কোন পথে শাহবাগ by সাজেদুল হক
তথ্যটি জানা গেল আচমকাই। শাহবাগে গণজাগরণ
মঞ্চের সমাবেশ করতেও অনুমতির প্রয়োজন হয়। এখানেও ঘটনা শেষ হয়নি। অনুমতি না
থাকায় মঞ্চকে সমাবেশ তো করতেই দেয়া হয়নি, এমনকি মঞ্চের কর্মীদের লাঠিপেটা
আর গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ। অথচ গত এক বছরের বেশি সময় ধরে পুলিশি
প্রোটেকশনে দিনের পর দিন শাহবাগে অবস্থান করেছে গণজাগরণ মঞ্চ।
এর
ন্যূনতম বিরোধিতাকেও সহ্য করা হয়নি। আইন সভা থেকে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ‘
হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে শাহবাগ আন্দোলনকে। কিন্তু হঠাৎ করে কেন গণজাগরণ
মঞ্চের ওপর খড়গহস্ত পুলিশ? কেনই বা মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারকে
অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে? তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ?
তাহলে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ কি বিভক্ত হয়ে গেল? এর আগে অতীতে খানিক দৃষ্টি
ফেরানো যাক। মোগল আমলে সুবা বাংলার রাজধানী ঢাকা। ঠিক সে সময়ে গোড়াপত্তন
হয় শাহবাগ এলাকার। তখন এর নাম ছিলো বাগ-ই বাদশাহী। যার মানে রাজার বাগান।
মোগল আমলের অবসানের পর পরিত্যক্ত এ বাগানবাড়ি নতুন করে নির্মাণ হয় ১৮৭৩
সালে। নওয়াব আবদুল গনি ফিরিয়ে আনেন এর ঐতিহ্য। বাগ-ই বাদশাহীর নতুন নাম করা
হয় শাহবাগ। ইতিহাসের বহু ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শাহবাগের নাম। ১৯৭১ সালের
৭ই মার্চ শাহবাগের কাছাকাছি রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
ভাষণ সৃষ্টি করেছিল এক আলোকোজ্জ্বল ইতিহাস। ৪১ বছর পর ২০১৩ সালের ৫ই
ফেব্রুয়ারি শাহবাগে শুরু হয় নতুন ইতিহাসের যাত্রা। জামায়াতের সহকারী
সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে সেদিন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের প্রতিবাদে ফেসবুকে প্রচারণা
চালিয়ে বিকালে শাহবাগে জড়ো হয় কিছু তরুণ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হতে
থাকে জমায়েত। উচ্চকিত হতে থাকে শ্লোগান, দাবি কাদের মোল্লার ফাঁসি। ক্রমশ
তৈরি হয় রেকর্ড। টানা ১৫ দিনের বেশি রাত-দিন চলে অবস্থান। টিভি চ্যানেলে
সার্বক্ষণিক লাইভ সম্প্রচার। সংবাদপত্রে প্রধান খবর। দেশের সীমানা ফেরিয়ে
ভিনদেশী সংবাদ মাধ্যমেও গণজাগরণ মঞ্চ আলোচিত হয়। লন্ডনের দি ইকোনমিস্ট একে
বাংলাদেশে গত দুই দশকে সবচেয়ে বড় গণজমায়েত হিসেবে অভিহিত করে। ভারতীয় সংবাদ
মাধ্যমের বিশ্লেষণে বলা হয়, শাহবাগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরে এসেছে।
শাহবাগের দাবির ফর্দ অবশ্য এক সময় বড় হতে থাকে। কাদের মোল্লার ফাঁসি থেকে
সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবি, ‘যুদ্ধাপরাধী’ প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ,
জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি যুক্ত হয় একসময়। এক পর্যায়ে
আন্দোলনে প্রাথমিক বিজয়ও লাভ করে গণজাগরণ মঞ্চ। আন্তর্জাতিক অপরাধ
ট্রাইব্যুনালস আইন সংশোধন করে সাজা হওয়া মামলাতেও রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের
বিধান করা হয়। এ সংশোধনীতে দায়ের করা আপিলেই পরে কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়।
তবে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ব্লগার রাজীবের হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনা নতুন মোড়
নেয়। নাস্তিকতার অভিযোগ আনা হয় মঞ্চের বিরুদ্ধে। এক পর্যায়ে ঘটনাপ্রবাহে
আবির্ভাব ঘটে হেফাজতে ইসলামের। যদিও প্রবল আক্রমণের মুখে একসময় হেফাজত
নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। কাদের মোল্লার ফাঁসির পর গণজাগরণ মঞ্চকেও আর
উচ্চকিত দেখা যায়নি। রুটিন কার্যক্রমেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখে মঞ্চ। যদিও
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারকে নিয়ে কখনও
কখনও বিতর্ক হয়েছে। তবে এখন সরকারের সঙ্গে গণজাগরণ মঞ্চের একটি অংশের
দূরত্ব সৃষ্টির পর নানা বিষয়ই নতুন করে সামনে এসেছে। জাতীয় সংগীতে রেকর্ড
সৃষ্টির অনুষ্ঠানে ইসলামী ব্যাংকের টাকা নেয়ার প্রতিবাদসহ সরকারের বিরোধিতা
করার কারণেই ছাত্রলীগ-যুবলীগ গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে
বলে মনে করেন ইমরান এইচ সরকার। অন্যদিকে, তার বক্তব্যকে মিথ্যা ও
বিভ্রান্তিকর হিসেবে অভিহিত করেছে ছাত্রলীগ। গণজাগরণ মঞ্চের শুরুর দিন
থেকেই সরকার মঞ্চের ওপর শতভাগ নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করে। বেশির ভাগ
ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়। এ নিয়ে বাম সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে ছাত্রলীগের
শুরু থেকেই বিভেদ ছিল। এখন সে বিভেদ আরও প্রকট রূপ ধারণ করেছে। একপক্ষীয়
নির্বাচন শেষে ক্ষমতায় ফেরার পর সরকার এখন আর গণজাগরণ মঞ্চের প্রয়োজনও
অনুভব করছে না। মঞ্চ থাকলেও তা যেন শতভাগ সরকার নিয়ন্ত্রিত থাকে তা নিশ্চিত
করার প্রচেষ্টাই এখন প্রবল। এ কারণে সরকার এবং রাষ্ট্র না বদলালেও গণজাগরণ
মঞ্চের আতিথেয়তা বদলে গেছে। গণজাগরণ মঞ্চের যাত্রার ১৬ দিন পর আমরা শাহবাগ
অভ্যুত্থানের শেষ অঙ্ক দেখার চেষ্টা করেছিলাম। হাজার হাজার মশালে শুরু
হওয়া আন্দোলনের শেষ হয়তো দেখা যাচ্ছে।
No comments