হ্রস্ব-দীর্ঘ স্বর ও ভাষার বাধ্যবাধকতা by আখতার হোসেন খান
যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায়
বদরুদ্দীন উমরের লেখায় বাংলা বানান নিয়ে কতগুলো সুচিন্তিত বিষয় উত্থাপিত
হয়েছে। এ নিয়ে ভাষার মাসের বাইরেও যারা ভাষা নিয়ে ভাবেন, তাদের চোখ ফেরানো
দরকার। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য বদরুদ্দীন উমরের চিন্তা ও অভিনিবেশ
শুধু অতুলনীয়ই নয়, কবি ও ঔপন্যাসিকদের কথা বাদ দিলে, এ ক্ষেত্রে তার তুল্য
অবদান আর কার আছে, তার সন্ধান দুরূহ। কিন্তু শুধু এ কারণেই নয়, তার মতামত
এজন্যই গুরুত্ববহ যে, তিনি ভাষা নিয়ে যেসব মৌল প্রশ্ন তুলতে সক্ষম, তা
আজকালকার দিনের রাজনীতিভিত্তিক ভাষাপ্রেম দেখানোর গড্ডলপ্রবাহের যুগে
সচরাচর চোখে পড়ে না।
উমর আনন্দবাজারের বানান রীতির কথা তুলেছেন। আরও তুলেছেন একাডেমী বানানটিকে একাডেমিতে রূপান্তরের সাম্প্র্রতিক সিদ্ধান্তের প্রসঙ্গ। আনন্দবাজার পত্রিকা ও তার প্রকাশালয় বাংলা ভাষার আধুনিকায়নে ও ভারত প্রজাতন্ত্রের মতো একটা অসুবিধাজনক (ডিফিকাল্ট) দেশে বাংলা ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে যুগের পরে যুগ ধরে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে ও রেখে যাচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু ওই পত্রিকাভিত্তিক বানান-রীতিকে হুবহু অনুসরণ করতে গেলে সুবিধা-অসুবিধা তথা লাভ-লোকসান অবশ্যই হিসাবে আনতে হবে। এর কিছু রীতি উৎকটভাবে লোমহর্ষক : যেমন চীনকে চিন লেখা, যার কথা উমর উল্লেখ করেছেন; আমার প্রজন্মের গবেষক, লেখক ও শিক্ষাবিদ ভূইয়া ইকবাল বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় কথাটি টেনে আনেন।
উপরে বর্ণিত লাভ-লোকসান কে হিসাব করবেন? নিশ্চয়ই বক্তারা ও লেখকেরা। কিন্তু ভাষার বক্তা ও লেখকরা তো কোনো সরকারি আইনের বা আদালতের আওতাধীন নন। তাছাড়া এমন নয় যে, বাংলা ভাষা শুধু পশ্চিম বঙ্গ বা পূর্ব বাংলা (যার দাফতরিক নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ)-রই ভাষা। এ ভাষা ভারত প্রজাতন্ত্রের আরও রাজ্যে দাফতরিকভাবেই প্রথম বা দ্বিতীয় ভাষা। সুতরাং শুধু কলকাতা বা ঢাকা থেকে আকাদেমি বা একাডেমির মাধ্যমে বা সরকারি নির্দেশে (বা টিভিতে প্রমিত বানান ও উচ্চারণের প্রোগ্রাম করে, বা বছর দুয়েক আগের আদালতের হুকুমনামায়) ভাষার রীতি বা বানান পরিবর্তন সর্বগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। এর জন্য সময় দিতে হবে; দরকার হলে দশক-দশক বা শতাব্দী ধরে অপেক্ষা করা বাঞ্ছনীয়। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের বানান রীতি কোনো আকাদেমি বা একাডেমির অনুশাসনে বা কোনো পত্রিকার অনুসৃত রীতিতে পরিবর্তিত হয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এসে ঠেকেনি; এবং বিশ্বকবির ভাষার বানান-রীতি নিয়েই কি সবাই একমত ছিলেন? সে-নিয়েও তো ছোট আকারে হলেও ভিন্ন মত আর বিতর্ক ছিল।
এরপরও আছে লেখকদের নিজস্ব রীতি বা তরিকা, যাকে আত্মম্ভরিতাও বলা চলে। প্রয়াত নীরদ চৌধুরী সারা জীবন সাধু ভাষায় লিখে গেছেন। ১৯৮৯ সালে অক্সফোর্ডে এক দুর্লভ সাক্ষাতের সুযোগে তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করেছিলাম; তার সোজা উত্তর : অন্য কোনো ভাষায় একই ক্রিয়াপদের একাধিক ফর্ম/রূপকল্প নেই, সুতরাং বাংলায় কেন এ বিশৃংখলা থাকবে। অনেকের পরই চলতি ভাষায় লেখা শুরু করার পর রবীন্দ্রনাথও সাধু ভাষা সম্পর্কে এ জাতীয় বক্তব্য রেখে গিয়েছিলেন : এবং আশা করব, সাধু ভাষা... ঐতিহাসিক কবরস্থানে বিশ্রামলাভ করবে। সেই কবরস্থান তীর্থস্থান হবে, এবং অলংকৃত হবে তার স্মৃতিশিলাপট। এ বাণীর প্রায় অর্ধশতক পরও নীরদ চৌধুরী সাধু ভাষায়ই আরাধণা চালিয়ে যান; এবং যে আনন্দবাজার পত্রিকার কথা বলা হয়েছে তা, ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাকসহ, আজও সাধু ভাষায় তার সম্পাদকীয় লিখে থাকে। বুদ্ধদেব বসু... এবং আরও অনেক লেখক... ফেলে-র জায়গায় ফ্যালে লিখতেন; রবীন্দ্রনাথ এ প্রবণতাকে পূর্ববঙ্গীয় রীতি বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু তা-ওতো ভাষায় গৃহীত হয়েছে। আসলে রবীন্দ্রনাথের কথায়ই ফিরতে হবে : ভাষা সব সময়ে যুক্তি মানে না।
কিছুদিন আগে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান তুষ্ট চিত্তে সবাইকে জানান তার প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে দীর্ঘ ঈ-কার বাদ দিয়ে হ্রস্ব ই-কার যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ বাংলা একাডেমী এখন থেকে বাংলা একাডেমি। অনেক বছর আগে থেকেই ভারত প্রজাতন্ত্রে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি নামে আরেকটি সংস্থা কার্যকর আছে। দুনিয়ার কেউ পরিবর্তন ও আধুনিকায়ন থামাতে চাইবে না, বিশেষত তা যদি হয় অগ্রগতির প্রয়োজনে। অবশ্য সে-অগ্রগতিকে হতে হবে দৃশ্যমান, যুক্তিনির্ভর এবং পরিমাপযোগ্য।
শামসুজ্জামান খান একজন নিবেদিত প্রাণ বাংলাভাষাসেবী এবং তার ভাষা-সংক্রান্ত বেশিরভাগ চিন্তার সঙ্গে শুধু পণ্ডিতরাই নন, যে-কোনো সাধারণ বাংলা ভাষা-প্রেমিক একমত হবেন। এর পরও একটা প্রশ্ন এসেই যাবে, আর তা হল এসব পরিবর্তন বিভিন্ন ভাষা-বিশারদ-কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন পথে পরিচালিত বাংলা হওয়াতে তা ভাষাকে কতটা অখণ্ড-অবিভাজ্য রাখছে। আর সে-বিবেচনায় একাডেমি বা আকাদেমি, কোনো বানান নিয়েই আহ্লাদে আটখানা হওয়ার কিছু নেই; কেননা প্রথমটি দীর্ঘ ঈ-কার বা হ্রস্ব ই-কার, যা দিয়েই লেখা হোক না কেন, বাংলাভাষীরা শব্দটিকে যেভাবে উচ্চারণ করেন, তার অনেক কাছের। দ্বিতীয়টি, আকাদেমি, নিরর্থক অতিসচেতনতার ফল, যাতে আবার সারাক্ষণ-উচ্চারিত ইটালীকে ইতালি লেখার ভাষা-দর্শন ঢুকে আছে। মূল কথা, কোনো পরিবর্তনই ভাষার অবিভাজ্যতার মূল চিন্তাকে সামনে রেখে করা হয়নি।
যারা বাংলা ভাষাকে ভালোবাসেন, তাদের একটা সাধারণ দাবি এ হতে পারে যে যেখানে যাই হোক, আধুনিকতা বা অন্যকিছু, সবকিছু ছাপিয়ে ভাষার এ অবিভাজ্যতার প্রশ্নটি যেন মাথায় থাকে। বিভক্ত জার্মানির পূর্বাংশে এক ধরনের ভাষাবিদ বোঝাতে চাইতেন যে সমাজতান্ত্রিক শাসনের ফলে দুজার্মানির ভাষায় কিছু মৌলিক পার্থক্য জন্ম নিয়েছে। এটা ছিল রাজনীতি-প্রণোদিত ভাষাচার। ইতিহাসের কলের তলে এখন তা কোথায়? ভৌগলিকভাবে সংযুক্ত একটা ভাষাগোষ্ঠীর ভাষায় শুধু রাজনৈতিক কারণে জোর করে ভিন্ন ভিন্ন কৃত্রিম বৈশিষ্ট্য আমদানিতে গৌরবের কিছু নেই; এবং তার উদ্দেশ্য যে মহৎ নয়, তা সবাই বুঝতে পারেন। মার্কিন দেশের ইংরেজি বানানের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের ভাষার কিছু শব্দের বানানের একটা ফারাক তৈরি হয়ে গেছে; কিন্তু, তার পরও কেউ বলবেন না যে নতুন ভাষা তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া সেখানে তো আছে মহাসমুদ্রের ভৌগলিক ব্যবধান।
সুতরাং, বর্তমানে কিছু স্ত্রীপ্রত্যয় ছাড়া অতৎসম শব্দে সর্বত্র ই (হ্রস্ব ই) প্রত্যয়ের ব্যবহার চালু হয়েছে, এ দাবি করা সহজ বটে, কিন্তু তাতে ভাষার দীর্ঘস্থায়ী কী উপকার হচ্ছে, তা বোঝা শক্তই শুধু নয়, প্রমাণ করাও কঠিন। যদি বৈচিত্র্যই সভ্যতা-সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকে, তবে তো একাধিক বানান-পদ্ধতির মধ্যে ক্ষতিকর কিছু না থাকারই কথা। আর অতৎসম শব্দের শেষে কোথাও দীর্ঘ ঈ-স্বরের উচ্চারণ নেই, তাই বা কীভাবে দৃঢ় প্রতিষ্ঠ বা প্রমাণিত হল। যদি থাকে, এবং অবশ্যই আছে, কেন একভাবে লিখে আরেকভাবে উচ্চারণ করা হবে? একটা ভাষার বৈশিষ্ট্য ও ঐশ্বর্য একাধিক সম্ভাব্য রীতিতে কমে না, বরং বাড়ে।
একইভাবে, অভিন্ন উচ্চারণের পরও শ, ষ আর স কে তো আমরা ছাড়তে পারিনি। বাংলার মতো একই ব্রাহ্মী লিপি থেকে জন্ম হলেও এবং উচ্চারণে মূর্ধ্য বর্ণ আর দন্ত বর্ণের প্রভেদ চলে যাওয়ার পরেও তো থাইরা তাদের ভাষায় ট-বর্গ ও ত-বর্গ অব্যাহত রেখে ৪৪টি ব্যঞ্জন বর্ণ আর ১৫টি স্বরবর্ণ দিয়ে কাজ চালাচ্ছে।
অনেক বিজ্ঞ ভাষাবিদ কি ও কী নিয়ে বিব্রত এবং বিক্ষুব্ধ। কিন্তু ভাষার সাধারণ কথক ও পাঠক হিসেবে বলতে পারি, এ দুটি বর্ণবন্ধ শুধু যে দুধরনের অর্থ দ্যোতক তাই নয়, বাংলা ভাষার সূক্ষ্মতা ও পরিশীলতার অকাট্য প্রমাণ। এসব প্রমাণ ঝেড়ে ফেলে দিলে কী-লাভ হবে, তা বোঝা শক্ত। এতে হয়তো এক ধরনের কুচকাওয়াজসুলভ শৃংখলা আসবে, কিন্তু ভাষার মর্যাদাবৃদ্ধি কি আসলেই হবে? আর ভাষার কী ওই ধরনের শৃংখলার প্রয়োজন আছে।
সম্প্রতি অন্যত্র প্রকাশিত এক সুন্দর লেখায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিশ্বজিৎ ঘোষ বাংলা ভাষায় গোটা পাঁচেক প্রয়োগ-অপপ্রয়োগের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। তার সবগুলো যুক্তির সঙ্গে একমত হয়েও আমি বলব, যেখানে বিরাম চিহ্নের বদলে অনুস্বর আসেনি, এসেছে সংক্ষিপ্তকরণের জন্য, তা থাকুক না বাংলা ভাষার একটা বৈশিষ্ট্য হয়েই, এ-বৈশিষ্ট্য তো ভাষার সম্পদ হিসেবেই বিবেচিত হতে পারে। অনেকের কাছেই তাকে গ্রাম্য বা কৃষিজ (এগ্রিকালচারাল) মনে হতে পারে, কিন্তু এটাওতো ভাষার একটা অর্জন হিসেবে থাকতে পারে। আমার ছোট বেলায় ফরিদপুরে আমার শহুরে সরকারি চাকরিজীবী মাতামহের চিঠিতে হাওলাদারের জায়গায় হাং এবং বারবারের স্থানে বার২ লেখা দেখে বিস্মিত হতাম। নিকট অতীতে সচিবালয়ের নথিতেও তা দেখেছি। কিন্তু এখন তো আমার মনে হয়, এসব প্রয়োগ বাংলা ভাষার ঔদার্য ও বৃহত্তরকেই প্রমাণ করে; এবং তাই ভাষার এ সম্পদগুলোকে আমাদের রক্ষা করা উচিত। মালয় ভাষায় কোনো শব্দের বহুবচন লিখতে হলে শব্দটিকে দুবার লিখতে হয়; যেমন সুকান অর্থ ক্রীড়া; আর বহুবচনে তা হয়ে যায় সুকান সুকান : কী অসুবিধা এতে? শুনেছি চীনা ভাষায় বহুবচন নেই, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎকাল নেই। কিন্তু তার পরেওতো দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি লোক ওই ভাষাতেই কথা বলেন; এবং তারা এক মহান সাহিত্যের ধারক।
একই পত্রিকায় বেগম জাহান আরার আরেকটি সুপাঠ্য লেখাতেও হ্রস্ব ই ও দীর্ঘ ঈ-র প্রসঙ্গ এসেছে। মনে হচ্ছে, তিনিও ঢালাওভাবে হ্রস্ব-ই-রই সমর্থক। কেন সব অতৎসম শব্দে দীর্ঘ ঈ-র জায়গায়ও হ্রস্ব-ই লিখতে হবে, তা বুঝতে আমি অক্ষম। আমার ভাষাজ্ঞানের অভাবকে এজন্য দায়ী করা সহজ। কিন্তু অতৎসম শব্দের উচ্চারণে ক্ষেত্রমতো এত সব বিধিকরণের পরেওতো দীর্ঘ-ঈ স্বর থেকেই যাবে, আমরা যাই লিখি না কেন। এদের তো এ ভাষা তাড়াতে পারবে না, তা শতটি একাডেমির বিধি হোক বা না হোক। লীগ, আওয়ামী, ইসলামী ইত্যাদি শব্দ তাহলে কোথায় যাবে? শ্রেণী-কে শ্রেণি লিখে এক ধরনের আÍতুষ্টি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু কী তাতে কী বিজয় মিলবে?
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের বাংলা ভাষ্যে বাঙালী, স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার, সুপ্রীম কোর্ট, আপীল বিভাগ, ইংরাজী ইত্যাদি দীর্ঘ-ঈ বানানের শব্দ রয়েছে। আমি জানি না, সাম্প্রতিককালের সংশোধনীতে সে-সব পালটেছে কিনা। না পালটালে বেশ কিছু অতৎসম শব্দে পরিত্যাজ্য দীর্ঘ-ঈ নিয়েই বসবাস করতে হবে। ভাষার ব্যাপারে যেহেতু বাধ্যবাধকতা নেই, তাই ক্ষেত্রমতো একাধিক বানান-পদ্ধতির সহাবস্থান ভাষার খুব ক্ষতি সাধন করবে না; বরং এর মাধুর্য বাড়াতেও পারে; এবং সাধু ভাষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যৎ বাণীর পরও তা এখনও বেঁচে-বর্তে আছে : কবি ও ঔপন্যাসিকরা সম্ভবত এসবে উপকৃতই হবেন।
উমর আনন্দবাজারের বানান রীতির কথা তুলেছেন। আরও তুলেছেন একাডেমী বানানটিকে একাডেমিতে রূপান্তরের সাম্প্র্রতিক সিদ্ধান্তের প্রসঙ্গ। আনন্দবাজার পত্রিকা ও তার প্রকাশালয় বাংলা ভাষার আধুনিকায়নে ও ভারত প্রজাতন্ত্রের মতো একটা অসুবিধাজনক (ডিফিকাল্ট) দেশে বাংলা ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে যুগের পরে যুগ ধরে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে ও রেখে যাচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু ওই পত্রিকাভিত্তিক বানান-রীতিকে হুবহু অনুসরণ করতে গেলে সুবিধা-অসুবিধা তথা লাভ-লোকসান অবশ্যই হিসাবে আনতে হবে। এর কিছু রীতি উৎকটভাবে লোমহর্ষক : যেমন চীনকে চিন লেখা, যার কথা উমর উল্লেখ করেছেন; আমার প্রজন্মের গবেষক, লেখক ও শিক্ষাবিদ ভূইয়া ইকবাল বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় কথাটি টেনে আনেন।
উপরে বর্ণিত লাভ-লোকসান কে হিসাব করবেন? নিশ্চয়ই বক্তারা ও লেখকেরা। কিন্তু ভাষার বক্তা ও লেখকরা তো কোনো সরকারি আইনের বা আদালতের আওতাধীন নন। তাছাড়া এমন নয় যে, বাংলা ভাষা শুধু পশ্চিম বঙ্গ বা পূর্ব বাংলা (যার দাফতরিক নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ)-রই ভাষা। এ ভাষা ভারত প্রজাতন্ত্রের আরও রাজ্যে দাফতরিকভাবেই প্রথম বা দ্বিতীয় ভাষা। সুতরাং শুধু কলকাতা বা ঢাকা থেকে আকাদেমি বা একাডেমির মাধ্যমে বা সরকারি নির্দেশে (বা টিভিতে প্রমিত বানান ও উচ্চারণের প্রোগ্রাম করে, বা বছর দুয়েক আগের আদালতের হুকুমনামায়) ভাষার রীতি বা বানান পরিবর্তন সর্বগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। এর জন্য সময় দিতে হবে; দরকার হলে দশক-দশক বা শতাব্দী ধরে অপেক্ষা করা বাঞ্ছনীয়। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের বানান রীতি কোনো আকাদেমি বা একাডেমির অনুশাসনে বা কোনো পত্রিকার অনুসৃত রীতিতে পরিবর্তিত হয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এসে ঠেকেনি; এবং বিশ্বকবির ভাষার বানান-রীতি নিয়েই কি সবাই একমত ছিলেন? সে-নিয়েও তো ছোট আকারে হলেও ভিন্ন মত আর বিতর্ক ছিল।
এরপরও আছে লেখকদের নিজস্ব রীতি বা তরিকা, যাকে আত্মম্ভরিতাও বলা চলে। প্রয়াত নীরদ চৌধুরী সারা জীবন সাধু ভাষায় লিখে গেছেন। ১৯৮৯ সালে অক্সফোর্ডে এক দুর্লভ সাক্ষাতের সুযোগে তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করেছিলাম; তার সোজা উত্তর : অন্য কোনো ভাষায় একই ক্রিয়াপদের একাধিক ফর্ম/রূপকল্প নেই, সুতরাং বাংলায় কেন এ বিশৃংখলা থাকবে। অনেকের পরই চলতি ভাষায় লেখা শুরু করার পর রবীন্দ্রনাথও সাধু ভাষা সম্পর্কে এ জাতীয় বক্তব্য রেখে গিয়েছিলেন : এবং আশা করব, সাধু ভাষা... ঐতিহাসিক কবরস্থানে বিশ্রামলাভ করবে। সেই কবরস্থান তীর্থস্থান হবে, এবং অলংকৃত হবে তার স্মৃতিশিলাপট। এ বাণীর প্রায় অর্ধশতক পরও নীরদ চৌধুরী সাধু ভাষায়ই আরাধণা চালিয়ে যান; এবং যে আনন্দবাজার পত্রিকার কথা বলা হয়েছে তা, ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাকসহ, আজও সাধু ভাষায় তার সম্পাদকীয় লিখে থাকে। বুদ্ধদেব বসু... এবং আরও অনেক লেখক... ফেলে-র জায়গায় ফ্যালে লিখতেন; রবীন্দ্রনাথ এ প্রবণতাকে পূর্ববঙ্গীয় রীতি বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু তা-ওতো ভাষায় গৃহীত হয়েছে। আসলে রবীন্দ্রনাথের কথায়ই ফিরতে হবে : ভাষা সব সময়ে যুক্তি মানে না।
কিছুদিন আগে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান তুষ্ট চিত্তে সবাইকে জানান তার প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে দীর্ঘ ঈ-কার বাদ দিয়ে হ্রস্ব ই-কার যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ বাংলা একাডেমী এখন থেকে বাংলা একাডেমি। অনেক বছর আগে থেকেই ভারত প্রজাতন্ত্রে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি নামে আরেকটি সংস্থা কার্যকর আছে। দুনিয়ার কেউ পরিবর্তন ও আধুনিকায়ন থামাতে চাইবে না, বিশেষত তা যদি হয় অগ্রগতির প্রয়োজনে। অবশ্য সে-অগ্রগতিকে হতে হবে দৃশ্যমান, যুক্তিনির্ভর এবং পরিমাপযোগ্য।
শামসুজ্জামান খান একজন নিবেদিত প্রাণ বাংলাভাষাসেবী এবং তার ভাষা-সংক্রান্ত বেশিরভাগ চিন্তার সঙ্গে শুধু পণ্ডিতরাই নন, যে-কোনো সাধারণ বাংলা ভাষা-প্রেমিক একমত হবেন। এর পরও একটা প্রশ্ন এসেই যাবে, আর তা হল এসব পরিবর্তন বিভিন্ন ভাষা-বিশারদ-কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন পথে পরিচালিত বাংলা হওয়াতে তা ভাষাকে কতটা অখণ্ড-অবিভাজ্য রাখছে। আর সে-বিবেচনায় একাডেমি বা আকাদেমি, কোনো বানান নিয়েই আহ্লাদে আটখানা হওয়ার কিছু নেই; কেননা প্রথমটি দীর্ঘ ঈ-কার বা হ্রস্ব ই-কার, যা দিয়েই লেখা হোক না কেন, বাংলাভাষীরা শব্দটিকে যেভাবে উচ্চারণ করেন, তার অনেক কাছের। দ্বিতীয়টি, আকাদেমি, নিরর্থক অতিসচেতনতার ফল, যাতে আবার সারাক্ষণ-উচ্চারিত ইটালীকে ইতালি লেখার ভাষা-দর্শন ঢুকে আছে। মূল কথা, কোনো পরিবর্তনই ভাষার অবিভাজ্যতার মূল চিন্তাকে সামনে রেখে করা হয়নি।
যারা বাংলা ভাষাকে ভালোবাসেন, তাদের একটা সাধারণ দাবি এ হতে পারে যে যেখানে যাই হোক, আধুনিকতা বা অন্যকিছু, সবকিছু ছাপিয়ে ভাষার এ অবিভাজ্যতার প্রশ্নটি যেন মাথায় থাকে। বিভক্ত জার্মানির পূর্বাংশে এক ধরনের ভাষাবিদ বোঝাতে চাইতেন যে সমাজতান্ত্রিক শাসনের ফলে দুজার্মানির ভাষায় কিছু মৌলিক পার্থক্য জন্ম নিয়েছে। এটা ছিল রাজনীতি-প্রণোদিত ভাষাচার। ইতিহাসের কলের তলে এখন তা কোথায়? ভৌগলিকভাবে সংযুক্ত একটা ভাষাগোষ্ঠীর ভাষায় শুধু রাজনৈতিক কারণে জোর করে ভিন্ন ভিন্ন কৃত্রিম বৈশিষ্ট্য আমদানিতে গৌরবের কিছু নেই; এবং তার উদ্দেশ্য যে মহৎ নয়, তা সবাই বুঝতে পারেন। মার্কিন দেশের ইংরেজি বানানের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের ভাষার কিছু শব্দের বানানের একটা ফারাক তৈরি হয়ে গেছে; কিন্তু, তার পরও কেউ বলবেন না যে নতুন ভাষা তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া সেখানে তো আছে মহাসমুদ্রের ভৌগলিক ব্যবধান।
সুতরাং, বর্তমানে কিছু স্ত্রীপ্রত্যয় ছাড়া অতৎসম শব্দে সর্বত্র ই (হ্রস্ব ই) প্রত্যয়ের ব্যবহার চালু হয়েছে, এ দাবি করা সহজ বটে, কিন্তু তাতে ভাষার দীর্ঘস্থায়ী কী উপকার হচ্ছে, তা বোঝা শক্তই শুধু নয়, প্রমাণ করাও কঠিন। যদি বৈচিত্র্যই সভ্যতা-সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকে, তবে তো একাধিক বানান-পদ্ধতির মধ্যে ক্ষতিকর কিছু না থাকারই কথা। আর অতৎসম শব্দের শেষে কোথাও দীর্ঘ ঈ-স্বরের উচ্চারণ নেই, তাই বা কীভাবে দৃঢ় প্রতিষ্ঠ বা প্রমাণিত হল। যদি থাকে, এবং অবশ্যই আছে, কেন একভাবে লিখে আরেকভাবে উচ্চারণ করা হবে? একটা ভাষার বৈশিষ্ট্য ও ঐশ্বর্য একাধিক সম্ভাব্য রীতিতে কমে না, বরং বাড়ে।
একইভাবে, অভিন্ন উচ্চারণের পরও শ, ষ আর স কে তো আমরা ছাড়তে পারিনি। বাংলার মতো একই ব্রাহ্মী লিপি থেকে জন্ম হলেও এবং উচ্চারণে মূর্ধ্য বর্ণ আর দন্ত বর্ণের প্রভেদ চলে যাওয়ার পরেও তো থাইরা তাদের ভাষায় ট-বর্গ ও ত-বর্গ অব্যাহত রেখে ৪৪টি ব্যঞ্জন বর্ণ আর ১৫টি স্বরবর্ণ দিয়ে কাজ চালাচ্ছে।
অনেক বিজ্ঞ ভাষাবিদ কি ও কী নিয়ে বিব্রত এবং বিক্ষুব্ধ। কিন্তু ভাষার সাধারণ কথক ও পাঠক হিসেবে বলতে পারি, এ দুটি বর্ণবন্ধ শুধু যে দুধরনের অর্থ দ্যোতক তাই নয়, বাংলা ভাষার সূক্ষ্মতা ও পরিশীলতার অকাট্য প্রমাণ। এসব প্রমাণ ঝেড়ে ফেলে দিলে কী-লাভ হবে, তা বোঝা শক্ত। এতে হয়তো এক ধরনের কুচকাওয়াজসুলভ শৃংখলা আসবে, কিন্তু ভাষার মর্যাদাবৃদ্ধি কি আসলেই হবে? আর ভাষার কী ওই ধরনের শৃংখলার প্রয়োজন আছে।
সম্প্রতি অন্যত্র প্রকাশিত এক সুন্দর লেখায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিশ্বজিৎ ঘোষ বাংলা ভাষায় গোটা পাঁচেক প্রয়োগ-অপপ্রয়োগের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। তার সবগুলো যুক্তির সঙ্গে একমত হয়েও আমি বলব, যেখানে বিরাম চিহ্নের বদলে অনুস্বর আসেনি, এসেছে সংক্ষিপ্তকরণের জন্য, তা থাকুক না বাংলা ভাষার একটা বৈশিষ্ট্য হয়েই, এ-বৈশিষ্ট্য তো ভাষার সম্পদ হিসেবেই বিবেচিত হতে পারে। অনেকের কাছেই তাকে গ্রাম্য বা কৃষিজ (এগ্রিকালচারাল) মনে হতে পারে, কিন্তু এটাওতো ভাষার একটা অর্জন হিসেবে থাকতে পারে। আমার ছোট বেলায় ফরিদপুরে আমার শহুরে সরকারি চাকরিজীবী মাতামহের চিঠিতে হাওলাদারের জায়গায় হাং এবং বারবারের স্থানে বার২ লেখা দেখে বিস্মিত হতাম। নিকট অতীতে সচিবালয়ের নথিতেও তা দেখেছি। কিন্তু এখন তো আমার মনে হয়, এসব প্রয়োগ বাংলা ভাষার ঔদার্য ও বৃহত্তরকেই প্রমাণ করে; এবং তাই ভাষার এ সম্পদগুলোকে আমাদের রক্ষা করা উচিত। মালয় ভাষায় কোনো শব্দের বহুবচন লিখতে হলে শব্দটিকে দুবার লিখতে হয়; যেমন সুকান অর্থ ক্রীড়া; আর বহুবচনে তা হয়ে যায় সুকান সুকান : কী অসুবিধা এতে? শুনেছি চীনা ভাষায় বহুবচন নেই, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎকাল নেই। কিন্তু তার পরেওতো দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি লোক ওই ভাষাতেই কথা বলেন; এবং তারা এক মহান সাহিত্যের ধারক।
একই পত্রিকায় বেগম জাহান আরার আরেকটি সুপাঠ্য লেখাতেও হ্রস্ব ই ও দীর্ঘ ঈ-র প্রসঙ্গ এসেছে। মনে হচ্ছে, তিনিও ঢালাওভাবে হ্রস্ব-ই-রই সমর্থক। কেন সব অতৎসম শব্দে দীর্ঘ ঈ-র জায়গায়ও হ্রস্ব-ই লিখতে হবে, তা বুঝতে আমি অক্ষম। আমার ভাষাজ্ঞানের অভাবকে এজন্য দায়ী করা সহজ। কিন্তু অতৎসম শব্দের উচ্চারণে ক্ষেত্রমতো এত সব বিধিকরণের পরেওতো দীর্ঘ-ঈ স্বর থেকেই যাবে, আমরা যাই লিখি না কেন। এদের তো এ ভাষা তাড়াতে পারবে না, তা শতটি একাডেমির বিধি হোক বা না হোক। লীগ, আওয়ামী, ইসলামী ইত্যাদি শব্দ তাহলে কোথায় যাবে? শ্রেণী-কে শ্রেণি লিখে এক ধরনের আÍতুষ্টি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু কী তাতে কী বিজয় মিলবে?
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের বাংলা ভাষ্যে বাঙালী, স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার, সুপ্রীম কোর্ট, আপীল বিভাগ, ইংরাজী ইত্যাদি দীর্ঘ-ঈ বানানের শব্দ রয়েছে। আমি জানি না, সাম্প্রতিককালের সংশোধনীতে সে-সব পালটেছে কিনা। না পালটালে বেশ কিছু অতৎসম শব্দে পরিত্যাজ্য দীর্ঘ-ঈ নিয়েই বসবাস করতে হবে। ভাষার ব্যাপারে যেহেতু বাধ্যবাধকতা নেই, তাই ক্ষেত্রমতো একাধিক বানান-পদ্ধতির সহাবস্থান ভাষার খুব ক্ষতি সাধন করবে না; বরং এর মাধুর্য বাড়াতেও পারে; এবং সাধু ভাষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যৎ বাণীর পরও তা এখনও বেঁচে-বর্তে আছে : কবি ও ঔপন্যাসিকরা সম্ভবত এসবে উপকৃতই হবেন।
No comments