মুমূর্ষু অর্থনীতি by এমএম মাসুদ
একের পর এক হরতাল। রাজনৈতিক অস্থিরতা।
সংঘাত-সহিংসতায় মুমূূর্ষু অবস্থা দেশের অর্থনীতির। ভেঙে পড়েছে পণ্য পরিবহন
ব্যবস্থা। আমদানি-রপ্তানিতে স্থবিরতা। বিনিয়োগে ভাটা। ব্যাংকে তারল্য
সঙ্কট। অস্থিরতা। দেশের প্রধান রপ্তানিখাত তৈরী পোশাক শিল্পে প্রচণ্ড চাপ।
কমছে
রপ্তানি আদেশ। রপ্তানি পণ্য সময়মতো সরবরাহ করা যাচ্ছে না। অর্থনীতির
টানাপড়েন এখন শিল্পখাত থেকে ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত। শিল্প উৎপাদন কমে
গেছে। পুুঁজিবাজারে বিনিয়োগ কমছে প্রতিনিয়ত। শ্রমিক-দিনমজুর শ্রেণীর মানুষও
চরম ভোগান্তিতে। কাজ নেই। তাই খাবার জুটছে না। শিল্প ও ব্যবসায়
বিনিয়োগকারীরা চরম হতাশায়। হরতাল ও রাজনৈতিক সহিংসতায় ব্যবসায়ী ও তৈরী
পোশাক শিল্প মালিকরা সরকারের কাছে নিরাপত্তা দাবি করেছেন। তারা শঙ্কিত
সামনের পরিস্থিতি নিয়ে। চলমান সঙ্কট অবসানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ
উদ্যোগ নেয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
চলতি সপ্তাহে মাত্র একদিন কর্মদিবস ছিল। আর বাকি ৬ দিনই হরতাল আর ছুটি। অর্থাৎ টানা ৫ দিন হরতাল আর ছুটির ফাঁদে পড়েছে দেশ। অন্যদিকে অর্থনীতিতে অবদান রাখা বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ ও ইএবি’র পক্ষ থেকে হরতালের বিকল্প কর্মসূচি গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রধান দুই দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে অর্থনীতি সহায়ক কর্মসূচি নেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। দেশের ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করে বলেছেন, যে হরতাল দেশের অর্থনীতিকে মেরে ফেলে তা থেকে বিরত থাকা উচিত। রাজনীতি ও অর্থনীতি একই সূত্রে গাঁথা। এ কারণে অর্থনীতির ক্ষতি হয় এমন কর্মসূচি দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন অর্থনীতির বিশ্লেষকরাও। এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়বে। রাজনীতিকদের অনেকবার হরতালের বিকল্প কর্মসূচি দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। পরামর্শ আমলে নেয়া হয়নি। কিন্তু তারপরেও হরতাল থেমে থাকেনি। তিনি বলেন, এ অবস্থায় অর্থনীতির গতি যদি তলানিতে ঠেকে যায়, তাহলে সেখান থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা খুবই মুশকিল হবে। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে বেশির ভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠানের নগদ অর্থ প্রবাহে বড় ধরনের সঙ্কটে পড়বে। আর এটা দিনকে দিন আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে বলে মনে করেন সাবেক এই ব্যবসায়ী নেতা। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আমির হোসেন খান বলেন, বড় দোকানগুলোতে দৈনিক ৬০০ কোটি ও ছোট-বড় সব মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। তিনি বলেন, আগামী হরতালগুলোতে যেভাবে হোক ২টা থেকে সব দোকান খুলে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এটি আজ থেকে কার্যকর হবে বলেও জানান তিনি।
এবিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ বলেন, হরতাল কার্যত প্রাণঘাতী কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। সামপ্রতিককালে হরতালের সময় ব্যাপক সহিংসতা ব্যবসায়ীসহ সকল মহলকে আতঙ্কিত করে তুলছে। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে এ বিষয়ে ফয়সালা করতে হবে। এনিয়ে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা বিভিন্ন মতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একাধিকবার বসেছি। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল আহ্বান করলে ব্যবসায়ীরা এর বিরুদ্ধে স্টেটমেন্ট দেয়। কিন্তু তাতে কি হরতাল বন্ধ হয়? তাই আমরা চিরস্থায়ী এর সমাধান চাইছি। তিনি বলেন, সহিংসতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। প্রধান বিরোধী দলের নেতার সঙ্গেও আমরা কথা বলতে চাই। আশা করি, আমরা সফল হবো।
বিজিএমইএ’র নেতারা বলছেন, এমনিতেই তৈরী পোশাক খাত নিয়ে চলছে নানা সঙ্কট। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিশেষ অগ্রাধিকারমূলক বাজার-সুবিধা বা জিএসপি বাতিলের হুমকির মধ্যে আছে। তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডে ১১১ জন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা এখনও সামাল দেয়া যায়নি। পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের কারণে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনের ফলে ভাবমূর্তির সঙ্কটেও রয়েছে দেশ। এ অবস্থায় হরতাল কর্মসূচি দেয়ার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহে সমস্যার কারণে দ্রব্যমূল্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী হরতালের ক্ষতির পরিমাণ: ঢাকা চেম্বারের হিসাবে, এক দিনের হরতালে দেশে ২০ কোটি ডলারের (প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা) ক্ষতি হয়। ঢাকা চেম্বারের সভাপতি সবুর খান বলেন, বিভিন্ন খাতের লোকসানের হিসাব থেকে এই পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ এখন আরও বেশি হবে। কারণ, হরতাল ও সহিংসতা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। আগে রপ্তানিমুখী পণ্যবাহী ট্রাক ছেড়ে দেয়া হতো, এখন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ট্রেনে পর্যন্ত আগুন দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাবে, হরতালে দেশের ২০ লাখ দোকানে প্রতিদিন ক্ষতি হয় ২০০০-৩০০০ কোটি টাকা। আর জুয়েলার্স সমিতির হিসাবে, হরতালে প্রতিদিন কমপক্ষে ৭ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানও লোকসানে পড়ছে।
অর্ডার হারাতে বসছে দেশ: রাজনৈতিক অস্থিরতাজনিত ইমেজ সঙ্কট এবং লিড টাইম বেড়ে যাওয়ায় ইতিমধ্যেই এক্সপোর্ট অর্ডার হারাতে শুরু করেছে দেশ। এমনিতেই জিএসপি সঙ্কট, ইউরো জোনের অর্থনৈতিক মন্দা ইত্যাদি কারণে রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। এর ওপর রাজনৈতিক সংঘাত রপ্তানি খাতকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলছে।
এদিকে দেশের স্থল বন্দরগুলোতে আমদানি-রপ্তানিসহ সকল কার্যক্রম বন্ধের ফাঁদে পড়েছে। সোমবার ছিল হেফাজতে ইসলামের, মঙ্গল ও বুধবার ১৮ দলীয় জোটের, বৃহস্পতিবার শিবিরের হরতাল। আগামী শুক্র-শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। এছাড়া, আগামী রোববার বাংলা নববর্ষের সরকারি ছুটি। ফলে পুরো ৭ দিন এ স্থল বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকছে। বন্দর সূত্র মতে, স্বাভাবিক সময়ে এ বন্দর থেকে প্রতিদিন ১১ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়। আর গত হরতালে প্রতিদিন রাজস্ব আদায় হয়েছিল পৌনে ২ কোটি টাকা। এদিকে বন্দরগুলোর প্রায় কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। অনেকেই খেয়ে না খেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে।
রাজস্ব আদায় ব্যাহত: চলতি অর্থবছরে (২০১২-১৩) সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপি’র প্রায় ১৩ শতাংশ। কিন্তু সুষ্ঠু বিনিয়োগ পরিবেশ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা না হলে উৎপাদন ও আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হবে এবং যার কারণে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত: ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাগণ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার-এর কারণে যেখানে উদ্যোক্তাদের পক্ষে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে, সেখানে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে শিল্প-কারখানাসমূহ রুগ্ণ হয়ে পড়ছে এবং ঋণ শ্রেণীবিন্যাসিত হচ্ছে যার দায়ভার ব্যবসায়ীদেরই বহন করতে হচ্ছে।
পুঁজিবাজার ছাড়ছেন বিদেশীরা: রাজনৈতিক অস্থিরতায় পুঁজিবাজার ছাড়ছেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। ফেব্রুয়ারিতে পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগকারীর বিও হিসাব ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার। মার্চ মাসে তা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজারে। অর্থাৎ ১ মাসে ৭ হাজার বিদেশী বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার ছেড়েছেন। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ (সিডিবিএল) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন: পণ্য সরবরাহ ও বিক্রি কমে গেলে অনেক প্রতিষ্ঠান পণ্য উৎপাদনও কমিয়ে দেয়। হরতালে শ্রমিকরা কাজে আসতে পারে না। আবার হরতালে সরবরাহ বিঘ্নিত হলে কারখানায় কাঁচামাল ও তৈরি পণ্যের স্তূপ পড়ে থাকে। এর ফলে উৎপাদনই কমিয়ে দিতে বাধ্য হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো।
পুঁজিবাজারবিমুখ হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা: দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা চরমে পৌঁছেছে। এ কারণে হাতে পুঁজি থাকা সত্ত্বেও অনেক বিনিয়োগকারী বাজারবিমুখ হয়ে পড়েছেন। নতুন বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে চাইছেন না তারা। সামপ্রতিক সময়ে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কবলে পড়ে পুঁজিবাজারে অব্যাহতভাবে দরপতন চলছেই আর এতে বাজার নিয়ে নতুন করে শঙ্কায় পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, রাজনীতিবিদদের ডাকা হরতালে অর্থনীতির ক্ষতি ছাড়া লাভ হয়নি কোন কালেই। এছাড়া, জনগণের ভোগান্তি ও জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়া কোন উপকারে আসেনি। তিনি উল্লেখ করেন, এমনিতেই দুর্বল অবকাঠামো, ব্যাংকের অতি উচ্চ সুদহার এবং জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে রপ্তানিকারীরা আজ দিশাহারা। এ অবস্থায় টানা হরতাল কর্মসূচি অর্থনীতিকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।
চলতি সপ্তাহে মাত্র একদিন কর্মদিবস ছিল। আর বাকি ৬ দিনই হরতাল আর ছুটি। অর্থাৎ টানা ৫ দিন হরতাল আর ছুটির ফাঁদে পড়েছে দেশ। অন্যদিকে অর্থনীতিতে অবদান রাখা বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ ও ইএবি’র পক্ষ থেকে হরতালের বিকল্প কর্মসূচি গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রধান দুই দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে অর্থনীতি সহায়ক কর্মসূচি নেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। দেশের ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করে বলেছেন, যে হরতাল দেশের অর্থনীতিকে মেরে ফেলে তা থেকে বিরত থাকা উচিত। রাজনীতি ও অর্থনীতি একই সূত্রে গাঁথা। এ কারণে অর্থনীতির ক্ষতি হয় এমন কর্মসূচি দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন অর্থনীতির বিশ্লেষকরাও। এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়বে। রাজনীতিকদের অনেকবার হরতালের বিকল্প কর্মসূচি দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। পরামর্শ আমলে নেয়া হয়নি। কিন্তু তারপরেও হরতাল থেমে থাকেনি। তিনি বলেন, এ অবস্থায় অর্থনীতির গতি যদি তলানিতে ঠেকে যায়, তাহলে সেখান থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা খুবই মুশকিল হবে। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে বেশির ভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠানের নগদ অর্থ প্রবাহে বড় ধরনের সঙ্কটে পড়বে। আর এটা দিনকে দিন আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে বলে মনে করেন সাবেক এই ব্যবসায়ী নেতা। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আমির হোসেন খান বলেন, বড় দোকানগুলোতে দৈনিক ৬০০ কোটি ও ছোট-বড় সব মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। তিনি বলেন, আগামী হরতালগুলোতে যেভাবে হোক ২টা থেকে সব দোকান খুলে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এটি আজ থেকে কার্যকর হবে বলেও জানান তিনি।
এবিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ বলেন, হরতাল কার্যত প্রাণঘাতী কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। সামপ্রতিককালে হরতালের সময় ব্যাপক সহিংসতা ব্যবসায়ীসহ সকল মহলকে আতঙ্কিত করে তুলছে। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে এ বিষয়ে ফয়সালা করতে হবে। এনিয়ে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা বিভিন্ন মতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একাধিকবার বসেছি। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল আহ্বান করলে ব্যবসায়ীরা এর বিরুদ্ধে স্টেটমেন্ট দেয়। কিন্তু তাতে কি হরতাল বন্ধ হয়? তাই আমরা চিরস্থায়ী এর সমাধান চাইছি। তিনি বলেন, সহিংসতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। প্রধান বিরোধী দলের নেতার সঙ্গেও আমরা কথা বলতে চাই। আশা করি, আমরা সফল হবো।
বিজিএমইএ’র নেতারা বলছেন, এমনিতেই তৈরী পোশাক খাত নিয়ে চলছে নানা সঙ্কট। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিশেষ অগ্রাধিকারমূলক বাজার-সুবিধা বা জিএসপি বাতিলের হুমকির মধ্যে আছে। তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডে ১১১ জন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা এখনও সামাল দেয়া যায়নি। পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের কারণে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনের ফলে ভাবমূর্তির সঙ্কটেও রয়েছে দেশ। এ অবস্থায় হরতাল কর্মসূচি দেয়ার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহে সমস্যার কারণে দ্রব্যমূল্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী হরতালের ক্ষতির পরিমাণ: ঢাকা চেম্বারের হিসাবে, এক দিনের হরতালে দেশে ২০ কোটি ডলারের (প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা) ক্ষতি হয়। ঢাকা চেম্বারের সভাপতি সবুর খান বলেন, বিভিন্ন খাতের লোকসানের হিসাব থেকে এই পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ এখন আরও বেশি হবে। কারণ, হরতাল ও সহিংসতা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। আগে রপ্তানিমুখী পণ্যবাহী ট্রাক ছেড়ে দেয়া হতো, এখন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ট্রেনে পর্যন্ত আগুন দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাবে, হরতালে দেশের ২০ লাখ দোকানে প্রতিদিন ক্ষতি হয় ২০০০-৩০০০ কোটি টাকা। আর জুয়েলার্স সমিতির হিসাবে, হরতালে প্রতিদিন কমপক্ষে ৭ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানও লোকসানে পড়ছে।
অর্ডার হারাতে বসছে দেশ: রাজনৈতিক অস্থিরতাজনিত ইমেজ সঙ্কট এবং লিড টাইম বেড়ে যাওয়ায় ইতিমধ্যেই এক্সপোর্ট অর্ডার হারাতে শুরু করেছে দেশ। এমনিতেই জিএসপি সঙ্কট, ইউরো জোনের অর্থনৈতিক মন্দা ইত্যাদি কারণে রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। এর ওপর রাজনৈতিক সংঘাত রপ্তানি খাতকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলছে।
এদিকে দেশের স্থল বন্দরগুলোতে আমদানি-রপ্তানিসহ সকল কার্যক্রম বন্ধের ফাঁদে পড়েছে। সোমবার ছিল হেফাজতে ইসলামের, মঙ্গল ও বুধবার ১৮ দলীয় জোটের, বৃহস্পতিবার শিবিরের হরতাল। আগামী শুক্র-শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। এছাড়া, আগামী রোববার বাংলা নববর্ষের সরকারি ছুটি। ফলে পুরো ৭ দিন এ স্থল বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকছে। বন্দর সূত্র মতে, স্বাভাবিক সময়ে এ বন্দর থেকে প্রতিদিন ১১ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়। আর গত হরতালে প্রতিদিন রাজস্ব আদায় হয়েছিল পৌনে ২ কোটি টাকা। এদিকে বন্দরগুলোর প্রায় কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। অনেকেই খেয়ে না খেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে।
রাজস্ব আদায় ব্যাহত: চলতি অর্থবছরে (২০১২-১৩) সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপি’র প্রায় ১৩ শতাংশ। কিন্তু সুষ্ঠু বিনিয়োগ পরিবেশ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা না হলে উৎপাদন ও আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হবে এবং যার কারণে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত: ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাগণ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার-এর কারণে যেখানে উদ্যোক্তাদের পক্ষে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে, সেখানে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে শিল্প-কারখানাসমূহ রুগ্ণ হয়ে পড়ছে এবং ঋণ শ্রেণীবিন্যাসিত হচ্ছে যার দায়ভার ব্যবসায়ীদেরই বহন করতে হচ্ছে।
পুঁজিবাজার ছাড়ছেন বিদেশীরা: রাজনৈতিক অস্থিরতায় পুঁজিবাজার ছাড়ছেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। ফেব্রুয়ারিতে পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগকারীর বিও হিসাব ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার। মার্চ মাসে তা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজারে। অর্থাৎ ১ মাসে ৭ হাজার বিদেশী বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার ছেড়েছেন। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ (সিডিবিএল) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন: পণ্য সরবরাহ ও বিক্রি কমে গেলে অনেক প্রতিষ্ঠান পণ্য উৎপাদনও কমিয়ে দেয়। হরতালে শ্রমিকরা কাজে আসতে পারে না। আবার হরতালে সরবরাহ বিঘ্নিত হলে কারখানায় কাঁচামাল ও তৈরি পণ্যের স্তূপ পড়ে থাকে। এর ফলে উৎপাদনই কমিয়ে দিতে বাধ্য হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো।
পুঁজিবাজারবিমুখ হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা: দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা চরমে পৌঁছেছে। এ কারণে হাতে পুঁজি থাকা সত্ত্বেও অনেক বিনিয়োগকারী বাজারবিমুখ হয়ে পড়েছেন। নতুন বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে চাইছেন না তারা। সামপ্রতিক সময়ে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কবলে পড়ে পুঁজিবাজারে অব্যাহতভাবে দরপতন চলছেই আর এতে বাজার নিয়ে নতুন করে শঙ্কায় পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, রাজনীতিবিদদের ডাকা হরতালে অর্থনীতির ক্ষতি ছাড়া লাভ হয়নি কোন কালেই। এছাড়া, জনগণের ভোগান্তি ও জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়া কোন উপকারে আসেনি। তিনি উল্লেখ করেন, এমনিতেই দুর্বল অবকাঠামো, ব্যাংকের অতি উচ্চ সুদহার এবং জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে রপ্তানিকারীরা আজ দিশাহারা। এ অবস্থায় টানা হরতাল কর্মসূচি অর্থনীতিকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।
No comments