অর্থনৈতিক উন্নতি ও নৈতিক দায়
ভোরবেলা যাচ্ছিলাম কমলাপুর স্টেশনে। রাস্তায় খুব কম যানবাহন। তবু এক সিগন্যালে একটু থামতে হলো বাঁ দিক থেকে কয়েকটি গাড়ি ক্রসিং পার হয়ে ডান দিকে আসায়। একটি পিকআপ পাশ ঘেঁষে থামতে বাধ্য হলো। অত ভোরে কোনো বোকা চালকও লালবাতি মানেন না। পিকআপে দুটো চটের বস্তা। একটি বস্তার মুখের দিকে সামান্য ফাঁক দিয়ে দেখা গেল একটি মরা মুরগির পা ও পাখনা। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে হলে মনে করতাম মরা মুরগি কুড়িয়ে কেউ ডাস্টবিনে ফেলে দিতে নিয়ে যাচ্ছে। এখন মনে পড়ল অন্য কথা। আমার কর্তব্য ছিল গাড়িটিকে আটকে পুলিশকে খবর দেওয়া। তা না করতে পারায় গ্লানি ও অপরাধ বোধ করি। শাঁ করে বস্তাওয়ালা গাড়ি চলে গেল। আমার মনে পড়ল কয়েক সপ্তাহ আগে প্রথম আলো ও অন্যান্য কাগজে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন: ‘তেজগাঁও রেলগেট এলাকায় খাটের নিচে স্তূপ করে রাখা ১২০টি মরা মুরগি উদ্ধার করে র্যাব। দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রত্যেককে দুই বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে আরও তিন মাস জেল।’ প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, দূরদূরান্ত থেকে প্রায় প্রতিদিন ট্রাকে করে আনা মুরগি বিভিন্ন কারণে মারা যায়। এই মুরগি তারা প্রতিটি ৫০ টাকা করে কিনে নেয়। তারপর গরিব মানুষের কাছে জ্যান্ত বলে বিক্রি করে। মরা মুরগি বিক্রির সাত সদস্যের একটি চক্র আছে। এরা বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় ওই মুরগি বিক্রি করে। মোবাইল কোর্টের দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা জানায়, তারা প্রতিদিন এক লাখ টাকার মতো মরা মুরগি বিক্রি করে।
ওই যে মরা মুরগি বস্তায় ভরে আমার চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে গেল, দুপুরে ওগুলো দিয়েই হবে সুস্বাদু চিকেন ফ্রাই, হাম্বার্গার বা চিকেন কারি। অতি কষ্ট করে এ রাজধানীতে থেকে যেসব ছেলেমেয়ে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, তারা খাবে ওই হাম্বার্গার বা চিকেন ফ্রাই। আমার ছেলে ও মেয়েও যে খাবে না, তার নিশ্চয়তা কি? আমাদের সরকারের একমাত্র লক্ষ্য অতি দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন। যত বেশিসংখ্যক মানুষ যত দ্রুত অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করতে পারে। চাই টাকা, টাকা আর টাকা। যে যেদিক দিয়ে পারবে টাকা কামাই করবে। মরা মুরগির ব্যাপারীদের প্রশংসাই করতে হয়। দু-তিন বছরেই ২০-৫০ লাখ টাকার মালিক। পৃথিবীর ব্যবসা-বাণিজ্যের ইতিহাসে একটি নতুন সেক্টর খোলার কৃতিত্ব কম নয়। এই সেক্টরে ব্যবসা করে বস্তিবাসী থেকে বিত্তবান হওয়া কম যোগ্যতা নয়। এদেরই তো বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে পরাক্রান্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। তখন বস্তির বেড়ার ঘরে তাদের পক্ষে বাস করা সম্ভব হবে না। হয়ে যাবে বিশেষ মহল্লার স্বঘোষিত নেতা। বাসার সামনে ঝুলবে দলের সাইনবোর্ড, যা দেখলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আর স্পর্শ করার স্পর্ধা দেখাবেন না। একপর্যায়ে তার দরকার পড়বে এক খণ্ড জমি। সে জমি যদি রাজউক থেকে না পাওয়া যায় তো দখলকৃত নদীর পাড়ের খাসজমি হলেও চলবে। উঠবে সেখানে দালান। একতলা,
তারপর দোতলা, তিনতলা বা আরও বেশি। সেসব ঘর ভাড়া দিয়ে টাকা আসবে, তখন আর মরা মুরগির ব্যবসা না করলেও হবে। গণতন্ত্র যখন আছে, তখন নিচের স্থানীয় পর্যায়ে কোথাও নির্বাচনে দাঁড়িয়ে মেম্বারটা হওয়া যাবে। হজ করে নাম হবে আলহাজ খেদামতুল্লাহ মোরগপুরী। তারপর যেকোনো সরকারি দলের স্থায়ী বন্ধু হতে বাধা থাকবে না মোরগপুরীর। দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশ হতে গিয়ে অর্থনৈতিক দিকে জোর দিয়ে জাতির নৈতিক অবস্থানটা ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। তাতে কোনো জাতি দপ্ করে জ্বলে উঠে নিভে যাবে। তা ছাড়া, নিম্নমানের নিকৃষ্ট মানুষের মধ্যম আয়ের দেশ হলেই বা কী লাভ? কোন আয়ের দেশ, তার চেয়ে বড় কথা কোন মানের এবং কেমন চরিত্রের মানুষের দেশ। খাদ্যদ্রব্য ছাড়া মানুষ বাঁচে না। ভেজাল ও দূষিত খাদ্য খেলে সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ মরে না—দ্রুত মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হয়। করাতকলের ভুসি চলে যাচ্ছে মসলার কারখানায়। মেশানো হচ্ছে তা গুঁড়া মসলার সঙ্গে। ইটের গুঁড়া মিশছে হলুদ-মরিচের সঙ্গে। মানুষের পেটে যাচ্ছে। কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ওই সব কারখানায় হানা দিয়ে জেল-জরিমানাও করছেন। ৫০ লাখ টাকা মুনাফা করে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা গুনলে কী যায়-আসে। যেভাবেই টাকা রোজগার হোক না কেন, সমাজে টাকাওয়ালার জোর বেশি। যার টাকা আছে, যত বড় অভিযোগেই সে অভিযুক্ত হোক, রাষ্ট্র তার একটি লোমও ছিঁড়তে পারে না। যত উন্নয়ন তত প্রকল্প। যত প্রকল্প তত টাকা। প্রকল্পের টাকা বরাদ্দটাই বড়, কাজ কিছু হলে তো হলো, না হলে কিছু যায়-আসে না।
কাজ শেষ হওয়ার আগে টাকা তুলে ভাগাভাগি। সরকারি দলের ছাত্র যুব ক্যাডারদের আয়ের উৎস একাধিক। চাঁদাবাজি হলো সবচেয়ে সহজ পথ। একটু ঝুঁকিপূর্ণ বা ঝামেলার হলো টেন্ডারবাজি। চাঁদাবাজি করে হোক বা টেন্ডারবাজি করে হোক, বিত্তবান হলে তার চড়া বাজারদর শুধু হবু শ্বশুরবাড়ির লোকদের কাছে নয়, দলের কাছেও। কারণ, বিত্তবান হওয়ার মধ্যেই যোগ্যতা প্রমাণিত। বিনাশ্রমে বিত্তবান হওয়ায় আরও বেশি করে প্রমাণিত হয় যোগ্যতা। তিন-চার বছরের মধ্যে ডেসটিনির এক কর্তার অজপাড়াগাঁয়ে উঠে গেছে প্রাসাদ। (একটি অট্টালিকা আমাকে দেখিয়েছেন একজন)। উপজেলাজুড়ে অমন সুরম্য অট্টালিকা আর দ্বিতীয়টি নেই। কেউ প্রশ্ন করেনি কোথায় পেলেন টাকা। ১০ বছর আগে তো টিনের ঘর তোলার ক্ষমতা ছিল না। যে দেশের মানুষ মরা মুরগির ব্যবসা করে বড়লোক হতে জানে, সেখানে যেকোনো কিছু নিয়েই ব্যবসা হবে। উপার্জিত হবে অর্থ। মরা মুরগি বিক্রি আর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিক্রির মধ্যে তফাত কী? তফাত হলো মরা মুরগির ব্যবসায়ীদের দু-এক বছর জেল খাটতে হয়, প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের কিছুই হয় না। আর শাস্তি যদি হয়ও, বিজি প্রেসের পিয়ন বা মেশিনম্যানের হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পেছনে তোয়ালে দেওয়া গদিওয়ালা চেয়ারের কর্মকর্তার কিছু হবে না। এই বাংলার মাটিতে ব্যবসাটা হচ্ছে না কী নিয়ে? যারা মরা মুরগির ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন করতে জানে, তারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করবে না কেন? তারা মাদকের ব্যবসা করবে, শিশুদের জন্য কিন্ডারগার্টেন খুলে ব্যবসা করবে, মাদ্রাসা বানিয়ে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করবে, উচ্চশিক্ষার নামে কলেজ-বিদ্যালয় খুলে
No comments