মরণোত্তর by খুশবন্ত সিং, অনুবাদ: আন্দালিব রাশদী
সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন ভারতের প্রখ্যাত লেখক খুশবন্ত সিং৷ তাঁর স্মৃতির
প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ছাপা হলো এই গল্প আমি জ্বর নিয়ে বিছানায় পড়ে আছি৷
তেমন গুরুতর নয় বলে নিজেকেই নিজের দেখভাল করার জন্য একা ফেলে রেখে গেছি৷
ভাবি, হঠাৎ গায়ের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে আমি সম্ভবত মরে যাব৷ আমার এত বন্ধু
এবং আমি এত জনপ্রিয়, আমার মৃত্যুতে খবরের কাগজগুলো কী যে বলবে! আমার ছোট
একটা ছবি দিয়ে ট্রিবিউন সম্ভবত খবরটা প্রথম পাতায় ছাপবে৷ শিরোনাম হবে
‘সর্দার খুশবন্ত সিং মৃত’, তারপর ছোট হরফে ছাপা হবে:
আমরা দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, সর্দার খুশবন্ত সিং গতকাল সন্ধ্যা ছয়টায় আকস্মিকভাবে মারা গেছেন৷ তাঁর মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত হওয়ার মতো একজন কম বয়সী বিধবা স্ত্রী, দুটি শিশুসন্তান এবং বহুসংখ্যক বন্ধু ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন তিনি৷ স্মরণ করা যেতে পারে, প্রায় পাঁচ বছর আগে নিজ শহর দিল্লি ছেড়ে বসতি স্থাপনের জন্য লাহোরে এসেছিলেন৷ এই সময়ের মধ্যে তিনি আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ হিসেবে খ্যাতির আসনে পৌঁছেছেন৷ তাঁর মৃত্যুতে গোটা প্রদেশ শোকাচ্ছন্ন৷
শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সর্দারের বাসায় যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সহকারী, প্রধান বিচারপতির একান্ত সহকারী, বেশ কজন মন্ত্রী ও হাইকোর্টের জজ৷
সংবাদপত্রে দেওয়া এক বিবৃতিতে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘এই মানুষটিকে হারিয়ে পাঞ্জাব আরও নিঃস্ব হলো৷ মৃত্যুর নির্মম হাত তাঁর সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অকাল সমাপ্তি ঘটিয়েছে৷’
কাগজে নিচের দিকের একটি ঘোষণায় বলা হবে:
আজ সকাল ১০টায় তাঁর শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান৷
আমার নিজের জন্য ও বন্ধুদের জন্য খুব দুঃখ হচ্ছে৷ কিছুটা উৎফুল্লও হয়েছি৷ আমি চাই মানুষ আমার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করুক৷ কাজেই মরার সিদ্ধান্ত নিই৷ সন্ধ্যার দিকে গণমাধ্যমকে আমার মৃত্যুসংবাদ শোনার মতো পর্যাপ্ত সময় দিয়ে আমি পরলোকগমন করলাম৷
এক সময় মৃতদেহ থেকে উত্থিত হয়ে নেমে আসি এবং বাড়ির প্রবেশপথে শীতল মার্বেলের ওপর বসে আমার মরণোত্তর গৌরবগাথা শোনার জন্য নিমগ্ন হয়ে থাকি৷ সকালে আমার স্ত্রীর আগেই আমি খবরের কাগজ পেয়ে যাই৷ ট্রিবিউন পত্রিকা আমাকে একেবারে ডুবিয়ে দিয়েছে৷ তৃতীয় পৃষ্ঠার নিচে প্রথম কলামে অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের মৃত্যুসংবাদের ফাঁকে নিজেকে আবিষ্কার করলাম৷ বিরক্ত হলাম৷ এটা নিশ্চয়ই পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি বিরক্তিকর শফির কাণ্ড৷ সে আমাকে কখনো পছন্দ করতে পারেনি৷ তবে আমি এটা ভাবতে পারিনি, মৃত্যুর পরও আমাকে এতটুকু গুরুত্ব দিতে সে এতটা হীনম্মন্য হবে৷ তবে আমার মৃত্যু প্রদেশের ওপর দিয়ে যে শোকের ঢেউ বইয়ে দেবে, ট্রিবিউন-এ চুইয়ে পড়া সংবাদ তাকে রোধ করতে পারবে না৷
হাইকোর্ট এলাকায় খবরের কাগজ খুব ভোরেই বিতরণ করা হয়৷ আমার আইনজীবীবন্ধু কাদিরের বাড়িতে কাগজটা ভোরের আগেই পৌঁছায়৷ তার মানে এই নয় যে কাদির খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার মানুষ৷ একটি ট্রেতে করে কাগজটা আনা হলো৷ সঙ্গে হাতলবিহীন পানপাত্রে গরম পানি, তাতে লেবুর রস৷ সিগারেট টানার ফাঁকে ফাঁকে কাদির গরম পানিতে চুমুক দিতে থাকে৷ অন্ত্র থেকে বর্জ্য পরিষ্কার করার জন্য তাকে এ কাজ করতে হয়৷ বিছানায় শুয়ে সে কেবল খবরের শিরোনামগুলো দেখল৷ যখন সিগারেট আর লেবুর যুগপৎ প্রতিক্রিয়া হতে থাকে, তখনই আসলে তার কাগজ পড়ার শুরু৷ নিয়তি আমার সঙ্গে কেমন আচরণ করবে, তা জানার জন্য আমাকে কাদিরের টয়লেটে ঢোকার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়৷
এক হাতে খবরের কাগজ আর নিচের ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে কাদির আয়েশ করে বাথরুমে ঢোকে৷ আরাম করে বসে, তারপর খবরগুলোর ওপর ভালো করে চোখ বোলাতে থাকে৷ ৩-এর পৃষ্ঠায় প্রথম কলামে এসে মুহূর্তের জন্য তার সিগারেট ফোঁকা থেমে যায়৷ সে কি উঠে চিৎকার করে স্ত্রীকে ডাকবে? না, সে সিদ্ধান্ত নিল, দরকার নেই, এটা অপ্রয়োজনীয় লোক দেখানো ব্যাপার হয়ে উঠবে৷ কাদির যুক্তিবাদী মানুষ৷ সে জানে, খবরটি তার স্ত্রীকে বললে সে কান্নায় ভেঙে পড়বে৷ এ কারণেই কথাটি তার স্ত্রীকে এমনভাবে বলবে যেন মনে হয় হেরে যাওয়া একটি মামলার কথা তাকে শোনাচ্ছে৷
কাদির তার স্ত্রীকে যেনতেনভাবেই খবরটি দিল, কিন্তু সে কান্নায় ভেঙে পড়ল৷ তার ১০ বছর বয়সী মেয়েটি দৌড়ে তাদের রুমে ঢুকল৷ মায়ের চোখের দিকে একনজর দৃষ্টি দিয়ে সেও কাঁদতে শুরু করল৷ কিন্তু কাদির কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল৷
শক্তভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাদের এই কান্নাকাটির মানে কী? তোমরা কি মনে করো, এভাবে তাকে আবার বাঁচিয়ে তুলতে পারবে?’
তার স্ত্রী জানে, কাদিরের সঙ্গে যুক্তি দেখিয়ে লাভ নেই৷ যুক্তিতে কাদিরই সব সময় জেতে৷
স্ত্রী বলল, ‘আমার মনে হয়, এখনই ওদের বাড়িতে যাওয়া উচিত৷ তার বউটা নিশ্চয়ই খুব কষ্টের মধ্যে আছে৷’
কাদির নিজের কাঁধ ঝাঁকাল৷
‘বিধবা মহিলার কাছে গিয়ে আমিও সমবেদনা জানাতে চাই৷ কিন্তু আমাকে আধঘণ্টার মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে হবে৷’
কাদিরের সারা দিন কাটল ট্রাইব্যুনালে আর তার পরিবার বাড়ির বাইরে বেরোতে পারল না৷
শহরের বড় পার্ক থেকে তেমন দূরে নয়—সেখানে আমার বন্ধু খোশলা থাকে৷ সে একজন জজ এবং খুব ডাকসাইটে আমলা৷ খোশলা ভোরেই ঘুম থেকে ওঠে৷ কারণ, এটাই তার একমাত্র ব্যক্তিগত সময়৷ সারা দিন আদালতে কাজ করতে হয়৷ খোশলা যথেষ্ট জনপ্রিয় এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী৷ বালক বয়স থেকেই নিজেকে চালাক ভাবতে শুরু করে৷ যৌবনের শুরু থেকেই মাথার চুল পড়তে থাকে এবং চওড়া টেকো কপাল উন্মোচিত হয়৷ নিজের সম্পর্কে তার যে ধারণা, খোশলাটা টেকো মাথাকে তারই প্রত্যয়ন বলে মনে করে৷ সম্ভবত সে প্রতিভাধরই ছিল৷ সে বৃত্তি পেয়েছে৷ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থানটি লাভ করে তার শিক্ষাজীবন গুটিয়ে এনেছে৷ দেশের সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক মুকুট জিতে তার নিজের ওপর আস্থার যৌক্তিকতা প্রমাণ করল৷
কিন্তু যখনই সে মাথার পেছনের একগোছা চুল আঁচড়াত এবং বিশাল কপালে হাত বোলাত, তখন তার জীবনের কিছু অপূর্ণ প্রত্যাশা সম্পর্কে সে সচেতন হয়ে উঠত৷ তার মতো শত শত সিভিল সার্ভেন্ট রয়েছে৷ স্পষ্টত, সিভিল সার্ভিসই যথেষ্ট নয়; সে লিখতে জানত৷ সুতরাং, খোশলা লেখায় হাত দিল আর ভালো লেখার জন্য পড়তে শুরু করল৷
আজ সকালে তার মেজাজটা লেখালেখি করার৷ নিজে এক কাপ চা বানিয়ে হাতলওয়ালা আরামের চেয়ার নিয়ে ইলেকট্রিক রেডিয়েটরের পাশে বসল৷ পেনসিলটা মুখে গুঁজে সে ভাবতে শুরু করল, কী লিখবে? অবশেষে ডায়েরি লেখার সিদ্ধান্ত নিল৷ গতকাল সারাটা দিন গেছে গুরুত্বপূর্ণ একটি মামলার শুনানিতে৷ এজলাস পরিপূর্ণ, সবাই তার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ এটাই তো একটা ভালো বিষয় হতে পারে৷
সে বিরক্ত হলো খবরের কাগজওয়ালার কড়া নাড়ার শব্দে৷ পার্থিব অস্তিত্বের সত্য ঘটনাগুলো পড়ার জন্য খবরের কাগজ খুলল৷ তার আগ্রহ সামাজিক বিষয়—জন্ম, বিয়ে, মৃত্যু আর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনার দিকে৷ ৩ নম্বর পৃষ্ঠার প্রথম কলামে তার চোখ আটকে গেল, সঙ্গে সঙ্গে গা ঝাড়া দিয়ে উঠল৷
পেনসিল দিয়ে নোটবইয়ে বার কয়েক টোকা দিয়ে একবার গলা খাঁকারির পর স্ত্রীকে খবরটা দিল৷ সে হাই তুলে তার বড় স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখ বিস্ফারিত করে তাকাল৷
বলল, ‘আমার মনে হয়, তোমরা আজ হাইকোর্ট ছুটি দেবে৷’
‘কোনো একটা ছুতোয় হাইকোর্ট অন্তত ছুটি হয় না৷ আমাকে যেতে হবে৷ যদি সময় করতে পারি একবার উঁকি দেব, নতুবা রোববার আমরা দেখা করতে যাচ্ছি৷’
খোশলারা আসেনি৷ আরও অনেকে আসেনি৷ আমার মৃত্যুতে যাদের দুঃখে আমিও ব্যথিত হয়েছি, তারাও আসেনি৷ সকাল ১০টার দিকে আমার ফ্ল্যাটের নিচে সামনের দিকের খোলা জায়গায় কিছু লোক জড়ো হয়৷ তাদের প্রায় কাউকেই আমি আশা করিনি৷ আইনজীবীদের কয়েকজন এসেছে৷ আমার দুজন বন্ধুও এসেছে, তবে তারা জনতা থেকে দূরে দাঁড়িয়েছে৷ একজন লম্বা, ক্ষীণ দেহ, দেখতে শিল্পীর মতো৷ সে একজন লেখক৷ মৃতদেহের ব্যাপারটা তার কাছে সংক্রামক, তাই সে অবিরাম ধূমপান করে চলেছে এবং তার ও গোটা পৃথিবীর মাঝখানে একটি ধোঁয়ার পর্দা তৈরি করেছে৷
অন্য বন্ধুটি কমিউনিস্ট, খাটো, হালকা-পাতলা গড়ন, ঢেউ খেলানো চুল এবং চেহারায় বাজপাখির অভিব্যক্তি৷ সবকিছুর প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি শীতল মার্ক্সীয়৷ সেখানে আবেগের কোনো ঠাঁই নেই৷ মৃত্যু কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়৷ কারণটা গুরুত্বপূর্ণ৷ অনুচ্চ কানাকানিতে সে লেখকের সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে৷
‘তুমি কত দূর যাবে?’
‘কফি হাউসে নামার পরিকল্পনা করছি৷’
‘তুমিও পুরোটা পথ আসছ নাকি?’
কমিউনিস্ট জোর দিয়ে বলল, ‘তা হওয়ার নয়৷ ১০টায় আমার একটা মিটিং আছে৷ তোমার সঙ্গে সাড়ে ১১টায় কফি হাউসে দেখা করব৷ সুযোগ পেলে লাশবাহী গাড়ির চালককে জিজ্ঞেস কোরো সে টোঙ্গাওয়ালা ইউনিয়নের সদস্য হয়েছে কি না?’
কিছুক্ষণ পর হাড্ডিসার বাদামি ঘোড়ায় টানা শবযান হাজির হলে আমার দেহ দরজা বরাবর টেনে আনা হলো৷ ঘোড়া ও তার মনিবকে মনে হলো পরিস্থিতির গাম্ভীর্য সম্পর্কে পুরোপুরি নির্বিকার৷ ড্রাইভার নিশ্চিন্ত মনে বসে তার পান-সুপুরি চিবোচ্ছে আর উপস্থিত সমাবেশের ওপর চোখ বোলাচ্ছে৷ এ ধরনের লাশ টানায় সে আদৌ কোনো টিপস পাবে কি না ভাবছে৷
জনতাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি৷ গোটা শরীর সাদা কাপড়ে পেঁচিয়ে আমার মৃতদেহ শবযানের ভেতর রাখা হলো৷ আনুষ্ঠানিকভাবে আমার ওপর কিছু ফুল ছড়িয়ে দেওয়া হলো৷
শবযাত্রা শুরুর আগে সাইকেলে চেপে অন্য এক বন্ধু হাজির৷ কালো ও নাদুসনুদুস৷ বেশ কিছু বই এনেছে সাইকেলের ক্যারিয়ারে৷ তার চেহারায় পাণ্ডিত্যপূর্ণ রাশভারী অধ্যাপকের ভাব৷ যখন দেখল শবযানে লাশ তোলা হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি সাইকেল দাঁড় করিয়ে তালা দিয়ে জনতার সঙ্গে শামিল হলো৷ আমার স্ত্রী যখন আমাকে শেষবিদায় জানানোর জন্য নেমে এল, সেও বাহ্যত আপ্লুত হয়ে পড়ল৷ পকেট থেকে একটি ছোট বই বের করে সুচিন্তিতভাবে পাতা ওলটাতে শুরু করল৷ তারপর জনতার মাঝখান দিয়ে আমার স্ত্রীর সামনে গিয়ে হাজির হলো৷ অশ্রুভেজা চোখে সেটি আমার স্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করল৷
‘আমি এক কপি গীতা নিয়ে এসেছি৷ এটা আপনাকে অনেক স্বস্তি দেবে৷’ সে দ্রুত পিছিয়ে এসে চোখ ভার করে থাকা অশ্রু মুছল৷
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শোনাল, ‘বুদ্বুদের মতো, মানুষের জীবন বুদ্বুদের মতো ক্ষণস্থায়ী৷’
কিন্তু এমন তো নয় যে মানুষ মরে এবং মিলিয়ে যায়৷ বস্তু তো কখনো অশরীরী হয়ে যায় না, এটা কেবল ধরন বদলায়৷ বিষয়টি গীতায় খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে—‘মানুষ যেমন পুরোনো পোশাক ছেড়ে নতুন পোশাক পরে৷ আত্মার ব্যাপারটাও তাই...ইত্যাদি ইত্যাদি৷’
শবমিছিল বাঁক নিয়ে নদীর দিকে যাচ্ছে৷ আধা ডজন মানুষ পেছন পেছন হাঁটছে৷ প্রধান সড়ক ডিঙিয়ে আসার পর থেকে আমি নিজেকে নির্জনতায় আবিষ্কার করি৷ উকিলদের কেউ কেউ হাইকোর্ট ত্যাগ করেছে৷ ধোঁয়া ফুঁকতে ফুঁকতে আমার লেখকবন্ধু কফি হাউসের দিকে চলে গেছে৷ স্থানীয় কলেজের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অধ্যাপক প্রত্যাশার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন—দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টি৷ তারপর দ্রুত ঢাল বেয়ে ক্লাসরুমের দিকে চলে যান৷ অবশিষ্ট ছয়-সাতজন জেলা আদালতের কাছে পৌঁছে একে একে অদৃশ্য হয়ে যায়৷
নিজেকে তখন ছোট মনে হতে থাকে৷ আমার চেয়েও অনেক কম যোগ্য মানুষ অনেক বড় জনতার মিছিল পেয়েছে৷ এমনকি কানাকড়িহীন দরিদ্র মানুষের মৃত্যু হলেও কিছু মানুষ তো থাকে৷ আমার বেলায় কেবল একজন ড্রাইভার৷
আমার সৌভাগ্য, মরণোত্তর গুরুত্বের ভ্রান্ত হিসাব রোমন্থন করার মতো কিছুটা সময় আমাকে দেওয়া হলো৷ ড্রাইভার বিশাল এক পিপুলগাছের নিচে লাগাম টানল, এখান থেকেই রাস্তা বাঁক নিয়ে শ্মশানের দিকে চলে গেছে৷ পিপুলগাছের নিচে টোঙ্গাগাড়ির স্ট্যান্ড, সেখান ঘোড়াকে পান করানোর জন্য বড় একটি পানির পাত্র৷ ড্রাইভার তার আসন থেকে নেমে সিগারেট ধরাতে টোঙ্গাচালকদের কাছে আগুন চাইল৷ টোঙ্গাচালকেরা চারদিক থেকে এসে শবযান ঘিরে দাঁড়াল এবং চারদিক থেকে উঁকি দিল৷
তাদের একজন বলল, ‘নিশ্চয়ই ধনী কেউ হবে৷’
অন্যজন জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু সঙ্গে তো কেউ নেই৷’
অন্য একজন জবাব দিল, ‘শেষকৃত্যে কেউ থাকবে না৷ সম্ভবত এটা ইংরেজদের একটি রীতি৷’
ততক্ষণে আমি পুরো হতাশ হয়ে পড়েছি৷ আমার সামনে তখন তিনটা পথ খোলা৷ একটা হচ্ছে অন্যেরা যেভাবে যায়, সেভাবে শ্মশানে পৌঁছা, হয়তো আরেকবার ভালো একটি পৃথিবীতে জন্ম নেওয়ার জন্য জ্বলন্ত আগুনে আত্মসমর্পণ করা, কিন্তু সম্ভবত শূন্যতার মধ্যে নির্বাপিত হওয়া৷
আরেকটি পথ যা তুলে নিয়ে যায় সরাসরি শহরে৷ সেখানে বেশ্যা ও কুখ্যাত মানুষের বসবাস৷ তারা সেখানে মদ খায়, জুয়া খেলে আর লাম্পট্য করে বেড়ায়৷ তাদের পৃথিবীটা উত্তেজনার বহু ধরনের বৈচিত্র্যে পূর্ণ৷
তৃতীয়টি হচ্ছে ফিরে যাওয়া৷ এ ব্যাপারে মনস্থির করা বড় কঠিন কাজ৷ এ রকম পরিস্থিতিতে মুদ্রা দিয়ে টস করলে কাজ হয়৷ আমি সে সিদ্ধান্ত নিলাম, যদি ওপর পিঠ হয়, আমি এ পৃথিবী ছেড়ে যাব, যদি নিচের দিক হয়, আমি শহরের আনন্দসন্ধানী মানুষের সঙ্গে যোগ দেব৷ যদি হেড বা টেল কিছু না হয়, যদি মুদ্রা তার কোনো এক প্রান্তের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে আমি আবার আমার পদক্ষেপ খুঁজে পাব একঘেয়ে অস্তিত্বে, যার অভিযানের শক্তি রহিত, জীবনের জন্য বাসনাও বিলীন৷
(সংক্ষেপিত)
No comments