পুবে মুখ ফেরাচ্ছেন পুতিন by শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার ভেতর টেনে নেওয়ার
ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট
ভ্লাদিমির পুতিনের সম্পর্ক এখন দা-কুমড়া। ইউক্রেন তো বলেই দিয়েছে, পুতিন
যা করছেন, পরিণামে তা সামরিক বিরোধ ডেকে আনবে।
এর মধ্যে জি-৮ থেকে রাশিয়াকে বর্জন করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা সহযোগীরা। এ কারণে সম্প্রতি নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে শহরে অনুষ্ঠিত জি-৮ শীর্ষ সম্মেলন হয়ে যায় জি-৭ সম্মেলন। এতে রাশিয়ার অনুপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। ক্রিমিয়াকে পেটের ভেতর টেনে নেওয়ার সাজা হিসেবে রাশিয়াকে এখন নিষেধাজ্ঞার ফাঁদে ফেলে একটা মোক্ষম ডলা দিতে প্রস্তুত পশ্চিমারা।
রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর এই ক্ষোভ অবশ্য নতুন নয়। ইরানকে পারমাণবিক কর্মসূচিতে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করায় মস্কোর ওপর আগে থেকেই প্রচণ্ড ক্ষোভ রয়েছে তাদের। মাঝখানে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এ ক্ষোভে সতেজে ইন্ধন জোগায়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের প্রভাবশালী দেশগুলো প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে যেভাবে সহজে সরিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিল, বাস্তবে তা হয়নি। আর তা হয়নি মূলত রাশিয়ার বিরোধিতার কারণেই। মাঝখানে মার্কিন চর স্নোডেন-নাটক অবস্থানগত দিক থেকে রাশিয়ার কাছে যুক্তরাষ্ট্রকে খানিকটা বেকায়দায় ফেলে দেয়। এসব মিলিয়ে রুশ-মার্কিন সম্পর্কে প্রাচীন স্নায়ুযুদ্ধ মৃদুলয়ে দামামা বাজাতে শুরু করে। সবশেষে ক্রিমিয়ার ধূমায়িত বাষ্প এ সম্পর্কের মধ্যে যেন আরও বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়ায়। এখন অবস্থাটা এমন, যুক্তরাষ্ট্র একহাত নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে তো পাল্টা জবাবে রাশিয়াও দেখে নেওয়ার ভয় দেখাচ্ছে।
এখন কথা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার চারপাশে নিষেধাজ্ঞার কঠিন বেড়াজাল তৈরি করলে, রাশিয়া কী করবে?
এ ব্যাপারে এখনই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে রাশিয়া। পশ্চিম তাকে বিমুখ করেছে তো কী হয়েছে? পুবের মিত্ররা আছে না! তারা এখন রাশিয়ার বিরাট ভরসা। পুতিনের বিশেষ সহযোগী ইগর সেচিনের সাম্প্রতিক এশিয়ার সফর এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি যে বার্তা নিয়ে এশিয়া সফর করেন, এর সারবত্তা হচ্ছে: যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ যদি রাশিয়াকে একঘরে করে, মস্কো তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্বালানি সরবরাহ, অস্ত্রসংক্রান্ত লেনদেন ও রাজনৈতিক সহযোগিতার বিষয়ে এশিয়ার সঙ্গে নতুন করে সখ্য গড়ে তুলবে।
এশিয়ায় বর্তমানে অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে চীনকে বিবেচনা করা হয়। সাম্যবাদের নীতির সূত্র ধরে বেইজিংয়ের সঙ্গে মস্কোর দহরম-মহরম অনেক পুরোনো। পুতিনকে অবশ্য অনেক বিশ্লেষক সমাজতন্ত্রের প্রতিভূ দেশের সাম্রাজ্যবাদের লেবাস পরা নেতা বলে নিন্দা করে থাকেন। কিন্তু সংস্কারের পথ ধরে এগোনো চীনও এখন সেই প্রাচীন মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরে বসে নেই। যুগের চাহিদা ও সময়ের দাবির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের মাওবাদী নীতিতেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। পুতিনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতায় কোনো আপত্তি নেই তাদের। মস্কো থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানিতে কয়েক বছর ধরে চলা চীনের আলোচনা এখন দৃশ্যত সমঝোতায় পৌঁছেছে। আগামী মে মাসে পুতিনের চীন সফরকালে যদি এ ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তাহলে তিনি ইউরোপকে দেখাতে পারবেন যে বৈশ্বিক ক্ষমতা এখন পশ্চিম থেকে পূর্বে স্থানান্তরিত হয়েছে। এখন আর পশ্চিমাদের প্রয়োজন নেই তাঁদের।
এ ব্যাপারে অ্যানালাইসিস অব স্ট্র্যাটেজিস অ্যান্ড টেকনোলজিস নামের একটি চিন্তন গোষ্ঠীর চীনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ভ্যাসিলি কাশিন বলেন, ‘পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় রাশিয়া এখন চীনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হতে চাইছে। চীনের সমর্থন পেলে কেউ আর তাদের একঘরে বলতে পারবে না।’
রাশিয়ার অস্ত্র ও যুদ্ধবিমান বাগানোর বিষয়ে অনেক আগে থেকেই প্রবল আগ্রহ রয়েছে চীনের। রাশিয়ার সুখোই এসইউ-৩৫ যুদ্ধবিমান পেতে ২০১০ সাল থেকে চেষ্টা করে আসছে চীন। অপর দিকে রাশিয়ার অভ্যন্তরে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, জ্বালানিসহ অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের বেশ আগ্রহ রয়েছে চীনের। রাশিয়াও এসব বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে। এভাবে রাশিয়া ও চীন ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে পারে।
একটা সময় ছিল যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের মৈত্রী ছিল প্রগাঢ়। যুক্তরাষ্ট্র ছিল বেশ দূরে। এখন সময় পাল্টেছে। ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র রপ্তানির বড় বাজারে পরিণত হয়েছে। তাই বলে সোভিয়েত যুগ থেকে বেরিয়ে আসা রাশিয়াকেও দূরে ঠেলে দেয়নি ভারত। এখনো রাশিয়া পুরোনো বন্ধু হিসেবে ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে যাচ্ছে। এশিয়ায় এখন রাশিয়ার মূল লক্ষ্যটা হবে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বন্ধন জোরালো করে এ অঞ্চলে একটা শক্ত ভিত তৈরি করা। সে ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে অন্যান্য অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ অন্যান্য দেশের সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা চালাবে তারা। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কতটা প্রভাব ফেলবে, তা সময়ই বলে দেবে।
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
সূত্র: রয়টার্স
No comments