অপরাহ্নের দীর্ঘতর ছায়া by মোসাদ্দেক আহমেদ
অফিস ছুটির পর বাসাগামী বাসে চড়ে দিনভর
ক্লান্তিকে যে ঝেড়ে ফেলবে, সে উপায় নেই। বরং পিত্তিটা জ্বলতে শুরু করে
বাসের সিটে বসার পর থেকে। এটা ভার্সিটির স্টাফদের বাস বলে সেই অর্থে
ভিড়ভাড়াক্কা নেই, বলতে গেলে সব স্টাফই গা এলিয়ে বসে আসতে পারে; এই
বিলাসিতাটুকু তাদের আছে। কিন্তু আফরোজার সমস্যা অন্য; বলতে কি এটাই তাকে
পলে পলে দগ্ধ করে মারে।
আপনার পাশে সিট খালি আছে দেখছি, ভালোই হল গল্পে গল্পে যাওয়া যাবে। এমনটা বলে রশীদ সাহেব ঝপ করে বসে পড়েন; শুধু বসেই পড়েন না, আফরোজা ভাবীর ওপর দেহের একটা অংশের ভার ছেড়ে দেন দিব্যি।
এমন অত্যাচার নতুন নয়, আজ রশীদ সাহেব, কাল হাবিব সাহেব, পরশু সত্যেন বাবুরা এ কাজটা করে যাচ্ছেন নিয়মিতই। আর এখানেই কষ্টটা তার। কেন সে কি পুরুষ সহকর্মীর কাছে মিনিমাম একটা সম্মান আশা করতে পারে না? অবশ্য সব সহকর্মীই যে তেমন, তা নয়; কিন্তু সেসব কলিগরা কদাচ বসে যাত্রাপথে। আবার যেসব নারী কলিগ রয়েছে, তারাও যে যথেষ্ট উদার, তেমনটা বলাতেও ঝুঁকি আছে। তারাও তার দিকে কেমন উপহাসের চোখে তাকায়; এড়িয়েও কম চলে না; ফলে তার পাশের সিটটি খালি থাকে একজন পুরুষ সহকর্মীর জন্য।
আমি বেশ লাকি, প্রায়শ আপনার পাশে বসার সুযোগ মিলে যায়। রশীদ সাহেবের কণ্ঠে বাড়তি উষ্ণতা ঝরে পড়ে।
কিছু একটা বলতে গিয়ে নিজের মধ্যে কুঁকড়ে যায় আফরোজা। ততক্ষণে বাসটি যাত্রা শুরু করেছে শহরের দিকে। চলন্ত বাসের জানালা গলে বাইরের অপস্রিয়মাণ গাছপালা আর খেতখোলার পানে তাকিয়ে থাকে সে। মনের বিরাগ ভাবটি গলার কাছে দলা পাকিয়ে তাকে জ্বালায়। রশীদ সাহেবদের আর দোষ কী! স্বীয় কপাল মন্দ বলেই না স্বামী তার কেবল নিজেই মরল না, তাকেও মেরে গেল। আবার মজা দেখ, তার স্বামীর অপমৃত্যুর বিনিময়ে যে সাধারণ শ্রেণীর চাকরিটা ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ দয়াপরবশ হয়ে তাকে দিল, সেটাও প্রতিনিয়ত তার ধৈর্য পরীক্ষা নিচ্ছে। ফলে স্বামীর মৃত্যুশোক দানা বাঁধল না আজতক; এমনকি প্রতিবার স্বামীর মৃত্যুবার্ষিকী এগিয়ে এলে সেই ফাটল প্রশস্ততর হয়। যে অপবাদ স্বামী তার ছড়িয়ে গেছে কলিগদের মধ্যে, সেটাই এখন গলার কাঁটা, রক্তাক্ত করে চলেছে অহরহ। না, রশীদ সাহেব আজ বড্ড বাড়াবাড়ি করছে বলে মনে হয়; অনেকটাই হেলে পড়ে কোণঠাসা করে ফেলেছে যেন।
আহা ভাবি, আপনি এতটা জড়সড় হচ্ছেন কেন? জানেনই তো, আমি আপনার স্বামীর ভালো বন্ধু ছিলাম; অ্যাকাউন্টস সেকশনে বসতাম পাশাপাশি। ভাবি, বি ফ্রাংক।
শক্ত ধরনের একটা জবাব মুখে এসেও আটকে যায়, নিরুত্তাপ গলায় আফরোজা বলে, প্লিজ, একটু সোজা হয়ে বসেন। সিটগুলো এমনিতে চাপা।
হে হে, ঠিক বলেছেন, সিটগুলো সত্যিই চাপা। কী আর করা, যা হোক, ভাবছি সামনের মিটিংয়ে ভিসি স্যারের কাছে আরামদায়ক বাসের দাবি তুলব। জানেন তো, ভার্সিটির রাজনীতিতে আমি বেশ প্রভাবশালী। রশীদ সাহেবের গলায় বিরক্তিকর ঝাঁজ স্পষ্ট; প্রচ্ছন্ন হুমকিও থাকতে পারে শেষের বাক্যে।
নিজের মধ্যে গুটিয়ে যায় ফের; এমনিতে একজন নারীর জন্য চারপাশ একটা চ্যালেঞ্জ, এটা বহুগুণ কঠিন হয়ে ওঠে যখন সে জড়িয়ে যায় এমন কোনো অপবাদে যার উদ্গাতা স্বয়ং তার স্বামী। মেয়েলি বদনাম এমনিতে বাতাসের আগে ছোটে, কেননা মানুষ সেখানে প্রভূত মজা লোটার সুযোগ পায়, পরিস্থিতি যখন এমত, সেখানে পতি বাহাদুর যদি নিজেই নামে প্রচারকের ভূমিকায়, তাহলে তো কথাই নেই, লোকজনের মনোরঞ্জনের ষোলোকলা পূর্ণ হয়। মানুষজনের আর দায় কোথায় বিষয়টি খতিয়ে দেখার, তলিয়ে দেখতে তাদের বয়েই গেছে।
বাসটা একটা বাজার পার হচ্ছিল, আজ কলা বেচার হাট রাস্তায় ওপর বসায় চলার গতি রুদ্ধ হতে হতে বাসটা দাঁড়িয়ে পড়ে শেষমেশ। কলার আমদানি বেশি থাকায় অন্য হাটবারের তুলনায় লোকসমাগম বেশি। দুদিকেই ছোটখাটো যানজট, ধীরলয়ে বাস এগুতে থাকলে রশীদ সাহেব অপ্রসন্ন হন, এভাবে হাইওয়েতে হাট বসানো ভারি অন্যায়। নিয়মকানুনের যদি কোনো বালাই থাকে।
কথাটা আফরোজাকে সাক্ষী মেনে বলা, কিন্তু তাতে সাড়া দিতে মন টানে না আফরোজার। বস্তুত তেমন মানসিক অবস্থাও নেই। এক অসম লড়াইয়ের বেদনা লাগামছাড়া হতে গলার কাছে শ্বাসরোধী অনুভূতির সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে যাকে অবলম্বন করে সে ঘুরে দাঁড়াত পারত, সেই লোকটা, তার স্বামী কায়সারই কিনা সবচেয়ে ফাঁসিয়ে গেল তাকে। আÍহত্যা করার বছর দুয়েক আগে থেকেই কায়সার মনোরোগের শিকার হয়, সাংঘাতিক সন্দেহবাতিকে ভুগতে থাকে। যত লোকটা ক্ষয়ে যেতে থাকে তত তীক্ষè হতে থাকে সন্দেহের তীরগুলো, প্রতিটি তীরের অভিমুখই স্ত্রীর দিকে; সরাসরি তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকে; এক পরিত্রাণহীন ভয়ংকর পরিস্থিতি সেটা। হয়তো প্রসাধনীর একটা পর্যায়ে সে কোনো পারফিউম ব্যবহার করেছে, ব্যস, আর যাবে কোথায়, হাজারো প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হতে হয়েছে, কে দিল বলো তো, ঘ্রাণটা বেশ সেক্সি মনে হচ্ছে। না, না, কী বল, এটা তো তোমাকে ব্যবহার করতে আগে দেখিনি। বেশ তোফা আছ দেখছি। শুধু কি তাই, এসব সংশয়ের কথা ঢাকে কাঠি মেরে কলিগদের মধ্যে বলে বেড়াত। ফলে সেটাই হয়ে দাঁড়ায় অনিষ্টের গোড়া। স্বামীর কণ্ঠে স্ত্রীর কলঙ্কের প্রচারণা সব সময় এমন এক অমোচনীয় শক্ত ভিত্তি পায় যে, তখন তা শুধু মুখরোচকই হয় না, অন্যকেও উস্কানি দেয়; বহুভোগ্যা হওয়ার ঝুঁকিকে বৃদ্ধি করে। আর সেটাই হচ্ছে এখন। অবস্থা এমন যে, চাকরিটা কতদিন চালিয়ে যাওয়া যাবে, তাও অনিশ্চিত। কিন্তু মুখ বুজে সবই সহ্য করতে হচ্ছে স্কুলপড়ুয়া মেয়ে সোনালির মলিন মুখখানার দিকে চেয়ে। এই সোনালি ছাড়া জগৎসংসারে তার আর কে আছে বল? কিন্তু মেয়েটার এমনি দুর্ভাগ্য যে, বাপিটা তো গেছেই, এখন মাকেও হারানোর ভয়ে থাকে। এসব একজন কোমলমতী বালিকার জন্য কখনো ভালো ফল বয়ে আনে না। ভাবনার এই জায়গাটি ধসিয়ে দিতে সে ছলছল চোখে হাটের মানুষজন দেখে।
হাটের ভিড় কাটিয়ে বাসটা এবার গতি তুলছে। আফরোজা যতই জানালার দিকে চেপে আসার চেষ্টা করুক, রশীদ সাহেব তত চেপে এসে পিষ্ট করার তালে সচেষ্ট। কেবল রশীদ সাহেবকে একাকী দোষ দিয়ে লাভ কি, যখন যে তার পাশে বসেছে, তখন সেসব সাহেবেরই আসল চেহারা এমনিভাবে প্রকটিত। মুখোশ-আঁটা পুরুষদের দঙ্গলে সবাই যে এমন, তা অবশ্য নয়, তবে তার বেলায় তা সংখ্যায় অল্পই; হৃদয়বান মানুষজন তবে কি সংখ্যালঘুই হয় কে জানে। চিন্তাস্রোতটি পরিণতি পাওয়ার আগেই এক কাণ্ড ঘটে। দ্রুতগতিসম্পন্ন বাসটা আচমকা সজোরে ব্রেক কষতে আফরোজা ঝুঁকে পড়ে ধাক্কা খায় সামনের সিটে। বাসের এই হার্ডব্রেকটি বুঝি রশীদ সাহেবদের অ্যাডোলেসেন্ট পরিতৃপ্তির উপায় হয়ে আসে; মুহূর্তকালের ঘটনা, বাসটাও সামলে নিয়ে হাইওয়ে ধরে ছুটে চলেছে, যাত্রীসবও ধকল কাটিয়ে উঠেছে, কিন্তু সেই ক্ষণকালের মধ্যেই তার গায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে রশীদ সাহেব, যা করল তা কহতব্য নয়; ডাকাতিয়া হাতে তছনছ করে দিয়েছে তার মেয়েলি ভরাট বুক। কিন্তু তা এতটা ত্বরিত, এমন সূচারুভাবে সম্পাদিত যে, আকস্মিক ব্রেকটাকে ঢাল হিসেবে দাঁড় করাতে বেগ পেতে হয় না রশীদ সাহেবের, এভাবে কেউ বাস চালায় বলেন, আর একটু হলেই তো সোজা খাদে নেমে যেত গাড়ি। জব্বর বেঁচে গেছি। কিছু মনে করবেন না, আমি তো প্রায় ব্যালান্স হারিয়ে ফেলেছিলাম, ভাগ্যিস আপনি পাশে ছিলেন। হে হে।
চরম বিতৃষ্ণা ও বিবমিষায় আফরোজার গা ঘিনঘিন করে উঠল। আচ্ছা এরা এমন কেন, এরা কি রগরগে সেক্সচিন্তায় সর্বক্ষণ হাবুডুবু খায়? কিন্তু তেমন সেক্সচিচিন্তায় যে স্নিগ্ধতার লেশমাত্র থাকে না, বিধ্বংসী অঙ্গার ছাড়া যে ওতে কিছু নেই- তা কি তারা আমলে নেবে না কখনো? মন ও দেহ দুটো পাশাপাশি স্নিগ্ধ জলধারার মতো, সমান্তরাল জলধারাযুগল চলে চলে যখন কাছাকাছি আসে, তখনই কেবল তাতে আলোর ফুলকি উঠতে পারে; আফসোস এরা যদি তা জানত! সে নিজেও কি সব জানত, সাহিত্যের পাঠাভ্যাস বজায় থাকলেই তা জানা যায়। বিবমিষার তিতকুটো অস্বস্তি সঙ্গে নিয়েই বাড়ি ফিরে মেয়ে সোনালির খোঁজ করে সে। ডাকাডাকির পর সোনালি তার ঘর থেকে বিষণ্নতার প্রতিমূর্তি হয়ে সামনে এসে দাঁড়ালে বিচলিত হয় আফরোজা, কিরে মা, দুপুরে খেয়েছিস? মুখ তবে এত ম্লান কেন?
দুই রুমের একটা ছোট্ট বাসায় তারা ভাড়া থাকে; মেয়ের স্কুলের কাছে বলে বাসাটা এখানে নেওয়া। সকালে মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিলেও বেলা একটা নাগাদ মেয়ে একাই বাসায় ফেরে। পড়াশোনার যত চাপ থাক, অফিসফেরতা মা কাছে এসে দাঁড়ালে মেয়ের মুখে হাসি ঝলমল করবেই। তবে ব্যতিক্রম শেষের একমাস; এখন সে অনেক কিছুই আঁচ করতে শিখেছে। বাপি তার অন্যায্য কলঙ্ক তার মায়ের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নিজে তো বিদায় নিলোই, এখন তার মাও পড়েছে আচ্ছা ফাঁপরে; বালিকামনের অনুভূতি দিয়ে সে হয়তো মেলা কিছুই কল্পনা করে নেয়। আর ঠিক এখানেই আফরোজার ভয়। এসব তো চপলমতি মনের জন্য মারাত্মকই বটে। আরও একটা শঙ্কা বুকের গহিনে কাজ করছে ইদানীং। এভাবে চলে চলে সোনালি যদি দ্বন্দ্বমুখর হয়ে পড়ে, তখন তো মনোবিকলনের শিকার হয়ে পড়বে। আর সেটা অসম্ভব নয়; এটা মেয়ের রক্তে আছে, বাবার অসুখ মেয়ে পেতে পারে সহজেই। তখন? ভাবতেই শিউরে ওঠে। আশঙ্কা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে; আজ অফিসে যাওয়ার সময় মোবাইলটা ফেলে রেখে গিয়েছিল ভুলে। মোবাইলে প্রতিনিয়ত অশ্লীল অসভ্য সব মেসেজ আসতে থাকে; অনেক সময় ডিলিট করেও কূল পাওয়া যায় না। তেমন কিছু আপত্তিকর মেসেজ পড়ে ফেলেনি তো মেয়েটা?
একছুটে ঘরে এসে দেখল মোবাইলের স্থান পরিবর্তিত হয়েছে; তাহলে পরের দুর্ভাবনাই সত্য হতে চলেছে। অবেলায় স্বামীকে হারিয়েছে সে, এখন পেটের একমাত্র সন্তানকে যদি হারাতে হয় দ্বিতীয় দফা মনোবৈকল্যের মধ্য দিয়ে, তবে সে কী নিয়ে বাঁচবে! ভয়ে ভয়ে মুখ ঘুরিয়ে মেয়ের পানে তাকায় আফরোজা; ধক করে ওঠে পাঁজরের মাঝখানে। মেয়ের কচি মুখে যে সেই অশুভ কালো ছায়াই পড়েছে, যা শুরুর দিকে তার স্বামীর মুখমণ্ডলে পড়েছিল! পূর্বঅভিজ্ঞাবলে জানে, ওই মিশকালো ছায়াই পরে অপরাহ্নের দীর্ঘতর ছায়াকে টেক্কা দেয়, অমাবস্যার ঘনঘোর আঁধারে রূপান্তরিত হয়। মনের ওই অদৃশ্য কালো দাগ যারপরনাই সর্বনাশা; ধ্বংসযজ্ঞে তা দুকূলপ্লাবী বান-ডাকা নদীকেও ছাড়িয়ে যায়, অন্তস্তলের সব আলোক শুঁষে নিয়ে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলতে অব্যর্থ। হতভম্ভ আফরোজা টলমলো পায়ে উঠে এসে মেয়েকে জাঁপটে ধরে বুকে টেনে নেয়, মেয়ের ঘনায়মান কৃষ্ণকালো গহ্বরকে মুছে দিতে চায় মাতৃøেহের ওমে; কিন্তু মায়ের নিরাপদ উষ্ণ কোলে আশ্রয়লাভের পরও তেমন আশ্বাসের আভাস ফুটে ওঠে না; ফিনফিনে বাঁশপাতার মতো কাঁপতে থাকে একরত্তি মেয়েটা!
আপনার পাশে সিট খালি আছে দেখছি, ভালোই হল গল্পে গল্পে যাওয়া যাবে। এমনটা বলে রশীদ সাহেব ঝপ করে বসে পড়েন; শুধু বসেই পড়েন না, আফরোজা ভাবীর ওপর দেহের একটা অংশের ভার ছেড়ে দেন দিব্যি।
এমন অত্যাচার নতুন নয়, আজ রশীদ সাহেব, কাল হাবিব সাহেব, পরশু সত্যেন বাবুরা এ কাজটা করে যাচ্ছেন নিয়মিতই। আর এখানেই কষ্টটা তার। কেন সে কি পুরুষ সহকর্মীর কাছে মিনিমাম একটা সম্মান আশা করতে পারে না? অবশ্য সব সহকর্মীই যে তেমন, তা নয়; কিন্তু সেসব কলিগরা কদাচ বসে যাত্রাপথে। আবার যেসব নারী কলিগ রয়েছে, তারাও যে যথেষ্ট উদার, তেমনটা বলাতেও ঝুঁকি আছে। তারাও তার দিকে কেমন উপহাসের চোখে তাকায়; এড়িয়েও কম চলে না; ফলে তার পাশের সিটটি খালি থাকে একজন পুরুষ সহকর্মীর জন্য।
আমি বেশ লাকি, প্রায়শ আপনার পাশে বসার সুযোগ মিলে যায়। রশীদ সাহেবের কণ্ঠে বাড়তি উষ্ণতা ঝরে পড়ে।
কিছু একটা বলতে গিয়ে নিজের মধ্যে কুঁকড়ে যায় আফরোজা। ততক্ষণে বাসটি যাত্রা শুরু করেছে শহরের দিকে। চলন্ত বাসের জানালা গলে বাইরের অপস্রিয়মাণ গাছপালা আর খেতখোলার পানে তাকিয়ে থাকে সে। মনের বিরাগ ভাবটি গলার কাছে দলা পাকিয়ে তাকে জ্বালায়। রশীদ সাহেবদের আর দোষ কী! স্বীয় কপাল মন্দ বলেই না স্বামী তার কেবল নিজেই মরল না, তাকেও মেরে গেল। আবার মজা দেখ, তার স্বামীর অপমৃত্যুর বিনিময়ে যে সাধারণ শ্রেণীর চাকরিটা ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ দয়াপরবশ হয়ে তাকে দিল, সেটাও প্রতিনিয়ত তার ধৈর্য পরীক্ষা নিচ্ছে। ফলে স্বামীর মৃত্যুশোক দানা বাঁধল না আজতক; এমনকি প্রতিবার স্বামীর মৃত্যুবার্ষিকী এগিয়ে এলে সেই ফাটল প্রশস্ততর হয়। যে অপবাদ স্বামী তার ছড়িয়ে গেছে কলিগদের মধ্যে, সেটাই এখন গলার কাঁটা, রক্তাক্ত করে চলেছে অহরহ। না, রশীদ সাহেব আজ বড্ড বাড়াবাড়ি করছে বলে মনে হয়; অনেকটাই হেলে পড়ে কোণঠাসা করে ফেলেছে যেন।
আহা ভাবি, আপনি এতটা জড়সড় হচ্ছেন কেন? জানেনই তো, আমি আপনার স্বামীর ভালো বন্ধু ছিলাম; অ্যাকাউন্টস সেকশনে বসতাম পাশাপাশি। ভাবি, বি ফ্রাংক।
শক্ত ধরনের একটা জবাব মুখে এসেও আটকে যায়, নিরুত্তাপ গলায় আফরোজা বলে, প্লিজ, একটু সোজা হয়ে বসেন। সিটগুলো এমনিতে চাপা।
হে হে, ঠিক বলেছেন, সিটগুলো সত্যিই চাপা। কী আর করা, যা হোক, ভাবছি সামনের মিটিংয়ে ভিসি স্যারের কাছে আরামদায়ক বাসের দাবি তুলব। জানেন তো, ভার্সিটির রাজনীতিতে আমি বেশ প্রভাবশালী। রশীদ সাহেবের গলায় বিরক্তিকর ঝাঁজ স্পষ্ট; প্রচ্ছন্ন হুমকিও থাকতে পারে শেষের বাক্যে।
নিজের মধ্যে গুটিয়ে যায় ফের; এমনিতে একজন নারীর জন্য চারপাশ একটা চ্যালেঞ্জ, এটা বহুগুণ কঠিন হয়ে ওঠে যখন সে জড়িয়ে যায় এমন কোনো অপবাদে যার উদ্গাতা স্বয়ং তার স্বামী। মেয়েলি বদনাম এমনিতে বাতাসের আগে ছোটে, কেননা মানুষ সেখানে প্রভূত মজা লোটার সুযোগ পায়, পরিস্থিতি যখন এমত, সেখানে পতি বাহাদুর যদি নিজেই নামে প্রচারকের ভূমিকায়, তাহলে তো কথাই নেই, লোকজনের মনোরঞ্জনের ষোলোকলা পূর্ণ হয়। মানুষজনের আর দায় কোথায় বিষয়টি খতিয়ে দেখার, তলিয়ে দেখতে তাদের বয়েই গেছে।
বাসটা একটা বাজার পার হচ্ছিল, আজ কলা বেচার হাট রাস্তায় ওপর বসায় চলার গতি রুদ্ধ হতে হতে বাসটা দাঁড়িয়ে পড়ে শেষমেশ। কলার আমদানি বেশি থাকায় অন্য হাটবারের তুলনায় লোকসমাগম বেশি। দুদিকেই ছোটখাটো যানজট, ধীরলয়ে বাস এগুতে থাকলে রশীদ সাহেব অপ্রসন্ন হন, এভাবে হাইওয়েতে হাট বসানো ভারি অন্যায়। নিয়মকানুনের যদি কোনো বালাই থাকে।
কথাটা আফরোজাকে সাক্ষী মেনে বলা, কিন্তু তাতে সাড়া দিতে মন টানে না আফরোজার। বস্তুত তেমন মানসিক অবস্থাও নেই। এক অসম লড়াইয়ের বেদনা লাগামছাড়া হতে গলার কাছে শ্বাসরোধী অনুভূতির সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে যাকে অবলম্বন করে সে ঘুরে দাঁড়াত পারত, সেই লোকটা, তার স্বামী কায়সারই কিনা সবচেয়ে ফাঁসিয়ে গেল তাকে। আÍহত্যা করার বছর দুয়েক আগে থেকেই কায়সার মনোরোগের শিকার হয়, সাংঘাতিক সন্দেহবাতিকে ভুগতে থাকে। যত লোকটা ক্ষয়ে যেতে থাকে তত তীক্ষè হতে থাকে সন্দেহের তীরগুলো, প্রতিটি তীরের অভিমুখই স্ত্রীর দিকে; সরাসরি তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকে; এক পরিত্রাণহীন ভয়ংকর পরিস্থিতি সেটা। হয়তো প্রসাধনীর একটা পর্যায়ে সে কোনো পারফিউম ব্যবহার করেছে, ব্যস, আর যাবে কোথায়, হাজারো প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হতে হয়েছে, কে দিল বলো তো, ঘ্রাণটা বেশ সেক্সি মনে হচ্ছে। না, না, কী বল, এটা তো তোমাকে ব্যবহার করতে আগে দেখিনি। বেশ তোফা আছ দেখছি। শুধু কি তাই, এসব সংশয়ের কথা ঢাকে কাঠি মেরে কলিগদের মধ্যে বলে বেড়াত। ফলে সেটাই হয়ে দাঁড়ায় অনিষ্টের গোড়া। স্বামীর কণ্ঠে স্ত্রীর কলঙ্কের প্রচারণা সব সময় এমন এক অমোচনীয় শক্ত ভিত্তি পায় যে, তখন তা শুধু মুখরোচকই হয় না, অন্যকেও উস্কানি দেয়; বহুভোগ্যা হওয়ার ঝুঁকিকে বৃদ্ধি করে। আর সেটাই হচ্ছে এখন। অবস্থা এমন যে, চাকরিটা কতদিন চালিয়ে যাওয়া যাবে, তাও অনিশ্চিত। কিন্তু মুখ বুজে সবই সহ্য করতে হচ্ছে স্কুলপড়ুয়া মেয়ে সোনালির মলিন মুখখানার দিকে চেয়ে। এই সোনালি ছাড়া জগৎসংসারে তার আর কে আছে বল? কিন্তু মেয়েটার এমনি দুর্ভাগ্য যে, বাপিটা তো গেছেই, এখন মাকেও হারানোর ভয়ে থাকে। এসব একজন কোমলমতী বালিকার জন্য কখনো ভালো ফল বয়ে আনে না। ভাবনার এই জায়গাটি ধসিয়ে দিতে সে ছলছল চোখে হাটের মানুষজন দেখে।
হাটের ভিড় কাটিয়ে বাসটা এবার গতি তুলছে। আফরোজা যতই জানালার দিকে চেপে আসার চেষ্টা করুক, রশীদ সাহেব তত চেপে এসে পিষ্ট করার তালে সচেষ্ট। কেবল রশীদ সাহেবকে একাকী দোষ দিয়ে লাভ কি, যখন যে তার পাশে বসেছে, তখন সেসব সাহেবেরই আসল চেহারা এমনিভাবে প্রকটিত। মুখোশ-আঁটা পুরুষদের দঙ্গলে সবাই যে এমন, তা অবশ্য নয়, তবে তার বেলায় তা সংখ্যায় অল্পই; হৃদয়বান মানুষজন তবে কি সংখ্যালঘুই হয় কে জানে। চিন্তাস্রোতটি পরিণতি পাওয়ার আগেই এক কাণ্ড ঘটে। দ্রুতগতিসম্পন্ন বাসটা আচমকা সজোরে ব্রেক কষতে আফরোজা ঝুঁকে পড়ে ধাক্কা খায় সামনের সিটে। বাসের এই হার্ডব্রেকটি বুঝি রশীদ সাহেবদের অ্যাডোলেসেন্ট পরিতৃপ্তির উপায় হয়ে আসে; মুহূর্তকালের ঘটনা, বাসটাও সামলে নিয়ে হাইওয়ে ধরে ছুটে চলেছে, যাত্রীসবও ধকল কাটিয়ে উঠেছে, কিন্তু সেই ক্ষণকালের মধ্যেই তার গায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে রশীদ সাহেব, যা করল তা কহতব্য নয়; ডাকাতিয়া হাতে তছনছ করে দিয়েছে তার মেয়েলি ভরাট বুক। কিন্তু তা এতটা ত্বরিত, এমন সূচারুভাবে সম্পাদিত যে, আকস্মিক ব্রেকটাকে ঢাল হিসেবে দাঁড় করাতে বেগ পেতে হয় না রশীদ সাহেবের, এভাবে কেউ বাস চালায় বলেন, আর একটু হলেই তো সোজা খাদে নেমে যেত গাড়ি। জব্বর বেঁচে গেছি। কিছু মনে করবেন না, আমি তো প্রায় ব্যালান্স হারিয়ে ফেলেছিলাম, ভাগ্যিস আপনি পাশে ছিলেন। হে হে।
চরম বিতৃষ্ণা ও বিবমিষায় আফরোজার গা ঘিনঘিন করে উঠল। আচ্ছা এরা এমন কেন, এরা কি রগরগে সেক্সচিন্তায় সর্বক্ষণ হাবুডুবু খায়? কিন্তু তেমন সেক্সচিচিন্তায় যে স্নিগ্ধতার লেশমাত্র থাকে না, বিধ্বংসী অঙ্গার ছাড়া যে ওতে কিছু নেই- তা কি তারা আমলে নেবে না কখনো? মন ও দেহ দুটো পাশাপাশি স্নিগ্ধ জলধারার মতো, সমান্তরাল জলধারাযুগল চলে চলে যখন কাছাকাছি আসে, তখনই কেবল তাতে আলোর ফুলকি উঠতে পারে; আফসোস এরা যদি তা জানত! সে নিজেও কি সব জানত, সাহিত্যের পাঠাভ্যাস বজায় থাকলেই তা জানা যায়। বিবমিষার তিতকুটো অস্বস্তি সঙ্গে নিয়েই বাড়ি ফিরে মেয়ে সোনালির খোঁজ করে সে। ডাকাডাকির পর সোনালি তার ঘর থেকে বিষণ্নতার প্রতিমূর্তি হয়ে সামনে এসে দাঁড়ালে বিচলিত হয় আফরোজা, কিরে মা, দুপুরে খেয়েছিস? মুখ তবে এত ম্লান কেন?
দুই রুমের একটা ছোট্ট বাসায় তারা ভাড়া থাকে; মেয়ের স্কুলের কাছে বলে বাসাটা এখানে নেওয়া। সকালে মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিলেও বেলা একটা নাগাদ মেয়ে একাই বাসায় ফেরে। পড়াশোনার যত চাপ থাক, অফিসফেরতা মা কাছে এসে দাঁড়ালে মেয়ের মুখে হাসি ঝলমল করবেই। তবে ব্যতিক্রম শেষের একমাস; এখন সে অনেক কিছুই আঁচ করতে শিখেছে। বাপি তার অন্যায্য কলঙ্ক তার মায়ের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নিজে তো বিদায় নিলোই, এখন তার মাও পড়েছে আচ্ছা ফাঁপরে; বালিকামনের অনুভূতি দিয়ে সে হয়তো মেলা কিছুই কল্পনা করে নেয়। আর ঠিক এখানেই আফরোজার ভয়। এসব তো চপলমতি মনের জন্য মারাত্মকই বটে। আরও একটা শঙ্কা বুকের গহিনে কাজ করছে ইদানীং। এভাবে চলে চলে সোনালি যদি দ্বন্দ্বমুখর হয়ে পড়ে, তখন তো মনোবিকলনের শিকার হয়ে পড়বে। আর সেটা অসম্ভব নয়; এটা মেয়ের রক্তে আছে, বাবার অসুখ মেয়ে পেতে পারে সহজেই। তখন? ভাবতেই শিউরে ওঠে। আশঙ্কা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে; আজ অফিসে যাওয়ার সময় মোবাইলটা ফেলে রেখে গিয়েছিল ভুলে। মোবাইলে প্রতিনিয়ত অশ্লীল অসভ্য সব মেসেজ আসতে থাকে; অনেক সময় ডিলিট করেও কূল পাওয়া যায় না। তেমন কিছু আপত্তিকর মেসেজ পড়ে ফেলেনি তো মেয়েটা?
একছুটে ঘরে এসে দেখল মোবাইলের স্থান পরিবর্তিত হয়েছে; তাহলে পরের দুর্ভাবনাই সত্য হতে চলেছে। অবেলায় স্বামীকে হারিয়েছে সে, এখন পেটের একমাত্র সন্তানকে যদি হারাতে হয় দ্বিতীয় দফা মনোবৈকল্যের মধ্য দিয়ে, তবে সে কী নিয়ে বাঁচবে! ভয়ে ভয়ে মুখ ঘুরিয়ে মেয়ের পানে তাকায় আফরোজা; ধক করে ওঠে পাঁজরের মাঝখানে। মেয়ের কচি মুখে যে সেই অশুভ কালো ছায়াই পড়েছে, যা শুরুর দিকে তার স্বামীর মুখমণ্ডলে পড়েছিল! পূর্বঅভিজ্ঞাবলে জানে, ওই মিশকালো ছায়াই পরে অপরাহ্নের দীর্ঘতর ছায়াকে টেক্কা দেয়, অমাবস্যার ঘনঘোর আঁধারে রূপান্তরিত হয়। মনের ওই অদৃশ্য কালো দাগ যারপরনাই সর্বনাশা; ধ্বংসযজ্ঞে তা দুকূলপ্লাবী বান-ডাকা নদীকেও ছাড়িয়ে যায়, অন্তস্তলের সব আলোক শুঁষে নিয়ে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলতে অব্যর্থ। হতভম্ভ আফরোজা টলমলো পায়ে উঠে এসে মেয়েকে জাঁপটে ধরে বুকে টেনে নেয়, মেয়ের ঘনায়মান কৃষ্ণকালো গহ্বরকে মুছে দিতে চায় মাতৃøেহের ওমে; কিন্তু মায়ের নিরাপদ উষ্ণ কোলে আশ্রয়লাভের পরও তেমন আশ্বাসের আভাস ফুটে ওঠে না; ফিনফিনে বাঁশপাতার মতো কাঁপতে থাকে একরত্তি মেয়েটা!
No comments