গুজবের ঘুড়ি এবং রাজনীতির বাস্তবতা by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বাংলাদেশ
এখন গুজবে গুজবে সয়লাব। আগস্ট মাসের গোটা দুই সপ্তাহ ঢাকায় কাটিয়ে এসেছি।
তখনও নানা গুজব কানে এসেছে। কোনটা সঠিক, কোনটা বেঠিক, তা নির্ণয় করা
মুশকিল। বর্তমানে যেমন আমাদের রাজনীতিতে, তেমনি সাংবাদিকতায়ও হলুদের ছাপ
বেশি। ব্রডশিট জাতীয় দৈনিক আর হলুদ ছুপানো ট্যাবলয়েড-মার্কা পত্রিকার মধ্যে
অনেক সময় পার্থক্য খুব কম চোখে পড়ে। গুজবগুলোর মূল কেন্দ্র এখন জাতীয়
পার্টি ও ঢাকার ইউনূস সেন্টার। আমি তখন ঢাকায়। খবর রটে গেল, ড. ইউনূসকে
প্রধান করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে। তাতে ড. কামাল হোসেন, ড.
বদরুদ্দোজা চৌধুরী প্রমুখ থাকবেন। এরপর ১৮ আগস্ট রোববার ঢাকা থেকে লন্ডনে
এসে পৌঁছতে না পৌঁছতে শুনলাম, ঢাকার বাজারে রটে গেছে, বিএনপি নেত্রী
জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে একটি প্রস্তাব দিয়েছেন।
প্রস্তাবটি হল, জে. এরশাদ বিএনপি জোটে যোগ দিলে এবং আগামী নির্বাচনে জোট
জয়ী হলে তিনি রাষ্ট্রপতি হবেন। নির্বাচনে ৭০টি আসন তার দলকে ছেড়ে দেয়া হবে
এবং মন্ত্রিসভায় তার দল ১০টি আসন পাবে।
একেবারে বিশ্বাস করার মতো খবর। সারাদিন টেলিফোনে খোঁজখবর নিলাম। ঢাকায় কাগজগুলো দেখলাম। কিন্তু এই খবর যে সঠিক তার কোনো প্রমাণ পেলাম না। বুঝলাম, দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চলছে। সেই সুযোগে গুজবের ঘুড়ি ওড়ানো হচ্ছে। জেনারেল এরশাদের সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে যাওয়া নিয়েও গুজব ছড়ানো হয়েছে। বলা হয়েছে, সিঙ্গাপুরে যাওয়ার আগে অথবা পরে এরশাদ সাহেব টেলিফোনে বেগম জিয়ার সঙ্গে কুড়ি মিনিট কথা বলেছেন। কী বলেছেন তার কোনো হদিস নেই।
আমাদের নতুন রাষ্ট্রপতিও সিঙ্গাপুর গেছেন। তা নিয়েও নানা গুজব। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর আবদুল হামিদ সাহেব ঘনঘন সিঙ্গাপুরে যাচ্ছেন। অনেকে বলেন, ছোটখাটো রোগে চিকিৎসার জন্যও কি বাংলাদেশে ভালো চিকিৎসক নেই? জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন প্রয়াত ডা. নুরুল ইসলাম। তিনিই বঙ্গবন্ধুর চিকিৎসা করতেন। বড় ধরনের সার্জারি ছাড়া বঙ্গবন্ধুকে তো কখনও চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতে হয়নি। এখন কথায় কথায় চিকিৎসার নামে সিঙ্গাপুর, ব্যাংককে যাওয়ার ধুম পড়ে গেছে। বর্তমান রাষ্ট্রপতির চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যাওয়া নিয়েও রাজনৈতিক গুজব কানে এসেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন একটা অস্থিরতা চলছে। এই অস্থিরতা সৃষ্টির পেছনে গুজবের একটা অবদান রয়েছে। রাজনীতিতে সুস্থতা ও স্থিরতা ফিরিয়ে আনতে হলে গুজবের ধূম্রজাল থেকে দেশকে মুক্ত করা প্রয়োজন। কিন্তু কে তা করবেন? আমাদের প্রিন্টিং অথবা ইলেকট্রনিক মিডিয়া? এই মিডিয়ার একটা বড় অংশ তো নিজেরাই গুজব ছড়ানোর কাজে ব্যস্ত। এটাই তাদের ব্যবসা। দেশে এখন একশ্রেণীর হলুদ সাংবাদিকের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রকৃত সাংবাদিকদের মতো তাদের একই মর্যাদা। সংবাদপত্রের কলাম, টেলি টকশোতে তাদের প্রাধান্য বেশি। অর্থাৎ আমাদের সাংবাদিকতায় মুড়ি ও মুড়কির এখন এক দাম। এ অবস্থা থেকে দেশ মুক্ত না হলে সমাজ বা রাজনীতিতে নীতি-নৈতিকতা কখনও ফিরে আসবে না।
জেনারেল এরশাদ এবং ড. ইউনূসকে নিয়ে সত্য-মিথ্যা খবর রটানো হলুদ সাংবাদিকতায় যে লাভজনক ব্যবসা হয়ে উঠেছে, তার একটা বড় কারণ সম্ভবত দেশের বহমান রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির ওপর অনেকেই আস্থা হারিয়েছেন। বহমান রাজনীতির এই গোলকধাঁধা থেকে বেরোনোর কোনো পথও তারা দেখছেন না। তখন তারা ভাবেন, জে. এরশাদ কিংবা ড. ইউনূসই সম্ভবত তাদের ত্রাতা হতে পারবেন। হতাশ মনের এই ক্ষোভকেই পুঁজি করে হলুদ সাংবাদিকরা তাদের গুজবের ব্যবসাকে জমজমাট করে তুলেছেন। জে. এরশাদ বা ড. ইউনূস কী করতে পারেন বা কী করতে পারবেন তা খতিয়ে দেখার কাজটি এই হলুদ সাংবাদিকরা এড়িয়ে চলেন।
জেনারেল এরশাদ ও ড. ইউনূসের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। জেনারেল এরশাদ সামরিক ডিক্টেটর থেকে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এসেছেন। নেতা হয়েছেন। একজন সামরিক শাসক ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার পর রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন এমন ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসেই বিরল। আমরা পছন্দ করি বা না করি জে. এরশাদ এবং তার জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন একটা ফ্যাক্টর। তাই তাকে নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দু’দলেই এত টানাটানি।
ড. ইউনূস একজন ব্যাংকার এবং ব্যবসায়ী। রাজনীতিক নন। আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও তিনি রাজনীতিতে আসেননি। তবে রাজনৈতিক কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতীতেও তার কোনো ভূমিকা ছিল না। এক-এগারোর সময় নোবেল পুরস্কারকে পুঁজি করে তিনি খালি মাঠে গোল দিতে চেয়েছিলেন। পারেননি। এখন যে তিনি রাজনীতিতে নামার পাঁয়তারা করছেন তা রাজনীতি বা জনগণের প্রতি ভালোবাসার জন্য নয়। গ্রামীণ ব্যাংকের একচ্ছত্র আধিপত্য হারানোর পর তিনি বর্তমান সরকারের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন এবং এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামাতে চান।
ড. ইউনূসের লক্ষ্য আওয়ামী লীগ-বধ। তাই নীতি ও আদর্শগতভাবে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে কোনো মিল না থাকা সত্ত্বেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষের শিবিরে গিয়ে ভিড়েছেন। তাদের গডফাদার হওয়ার চেষ্টা করছেন। দেশের রাজনীতিতে যেসব দল বা নেতার কোনো গুরুত্ব ও অবস্থান নেই তারা গিয়ে ঢাকার ইউনূস সেন্টারে ভিড় জমিয়েছেন। উদ্দেশ্য, তাকে তাল দিয়ে রাজনীতিতে নামাতে পারলে বা তাকে দিয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দল খাড়া করতে পারলে এই শাখামৃগের দল হয়তো একটি নতুন শাখায় ঝুলে ক্ষমতার বলয়ে যাওয়ার আশা করতে পারবে।
আমার ধারণা, ড. ইউনূস নতুন দল গঠন করতে যাবেন না। তিনি আওয়ামী সরকারের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তার নেতৃত্বাধীন এলিট ক্লাস ও দুটি মিডিয়া নিয়ে যে রাজনৈতিক চেষ্টা চালাবেন, তাতে বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের লাভ হবে। তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে পারে। এ পথে না গিয়ে ড. ইউনূস যদি নতুন রাজনৈতিক দল গড়তে যান, তার পরিণতি হবে ড. কামাল হোসেনের গণফোরামের মতো।
ড. কামাল হোসেন তবু গণফোরাম গঠনের সময় কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের ভাঙনের যুগে কয়েকজন নীতিনিষ্ঠ পার্টি সদস্যকে পেয়েছিলেন তার দলে (তাদের অধিকাংশই এখন তার সঙ্গে নেই)। ড. ইউনূস এখন দল গঠন করতে গেলে কোনো নীতিনিষ্ঠ নেতাকর্মীই পাবেন না। পাবেন দলছুট, জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত কিছু নামসর্বস্ব নেতা। তাদের নিয়ে দল গঠনের পরিণাম হবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটে আরেকটি গুরুত্বহীন ছোট শরিক দল হওয়া। তার বেশি কিছু নয়। সুতরাং তাকে নিয়ে গুজব যারা ছড়াচ্ছেন তারা খতিয়ে দেখছেন না যে, ড. ইউনূস বিশ্ব চড়িয়ে বেড়ানো ব্যক্তি। তিনি এত বুদ্ধিহীন নন যে, গুজব রটনাকারী বা উস্কানিদাতাদের চাপে আবার লাফ দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাবেন। তবে আমার মতে, তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে নামলে ভালো হতো। দেশের মানুষ তার আসল চেহারাটা দেখতে পেত।
জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সহজে মহাজোট ছাড়বেন এমনটা আমার মনে হয় না। মহাজোটে অবস্থান করা সত্ত্বেও তার প্রতি যথেষ্ট অবিচার করা হয়েছে, তাদের জোটে গুরুত্ব দেয়া হয়নি একথা সত্য। সেই সঙ্গে এও সত্য, দলের ভেতর থেকেই তার ওপর মহাজোট ত্যাগের দারুণ চাপ আছে। তবু জে. এরশাদ এখনও মহাজোটে আছেন। তিনি যদি মহাজোটে থাকেন, তাহলে তার নীতিগত অবস্থান দৃঢ় হবে। বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থায় শেখ হাসিনা তাকে বা তার দলকে আর অবহেলা ও উপেক্ষা করতে পারবেন না। মহাজোটে জে. এরশাদ তার প্রভাব ও গুরুত্ব বাড়াতে পারেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে তার আস্থা সম্পর্কে জনগণের একাংশের মধ্যে যে সন্দেহ তা দূর করতে পারেন এবং দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ রক্ষাতেও শেষ বয়সে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যেতে পারবেন।
দলের একাংশের চাপে তিনি যদি ১৮ দলীয় জোটে যান, সেটা হবে তার জন্য আত্মঘাতী নীতি। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিএনপি এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা তাকে রাষ্ট্রপতি পদে বসাবে বলে টোপ দিতে পারে। কিন্তু যে খালেদা জিয়া এবং তার পুত্র তারেক রহমান নিজেদের দলের মনোনীত রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বঙ্গভবনে বসার কয়েক মাসের মধ্যে অবমাননাকরভাবে পদত্যাগে বাধ্য করে পুলিশ পাহারায় বঙ্গভবন ছাড়তে বাধ্য করতে পারেন। তারা সুযোগমতো জে. এরশাদের সঙ্গে কী আচরণ করবেন জেনারেল নিশ্চয়ই তা ভেবে দেখবেন। বিএনপি তাকে রাষ্ট্রপতি করলেও (গুজব অনুযায়ী) তিনি হবেন- ক্ষমতাহীন নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি। মাতা-পুত্রের ক্ষমতাচক্রের বাইরে বঙ্গভবনে বসে তিনি কী করবেন? আর মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির দশজন মন্ত্রী গ্রহণের কথা তো ইলেকশন প্রমিস। নির্বাচনের পর এই প্রতিশ্র“তি রক্ষা করা হবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? আর জাতীয় পার্টি থেকে নতুন সংসদে ক’জন প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারবে তা এখনই বা কে বলবে?
সবচেয়ে বড় কথা, আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে তাহলে তারেক রহমান গোড়াতেই প্রধানমন্ত্রী না হোন, তিনিই হবেন কার্যত সরকারের হর্তাকর্তা। আর মাতার একান্ত বাসনায় যদি তারেক রহমানকে গোড়াতেই প্রধানমন্ত্রী করা হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতির আসনটি মাতার জন্য নির্দিষ্ট থাকবে বলে জানা যায়। তাহলে বঙ্গভবনে জে. এরশাদের জন্য দরোজা খোলার সুযোগ কোথায়? আর সাময়িকভাবে জেনারেলকে যদি রাষ্ট্রপতি পদে বসার সুযোগ দেয়াও হয়, তাহলে তিনি রাষ্ট্রপতি আর তারেক রহমান সরকারের হর্তাকর্তা অথবা প্রধানমন্ত্রী এই কম্বিনেশনটা কেমন হবে? এই কম্বিনেশন রাষ্ট্রপতি হিসেবে জেনারেল এরশাদের মর্যাদা, ক্ষমতা ও গুরুত্ব কতটা রক্ষা করবে?
মহাজোট যদি কোনো কারণে ছাড়তেই হয়, তাহলে আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধির ধারণা, জে. এরশাদ তার জাতীয় পার্টি নিয়ে একা অথবা তার সমমনা কিছু গণতান্ত্রিক দল নিয়ে নতুন জোট করে নির্বাচনে নামলে ভালো করবেন। এমন হতে পারে, নির্বাচনে তার দল এত আসন পেতে পারে যে, তিনি তখন বড় দুটি দলের কাছেই কোয়ালিশন গঠনের জন্য নিজস্ব শর্ত আরোপ করতে পারবেন, চাই কি, আদায়ও করতে পারবেন। ব্রিটেনের লিবারেল পার্টির সুদীর্ঘকালের ইতিহাস থেকে তার শিক্ষা অর্জন করা উচিত। বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে ড. ইউনূস নন, জে. এরশাদই অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন।
একেবারে বিশ্বাস করার মতো খবর। সারাদিন টেলিফোনে খোঁজখবর নিলাম। ঢাকায় কাগজগুলো দেখলাম। কিন্তু এই খবর যে সঠিক তার কোনো প্রমাণ পেলাম না। বুঝলাম, দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চলছে। সেই সুযোগে গুজবের ঘুড়ি ওড়ানো হচ্ছে। জেনারেল এরশাদের সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে যাওয়া নিয়েও গুজব ছড়ানো হয়েছে। বলা হয়েছে, সিঙ্গাপুরে যাওয়ার আগে অথবা পরে এরশাদ সাহেব টেলিফোনে বেগম জিয়ার সঙ্গে কুড়ি মিনিট কথা বলেছেন। কী বলেছেন তার কোনো হদিস নেই।
আমাদের নতুন রাষ্ট্রপতিও সিঙ্গাপুর গেছেন। তা নিয়েও নানা গুজব। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর আবদুল হামিদ সাহেব ঘনঘন সিঙ্গাপুরে যাচ্ছেন। অনেকে বলেন, ছোটখাটো রোগে চিকিৎসার জন্যও কি বাংলাদেশে ভালো চিকিৎসক নেই? জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন প্রয়াত ডা. নুরুল ইসলাম। তিনিই বঙ্গবন্ধুর চিকিৎসা করতেন। বড় ধরনের সার্জারি ছাড়া বঙ্গবন্ধুকে তো কখনও চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতে হয়নি। এখন কথায় কথায় চিকিৎসার নামে সিঙ্গাপুর, ব্যাংককে যাওয়ার ধুম পড়ে গেছে। বর্তমান রাষ্ট্রপতির চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যাওয়া নিয়েও রাজনৈতিক গুজব কানে এসেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন একটা অস্থিরতা চলছে। এই অস্থিরতা সৃষ্টির পেছনে গুজবের একটা অবদান রয়েছে। রাজনীতিতে সুস্থতা ও স্থিরতা ফিরিয়ে আনতে হলে গুজবের ধূম্রজাল থেকে দেশকে মুক্ত করা প্রয়োজন। কিন্তু কে তা করবেন? আমাদের প্রিন্টিং অথবা ইলেকট্রনিক মিডিয়া? এই মিডিয়ার একটা বড় অংশ তো নিজেরাই গুজব ছড়ানোর কাজে ব্যস্ত। এটাই তাদের ব্যবসা। দেশে এখন একশ্রেণীর হলুদ সাংবাদিকের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রকৃত সাংবাদিকদের মতো তাদের একই মর্যাদা। সংবাদপত্রের কলাম, টেলি টকশোতে তাদের প্রাধান্য বেশি। অর্থাৎ আমাদের সাংবাদিকতায় মুড়ি ও মুড়কির এখন এক দাম। এ অবস্থা থেকে দেশ মুক্ত না হলে সমাজ বা রাজনীতিতে নীতি-নৈতিকতা কখনও ফিরে আসবে না।
জেনারেল এরশাদ এবং ড. ইউনূসকে নিয়ে সত্য-মিথ্যা খবর রটানো হলুদ সাংবাদিকতায় যে লাভজনক ব্যবসা হয়ে উঠেছে, তার একটা বড় কারণ সম্ভবত দেশের বহমান রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির ওপর অনেকেই আস্থা হারিয়েছেন। বহমান রাজনীতির এই গোলকধাঁধা থেকে বেরোনোর কোনো পথও তারা দেখছেন না। তখন তারা ভাবেন, জে. এরশাদ কিংবা ড. ইউনূসই সম্ভবত তাদের ত্রাতা হতে পারবেন। হতাশ মনের এই ক্ষোভকেই পুঁজি করে হলুদ সাংবাদিকরা তাদের গুজবের ব্যবসাকে জমজমাট করে তুলেছেন। জে. এরশাদ বা ড. ইউনূস কী করতে পারেন বা কী করতে পারবেন তা খতিয়ে দেখার কাজটি এই হলুদ সাংবাদিকরা এড়িয়ে চলেন।
জেনারেল এরশাদ ও ড. ইউনূসের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। জেনারেল এরশাদ সামরিক ডিক্টেটর থেকে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এসেছেন। নেতা হয়েছেন। একজন সামরিক শাসক ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার পর রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন এমন ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসেই বিরল। আমরা পছন্দ করি বা না করি জে. এরশাদ এবং তার জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন একটা ফ্যাক্টর। তাই তাকে নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দু’দলেই এত টানাটানি।
ড. ইউনূস একজন ব্যাংকার এবং ব্যবসায়ী। রাজনীতিক নন। আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও তিনি রাজনীতিতে আসেননি। তবে রাজনৈতিক কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতীতেও তার কোনো ভূমিকা ছিল না। এক-এগারোর সময় নোবেল পুরস্কারকে পুঁজি করে তিনি খালি মাঠে গোল দিতে চেয়েছিলেন। পারেননি। এখন যে তিনি রাজনীতিতে নামার পাঁয়তারা করছেন তা রাজনীতি বা জনগণের প্রতি ভালোবাসার জন্য নয়। গ্রামীণ ব্যাংকের একচ্ছত্র আধিপত্য হারানোর পর তিনি বর্তমান সরকারের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন এবং এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামাতে চান।
ড. ইউনূসের লক্ষ্য আওয়ামী লীগ-বধ। তাই নীতি ও আদর্শগতভাবে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে কোনো মিল না থাকা সত্ত্বেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষের শিবিরে গিয়ে ভিড়েছেন। তাদের গডফাদার হওয়ার চেষ্টা করছেন। দেশের রাজনীতিতে যেসব দল বা নেতার কোনো গুরুত্ব ও অবস্থান নেই তারা গিয়ে ঢাকার ইউনূস সেন্টারে ভিড় জমিয়েছেন। উদ্দেশ্য, তাকে তাল দিয়ে রাজনীতিতে নামাতে পারলে বা তাকে দিয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দল খাড়া করতে পারলে এই শাখামৃগের দল হয়তো একটি নতুন শাখায় ঝুলে ক্ষমতার বলয়ে যাওয়ার আশা করতে পারবে।
আমার ধারণা, ড. ইউনূস নতুন দল গঠন করতে যাবেন না। তিনি আওয়ামী সরকারের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তার নেতৃত্বাধীন এলিট ক্লাস ও দুটি মিডিয়া নিয়ে যে রাজনৈতিক চেষ্টা চালাবেন, তাতে বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের লাভ হবে। তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে পারে। এ পথে না গিয়ে ড. ইউনূস যদি নতুন রাজনৈতিক দল গড়তে যান, তার পরিণতি হবে ড. কামাল হোসেনের গণফোরামের মতো।
ড. কামাল হোসেন তবু গণফোরাম গঠনের সময় কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের ভাঙনের যুগে কয়েকজন নীতিনিষ্ঠ পার্টি সদস্যকে পেয়েছিলেন তার দলে (তাদের অধিকাংশই এখন তার সঙ্গে নেই)। ড. ইউনূস এখন দল গঠন করতে গেলে কোনো নীতিনিষ্ঠ নেতাকর্মীই পাবেন না। পাবেন দলছুট, জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত কিছু নামসর্বস্ব নেতা। তাদের নিয়ে দল গঠনের পরিণাম হবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটে আরেকটি গুরুত্বহীন ছোট শরিক দল হওয়া। তার বেশি কিছু নয়। সুতরাং তাকে নিয়ে গুজব যারা ছড়াচ্ছেন তারা খতিয়ে দেখছেন না যে, ড. ইউনূস বিশ্ব চড়িয়ে বেড়ানো ব্যক্তি। তিনি এত বুদ্ধিহীন নন যে, গুজব রটনাকারী বা উস্কানিদাতাদের চাপে আবার লাফ দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাবেন। তবে আমার মতে, তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে নামলে ভালো হতো। দেশের মানুষ তার আসল চেহারাটা দেখতে পেত।
জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সহজে মহাজোট ছাড়বেন এমনটা আমার মনে হয় না। মহাজোটে অবস্থান করা সত্ত্বেও তার প্রতি যথেষ্ট অবিচার করা হয়েছে, তাদের জোটে গুরুত্ব দেয়া হয়নি একথা সত্য। সেই সঙ্গে এও সত্য, দলের ভেতর থেকেই তার ওপর মহাজোট ত্যাগের দারুণ চাপ আছে। তবু জে. এরশাদ এখনও মহাজোটে আছেন। তিনি যদি মহাজোটে থাকেন, তাহলে তার নীতিগত অবস্থান দৃঢ় হবে। বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থায় শেখ হাসিনা তাকে বা তার দলকে আর অবহেলা ও উপেক্ষা করতে পারবেন না। মহাজোটে জে. এরশাদ তার প্রভাব ও গুরুত্ব বাড়াতে পারেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে তার আস্থা সম্পর্কে জনগণের একাংশের মধ্যে যে সন্দেহ তা দূর করতে পারেন এবং দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ রক্ষাতেও শেষ বয়সে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যেতে পারবেন।
দলের একাংশের চাপে তিনি যদি ১৮ দলীয় জোটে যান, সেটা হবে তার জন্য আত্মঘাতী নীতি। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিএনপি এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা তাকে রাষ্ট্রপতি পদে বসাবে বলে টোপ দিতে পারে। কিন্তু যে খালেদা জিয়া এবং তার পুত্র তারেক রহমান নিজেদের দলের মনোনীত রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বঙ্গভবনে বসার কয়েক মাসের মধ্যে অবমাননাকরভাবে পদত্যাগে বাধ্য করে পুলিশ পাহারায় বঙ্গভবন ছাড়তে বাধ্য করতে পারেন। তারা সুযোগমতো জে. এরশাদের সঙ্গে কী আচরণ করবেন জেনারেল নিশ্চয়ই তা ভেবে দেখবেন। বিএনপি তাকে রাষ্ট্রপতি করলেও (গুজব অনুযায়ী) তিনি হবেন- ক্ষমতাহীন নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি। মাতা-পুত্রের ক্ষমতাচক্রের বাইরে বঙ্গভবনে বসে তিনি কী করবেন? আর মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির দশজন মন্ত্রী গ্রহণের কথা তো ইলেকশন প্রমিস। নির্বাচনের পর এই প্রতিশ্র“তি রক্ষা করা হবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? আর জাতীয় পার্টি থেকে নতুন সংসদে ক’জন প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারবে তা এখনই বা কে বলবে?
সবচেয়ে বড় কথা, আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে তাহলে তারেক রহমান গোড়াতেই প্রধানমন্ত্রী না হোন, তিনিই হবেন কার্যত সরকারের হর্তাকর্তা। আর মাতার একান্ত বাসনায় যদি তারেক রহমানকে গোড়াতেই প্রধানমন্ত্রী করা হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতির আসনটি মাতার জন্য নির্দিষ্ট থাকবে বলে জানা যায়। তাহলে বঙ্গভবনে জে. এরশাদের জন্য দরোজা খোলার সুযোগ কোথায়? আর সাময়িকভাবে জেনারেলকে যদি রাষ্ট্রপতি পদে বসার সুযোগ দেয়াও হয়, তাহলে তিনি রাষ্ট্রপতি আর তারেক রহমান সরকারের হর্তাকর্তা অথবা প্রধানমন্ত্রী এই কম্বিনেশনটা কেমন হবে? এই কম্বিনেশন রাষ্ট্রপতি হিসেবে জেনারেল এরশাদের মর্যাদা, ক্ষমতা ও গুরুত্ব কতটা রক্ষা করবে?
মহাজোট যদি কোনো কারণে ছাড়তেই হয়, তাহলে আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধির ধারণা, জে. এরশাদ তার জাতীয় পার্টি নিয়ে একা অথবা তার সমমনা কিছু গণতান্ত্রিক দল নিয়ে নতুন জোট করে নির্বাচনে নামলে ভালো করবেন। এমন হতে পারে, নির্বাচনে তার দল এত আসন পেতে পারে যে, তিনি তখন বড় দুটি দলের কাছেই কোয়ালিশন গঠনের জন্য নিজস্ব শর্ত আরোপ করতে পারবেন, চাই কি, আদায়ও করতে পারবেন। ব্রিটেনের লিবারেল পার্টির সুদীর্ঘকালের ইতিহাস থেকে তার শিক্ষা অর্জন করা উচিত। বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে ড. ইউনূস নন, জে. এরশাদই অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন।
No comments