জাতিসংঘ মহাসচিব, চীনা রাষ্ট্রদূত এবং দেশের রাজনীতি by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
পাহাড়সম
অনিশ্চয়তার মধ্যে আকস্মিক এক ফোনালাপে রাজনীতির গতিপথ বদলে দিয়েছেন
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। দেশের চলমান অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও
আগামীতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে দুই শীর্ষ নেত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন
তিনি। বান কি মুনের এই উদ্যোগ আশান্বিত করেছে মানুষকে। অন্যদিকে
বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম চলমান রাজনীতি নিয়ে সরাসরি কথা বলেছে চীন।
চীনের রাষ্ট্রদূত সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া অপরিহার্য। এ লক্ষ্যে তিনি দুই
শীর্ষ নেত্রীকে সংলাপ শুরুর তাগিদ দিয়েছেন। ঈদের পর নির্বাচনকালীন সরকার
ইস্যুতে বিরোধী দল চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার কথা থাকলেও কৌশলগত কারণে
কর্মসূচি দেয়ার ক্ষেত্রে তারা অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। এর সুফলও
তারা পেয়েছেন। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সরকার যে চাপের মধ্যে পড়েছে-
বিএনপি জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে গেলে এর বিপরীতটা হতো। উল্টো বিএনপি চাপের
মধ্যে পড়ত। এ মুহূর্তে কঠোর আন্দোলনে না গিয়ে বিরোধী জোট রাজনীতিতে একধাপ
এগিয়ে গেছে। আগামীতে ভোটের রাজনীতিতে তারা এর ফল পাবে বলে রাজনৈতিক
বিশ্লেষকরা মনে করেন। বিরোধী দলের কৌশল যে কোনোভাবে দেশকে নির্বাচনমুখী
করা। নির্বাচনী রাজনীতিতে তাদের নেতাকর্মীরা উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত।
অন্যদিকে নির্বাচনের নাম শুনলেই যেন ক্ষমতাসীন দলের পরাজয়ের ভীতি পেয়ে বসে। তারা হয়তো মনে করছেন, নির্বাচন মানেই তাদের পরাজয় আর বিএনপির জয়। তাই ঈদের পর ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসহ কিছু জায়গায় পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও তা হবে না বলেই মনে হয়। পরাজয়ের ভীতি থেকেই তারা স্থানীয় নির্বাচন থেকে সরে এসেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনও কৌশলে বানচাল করার চেষ্টা চলছে বলে অনেকে মনে করেন। আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিমের কথায়ও নির্বাচন না হওয়ার ইঙ্গিত প্রকাশ পেয়েছে। তিনি অহরহ বলছেন, নির্বাচন না হলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই দেশ চালাবেন।
প্রশ্ন হল, নির্বাচন হবে না কেন? প্রধানমন্ত্রীও মেয়াদ শেষে আবার ক্ষমতায় থাকবেন কেন? উত্তর সহজ- ক্ষমতাসীন দল যে কোনো উপায়ে নির্বাচন বানচাল করে, পঞ্চদশ সংশোধনীর সুযোগ নিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায়। সে হিসেবে দেশে অস্থিরতা ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হয় এমন কোনো কর্মসূচি না দিয়ে বিএনপি নিঃসন্দেহে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। আর কঠোর কর্মসূচি না দেয়ায় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, আন্দোলন করার শক্তি নাকি বিএনপির নেই। বিএনপির আন্দোলনের শক্তি সরকার খোঁজে কেন? বিএনপি কখন আন্দোলন করবে, না করবে এটি তাদের রাজনৈতিক কৌশল। এ নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা কেন? ব্যথা এ জন্য যে, সরকার চায় দেশে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন হোক। পানি ঘোলা হোক। নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় থাকার প্রেক্ষাপট তৈরি হোক।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে চীনের রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক মন্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। চীন হয়তো মনে করছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর আঞ্চলিক নিরাপত্তার সম্পর্ক জড়িত। আগামীতে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন না হলে বাংলাদেশে একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিসহ আমদানি-রফতানির গতি মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হতে পারে। তাতে বাংলাদেশ যেমন ক্ষতির সম্মুখীন হবে, তেমনি ক্ষতির সম্মুখীন হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও। এমনটি হলে রফতানিমুখী দেশ হিসেবে চীনের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে; অনিবার্য ক্ষতির মুখে পড়তে পারে চীন। তাই চীন চাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি বজায় থাকুক। বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।
চীনের পরই জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে সরাসরি কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে। উদ্দেশ্য বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। বাংলাদেশের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবের আগ্রহ সবার নজর কেড়েছে। বান কি মুন এদেশের মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বুঝতে পেরেছেন। তার এই উদ্যোগ বাংলাদেশের অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তরণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে- এতে সন্দেহ নেই। এরই মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতিসংঘ মহাসচিবের ভূমিকার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। রাজনৈতিক সমঝোতার একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে এর বাস্তব প্রতিফলন মানুষ দেখতে পাবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
একজন এশিয়ান হিসেবে জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশকে দেখছেন ভবিষ্যতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে। তার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ হয়তো বিশ্ব পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্তিরতার প্রভাব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গোটা বিশ্বকেই আচ্ছন্ন করতে পারে। তাই বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা গুরুদায়িত্ব হিসেবে মনে করছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। সেই দায়িত্ববোধ থেকেই তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন এবং দুই নেত্রীকে ফোন করেছেন। শোনা যাচ্ছে, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে তিনি আরও বাস্তবধর্মী উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন। যাতে সব দলের অংশগ্রহণে একটি পক্ষপাতহীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
বিরোধী দলের উচিত এ জন্য দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা এবং কঠোর কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে বিরত থাকা। কথা ছিল ঈদের পর বিরোধী জোট রাজপথ উত্তপ্ত করতে কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে। যদি বাস্তবে এমনটি হতো, তাহলে এর বেনিফিশিয়ারি হতো নিঃসন্দেহে সরকারি দল। এখন তারা যে চাপের মধ্যে আছে, তখন এই চাপ সহ্য করতে হতো বিরোধী জোটকে। ফলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ইস্যুতে চীনও এগিয়ে আসত না, জাতিসংঘও এগিয়ে আসত না। ফলে সরকার একটা ফুরফুরে মেজাজে থাকত; তারা কোনো চাপ অনুভব করত না। এসব বিষয় মাথায় রেখেই বিরোধী জোটকে কৌশলে এগুতে হবে। কোনো হটকারী কাজ করা মোটেও সমীচীন হবে না।
সংবিধান পাঁচ বছরের বেশি কোনো সংসদ বহাল থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হলে পরবর্তী সময়ে বহাল থাকা সংসদ যদি সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতিতে ফিরে যায়, তাহলে কী হবে? নির্বাচিত এমপিদের সংবিধান অনুযায়ী কি কোনো করণীয় থাকবে? এসব জটিল প্রশ্ন মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। ফলে সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে নৈতিকভাবে চাপের মধ্যে আছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর অসঙ্গতিগুলো ক্ষমতাসীন দলের এমপিদের মুখেও প্রকাশ পাচ্ছে। এতে সরকার উভয় সংকটে পড়েছে। এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে তারা এখন পথ খুঁজছে। এ পথ করে দিতে পারে বিরোধী জোটের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন। তাই জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে সরকার উসকানি দিচ্ছে। বিএনপির আন্দোলনের শক্তি-সামর্থ্য নেই বলে মন্তব্য করছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি রাজনৈতিক দলকে জনগণের ভোটে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসতে হলে যে রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে হয়- নির্দ্বিধায় বলা যায়, বর্তমান শাসকদল তা তৈরি করতে পারেনি। কাজেই জনগণের ভোটে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের আবার সরকারে আসার চিন্তা অবান্তর। বরং যেনতেনভাবে সরকারে আসার চিন্তা বাদ দিয়ে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের অবস্থান যদি শাসক দল আগামীতে নিশ্চিত করতে পারে; এটি তাদের জন্য হবে অনেক পাওয়া। জনগণ তাদের পাঁচ বছর পর হয়তো আবার ক্ষমতায় আনবে। সুতরাং এখনও যে সময়টুকু ক্ষমতাসীন দলের হাতে আছে, তার সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হবে। রাজনৈতিক সংকট সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। সরকারকে অনুধাবন করতে হবে, জনগণ যদি জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ-আতংক ও দুশ্চিন্তায় ভোগেন, তাহলে মানুষের কাছে তারা আরও অজনপ্রিয় হয়ে উঠবে। তাদের সব সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। মানুষ মনে করে, দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অব্যাহত রাখার বিষয়টি এখন সর্বতোভাবে বর্তমান সরকারের ওপরই নির্ভর করছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে পক্ষপাতহীন নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি দেশও এক অনিবার্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে দেশে গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থা ব্যাহত হবে। আর এই সমঝোতার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারকেই।
বিএনপি উদার গণতান্ত্রিক পরিচয়ের ধারক একটি রাজনৈতিক দল। জিয়াউর রহমান উদার নীতিতে বিএনপির জন্ম দিয়ে খুব অল্প সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। উদার নীতির কারণেই বাংলাদেশের মানুষ বারবার ভোট দিয়ে বিএনপিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিএনপি পাঁচবার সরকার গঠন করেছে। উপমহাদেশের রাজনীতিতে এটা একটা রেকর্ড বলা যায়। কাজেই উগ্র ও জ্বালাও-পোড়াও পথে নয়, উদার গণতান্ত্রিক পরিচয়েই বিএনপির পথচলা সমীচীন।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
অন্যদিকে নির্বাচনের নাম শুনলেই যেন ক্ষমতাসীন দলের পরাজয়ের ভীতি পেয়ে বসে। তারা হয়তো মনে করছেন, নির্বাচন মানেই তাদের পরাজয় আর বিএনপির জয়। তাই ঈদের পর ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসহ কিছু জায়গায় পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও তা হবে না বলেই মনে হয়। পরাজয়ের ভীতি থেকেই তারা স্থানীয় নির্বাচন থেকে সরে এসেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনও কৌশলে বানচাল করার চেষ্টা চলছে বলে অনেকে মনে করেন। আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিমের কথায়ও নির্বাচন না হওয়ার ইঙ্গিত প্রকাশ পেয়েছে। তিনি অহরহ বলছেন, নির্বাচন না হলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই দেশ চালাবেন।
প্রশ্ন হল, নির্বাচন হবে না কেন? প্রধানমন্ত্রীও মেয়াদ শেষে আবার ক্ষমতায় থাকবেন কেন? উত্তর সহজ- ক্ষমতাসীন দল যে কোনো উপায়ে নির্বাচন বানচাল করে, পঞ্চদশ সংশোধনীর সুযোগ নিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায়। সে হিসেবে দেশে অস্থিরতা ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হয় এমন কোনো কর্মসূচি না দিয়ে বিএনপি নিঃসন্দেহে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। আর কঠোর কর্মসূচি না দেয়ায় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, আন্দোলন করার শক্তি নাকি বিএনপির নেই। বিএনপির আন্দোলনের শক্তি সরকার খোঁজে কেন? বিএনপি কখন আন্দোলন করবে, না করবে এটি তাদের রাজনৈতিক কৌশল। এ নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা কেন? ব্যথা এ জন্য যে, সরকার চায় দেশে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন হোক। পানি ঘোলা হোক। নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় থাকার প্রেক্ষাপট তৈরি হোক।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে চীনের রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক মন্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। চীন হয়তো মনে করছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর আঞ্চলিক নিরাপত্তার সম্পর্ক জড়িত। আগামীতে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন না হলে বাংলাদেশে একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিসহ আমদানি-রফতানির গতি মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হতে পারে। তাতে বাংলাদেশ যেমন ক্ষতির সম্মুখীন হবে, তেমনি ক্ষতির সম্মুখীন হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও। এমনটি হলে রফতানিমুখী দেশ হিসেবে চীনের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে; অনিবার্য ক্ষতির মুখে পড়তে পারে চীন। তাই চীন চাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি বজায় থাকুক। বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।
চীনের পরই জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে সরাসরি কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে। উদ্দেশ্য বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। বাংলাদেশের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবের আগ্রহ সবার নজর কেড়েছে। বান কি মুন এদেশের মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বুঝতে পেরেছেন। তার এই উদ্যোগ বাংলাদেশের অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তরণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে- এতে সন্দেহ নেই। এরই মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতিসংঘ মহাসচিবের ভূমিকার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। রাজনৈতিক সমঝোতার একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে এর বাস্তব প্রতিফলন মানুষ দেখতে পাবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
একজন এশিয়ান হিসেবে জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশকে দেখছেন ভবিষ্যতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে। তার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ হয়তো বিশ্ব পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্তিরতার প্রভাব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গোটা বিশ্বকেই আচ্ছন্ন করতে পারে। তাই বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা গুরুদায়িত্ব হিসেবে মনে করছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। সেই দায়িত্ববোধ থেকেই তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন এবং দুই নেত্রীকে ফোন করেছেন। শোনা যাচ্ছে, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে তিনি আরও বাস্তবধর্মী উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন। যাতে সব দলের অংশগ্রহণে একটি পক্ষপাতহীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
বিরোধী দলের উচিত এ জন্য দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা এবং কঠোর কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে বিরত থাকা। কথা ছিল ঈদের পর বিরোধী জোট রাজপথ উত্তপ্ত করতে কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে। যদি বাস্তবে এমনটি হতো, তাহলে এর বেনিফিশিয়ারি হতো নিঃসন্দেহে সরকারি দল। এখন তারা যে চাপের মধ্যে আছে, তখন এই চাপ সহ্য করতে হতো বিরোধী জোটকে। ফলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ইস্যুতে চীনও এগিয়ে আসত না, জাতিসংঘও এগিয়ে আসত না। ফলে সরকার একটা ফুরফুরে মেজাজে থাকত; তারা কোনো চাপ অনুভব করত না। এসব বিষয় মাথায় রেখেই বিরোধী জোটকে কৌশলে এগুতে হবে। কোনো হটকারী কাজ করা মোটেও সমীচীন হবে না।
সংবিধান পাঁচ বছরের বেশি কোনো সংসদ বহাল থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হলে পরবর্তী সময়ে বহাল থাকা সংসদ যদি সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতিতে ফিরে যায়, তাহলে কী হবে? নির্বাচিত এমপিদের সংবিধান অনুযায়ী কি কোনো করণীয় থাকবে? এসব জটিল প্রশ্ন মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। ফলে সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে নৈতিকভাবে চাপের মধ্যে আছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর অসঙ্গতিগুলো ক্ষমতাসীন দলের এমপিদের মুখেও প্রকাশ পাচ্ছে। এতে সরকার উভয় সংকটে পড়েছে। এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে তারা এখন পথ খুঁজছে। এ পথ করে দিতে পারে বিরোধী জোটের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন। তাই জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে সরকার উসকানি দিচ্ছে। বিএনপির আন্দোলনের শক্তি-সামর্থ্য নেই বলে মন্তব্য করছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি রাজনৈতিক দলকে জনগণের ভোটে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসতে হলে যে রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে হয়- নির্দ্বিধায় বলা যায়, বর্তমান শাসকদল তা তৈরি করতে পারেনি। কাজেই জনগণের ভোটে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের আবার সরকারে আসার চিন্তা অবান্তর। বরং যেনতেনভাবে সরকারে আসার চিন্তা বাদ দিয়ে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের অবস্থান যদি শাসক দল আগামীতে নিশ্চিত করতে পারে; এটি তাদের জন্য হবে অনেক পাওয়া। জনগণ তাদের পাঁচ বছর পর হয়তো আবার ক্ষমতায় আনবে। সুতরাং এখনও যে সময়টুকু ক্ষমতাসীন দলের হাতে আছে, তার সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হবে। রাজনৈতিক সংকট সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। সরকারকে অনুধাবন করতে হবে, জনগণ যদি জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ-আতংক ও দুশ্চিন্তায় ভোগেন, তাহলে মানুষের কাছে তারা আরও অজনপ্রিয় হয়ে উঠবে। তাদের সব সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। মানুষ মনে করে, দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অব্যাহত রাখার বিষয়টি এখন সর্বতোভাবে বর্তমান সরকারের ওপরই নির্ভর করছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে পক্ষপাতহীন নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি দেশও এক অনিবার্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে দেশে গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থা ব্যাহত হবে। আর এই সমঝোতার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারকেই।
বিএনপি উদার গণতান্ত্রিক পরিচয়ের ধারক একটি রাজনৈতিক দল। জিয়াউর রহমান উদার নীতিতে বিএনপির জন্ম দিয়ে খুব অল্প সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। উদার নীতির কারণেই বাংলাদেশের মানুষ বারবার ভোট দিয়ে বিএনপিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিএনপি পাঁচবার সরকার গঠন করেছে। উপমহাদেশের রাজনীতিতে এটা একটা রেকর্ড বলা যায়। কাজেই উগ্র ও জ্বালাও-পোড়াও পথে নয়, উদার গণতান্ত্রিক পরিচয়েই বিএনপির পথচলা সমীচীন।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments