ইয়ালতার মুলো by ইউলিয়া তিমোশেনকো
১৯৩৯ সালে যুদ্ধ ঘোষণা ও ১৯৪০ সালে
বেলজিয়াম ও ফ্রান্সে নাৎসিদের বোমা বর্ষণের মধ্যকার নীরব সময়টুকু প্রায়ই
‘ভুয়া যুদ্ধ’ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া আগ্রাসন ও
অধিগ্রহণ এবং আমাদের পূর্ব সীমান্তে সেনা সমাবেশ ও গোলাবারুদ মজুতকরণের ফলে
আমরা ইউক্রেনে একধরনের ‘ভুয়া শান্তি’র মধ্যে আছি।
আমরা ইউক্রেনের মানুষেরা যে আমাদের দেশ ও গণতন্ত্র রক্ষায় এককাট্টা হচ্ছি, এতে কোনো ভুয়া ব্যাপার নেই। আমাদের তরুণ-তরুণীরা সেনাবাহিনীর জন্য স্বেচ্ছা শ্রম দিচ্ছেন, এরূপ আগে কখনো হয়নি। আইএমএফের সঙ্গে আমাদের সরকার একটি অনুকূল ঋণচুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। এতে আমরা আমাদের আর্থিক খাত ও সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারব। এই চুক্তির কারণে অর্থনীতির ওপর বাস্তব কিছু চাপ পড়বে, কিন্তু আমরা ইউক্রেনবাসীরা দেশের স্বাধীনতাকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর।
একটা সময় আমরা হাত গুটিয়ে বসে ছিলাম। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো আমরাও ভেবেছিলাম, বলপ্রয়োগের দ্বারা আমাদের মানচিত্র আর পরিবর্তিত হবে না। কিন্তু এখন অর্থনীতির এই করুণ দশার মধ্যেও আমরা প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করছি। ইউক্রেনের সার্বভৌম অঞ্চল কারও হাতে আমরা আর ছেড়ে দেব না, সূচ্যগ্র মেদিনী পর্যন্ত নয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, রাশিয়ার সেনাবাহিনী আমাদের বিরুদ্ধে জড়ো হলেও আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আগামী মাসে ইউক্রেনের জনগণ তাঁদের নতুন প্রেসিডেন্ট বেছে নেবেন। আমরা গণতন্ত্র রক্ষা করতে পারি না—আমাদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার এ রকম প্রচারণার এক মোক্ষম জবাব হবে এটা।
হ্যাঁ, তার পরও ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আক্রমণাত্মক শাসনামলের পর ইউক্রেনের জনগণ নিজেদের দেশ পুনর্গঠনের কাজে মাঠে নেমেছেন। আমরা এখন নতুন এক হুমকির মুখে পড়েছি, এটা হচ্ছে একধরনের ‘শান্তি আক্রমণ’—পুরোনো সোভিয়েত আমলের কূটনীতি পশ্চিমকে খাটো করতে যা করেছিল। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে ফোন করে কূটনৈতিক আলোচনা পুনরায় শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন। এরপর রাশিয়া ক্রেমলিনের তৎপরতায় সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় একটি শ্বেতপত্রও দিয়েছে। এটা বাস্তবে শান্তির প্রতি হুমকি।
পুতিনের এই কৌশলের সঙ্গে ১৯৪৫ সালের কুখ্যাত ইয়ালতা সম্মেলনের সাদৃশ্য রয়েছে। জোসেফ স্তালিন সে সময় উইনস্টন চার্চিল ও ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টকে তাঁর ইউরোপ বিভাজনের পরিকল্পনার অংশীদার করে নেন। এর ফলে এই মহাদেশের প্রায় অর্ধেকটাই আধা শতাব্দীর জন্য দাসে পরিণত হয়। এখন পুতিন পশ্চিমকে ক্রেমলিন কর্তৃক প্রণীত ফেডারেল সংবিধানের মাধ্যমে ডজন খানেক ক্রিমিয়া তৈরির পরিকল্পনার ভাগীদার করে নিচ্ছেন। এর মাধ্যমে ছোট ছোট দেশকে রাশিয়া হজম করে নিতে পারবে।
নিঃসন্দেহে ফেডারেল ব্যবস্থার কথা শুনতে ভালোই লাগে। বিকাশমান রাজনৈতিক শক্তি, যার সান্নিধ্যে মানুষ বাস্তবে বসবাস করে, তার একটি আবেদন আছে এবং তা কার্যকরও বটে। কিন্তু পুতিনের মনে ইউক্রেনের জন্য শুভ কিছু নেই। তাঁর কাছে ফেডারেল ব্যবস্থা হচ্ছে রাজনৈতিক অপকর্ম করার একটি মাধ্যম। শেষ পর্যন্ত, এর মাধ্যমে ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলও রাশিয়া ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করে নেবেন পুতিন। মোদ্দা কথা, পুতিনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হচ্ছে সংযুক্তকরণ, অন্যান্য নানা উপায়ে।
রাশিয়ার প্রস্তাবের দিকে শুধু একবার চোখ রাখলেই হবে, ইউক্রেনের নতুন ফেডারেল ইউনিটগুলো ‘ইউক্রেনের বৈদেশিক নীতি প্রণয়নে’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এর ফলে পুতিন রুশ ভাষাভাষী অঞ্চলের মানুষকে দেশের ইউরোপীয় রূপান্তরে ভেটো প্রদানে বাধ্য করবেন।
ইউক্রেনের সংবিধানের কাঠামো কী হবে, তা ইউক্রেনের জনগণই নির্ধারণ করবেন। রাশিয়ার এখানে কিছু বলার নেই। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য, তারা যতই সহযোগিতা করার মানসিকতা দেখাক না কেন। ইউক্রেন বসনিয়া নয়, যারা যুগোস্লাভিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বছরের পর বছর যুদ্ধ হওয়ার পর শান্তি আলোচনার মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। এটা কসোভোও নয়, যাদের সরকারকাঠামো গঠন ও স্বাধীনতা একই সময়ে এসেছে। ইউক্রেন একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন রাষ্ট্র, সারা বিশ্বই একে স্বীকৃতি দিয়েছে, রাশিয়াসহ।
পুতিনের ফেডারেল ব্যবস্থার ধারণার খপ্পরে পড়ার মানে হচ্ছে ইউক্রেনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নিয়ে তাঁরা যে গল্প ছড়াচ্ছেন, তা মেনে নেওয়া। আর ইয়ানুকোভিচকে যে সাহসী মানুষেরা উৎখাত করেছেন, তাঁদের সম্পর্কিত মিথ্যাও মেনে নেওয়া। রুশভাষীরা সেখানে বিপন্ন, পুতিনের এই ভুয়া দাবির সপক্ষে একটি উদাহরণও দেওয়া যাবে না। পূর্ব ইউক্রেন ও ক্রিমিয়া থেকে একজন রুশভাষীও রাশিয়ায় পালিয়ে যাননি। কোনো রুশভাষী দেশের বাইরে কোথাও রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেননি।
কারণটা খুব সরল, ইউক্রেনে কোথাও রুশভাষীদের ওপর কোনো নির্যাতন হয় না এবং কোনো দিন হয়ওনি। ইয়ানুকোভিচের নেতৃত্বাধীন ইউক্রেন সরকার ছিল অযোগ্য, দুর্নীতিগ্রস্ত ও মিথ্যুক। কিন্তু তারা ছিল সমসুযোগ প্রদানের পরিপন্থী।
ইউক্রেনে যদি কোথাও রুশভাষীদের ওপর কোনো নির্যাতন না হয়, তাহলে সেখানকার রাজনৈতিক কাঠামোও পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন নেই। তাহলে কি বিরাট এক মিথ্যার ওপর ভর করে ইউক্রেন নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হবে? আমাদের প্রয়োজন হচ্ছে যোগ্য ও দুর্নীতিমুুক্ত সরকার। ইউরোপের সহায়তা ও প্রাযুক্তিক সহযোগিতায় আমরা তা বাস্তবায়ন করব।
কূটনীতিকদের তরফ থেকে ইউক্রেন সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজার তাগিদ আমাদের কাছে বোধগম্য। কিন্তু রাশিয়া যে শর্ত আরোপ করছে, পশ্চিম যদি তা মেনে নেয়, তাহলে তা ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর রাশিয়ার এই শর্ত মেনে নেওয়া হচ্ছে, অধিক শক্তিশালী রাষ্ট্র কম শক্তিশালী রাষ্ট্রকে তাদের আজ্ঞাবহে পরিণত করবে, এমনকি নিজেদের স্বাধীনতাকে বিকিয়ে দিতে বাধ্য করবে, এই ধারণাকে তেল-জল দিয়ে পুষ্ট করা। ইউক্রেন এই জবরদস্তির জবাব দেবে নিজে থেকেই, যদি প্রয়োজন হয়। ভবিষ্যতে ইতিহাসের পাঠ্যবইতে আমরা অসহায় আত্মসমর্পণকারী হিসেবে পরিচিত হতে চাই না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ইউলিয়া তিমোশেনকো: ইউক্রেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একজন প্রার্থী।
No comments