তবু বই পড়ুন

বইমেলা উদ্বোধন করছেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর
সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না। বই পড়লে মনের দেউলিয়াত্ব ঘোচে। জীবন জগৎ সম্পর্কে জানা-শোনা বাড়ে। রবীন্দ্রনাথ লাইব্রেরিকে সভ্যতার সেতু হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। বই যেমন জীবনের পরিধি বাড়ায়, তেমনি স্বপ্ন দেখতে শেখায়। তাই, এই ইন্টারনেট এবং ই-মেইলের যুগেও বইয়ের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি। অন্তত আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বইয়ের প্রচার, প্রসার বেড়েছে। বাড়ছে পাঠকের সংখ্যাও। আগে শহরে পাড়ায় পাড়ায় যেমন পাঠাগার ছিল, এখন আর সেটি চোখে পড়ে না। মানুষ নিজের আগ্রহেই পছন্দের বইটি খুঁজে নেয়।
আগে স্কুল-কলেজে পাঠ্যবইয়ের বাইরেও পাঠচক্রের আয়োজন করা হতো। প্রতিটি স্কুল ও কলেজে লাইব্রেরি ছিল; যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা বই বাসায় নিয়ে যেতে পারত। এখন অনেক স্কুলেই লাইব্রেরি নেই। তা ছাড়া স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাথায় পাঠ্যবইয়ের বোঝা এত ভারী যে তারা এর বাইরে কিছু পড়ার কথা ভাবতেই পারে না। এমনই প্রেক্ষাপটে বরিশালে শুরু হয়েছে ১২ দিনব্যাপী বিভাগীয় বইমেলা। ঢাকার নামীদামি ৬৩টি প্রকাশনা সংস্থা যোগ দিয়েছে এই মেলায়। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে মেলা উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বইয়ের স্টল, সাজসজ্জা—সবই আছে। বইমেলা নিয়ে বরিশালের বইপ্রেমী মানুষ তথা ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করা গেছে। তবে এই মেলা প্রতিবছর হওয়া উচিত। কালেভদ্রে হলে ছাত্র-ছাত্রীদের মনে দাগ কাটবে না। বরিশালের একটি নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বইমেলা নিয়ে কথা হলো। তারাও পাঠ্যবইয়ের বাইরের বিচিত্র বিষয়ে বইয়ের প্রতি আগ্রহ দেখাল। বলল, আমরাও গল্প, উপন্যাস কিংবা সাহিত্যের বই পড়তে চাই। কিন্তু সারা বছরই পরীক্ষার চাপ। বরিশাল একসময় লেখাপড়ায় অগ্রসর ছিল। এখানে শিক্ষার হারও বেশি। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে অনেক খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ছিলেন। ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশের মতো কবি। বিভিন্ন সংগঠন পাঠচক্রের আয়োজন করত।
ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠের আগ্রহ বাড়ত। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় একধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যাচ্ছে। অভিভাবকেরা বলছেন, পাশের বাসার ছেলেটি বা মেয়েটি পাঁচজন শিক্ষকের কাছে কোচিং করে। আমার সন্তান যদি চার জায়গায়ও না যায়, তাহলে তো মেধাতালিকায় নাম থাকবে না। একসময় বরিশালের পাড়া-মহল্লায় এলাকাবাসী গড়ে তুলতেন পাঠাগার, ক্লাব। যেখানে থাকত কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি, বিজ্ঞানের কল্পকাহিনিসহ নানা ধরনের বই এবং বিভিন্ন খেলার সামগ্রী। বই পড়ুয়ারা বিকেলে ঘুরেফিরে চলে যেত সেখানে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সবাই বসত পাঠ্যবইয়ের টেবিলে। আজ সেই রেওয়াজ অনেকটাই ফিকে হয়ে আসছে। যদিও খেলাঘর, উদীচীসহ কয়েকটি সংগঠন পাঠচক্রের আয়োজন করে। তবে তা নিয়মিত নয়। বই পাঠের অভ্যাস বাড়াতে হলে বরিশালে নিয়মিত পাঠচক্র, ভাষা প্রতিযোগের আয়োজন করা প্রয়োজন বলে জানালেন একজন সাংস্কৃতিক কর্মী। তবে বরিশালের পাবলিক লাইব্রেরির অবস্থাও খুব ভালো নয়। সেখানে নতুন বই তেমন নেই। পাবলিক লাইব্রেরি হিসেবে পরিচিত জাহানারা হল দখল হয়ে গেছে। বরিশালে সর্বশেষ কবে বইমেলা হয়েছে তা হিসাব করে বের করতে হবে।
বাংলা একাডেমির সঙ্গে তাল মিলিয়ে উদীচী বরিশালে আয়োজন করেছিল সাত দিনের বইমেলার। ১৯৮৯ সাল থেকে একটানা সাত-আট বছর চলে ওই মেলা। ঢাকার প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, লেখকদের পদচারণে মুখর থাকত তখন বরিশাল। হঠাৎ করেই আয়োজকেরা বন্ধ করে দিলেন মেলা। এরপর দু-একবার বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের উদ্যোগে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয় বইমেলার। এখন তাও বন্ধ। বরিশালের এই শূন্যতা পূর্ণ করতে হলে দরকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জেলায় জেলায় বইমেলার আয়োজন। তার আগে দরকার শিক্ষার্থীদের মাথার ওপর থেকে অসুস্থ প্রতিযোগিতার বোঝা নামানো। তা না হলে বইমেলার আয়োজন করেও শিক্ষার্থীদের বা আগামী প্রজন্মকে বইয়ের প্রতি আগ্রহী করা সম্ভব হবে না। এই দায় আমাদের সবার। শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান, অভিভাবক, সমাজ, রাষ্ট্র—সবাইকেই এই দায় নিতে হবে। একই সঙ্গে বইয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। তাহলেই অঞ্চল সমৃদ্ধ হবে। আঞ্চলিক ইতিহাস থেকেই জাতীয় ইতিহাস গড়ে ওঠে। তবু বই পড়ুন।
সাইফুর রহমান: সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী, বরিশাল।

No comments

Powered by Blogger.