আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ও আমাদের চিত্র by ড. নিয়াজ আহম্মেদ
সাক্ষরতা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবীয় অধিকার হিসেবে বিশ্বে গৃহীত হয়ে আসছে। এটি ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক ও মানবীয় উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণযোগ্য। এমনকি শিক্ষার সুযোগের বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করে সাক্ষরতার ওপর। সাক্ষরতা মৌলিক শিক্ষার ভিত্তি হিসেবেও কাজ করে।
দারিদ্র্য হ্রাস, শিশু মৃত্যু ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ, জেন্ডার সমতা আনয়ন, সুষম উন্নয়ন এবং শান্তি ও গণতন্ত্র বিকশিতকরণের ক্ষেত্রেও সাক্ষরতা প্রয়োজনীয় হাতিয়ার হিসেবে গণ্য হয়। মূলকথা সবার জন্য শিক্ষা- এ স্লোগান বাস্তবায়ন করতে সাক্ষরতাকে ভিত্তি হিসেবে মনে করার পেছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। একটি মানসম্মত মৌলিক শিক্ষা মানুষকে সাক্ষরতা ও দক্ষতার সঙ্গে তৈরি করতে সহায়তা করে। সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মা-বাবা তাঁদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে প্রেরণে উৎসাহিত হন, অব্যাহত শিক্ষায় নিজেকে প্রবেশ করতে উৎসাহ পান এবং উন্নয়নের দিকে দেশকে ধাবিত করার ক্ষেত্রে সচেষ্ট ও সরকারকে চাপ প্রয়োগে সাহায্য করে থাকেন।
১৯৬৬ সাল থেকে ইউনেস্কো ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। এ দিবসটি পালনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষকে তারা বলতে চায়, সাক্ষরতা একটি মানবীয় অধিকার এবং সর্বস্তরের শিক্ষার ভিত্তি। এ বছরে দিবসটির প্রতিপাদ্য 'সাক্ষরতা ও শান্তি'। ইউনেস্কোর এ প্রতিপাদ্যকে বেছে নেওয়ার উদ্দেশ্য হলো সাক্ষরতার বহুবিধ ব্যবহার ও গুরুত্ব, যা মানুষের মধ্যে আনয়নের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। শুধু সাক্ষরতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তিই নয়; বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক মুক্তি আনয়নের মাধ্যমে প্রাত্যহিক জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই এর লক্ষ্য। কেননা সাক্ষরতা ও শান্তি আনয়নে অবদান রাখে এবং মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করে। শুধু তা-ই নয়, বিশ্ব সম্পর্কে ভালো ধারণা অর্জনেও সাক্ষরতা কাজ করে। যিনি লিখতে ও পড়তে পারবেন, একমাত্র তিনিই জানবেন দেশ ও দেশের বাইরে কোথায় কী ঘটছে। এটি এমন একটি মাধ্যম, যা পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত নিরসন এবং প্রতিরোধেও সহায়তা করে। সাক্ষরতার সঙ্গে শান্তির সম্পর্ক বা যোগাযোগ এতটাই বেশি যে অস্থিতিশীল, অগণতন্ত্রকামী এবং সংঘাতপূর্ণ দেশগুলো সাক্ষরতার পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত করা কিংবা বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আমরা আফ্রিকা মহাদেশের কিছু দেশে লক্ষ করি, যেখানে শান্তির পরিবর্তে প্রতিনিয়ত সংঘাত চলছে। এসব দেশে সাক্ষরতার চিত্র ভালো নয়। মূলত তাদের দিকে তাকালে সাক্ষরতার সঙ্গে শান্তি প্রত্যয়টির একটি যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের রয়েছে সাক্ষরতা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার দীর্ঘ ঐতিহ্য। এ অঞ্চলে সাক্ষরতার জন্য সর্বপ্রথম সাংগঠনিক উদ্যোগ গৃহীত হয় ১৯১৮ সালে নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ১৯৩৪ সালে খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ ও নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র। ১৯৬০ সালে ভি-এইড কার্যক্রমের আওতায় সফলতার সঙ্গে পরিচালিত বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয় শত শত দরিদ্র মানুষ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালে ব্যুরো অব নন ফরমাল এডুকেশন গঠিত হয়। শুধু তা-ই নয়, সাক্ষরতা সমস্যা উত্তরণে বহুবিধ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ১৯৯১ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের শিক্ষাবৃত্তি ও বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়েও শিক্ষাবৃত্তি চালু রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে ৬-১০ বছরের ছেলেমেয়েদের জন্য বিনা মূল্যে মৌলিক শিক্ষা প্রদানের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সরকার ২০১৪ সাল নাগাদ দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করার ঘোষণা দিলেও জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর চূড়ান্ত খসড়া মতে, বর্তমানে ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের সাক্ষরতার হার ৪৯ শতাংশ অর্থাৎ ১৫ বছর বয়সীদের ৫১ শতাংশ এখনো নিরক্ষর।
সব মানুষকে সাক্ষরতার আওতায় আনয়নের লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের মৌলিক উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতিতে বয়স্ক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়টি অধিক গুরুত্ব পাওয়া। শিক্ষানীতির রিপোর্টের তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে, বয়স্ক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে ২০১৪ সালের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক সব নাগরিককে সাক্ষর করে তোলা। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অপ্রতুলতা ও অনমনীয়তা, অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও দারিদ্র্যের কারণে দেশে বিরাজমান নিরক্ষরতা ব্যাপক। নানা কারণে অনেক ছেলেমেয়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় না বা ভর্তি হয়েও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে না। নিরক্ষরতা সমস্যা সমাধানের জন্য শিক্ষার্থীর বয়স ও শিক্ষাবিষয়কে ভিত্তি করে বয়স্ক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে কার্যকর গণশিক্ষার বিস্তার জরুরি। বয়স্ক শিক্ষার উদ্দেশ্য মানুষকে সাক্ষর, লেখাপড়া ও হিসাব-নিকাশে নূ্যনতম দক্ষ, মানসিক গুণাবলির চেতনায় উদ্দীপ্ত, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সচেতনভাবে গড়ে তোলা এবং পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন। প্রাথমিক পর্যায়ে ভর্তি ১০০ শতাংশে উন্নীত ও প্রাপ্তবয়স্ক সবাইকে সাক্ষর করে না তোলা পর্যন্ত বয়স্ক শিক্ষার এ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পরিপূরক ব্যবস্থা, যা প্রয়োজনে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারে। সরকারের শিক্ষানীতিতে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে কর্মোদ্যোগের সমন্বয়ের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোকে 'বাংলাদেশ অব্যাহত ও দক্ষতা শিক্ষায়' রূপান্তরিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বয়স্ক শিক্ষা ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রসারের জন্য যে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা পূরণ করার প্রয়োজনে যথাযথ আইনগত কাঠামো প্রবর্তনের কথাও বলা হয়েছে। সরকার ইতিমধ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে। সাক্ষরতা আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য সরকারের উপরোক্ত পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন আমরা দ্রুত আশা করতে পারি।
আমাদের লক্ষ্য ২০১৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নিরক্ষরতামুক্ত হিসেবে ঘোষণা করা। এ সময়ের মধ্যে আমরা সব মানুষকে যেকোনো ভাষা পড়তে, লিখতে ও শুনতে পারার ক্ষমতা অর্জন করাতে চাই। এ সময়ের মধ্যে সবাইকে মৌখিক ও লিখিতভাবে পড়তে, বুঝতে ও ব্যাখ্যা করতে, প্রকাশ করতে এবং হিসাব করার সক্ষমতা অর্জন করাতে চাই। বর্তমান বিশ্বে ৮০০ মিলিয়ন মানুষ এখনো সাক্ষরতা থেকে বঞ্চিত। নানা পদক্ষেপ গৃহীত হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশে সাক্ষরতার অগ্রগতির বিষয়টি ধীরগতিতে এগোচ্ছে। সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যে সবার জন্য মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি টেকসই উন্নয়নের আবশ্যিক অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকার ২০১৫ সালের মধ্যে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এ কথা সত্য যে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে; কিন্তু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার অঞ্চল ও জনসমষ্টিভেদে সাক্ষরতার হারের তারতম্য লক্ষ করা যায়। হাওর অঞ্চল ও আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় শিক্ষার ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা না থাকায় ওই অঞ্চলগুলোয় সাক্ষরতার হার অনেকটা স্থির।
সাক্ষরতা এমন একটি বিষয়, যা একজন ব্যক্তির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক মনোবল বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, যা বৃহত্তর সমাজকে প্রভাবিত করার মতো উপরোক্ত সব ক্ষেত্রে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা পালন করে। ক্ষুদ্র পরিসর থেকে বৃহত্তর পরিসরে শান্তি আনয়নে সাক্ষরতা কাজ করতে পারে। আমরা যদি সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে ও সরকারের সাক্ষরতা অভিযানের কৌশলগুলো কাজে লাগিয়ে সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হয়ে ব্যক্তিগত ও বৃহত্তর সামাজিক পরিমণ্ডলে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারি, তাহলে আজকের সাক্ষরতা দিবস ও এর প্রতিপাদ্য সার্থক হবে। এমনটি আশা সবার।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
neazahmed_2002@yahoo.com
No comments