কুষ্টিয়ার রাজনীতি- নির্বাচন হবেই! নির্বাচন ঠেকিয়ে দেব! by সোহরাব হাসান

২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে কুষ্টিয়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজগঞ্জ থেকে কর্মস্থলে আসছিলেন। হঠাৎ অজ্ঞাত নম্বর থেকে একটি ফোন এল।
বলল, ‘আপনি আমার অনেক ক্ষতি করেছেন। আর ক্ষতি করার চেষ্টা করবেন না। করলে আপনার লাশও খুঁজে পাওয়া যাবে না।’

ওসি জানতে চাইলেন, কে বলছেন। ও প্রান্ত থেকে উত্তর এল। শাহীন। তিনি বুঝতে পারলেন, চরমপন্থী দল শ্রমজীবী গণমুক্তি আন্দোলনের মানিকজোড়ের একজন শাহীন। অপরজন মুকুল। তাঁদের নামে কুষ্টিয়াজুড়ে আতঙ্ক। তাঁরা জেলার সব টেন্ডারে ভাগ বসান। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করেন। না দিলে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি গুম হয়ে যান কিংবা রাস্তায় লাশ পড়ে থাকেন।
ওসি মনে সাহস সঞ্চয় করে বললেন, ‘যেদিন পুলিশের পোশাক পরেছি, সেদিন থেকেই মরার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। যেকোনো সময় মারা যেতে পারি। তবে শাহীন, আপনাকেও বলে রাখছি, আপনি পালিয়ে থাকলেও আপনার মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন কিন্তু আমার এলাকাতেই আছে। কয়েক দিন পর নির্বাচন। সে সময়ে কোনো অঘটন ঘটানোর চেষ্টা করবেন না। করলে বিপদ আছে।’
এরপর শাহীন নরম হলেন। বললেন, ‘ওসি সাব, আপনাকে আগামীকাল জানাই।’ পরদিন বাবুল সরদারের কাছে আরেকটি টেলিফোন এল। এবারের ফোনদাতা মুকুল। বললেন, ‘ঠিক আছে। আপনার এলাকায় কোনো অঘটন ঘটবে না।’
স্বাধীনতার পর থেকেই কুষ্টিয়া সন্ত্রাসের জনপদ। কুমারখালীর সাবেক সাংসদ গোলাম কিবরিয়াকে ঈদের জামাতে গুলি করে হত্যা করে চরমপন্থীরা। সেই থেকে চরমপন্থীদের হাতে এ পর্যন্ত কত লোক মারা গেছে, তার হিসাব নেই। আবার চরমপন্থী ধরার নামে অনেক নিরপরাধ মানুষও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে প্রাণ দিয়েছে। হত্যা কেবল হত্যাই ডেকে আনে।
সামান্য ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও যেখানে পাঁচ-দশটা লাশ পড়ে, সেখানে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে কুষ্টিয়ায় কেউ খুন হয়নি। এর কৃতিত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের। কিন্তু ২০০৯ সালের আগস্ট মাসের একটি ঘটনা পুরো কুষ্টিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের একটি দরপত্র ডাকার পর সার্কিট হাউসের সামনে তিনটি লাশ ফেলে রেখে যায় চরমপন্থীরা। এর মাধ্যমে তারা বুঝিয়ে দেয় যে তাদের পছন্দসই ব্যক্তি ছাড়া কেউ দরপত্র কিনতে পারবে না। এরপরই এসপি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চলে। কয়েক দিনের মধ্যে ২০-২২ জন চরমপন্থী ক্রসফায়ারে নিহত হয়। দলনেতা শাহীন ও মুকুল ভারতে পালিয়ে যান। কুষ্টিয়াবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
সে সময় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রতি মাসে কমিউনিটি কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হতো। এলাকাবাসীর কাছে জানতে চাওয়া হতো কেউ সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে কি না, কোনো পুলিশ সদস্য উৎকোচ দাবি করেছেন কি না; এলাকাবাসী তাদের অভিযোগ জানাবে। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিকারও পেয়েছে।
কুষ্টিয়ার সব কটি উপজেলাই একসময় সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি ছিল। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দৌলতপুরে জনসভা করতে গিয়ে মারা যান কাজী আরেফ আহমেদ। চরমপন্থীদের আত্মসমর্পণ করিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। ফলে চরমপন্থীদের রোষানলে পড়েন। চরমপন্থীদের তৎপরতা এখনো পুরো বন্ধ হয়নি। কয়েক মাস আগে ঢাকার বঙ্গবাজারে ব্যবসায়ী নেতা রফিকুল ইসলামও খুন হন এই চরমপন্থীদের হাতে। পারিবারিক বিরোধকে কেন্দ্র করেই এই হত্যাকাণ্ড। এ রকম ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক স্বার্থে অনেকেই চরমপন্থীদের ব্যবহার করেছেন, করছেন।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য গত ২৮ আগস্ট দুপুরে কুষ্টিয়ায় পৌঁছাই। ওই দিন সন্ধ্যায়ই প্রথম আলোর কুষ্টিয়া প্রতিনিধি তৌহিদী হাসানকে সঙ্গে নিয়ে জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সাংসদ সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমির সঙ্গে আলাপ করি। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, অতীতে কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সদ্ভাব থাকলেও বর্তমান সরকারের আমলে তা নষ্ট হয়ে যায় ক্ষমতাসীনদের হামলা ও মামলার কারণে। মাস কয়েক আগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মীদের সংঘর্ষের জের ধরে বিএনপির অফিস ভাঙচুর করা হয়। সাবেক দুই সাংসদসহ নেতাদের বিরুদ্ধে গাড়ি পোড়ানো ও ভাঙচুরের মামলা হয়। ৬০ থেকে ৭০ জন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। অনেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে এলেও ১০-১২ জন এখনো জেলে আছেন। মামলা হয়েছে ৪০০ জনের বিরুদ্ধে।
জামায়াতের অবস্থা কী?
রুমি বললেন, ‘এখানে জামায়াতে ইসলামীর তেমন তৎপরতা নেই। আমরা বলেছি, তোমরা এলে বেশি সমস্যা হয়। সে কারণে ১৮ দলের কর্মসূচিতে তাদের উপস্থিতি কম।’ আলাপের সময় রুমির কক্ষে অনেক নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের কাছে জানতে চাইলাম, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কুষ্টিয়ায় কী কী কাজ হয়েছে। তাঁদের জবাব, কোনো কাজই হয়নি। কুষ্টিয়াবাসীর প্রধান দাবি ছিল বাইপাস সড়ক ও হরিপুর সেতু। কিন্তু এর একটিও হয়নি। তাঁরা আরও যোগ করলেন, হ্যাঁ, একটিই উন্নতি হয়েছে, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ যখনই কুষ্টিয়ায় আসেন, কোনো না কোনো ফলক উন্মোচন করেন। কমপক্ষে ২০০ ফলক আছে তাঁর নামে।
তবে বিএনপির নেতা-কর্মীরাও স্বীকার করলেন, বর্তমান সরকারের আমলে চরমপন্থীদের তৎপরতা কমেছে।
রাতে কথা হয় আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রবিউল ইসলামের সঙ্গে। বিএনপির দাবি নাকচ করে দিয়ে তিনি বললেন, সরকার এখানে নির্বাচনী ওয়াদার প্রায় সবই পূরণ করেছে। সন্ত্রাসের জনপদ কুষ্টিয়া শান্তির জনপদে পরিণত হয়েছে। কুষ্টিয়ায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিএনপির আমলে যেটি জোর করে চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ ফরিদপুরে নিয়ে গিয়েছিলেন। ভাড়াবাড়িতে মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষ চলছে। নিজস্ব ভবনও নির্মিত হচ্ছে। হরিপুর সেতু ও বাইপাসের কাজের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
কুষ্টিয়ার একজন সাংবাদিক বন্ধু জানালেন, এই সেতু না হওয়ায় হরিপুরের লক্ষাধিক মানুষ প্রায় বিচ্ছিন্ন। প্রতিদিন প্রায় ৩০ হাজার লোক নদী পার হয়ে নানা কাজে শহরে আসেন। তাঁরা না এলে কুষ্টিয়ায় হরতাল হয়ে যায়। নির্বাচনের আগে দুই দলই সেতু করার ওয়াদা করে। কিন্তু বাস্তবায়ন করে না।
কুষ্টিয়ায় সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও মাঠপর্যায়ে দুই দলই তৎপর। আওয়ামী লীগের নেতারা গণসংযোগ কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত। আর বিভিন্ন উপলক্ষে বিএনপি সভা-সমাবেশ করে চলেছে। আবার নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় কোন্দলও বেড়েছে।
আগামী নির্বাচনে কুষ্টিয়ার চারটি আসনের ফল কী হতে পারে? জবাবে বিএনপির নেতারা জোর দিয়ে বলেছেন, কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগ একটি আসনও পাবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের এক নেতা বললেন, অন্তত দুটিতে তাঁরাই জিতবেন। দুই দলেই প্রার্থিতা নিয়ে চলছে গ্রুপিং-লবিং। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগেই সমস্যা বেশি। দৌলতপুরে বর্তমান সাংসদ আফাজউদ্দিন আহমদ বদনাম করেছেন ছেলেদের নানা অপকর্মের জন্য। ছেলেরা শুরু থেকেই টেন্ডারবাজি ও দখলবাজিতে ব্যস্ত আছে। সদর আসনের সাংসদ খন্দকার রশীদুজ্জামান গুরুতর অসুস্থ। ঢাকায় থাকেন। তিনি নাকি মোটা অঙ্কের চাঁদা দিয়ে মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছিলেন। নির্বাচনের পর মাত্র তিন-চারবার এলাকায় এসেছেন। অসুস্থতার সুযোগে তাঁর স্ত্রী ও সহযোগীরাই কাবিটা ও কাবিখার অর্থ বণ্টন করেন। এ নিয়েও প্রচুর অভিযোগ রয়েছে।
এ আসনে বিএনপির শক্ত প্রার্থী সাবেক সাংসদ সোহরাব উদ্দিন, মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি। তবে জাকির হোসেন নামের একজন তারেক রহমানের আশীর্বাদ নিয়ে সম্প্রতি মাঠে নেমেছেন। এ দুজনের যে-ই মনোনয়ন পান না কেন, তাঁকে মোকাবিলা করার মতো প্রার্থী আওয়ামী লীগে নেই। তবে সমর্থকদের কেউ কেউ আমীর-উল ইসলামের কথা বলছেন। ২০০৭ সালে তিনি দলের মনোনয়ন পেলেও এক-এগারোর পরিবর্তন সবকিছু ওলটপালট করে দেয়। ভাগ্য খুলে যায় রশীদুজ্জামানের।
কুষ্টিয়া-২ আসনে ১৪ দলের প্রার্থী তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশ চায় মাহবুব উল আলম হানিফ প্রার্থী হোন। এ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম। তাঁর বিরোধী গ্রুপও কম তৎপর নয়। কুষ্টিয়া-৪ আসনের প্রার্থিতা নিয়ে দুই দলেই বিরোধ প্রকট। আওয়ামী লীগের সাংসদ সুলতানা তরুণের বিপরীতে সদরউদ্দিন খান মনোনয়ন পেতে আগ্রহী। তিনি দলের জাতীয় পরিষদের সদস্য ও খোকসা উপজেলার চেয়ারম্যান। আর বিএনপির রুমীর বিপরীতে নূরুল হক আনসার শক্ত প্রার্থী। তাঁর পক্ষে জামায়াতের জোরালো সমর্থন আছে বলেও জানা গেছে।
কুষ্টিয়ায় দুই দলের উপদলীয় কোন্দল সম্পর্কে বিএনপির এক নেতার মন্তব্যটি বেশ মজার। তিনি বলেছেন, ‘যখন ওয়াজ-নসিহত হয়, তখন সবাই মনোযোগ দিয়ে শোনে। কিন্তু ওয়াজ শেষে শিরনি দিলেই কে আগে নেবে, তা নিয়ে মারামারি শুরু হয়ে যায়।’
আগামী নির্বাচন নিয়ে এ মারামারির ঘটনা যে হরদম ঘটে চলেছে, গতকাল প্রথম আলোর প্রথম পাতার দুটি ছবিই তার প্রমাণ। ওপরের ছবিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপকে ধারালো অস্ত্র হাতে মহড়া দিতে দেখা যাচ্ছে, আর নিচের ছবিতে রাজশাহীতে বিএনপির দুই গ্রুপ হাতাহাতিতে লিপ্ত। এটাই হলো দুই বড় দলের গণতন্ত্র চর্চার নমুনা।
নির্বাচন কীভাবে হবে? এর জবাবে কুষ্টিয়ার আওয়ামী লীগের নেতারা কেন্দ্রীয় নেতাদের সুরেই বলছেন, ‘নির্বাচন হবেই এবং বিএনপি না এলেও নির্বাচন হবে।’ জিজ্ঞেস করলাম, বিএনপি যদি নির্বাচন করতে না দেয়? জবাব এল, ‘ওরা পারবে না। নির্বাচন ঠেকানোর শক্তি ওদের নেই। জামায়াত-হেফাজতকে নিয়ে যেহেতু তারা আন্দোলন করছে, সেহেতু জনগণও তাদের ডাকে সাড়া দেবে না।’
তবে কুষ্টিয়ার বিএনপির নেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের দাবি, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়েই সরকারকে নির্বাচন দিতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। বিএনপি বা ১৮ দলকে বাদ দিয়ে একতরফা নির্বাচন করতে চাইলে আমরা ঠেকাব। সেই নির্বাচন করতে দেব না।’
আগামীকাল: মোহিনী মিল, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় না আত্মঘাতী বাঙালি?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.