভাল ফল পাবে বলে আমি মনে করি।’

No comments

Powered by Blogger.