ওষুধশিল্প পার্ক আর কত দূর? by আবুল হাসনাত ও মো. মোমিনুর রহমান
বাংলাদেশও ওষুধশিল্পে উল্লেখযোগ্য সাফল্য
অর্জন করেছে। দুই দশক আগেও এ দেশ ছিল বিদেশি ওষুধের ওপর নির্ভরশীল।
ওষুধশিল্পের মতো সংবেদনশীল শিল্পে আমাদের দেশে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা
বিস্ময়কর। বর্তমানে বাংলাদেশে যেসব ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে তা অভ্যন্তরীণ
চাহিদার শতকরা ৯৭ ভাগ জোগান দেওয়ার পাশাপাশি বিশ্বের ৮০টি দেশে রপ্তানি
হচ্ছে। দেশে উৎপাদিত ওষুধ আফ্রিকা, এশিয়ার বাজার ছাড়িয়ে এখন ইউরোপ-আমেরিকায়
রপ্তানি হওয়ার পথে। ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের ওষুধের
বাজার ধরতে পারলে ২০১৫ সালের মধ্যে পাঁচ বিলিয়ন ডলার বা ৩৫ হাজার কোটি টাকা
আয় করা সম্ভব বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন ওষুধশিল্পের সঙ্গে জড়িত
সংশ্লিষ্টরা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রভাবশালী সাময়িকী ফোর্বস-এ গত ১৬
জানুয়ারি ‘উইন্ডো অন এ ডিফরেন্ট ঢাকা’ শিরোনামে বাংলাদেশে ওষুধশিল্পের
ব্যাপক প্রশংসা করা হয়।
সুখের বার্তায় লুকিয়ে থাকা দুঃখটি হলো, বাংলাদেশের ওষুধের কাঁচামালের প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। প্রয়োজনের মাত্র ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কাঁচামাল তৈরি হচ্ছে স্থানীয়ভাবে, বাকি প্রায় ৭০ শতাংশ আসছে বিদেশ থেকে। যার ফলে আমাদের প্রচুর টাকা দেশের বাইরে চলে যায়। বাংলাদেশে যদি এই কাঁচামাল তৈরি করা যায়, তাহলে দেশের টাকা দেশেই থাকবে। সম্প্রতি এক সেমিনারে জানানো হয়, বর্তমানে বিশ্বে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলারের ওষুধশিল্পের বাজার রয়েছে। বাংলাদেশ যদি বর্তমানে উৎপাদিত ওষুধের সঙ্গে ওষুধের কাঁচামালও উৎপাদন করতে পারে, তবে প্রায় সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা তারও বেশি ওষুধ রপ্তানি করা সম্ভব।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী ২০১৬ সাল থেকে পেটেন্ট ড্রাগ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য রয়্যালটি প্রযোজ্য হবে। এ ক্ষেত্রে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমবিকাশমান ওষুধশিল্পকে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করার জন্য ৯০ শতাংশ আমদানিনির্ভর কাঁচামাল দেশে উৎপাদন করতে হবে। এ লক্ষ্যেই মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার পশ্চিম বাউশিয়া ও লক্ষ্মীপুর মৌজায় প্রায় ২০০ একর জায়গায় ‘অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট’ বা এপিআই শিল্প পার্ক স্থাপনের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়, যেখানে ৪২টি ওষুধশিল্প প্লট করা হবে এবং প্রায় ২৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। ২০০৮ সালের ২২ মে এ প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। ওই সময় ২০০৮ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের সময়সীমা ধরা হয়েছিল এবং ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১৩ কোটি টাকা। পরবর্তীকালে জমি অধিগ্রহণের সময় ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) বরাদ্দের চেয়ে জমির মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০০৯ সালের ১১ অক্টোবর প্রথম দফা প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। এ সময় প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৩৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। এ বর্ধিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনুরোধক্রমে আরও এক বছর অর্থাৎ ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে দেয় পরিকল্পনা কমিশন। কিন্তু এবারও লক্ষ্য পূরণ হয়নি, নানা জটিলতায় মেয়াদ বাড়িয়ে এবার ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত প্রস্তাব করা হয়, সেই সঙ্গে ব্যয়ও ধরা হয় ৩৩১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। ছয় বছর ধরে চলতে থাকা একটা প্রকল্পের মূল কাজ আমরা এখনো শুরুই করতে পারিনি। শুধুু অর্থ ও সময়ের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছে এই ওষুধশিল্প পার্ক। আর এদিকে সময়ও খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, ২০১৬ সালের চ্যালেঞ্জ আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। অথচ অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি ওষুধশিল্প পার্কের জন্য আমাদের তৈরি করতে হবে ওষুধসংশ্লিষ্ট দক্ষ জনশক্তি।
কারণ, ওষুধশিল্প আর দশটা শিল্পের মতো নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের জীবন-মরণ সম্পর্ক। কাঁচামাল তৈরির এই উদ্যোগের পাশাপাশি নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কারে আমাদের মৌলিক গবেষণার দিকেও নজর দেওয়া খুব প্রয়োজন। এখন আমাদের নিজেদের পেটেন্ট ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রেও গভীর মনোযোগ দিতে হবে। অন্যদিকে সমগ্র বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৪৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ভেষজ ওষুধের চাহিদা রয়েছে। সুতরাং অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের পাশাপাশি এই পার্ক থেকে কাঁচামালসহ কীভাবে ভেষজ ওষুধ তৈরি করা যায়, সেদিকে আমাদের লক্ষ করা উচিত। ওষুধশিল্প পার্কের অগ্রযাত্রার সঙ্গে উন্নত বিশ্বের মতো, শিল্পের সঙ্গে শিক্ষার যুগপৎ সেতুবন্ধ তৈরি করতে হবে।
দেশে গার্মেন্টসসহ অন্যান্য শিল্প যখন হুমকির সম্মুখীন, ওষুধশিল্প তখন শক্তিশালী অবস্থানে। তাই দ্রুত বর্ধনশীল, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং সেবামূলক এই শিল্পকে গুণে ও মানে এমন পর্যায়ে নিতে হবে, যেন অন্তত ওষুধশিল্পে বাংলাদেশ থাকে সামনের সারিতে। আর কালক্ষেপণ না করে উন্নত সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ওষুধশিল্প পার্ক প্রতিষ্ঠা জরুরি হয়ে পড়েছে।
আবুল হাসনাত: অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মো. মোমিনুর রহমান: সহকারী অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, আইআইইউসি।
No comments