নিজের খুনে লাল ছাত্রলীগ
প্রায় ৪০ বছর আগের ও পরের দুটি ঘটনা। প্রথমটি ঘটেছে ১৯৭৪ সালে, দ্বিতীয়টি ২০১৪ সালের ১ এপ্রিল। দুটো ঘটনারই ঘটক সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ এবং শিকারও ছাত্রলীগ। প্রথম ঘটনাটির স্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হল। ঘাতকেরা রাতের বেলা টিভিকক্ষের সামনে ব্রাশফায়ার করে কোহিনুরসহ ছাত্রলীগের সাতজন নেতা-কর্মীকে হত্যা করে, যাঁরা সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলমের বিরোধী হিসেবে পরিচিত। ঘটনার পরপরই শফিউল আলম প্রধান হত্যার বিচারের দাবিতে ক্যাম্পাসে মিছিল বের করেছিলেন। পরে জানা যায়, তিনিই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা। বিচারে ১৪ বছর জেল হলেও পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমানের অনুকম্পায় প্রধান মুক্তি পান এবং জাগপা নামে একটি রাজনৈতিক দল করেন। বর্তমানে তিনি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৯-দলীয় জোটের শরিক। দ্বিতীয় ঘটনার স্থল ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। গত ৩১ মার্চ চতুর্থ বর্ষের ফিশারিজ বায়োলজি ও জেনেটিকস বিভাগের একটি কোর্সের ক্লাস পরীক্ষা শিক্ষককে বলে পেছানোর জন্য সায়াদ ইবনে মোমতাজকে চাপ দিয়েছিলেন ছাত্রলীগের দুই নেতা সুজয় ও রোকন। সায়াদ নিজেও ছাত্রলীগের কর্মী। তিনি শিক্ষককে বলে পরীক্ষা পেছানোর ব্যবস্থা করবেন বলেও আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট শিক্ষক পরীক্ষা পেছাতে রাজি হননি বলে নির্ধারিত সময়েই পরীক্ষা হয়। এ নিয়ে সায়াদের সঙ্গে সুজয়ের বাগিবতণ্ডা হয় এবং এর জের ধরে সোমবার সন্ধ্যায় আশরাফুল হক হলের ২০৫ কক্ষে সায়াদকে ডেকে নেন সুজয় কুমার কুণ্ডু ও রোকনুজ্জামান। তাঁদের সঙ্গে আরও ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা স্বপন, রেজা, জাহিদ হাসান, রামচন্দ্র ও রাসেল। তাঁরা সবাই মিলে সায়াদকে রড, লাঠি ও হকিস্টিক দিয়ে বেধড়ক পেটান। সায়াদ পরদিন হাসপাতালে মারা যান।
ঘটনার পরই ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন যে ইসলামী ছাত্রশিবির এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ভাগ্যিস, ১৯৭৪ সালে ইসলামী ছাত্রশিবির ছিল না। থাকলে শফিউল আলম প্রধানও শিবিরের ওপর দায় চাপিয়ে শাস্তি থেকে রেহাই পেতে পারতেন। সন্দেহ নেই, ইসলামী ছাত্রশিবির একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। তাদের ক্যাডাররা শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে জন্মলগ্ন থেকেই। রগ কাটা ও হাত কাটা তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। গত বছর যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধে যে তারা দেশজুড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করে, তাও সবার জানা। আমরা তাদের এসব ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের নিন্দা ও প্রতিবাদ করি। বিচার চাই। কিন্তু যে হত্যাকাণ্ড ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী ক্যাডাররা ঘটিয়েছেন, তার দায় শিবির বা অন্য সংগঠনের ওপর চাপালে মানুষ সেটি মানবে কেন? এটি অপরাধীদের রক্ষায় সেই প্রধানীয় অপকৌশল বৈকি। প্রধানেরা ছাত্রলীগ ছেড়ে গেলেও তাঁদের প্রেতাত্মা ভর করে আছে। সায়াদ হত্যার প্রতিবাদে যখন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উত্তাল, সাধারণ ছাত্রছাত্রী থেকে শিক্ষকেরাও আন্দোলনে নেমেছেন, তখন ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মুর্শেদউজ্জামান নতুন কথা শোনালেন। তাঁর ভাষায়, ‘সায়াদ হত্যার বিচার আমরাও চাই। কারণ, তিনি আমাদের সংগঠনের কর্মী। কিন্তু সমস্যা হলো, এ ঘটনা নিয়ে ক্যাম্পাসে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রশিবির, ছাত্রদলসহ বিভিন্ন সংগঠন ষড়যন্ত্র করছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন অনেক শিক্ষক।’ (প্রথম আলো, ৪ এপ্রিল ২০১৪)
মুর্শেদউজ্জামানের দাবি অনুযায়ী ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রদল ও শিবিরের সঙ্গে মিলে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এবং সেই ষড়যন্ত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকও যোগ দিয়েছেন। এর চেয়ে হাস্যকর দাবি আর কী হতে পারে? এরপর হয়তো ছাত্রলীগের নেতারা ‘ষড়যন্ত্রকারী ছাত্র ও শিক্ষকদের’ বিতাড়িত করতে আন্দোলনে নামবেন! কেননা, স্বাধীনতার পক্ষশক্তির প্রধান সিপাহশালার হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পবিত্র রাখার দায়িত্ব তাঁদেরই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রশাসন, শিক্ষক ও অন্যান্য ছাত্রসংগঠন—এসব কিছুই না। এ রকম পবিত্র দায়িত্ব পালন করতেই ১৯৭৪ সালে মুহসীন হলে ব্রাশফায়ার করে সাতজনকে হত্যা করা হয়েছিল। ক্যাম্পাসকে পবিত্র রাখতেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক গ্রুপ অপর গ্রুপের কর্মী জুবায়ের আহমেদকে হত্যা করে। সেখানে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ ছিল। একটি তৎকালীন উপাচার্য শহীদ এনামুল কবিরের সমর্থক, অপরটি বিরোধী। জুবায়ের হত্যাকারীরা এনামুল কবিরের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছিলেন বলেই তিনি উপাচার্যের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় নিরাপদ ছিলেন। পরে কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও এখন পর্যন্ত মামলার চার্জশিট হয়নি। আদৌ হবে কি না, কে জানে। এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের’ পতাকাবাহী ছাত্রসংগঠনটি অভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত হয়ে প্রতিপক্ষের ওপর হামলে পড়ছে। অনেকের তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। অনেকে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করছে। আর ছাত্রলীগের নেতৃত্ব যথারীতি দোষ চাপাচ্ছেন অন্য ছাত্রসংগঠন কিংবা অদৃশ্য শক্তির ওপর। বর্তমানে কেউ ছাত্রলীগ বা যুবলীগের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করলেই তাঁকে জামায়াত-শিবিরের এজেন্ট বানানো হয়। স্বাধীনতাবিরোধী বলে গাল দেওয়া হয়।
ছাত্রলীগের ওই নেতার অভিযোগ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠনটি নাকি ছাত্রশিবিরের সঙ্গে মিলে তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। অথচ বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই আটক জামায়াত ও শিবিরের আটক নেতা-কর্মীদের ছাড়াতে তদবির করছেন। এসব তদবিরের আসল মাজেজাও কারও অজানা নয়। এখন ছাত্রলীগ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলবাজির সমার্থক শব্দ হয়ে পড়েছে। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা-কর্মীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সর্বশেষ বিরোধের কারণ হলো লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীতের আয়োজনে জামায়াতের সমর্থক বলে পরিচিত ইসলামী ব্যাংকের টাকা নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে। আরও অনেক প্রগতিশীল সংগঠনের সঙ্গে গণজাগরণ মঞ্চ ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়ার বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু ছাত্রলীগের কর্মীরা এই বিরোধিতাকে সহজভাবে নেয়নি। এ নিয়ে দুই পক্ষের বাগিবতণ্ডা, মারধর, চায়ের গরম পানি গায়ে ছুড়ে মারা এবং থানায় মামলা পর্যন্ত গড়ায়। কেবল সায়াদ হত্যাই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একমাত্র ‘কৃতিত্ব’ নয়, ছাত্রী উত্ত্যক্ত করা থেকে শুরু করে গরিব দোকানদারের দোকানে ফাউ খাওয়া—এমন কোনো অপরাধ নেই যা তারা করেনি। গত বছর দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে ১০ বছরের একটি শিশু নিহত হওয়ার পর ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। মাস কয়েক পর মুরাদউজ্জামান ও সাইফুল ইসলামকে নিয়ে নতুন কমিটি হওয়ার পর ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আরও বেড়েছে। যাঁরাই ছাত্রলীগ নেতৃত্বের বিরোধিতা করছেন, তাঁদের বিভিন্ন হলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। অন্তত তিনটি হলে তাদের টর্চার সেল আছে বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসে টর্চার সেল!
অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনও ছাত্রলীগের অনুগত থাকতে পছন্দ করে। তারা ছাত্রলীগের সব দুষ্কর্ম বিনা বাধায় মেনে নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শহিদুর রহমান খান, ক্যাম্পাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা যাঁর দায়িত্ব, বলেছেন, তাঁর কাছে নাকি এসব অঘটন সম্পর্কে কেউ লিখিত অভিযোগ করেননি। মৌখিক অভিযোগ করলে যখন তিনি অভিযোগকারীর নামধাম অভিযুক্তকে বলে দেন, তখন কীভাবে তাঁরা লিখিত অভিযোগ করবেন। এঁরা শিক্ষক নামের কলঙ্ক। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবু হাদী নূর আলী খান বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে টর্চার সেল রয়েছে বলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলেছেন, তাঁরা এসব থেকে মুক্তি চান। বিষয়টি নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রফিকুল হক প্রকারান্তরে ছাত্রলীগের মাস্তানির কথা স্বীকার করে বলেছেন, ‘সায়াদের মৃত্যুর ঘটনা আমাদের অনেক বোধোদয় ঘটিয়েছে।’ গত বছরের জানুয়ারিতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে রাব্বী নামে ১০ বছরের এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল। তার পরও উপাচার্য বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বোধোদয় হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চেয়ে পুলিশ অনেক বেশি সাহসী। বাসযোগে শেরপুরে পালানোর সময় তারা সুজয় ও রোকনকে গ্রেপ্তার করেছে। গত ৪০ বছরে রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সামরিক শাসককে হটিয়ে আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি। কিন্তু ছাত্রলীগের চরিত্র ও আচরণে কোনো পরিবর্তন নেই। তারা এখনো সেই শফিউল আলম প্রধানদের ‘নীতি ও আদর্শ’ আঁকড়ে আছে।
সায়াদ হত্যার আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জুবায়ের আহমেদ নামে এক ছাত্রলীগের কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। তারও আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল থেকে ছাত্রলীগের সভাপতিকে তিনতলা থেকে ফেলে হত্যা করা হয়। এ রকম হত্যা ও অঘটনের ঘটনা অনেক আছে। সায়াদ হত্যার পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মামলা করলেও কাউকে আসামি করা হয়নি। ভাশুরের নাম নেওয়ার মতো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ছাত্রলীগের নাম নিতে ভয় পায়। সারা দেশেই এখন ভয়ের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ২০০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, যার শিরোনাম ছিল ‘প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগকে সামলান’। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সামলাতে চেষ্টা করেননি। তবে তিনি একবার ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে সংগঠনটির সাংবিধানিক প্রধানের পদ ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আরেকবার তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে সাক্ষাৎ দেননি বলেও পত্রিকায় খবর এসেছিল। কিন্তু এসব মান-অভিমান বা সদুপদেশ যে কোনো কাজে আসেনি, ছাত্রলীগের কর্মী সায়াদ হত্যাই তার প্রমাণ। সম্প্রতি একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী এক সমাবেশে বলেছেন, বিরোধী দলকে মোকাবিলা করতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। বিরোধী দল মাঠে নেই, ক্যাম্পাসে নেই। তাই, ছাত্রলীগ নিজেই নিজেকে মোকাবিলা করছে এবং নিজের খুনে নিজে লাল হচ্ছে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
ঘটনার পরই ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন যে ইসলামী ছাত্রশিবির এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ভাগ্যিস, ১৯৭৪ সালে ইসলামী ছাত্রশিবির ছিল না। থাকলে শফিউল আলম প্রধানও শিবিরের ওপর দায় চাপিয়ে শাস্তি থেকে রেহাই পেতে পারতেন। সন্দেহ নেই, ইসলামী ছাত্রশিবির একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। তাদের ক্যাডাররা শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে জন্মলগ্ন থেকেই। রগ কাটা ও হাত কাটা তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। গত বছর যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধে যে তারা দেশজুড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করে, তাও সবার জানা। আমরা তাদের এসব ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের নিন্দা ও প্রতিবাদ করি। বিচার চাই। কিন্তু যে হত্যাকাণ্ড ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী ক্যাডাররা ঘটিয়েছেন, তার দায় শিবির বা অন্য সংগঠনের ওপর চাপালে মানুষ সেটি মানবে কেন? এটি অপরাধীদের রক্ষায় সেই প্রধানীয় অপকৌশল বৈকি। প্রধানেরা ছাত্রলীগ ছেড়ে গেলেও তাঁদের প্রেতাত্মা ভর করে আছে। সায়াদ হত্যার প্রতিবাদে যখন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উত্তাল, সাধারণ ছাত্রছাত্রী থেকে শিক্ষকেরাও আন্দোলনে নেমেছেন, তখন ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মুর্শেদউজ্জামান নতুন কথা শোনালেন। তাঁর ভাষায়, ‘সায়াদ হত্যার বিচার আমরাও চাই। কারণ, তিনি আমাদের সংগঠনের কর্মী। কিন্তু সমস্যা হলো, এ ঘটনা নিয়ে ক্যাম্পাসে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রশিবির, ছাত্রদলসহ বিভিন্ন সংগঠন ষড়যন্ত্র করছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন অনেক শিক্ষক।’ (প্রথম আলো, ৪ এপ্রিল ২০১৪)
মুর্শেদউজ্জামানের দাবি অনুযায়ী ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রদল ও শিবিরের সঙ্গে মিলে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এবং সেই ষড়যন্ত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকও যোগ দিয়েছেন। এর চেয়ে হাস্যকর দাবি আর কী হতে পারে? এরপর হয়তো ছাত্রলীগের নেতারা ‘ষড়যন্ত্রকারী ছাত্র ও শিক্ষকদের’ বিতাড়িত করতে আন্দোলনে নামবেন! কেননা, স্বাধীনতার পক্ষশক্তির প্রধান সিপাহশালার হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পবিত্র রাখার দায়িত্ব তাঁদেরই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রশাসন, শিক্ষক ও অন্যান্য ছাত্রসংগঠন—এসব কিছুই না। এ রকম পবিত্র দায়িত্ব পালন করতেই ১৯৭৪ সালে মুহসীন হলে ব্রাশফায়ার করে সাতজনকে হত্যা করা হয়েছিল। ক্যাম্পাসকে পবিত্র রাখতেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক গ্রুপ অপর গ্রুপের কর্মী জুবায়ের আহমেদকে হত্যা করে। সেখানে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ ছিল। একটি তৎকালীন উপাচার্য শহীদ এনামুল কবিরের সমর্থক, অপরটি বিরোধী। জুবায়ের হত্যাকারীরা এনামুল কবিরের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছিলেন বলেই তিনি উপাচার্যের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় নিরাপদ ছিলেন। পরে কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও এখন পর্যন্ত মামলার চার্জশিট হয়নি। আদৌ হবে কি না, কে জানে। এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের’ পতাকাবাহী ছাত্রসংগঠনটি অভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত হয়ে প্রতিপক্ষের ওপর হামলে পড়ছে। অনেকের তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। অনেকে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করছে। আর ছাত্রলীগের নেতৃত্ব যথারীতি দোষ চাপাচ্ছেন অন্য ছাত্রসংগঠন কিংবা অদৃশ্য শক্তির ওপর। বর্তমানে কেউ ছাত্রলীগ বা যুবলীগের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করলেই তাঁকে জামায়াত-শিবিরের এজেন্ট বানানো হয়। স্বাধীনতাবিরোধী বলে গাল দেওয়া হয়।
ছাত্রলীগের ওই নেতার অভিযোগ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠনটি নাকি ছাত্রশিবিরের সঙ্গে মিলে তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। অথচ বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই আটক জামায়াত ও শিবিরের আটক নেতা-কর্মীদের ছাড়াতে তদবির করছেন। এসব তদবিরের আসল মাজেজাও কারও অজানা নয়। এখন ছাত্রলীগ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলবাজির সমার্থক শব্দ হয়ে পড়েছে। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা-কর্মীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সর্বশেষ বিরোধের কারণ হলো লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীতের আয়োজনে জামায়াতের সমর্থক বলে পরিচিত ইসলামী ব্যাংকের টাকা নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে। আরও অনেক প্রগতিশীল সংগঠনের সঙ্গে গণজাগরণ মঞ্চ ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়ার বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু ছাত্রলীগের কর্মীরা এই বিরোধিতাকে সহজভাবে নেয়নি। এ নিয়ে দুই পক্ষের বাগিবতণ্ডা, মারধর, চায়ের গরম পানি গায়ে ছুড়ে মারা এবং থানায় মামলা পর্যন্ত গড়ায়। কেবল সায়াদ হত্যাই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একমাত্র ‘কৃতিত্ব’ নয়, ছাত্রী উত্ত্যক্ত করা থেকে শুরু করে গরিব দোকানদারের দোকানে ফাউ খাওয়া—এমন কোনো অপরাধ নেই যা তারা করেনি। গত বছর দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে ১০ বছরের একটি শিশু নিহত হওয়ার পর ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। মাস কয়েক পর মুরাদউজ্জামান ও সাইফুল ইসলামকে নিয়ে নতুন কমিটি হওয়ার পর ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আরও বেড়েছে। যাঁরাই ছাত্রলীগ নেতৃত্বের বিরোধিতা করছেন, তাঁদের বিভিন্ন হলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। অন্তত তিনটি হলে তাদের টর্চার সেল আছে বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসে টর্চার সেল!
অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনও ছাত্রলীগের অনুগত থাকতে পছন্দ করে। তারা ছাত্রলীগের সব দুষ্কর্ম বিনা বাধায় মেনে নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শহিদুর রহমান খান, ক্যাম্পাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা যাঁর দায়িত্ব, বলেছেন, তাঁর কাছে নাকি এসব অঘটন সম্পর্কে কেউ লিখিত অভিযোগ করেননি। মৌখিক অভিযোগ করলে যখন তিনি অভিযোগকারীর নামধাম অভিযুক্তকে বলে দেন, তখন কীভাবে তাঁরা লিখিত অভিযোগ করবেন। এঁরা শিক্ষক নামের কলঙ্ক। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবু হাদী নূর আলী খান বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে টর্চার সেল রয়েছে বলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলেছেন, তাঁরা এসব থেকে মুক্তি চান। বিষয়টি নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রফিকুল হক প্রকারান্তরে ছাত্রলীগের মাস্তানির কথা স্বীকার করে বলেছেন, ‘সায়াদের মৃত্যুর ঘটনা আমাদের অনেক বোধোদয় ঘটিয়েছে।’ গত বছরের জানুয়ারিতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে রাব্বী নামে ১০ বছরের এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল। তার পরও উপাচার্য বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বোধোদয় হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চেয়ে পুলিশ অনেক বেশি সাহসী। বাসযোগে শেরপুরে পালানোর সময় তারা সুজয় ও রোকনকে গ্রেপ্তার করেছে। গত ৪০ বছরে রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সামরিক শাসককে হটিয়ে আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি। কিন্তু ছাত্রলীগের চরিত্র ও আচরণে কোনো পরিবর্তন নেই। তারা এখনো সেই শফিউল আলম প্রধানদের ‘নীতি ও আদর্শ’ আঁকড়ে আছে।
সায়াদ হত্যার আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জুবায়ের আহমেদ নামে এক ছাত্রলীগের কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। তারও আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল থেকে ছাত্রলীগের সভাপতিকে তিনতলা থেকে ফেলে হত্যা করা হয়। এ রকম হত্যা ও অঘটনের ঘটনা অনেক আছে। সায়াদ হত্যার পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মামলা করলেও কাউকে আসামি করা হয়নি। ভাশুরের নাম নেওয়ার মতো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ছাত্রলীগের নাম নিতে ভয় পায়। সারা দেশেই এখন ভয়ের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ২০০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, যার শিরোনাম ছিল ‘প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগকে সামলান’। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সামলাতে চেষ্টা করেননি। তবে তিনি একবার ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে সংগঠনটির সাংবিধানিক প্রধানের পদ ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আরেকবার তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে সাক্ষাৎ দেননি বলেও পত্রিকায় খবর এসেছিল। কিন্তু এসব মান-অভিমান বা সদুপদেশ যে কোনো কাজে আসেনি, ছাত্রলীগের কর্মী সায়াদ হত্যাই তার প্রমাণ। সম্প্রতি একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী এক সমাবেশে বলেছেন, বিরোধী দলকে মোকাবিলা করতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। বিরোধী দল মাঠে নেই, ক্যাম্পাসে নেই। তাই, ছাত্রলীগ নিজেই নিজেকে মোকাবিলা করছে এবং নিজের খুনে নিজে লাল হচ্ছে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments