বিএনপি ও ইসির ওপর প্রভাব by আলী রীয়াজ
১৯ ফেব্রুয়ারি উপজেলা নির্বাচনের প্রথম
দফা শেষে প্রাপ্ত ফলাফল জানার পর থেকেই বিভিন্ন রকমের আলোচনা, বিশ্লেষণ
আমরা দেখতে পেয়েছি। প্রথম দফার ফলাফলে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের
তুলনামূলকভাবে বেশি চেয়ারম্যান পদে জেতার পর কেউ কেউ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন
যে গত বছরের শেষের দিকটাতে নির্বাচনের আগে বিএনপি সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ছিল
বলে জানার পরেও সাধারণ ভোটাররা কেন বিএনপির প্রার্থীদের বিজয়ী করছেন।
জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং প্রচার সত্ত্বেও দলের প্রার্থীদের ফলাফল এই
বিস্ময়ে আরেক মাত্রা যুক্ত করেছে।
অন্যদিকে
কেউ কেউ বলেছেন যে এটাই তাঁরা অনুমান করছিলেন। কেননা, গত বছরের বিভিন্ন
জনমত জরিপে বিএনপি এগিয়ে ছিল। সরকার-সমর্থকদের মধ্যে সাময়িক হতাশাও লক্ষ
করা গিয়েছিল। কিন্তু একটা স্বস্তি তৈরি হয়েছিল যে জাতীয় নির্বাচনের আগে
সহিংসতা দেখা গেলেও এ ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে
খানিকটা ইতিবাচক মনোভাবের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু প্রথম দফা
শান্তিপূর্ণ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের পর তৃতীয় দফা নাগাদ সহিংসতা বৃদ্ধি পায়।
পর্যায়ক্রমে বিএনপির প্রার্থীরা পিছিয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনরা
বেশিসংখ্যক চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন।
কিন্তু ফলাফলের চেয়েও নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে আমরা যেটা দেখতে পেলাম তা হলো, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন যে সংকটের মধ্যে নিপতিত হয়েছে, তাকে আরও বেশি সংকটের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হলো। এ বিষয়ে আমরা গতকাল আলোচনা করেছি। আজ আমরা দেখব বিএনপির ওপর এই ফলাফলের, বিশেষত শেষ তিন দফায় সংঘটিত অনিয়মের কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। এসব অনিয়মের ফলে কেবল যে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন উঠছে তা নয়, পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ল।
বিএনপি গোড়াতে ভালো ফল করলেও শেষ পর্যন্ত মোট হিসাবে আওয়ামী লীগের চেয়ে পিছিয়েই থেকেছে। অনেকে বলতে পারেন যে এই ফলাফল স্বাভাবিক, কেননা বিরোধী দলের যতটা জনপ্রিয়তা আছে, তাতে তারা যতটা বিজয়ী হতে পারত, তা-ই তারা পেয়েছে এবং তা এসেছে প্রথম দুই দফায়। বিরোধী দল বিজয়ী হলো কি না, সুষ্ঠু নির্বাচনে তারা এর চেয়েও খারাপ করত কি না, আমার কাছে তা ধর্তব্যের বিষয় নয়। ২০০৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীদের ফলাফল এর চেয়ে ভালো ছিল। তাঁরা যদি আবার ভালো করতেন তাতে অবাক হওয়ার কারণ ছিল না।
কিন্তু এবারের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদের ফলাফলের যেসব পরিসংখ্যান আমরা দেখতে পাই, তাতে নিঃসন্দেহে মনে প্রশ্ন জাগে। প্রথম দফা নির্বাচনে প্রাপ্ত হিসাবে বিএনপি পেয়েছে ৪৩ শতাংশ পদ, দ্বিতীয় দফায় পেয়েছে ৪৪ শতাংশ; তৃতীয় দফায় পেয়েছে ৩৪ শতাংশ; চতুর্থ দফায় পেয়েছে ২৭ শতাংশ এবং শেষ দফায় পেয়েছে ১৬ শতাংশ চেয়ারম্যান পদ। যেকোনো দলই কয়েক দিনের নির্বাচনে কখনো খারাপ কখনো ভালো ফল করতেই পারে, কিন্তু নির্বাচনে সহিংসতা বৃদ্ধি, নির্বাচন কমিশনের নজরদারি হ্রাসের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের প্রাপ্ত পদের হার ৩৫ শতাংশ থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থাৎ দ্বিগুণে পরিণত হওয়ার ঘটনা যেকোনো অবস্থায়ই প্রশ্নের জন্ম দেয়। এই রকম ফল যদি বিএনপির অনুকূলে যেত, তবে তাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকত না।
এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে পরিকল্পনা করে এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে বলার অভিপ্রায় আমার নেই। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রীরা যে বার্তা দিয়েছেন, সামান্য দেরিতে হলেও স্থানীয় কর্মীরা তা বুঝতে পেরেছেন। আর তা হলো কীভাবে জয় অর্জিত হলো সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়, বিজয় নিশ্চিত করাটাই মুখ্য কাজ। শেষ দুই পর্বে আমরা তারই ফল প্রত্যক্ষ করেছি।
বিএনপি সংসদ নির্বাচন বর্জন করার পর, বিশেষত ৫ জানুয়ারির পর, অনেকেই বিএনপির সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন এই বলে যে বিএনপির নেতারা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁদের একটা বড় যুক্তি ছিল যে এই রকম সময়ে বড় ধরনের কারচুপি করার ঘটনা ঘটতে পারত না। বিএনপির মধ্যেও অনেকেই এ রকম মনে করতে শুরু করেন। বিএনপি একটা চাপের মুখেই পড়েছিল। খানিকটা সেই চাপের কারণেও বিএনপিকে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে হয়। প্রথম দুই দফায় ভালো ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে যাঁরা বিএনপিকে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিলেন, তাঁরা খানিকটা প্রভাবশালী হয়ে ওঠার পথে এগোচ্ছিলেন। আরেকটি বিষয় ছিল বিএনপি-জামায়াত সখ্য। বিএনপি যে জামায়াতের সঙ্গে একত্রে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেটা যে অংশত হলেও দলের বাইরের এবং ভেতরের চাপের কারণেই, তা সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু এখন নির্বাচনের সময়কার ঘটনাপ্রবাহ এসব যুক্তিকে দুর্বল করে দিলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
কিন্তু এখানে এসে অনেকে বলবেন যে তাহলে কি বিএনপিকে সব সময় জিততেই হবে? না জিতলেই কি আমরা ধরে নেব যে বিএনপির নেতারা সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? তাহলে কি ভোটাররা না চাইলেও বিএনপিকে জিতিয়ে দিতে হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর একটাই, অবশ্যই নয়। বিএনপি এখন যে ফলাফল করেছে তার চেয়ে খারাপ করলেও বিএনপির যুক্তি খণ্ডন করা যেত যদি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হতো। বরং সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বিরোধীরা জয়ী হলে যেমন ক্ষমতাসীনদের লাভ হতো, তেমনি সুষ্ঠু নির্বাচনে বিরোধীরা পরাজিত হলে লাভ হতো দুই গুণ। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় প্রমাণিত হতো যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় থাকার ব্যাপারে বিএনপির যুক্তি দুর্বল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ঘটনা দেখিয়েছিল ক্ষমতাসীনদের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনের বিপদটা কোথায়, সেই জায়গাটাকে একেবারে পাকাপোক্ত করে দিল শেষ তিন পর্বের নির্বাচন। নির্বাচনে সে কারণেই বিরোধীদের চেয়ে সরকারের ক্ষতি বেশি হলো বলেই মনে হয়।
এই সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নির্বাচন কমিশনের কার্যকলাপ। যতটা ক্ষমতা আছে তার প্রয়োগই তো হয়নি, অসার আস্ফাালন ছাড়া আর কিছুই কি দেখতে পাওয়া গেছে? উপরন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক বিএনপিকে সমালোচনা করার ক্ষেত্রে যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, তাকে সরকারি দলের কথারই প্রতিধ্বনি বললে তা ভুল হবে না। সংসদ নির্বাচনের আগে অনেক বিশ্লেষক এমন মন্তব্য করেছিলেন যে আওয়ামী লীগ চায়নি বিএনপি নির্বাচনে আসুক। এবার মনে হচ্ছে নির্বাচন কমিশন এখন সেই ভূমিকা নিতে চলেছে। সেটা দুঃখজনক, কেননা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের ওপর দেশের মানুষের আস্থা ছিল না অনেক দিন। ধীরে ধীরে তা তৈরি হচ্ছিল। বিশেষ করে গত কমিশন খানিকটা সময় হলেও রাজনৈতিক দলের শাসনামলে দায়িত্ব পালন করেছিল এবং সাধারণ মানুষের মনে এ রকম একটা ধারণা তৈরি হতে শুরু করেছিল যে দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলেও ধীরে ধীরে একটা জোরদার নির্বাচন কমিশন হয়তো তৈরি করা যাবে। কিন্তু এই কমিশনের কার্যকলাপের কারণে সেই আস্থার জায়গাটা এখন আর প্রায় নেই। সম্ভবত এই মন্তব্যের পর সে আশাবাদের কফিনে পেরেক ঠুকে দেওয়া হলো।
এত কিছুর পর প্রশ্ন থাকে, তাহলে উপজেলা নির্বাচন থেকে ক্ষমতাসীনরা কী শিখবেন আর বিএনপিই বা ভবিষ্যতে কী করবে? আশা করি যে সরকারি দল দেরিতে হলেও বুঝতে পারবে নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনের এই ভূমিকা দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তৈরির পথ নয়। যতটা ক্ষতি হয়েছে তা স্বীকার করে নিয়েই তা বদলাতে হবে। অন্য পক্ষে বিএনপির জন্য একটা বড় বিষয় হলো, সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মধ্যে তার প্রতি সমর্থন আছে, সে জন্য জামায়াতের ওপর নির্ভর করার দরকার নেই। বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের ওপর ভরসা করেই বিএনপিকে দলের ভবিষ্যৎ রাজনীতির পদক্ষেপ ভাবতে হবে।
কিন্তু ফলাফলের চেয়েও নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে আমরা যেটা দেখতে পেলাম তা হলো, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন যে সংকটের মধ্যে নিপতিত হয়েছে, তাকে আরও বেশি সংকটের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হলো। এ বিষয়ে আমরা গতকাল আলোচনা করেছি। আজ আমরা দেখব বিএনপির ওপর এই ফলাফলের, বিশেষত শেষ তিন দফায় সংঘটিত অনিয়মের কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। এসব অনিয়মের ফলে কেবল যে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন উঠছে তা নয়, পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ল।
বিএনপি গোড়াতে ভালো ফল করলেও শেষ পর্যন্ত মোট হিসাবে আওয়ামী লীগের চেয়ে পিছিয়েই থেকেছে। অনেকে বলতে পারেন যে এই ফলাফল স্বাভাবিক, কেননা বিরোধী দলের যতটা জনপ্রিয়তা আছে, তাতে তারা যতটা বিজয়ী হতে পারত, তা-ই তারা পেয়েছে এবং তা এসেছে প্রথম দুই দফায়। বিরোধী দল বিজয়ী হলো কি না, সুষ্ঠু নির্বাচনে তারা এর চেয়েও খারাপ করত কি না, আমার কাছে তা ধর্তব্যের বিষয় নয়। ২০০৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীদের ফলাফল এর চেয়ে ভালো ছিল। তাঁরা যদি আবার ভালো করতেন তাতে অবাক হওয়ার কারণ ছিল না।
কিন্তু এবারের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদের ফলাফলের যেসব পরিসংখ্যান আমরা দেখতে পাই, তাতে নিঃসন্দেহে মনে প্রশ্ন জাগে। প্রথম দফা নির্বাচনে প্রাপ্ত হিসাবে বিএনপি পেয়েছে ৪৩ শতাংশ পদ, দ্বিতীয় দফায় পেয়েছে ৪৪ শতাংশ; তৃতীয় দফায় পেয়েছে ৩৪ শতাংশ; চতুর্থ দফায় পেয়েছে ২৭ শতাংশ এবং শেষ দফায় পেয়েছে ১৬ শতাংশ চেয়ারম্যান পদ। যেকোনো দলই কয়েক দিনের নির্বাচনে কখনো খারাপ কখনো ভালো ফল করতেই পারে, কিন্তু নির্বাচনে সহিংসতা বৃদ্ধি, নির্বাচন কমিশনের নজরদারি হ্রাসের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের প্রাপ্ত পদের হার ৩৫ শতাংশ থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থাৎ দ্বিগুণে পরিণত হওয়ার ঘটনা যেকোনো অবস্থায়ই প্রশ্নের জন্ম দেয়। এই রকম ফল যদি বিএনপির অনুকূলে যেত, তবে তাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকত না।
এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে পরিকল্পনা করে এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে বলার অভিপ্রায় আমার নেই। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রীরা যে বার্তা দিয়েছেন, সামান্য দেরিতে হলেও স্থানীয় কর্মীরা তা বুঝতে পেরেছেন। আর তা হলো কীভাবে জয় অর্জিত হলো সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়, বিজয় নিশ্চিত করাটাই মুখ্য কাজ। শেষ দুই পর্বে আমরা তারই ফল প্রত্যক্ষ করেছি।
বিএনপি সংসদ নির্বাচন বর্জন করার পর, বিশেষত ৫ জানুয়ারির পর, অনেকেই বিএনপির সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন এই বলে যে বিএনপির নেতারা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁদের একটা বড় যুক্তি ছিল যে এই রকম সময়ে বড় ধরনের কারচুপি করার ঘটনা ঘটতে পারত না। বিএনপির মধ্যেও অনেকেই এ রকম মনে করতে শুরু করেন। বিএনপি একটা চাপের মুখেই পড়েছিল। খানিকটা সেই চাপের কারণেও বিএনপিকে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে হয়। প্রথম দুই দফায় ভালো ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে যাঁরা বিএনপিকে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিলেন, তাঁরা খানিকটা প্রভাবশালী হয়ে ওঠার পথে এগোচ্ছিলেন। আরেকটি বিষয় ছিল বিএনপি-জামায়াত সখ্য। বিএনপি যে জামায়াতের সঙ্গে একত্রে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেটা যে অংশত হলেও দলের বাইরের এবং ভেতরের চাপের কারণেই, তা সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু এখন নির্বাচনের সময়কার ঘটনাপ্রবাহ এসব যুক্তিকে দুর্বল করে দিলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
কিন্তু এখানে এসে অনেকে বলবেন যে তাহলে কি বিএনপিকে সব সময় জিততেই হবে? না জিতলেই কি আমরা ধরে নেব যে বিএনপির নেতারা সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? তাহলে কি ভোটাররা না চাইলেও বিএনপিকে জিতিয়ে দিতে হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর একটাই, অবশ্যই নয়। বিএনপি এখন যে ফলাফল করেছে তার চেয়ে খারাপ করলেও বিএনপির যুক্তি খণ্ডন করা যেত যদি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হতো। বরং সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বিরোধীরা জয়ী হলে যেমন ক্ষমতাসীনদের লাভ হতো, তেমনি সুষ্ঠু নির্বাচনে বিরোধীরা পরাজিত হলে লাভ হতো দুই গুণ। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় প্রমাণিত হতো যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় থাকার ব্যাপারে বিএনপির যুক্তি দুর্বল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ঘটনা দেখিয়েছিল ক্ষমতাসীনদের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনের বিপদটা কোথায়, সেই জায়গাটাকে একেবারে পাকাপোক্ত করে দিল শেষ তিন পর্বের নির্বাচন। নির্বাচনে সে কারণেই বিরোধীদের চেয়ে সরকারের ক্ষতি বেশি হলো বলেই মনে হয়।
এই সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নির্বাচন কমিশনের কার্যকলাপ। যতটা ক্ষমতা আছে তার প্রয়োগই তো হয়নি, অসার আস্ফাালন ছাড়া আর কিছুই কি দেখতে পাওয়া গেছে? উপরন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক বিএনপিকে সমালোচনা করার ক্ষেত্রে যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, তাকে সরকারি দলের কথারই প্রতিধ্বনি বললে তা ভুল হবে না। সংসদ নির্বাচনের আগে অনেক বিশ্লেষক এমন মন্তব্য করেছিলেন যে আওয়ামী লীগ চায়নি বিএনপি নির্বাচনে আসুক। এবার মনে হচ্ছে নির্বাচন কমিশন এখন সেই ভূমিকা নিতে চলেছে। সেটা দুঃখজনক, কেননা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের ওপর দেশের মানুষের আস্থা ছিল না অনেক দিন। ধীরে ধীরে তা তৈরি হচ্ছিল। বিশেষ করে গত কমিশন খানিকটা সময় হলেও রাজনৈতিক দলের শাসনামলে দায়িত্ব পালন করেছিল এবং সাধারণ মানুষের মনে এ রকম একটা ধারণা তৈরি হতে শুরু করেছিল যে দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলেও ধীরে ধীরে একটা জোরদার নির্বাচন কমিশন হয়তো তৈরি করা যাবে। কিন্তু এই কমিশনের কার্যকলাপের কারণে সেই আস্থার জায়গাটা এখন আর প্রায় নেই। সম্ভবত এই মন্তব্যের পর সে আশাবাদের কফিনে পেরেক ঠুকে দেওয়া হলো।
এত কিছুর পর প্রশ্ন থাকে, তাহলে উপজেলা নির্বাচন থেকে ক্ষমতাসীনরা কী শিখবেন আর বিএনপিই বা ভবিষ্যতে কী করবে? আশা করি যে সরকারি দল দেরিতে হলেও বুঝতে পারবে নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনের এই ভূমিকা দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তৈরির পথ নয়। যতটা ক্ষতি হয়েছে তা স্বীকার করে নিয়েই তা বদলাতে হবে। অন্য পক্ষে বিএনপির জন্য একটা বড় বিষয় হলো, সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মধ্যে তার প্রতি সমর্থন আছে, সে জন্য জামায়াতের ওপর নির্ভর করার দরকার নেই। বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের ওপর ভরসা করেই বিএনপিকে দলের ভবিষ্যৎ রাজনীতির পদক্ষেপ ভাবতে হবে।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments