মনের কোণে হীরে-মুক্তো-শুধু সুশাসনই হতে পারে একটি দলের 'আইডিওলজি' by ড. সা'দত হুসাইন
নোয়াখালী শহরে ১৯৫২ থেকে ১৯৬১ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আমার স্কুলজীবন কেটেছে। এ সময় রাজনীতির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। আমাদের বলতে আমার মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবসহ সবাইকে বোঝানো হয়েছে।
শুধু আমার এক মামা মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন, তবে তা উৎসাহ নিয়ে খবরের কাগজ পড়া পর্যন্ত। আমরা তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করতাম এবং মুসলিম লীগের বিরুদ্বে উসকানিমূলক কথা বলে তাঁকে খেপিয়ে তুলতাম। এটা আমাদের জন্য এক ধরনের মজার ব্যাপার ছিল এবং এ ব্যাপারে আমরা ভাইবোনরা সবাই জোটবদ্বূ ছিলাম। আমাদের পাড়ায় অর্থাৎ লইয়ার্স কলোনি এবং নোয়াখালী শহরে, যা মাইজদী কোর্ট হিসেবে সমধিক পরিচিত, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল না বললেই চলে। এটি ছিল খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের শহর। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নামিদামি ফুটবল খেলোয়াড় ও শিল্পীরা অনেকবার এ শহরে এসেছেন। তাঁরাই ছিলেন আমাদের আনন্দ-উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দু। শহরে যে দু-একজন লোক রাজনীতি করতেন, তাঁদের সবাই এড়িয়ে চলত এবং সুযোগ পেলে টিটকারি করত। আমাদের মাথায় যে চিন্তা সব সময় ঘুরপাক খেত তা হলো, কবে নবী চৌধুরীর মতো খেলোয়াড়ের খেলা আবার দেখব কিংবা উঁচুমানের নাটক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখব। এরূপ একটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে আমি অতীব কৃতিত্বের সঙ্গে স্কুলজীবন শেষ করে ঢাকার উদ্দেশে নোয়াখালী ত্যাগ করলাম।
ঢাকায় এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম এবং সাউথ হোস্টেলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে কলেজজীবন শুরু করলাম। প্রথম বছর মূলত পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছু করেছি বলে মনে হয় না। তখন প্রতিবছর ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যেত। প্রথম বছরের পরীক্ষার ফল খুবই ভালো হলো, আমি রীতিমতো 'লাইমলাইটে' চলে এলাম। এতে আমার মনে হলো, এবার পড়াশোনা ছাড়াও অন্যান্য কর্মকাণ্ডে আমি অংশ নিতে পারি। দ্বিতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষায় মোটামুটি ফল করলেই আমি আইএসসিতে প্রথম ১০-১২ জনের মধ্যে স্থান পেয়ে যাব।
এ সময় ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে ক্লাস বন্ধ থাকছে। ছাত্র ধর্মঘট। দু-একজন বয়স্ক সতীর্থের সঙ্গে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার মিটিংয়ে গেলাম। এক দিন, দুই দিন, তিন দিন এবং আরো কয়েক দিন। মিটিংয়ে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা উপস্থিত। অগ্নিঝরা বক্তৃতা দিতেন শাহ মোয়াজ্জেম, কাজী জাফর, ফজলুল হক মনি, এনায়েতুর রহমান, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো প্রমুখ। এরপর শোভাযাত্রা হতো। দু-এক দিন আমরা শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছি। আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠল। সরকার ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়ে তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স দুই বছর করে দিল। যেসব ছাত্র থার্ড ইয়ারে পড়ছিল, তারা রাতারাতি অটো-গ্র্যাজুয়েট হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ক্লাসে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেল। আমাদের নুরুল ইসলাম ভাই, পরবর্তীকালে বড় মাপের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও গণতন্ত্রী পার্টির প্রেসিডেন্ট তাঁদের একজন। তিনি ঢাকা কলেজ হোস্টেল ছেড়ে ইকবাল হলে (বর্তমানে জহুরুল হক হল) চলে গেলেন। এরই মধ্যে কাকতালীয়ভাবে আলাউদ্দিন আল-আজাদের লেখা 'জেগে আছি ধানকন্যা' বইটি আমার হাতে আসে। এ বইটি আসলে দুটি বইয়ের একক সংকলন। বইটি আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। বলা যায়, এর মাধ্যমে আমার চেতনার উন্মেষ ঘটে। আমি সমাজতান্ত্রিক ধারায় মানসিকভাবে গ্রথিত হই।
আমতলার মিটিং এবং শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতির প্রতি আমি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। বড় নেতাদের মতো চিত্তাকর্ষক বক্তৃতা দেওয়ার ইচ্ছা আমাকে পেয়ে বসে। আমি মন স্থির করে ফেললাম, আইএসসি পাসের পর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি না হয়ে ইকোনমিকসে ভর্তি হব এবং চুটিয়ে ছাত্ররাজনীতি করব। যেই চিন্তা সেই কাজ। পরের বছরই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অনার্স কোর্সে ভর্তি হলাম, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (EPSU) তখন একীভূত ছিল। আমি ইপসুর কর্মী হিসেবে নিজেকে তালিকাভুক্ত করলাম। হলে সিট পেতে তখন মাস তিনেক সময় লাগত। এ সময় আমি মান্নান ভূঁইয়ার রুমে 'ডাবলিং' করতাম। মান্নান ভূঁইয়া বেশির ভাগ সময়, এমনকি মাঝেমধ্যে রাতেও হলের বাইরে থাকতেন। ফলে তাঁর বিছানায় ঘুমানো এবং তাঁর টেবিলে পড়াশোনা করা সম্ভব হতো।
এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাম ধারার ছাত্রনেতা, বিভিন্ন বিভাগের মেধাবী সেরা ছাত্র, তরুণ কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। তাঁদের সাহচর্য এবং উৎসাহে বাম ধারার বহু গুরুত্বপূর্ণ বই পড়ে ফেলি। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইপসুর কর্তৃত্বাধীন ছিল। যেসব ছাত্রনেতা এ হলে অবস্থান করতেন বা ঘন ঘন আসা-যাওয়া করতেন, তাঁরা হলেন- কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, মান্নান ভূঁইয়া, গিয়াস কামাল চৌধুরী এবং আইয়ুব রেজা চৌধুরী। মেধাবী সেরা ছাত্র হিসেবে যাঁদের কাছে পেয়েছি তাঁরা হলেন- ড. এস এ সামাদ, ড. ফরাসউদ্দিন আহমেদ, ড. আকবর আলি খান, এ কে এম জালাল উদ্দিন, শাহ হাসান ইমাম, ড. কামাল সিদ্দিকী, ড. শফি উল্লাহ, ড. মান্নান, ড. মাহবুব উল্লাহ, জিশান হুসাইন, ড. জাইদী সাত্তার, মাহবুব হুসেন খান এবং হায়দার আনোয়ার খান জুনো। তরুণ কবি-সাহিত্যিক- যাঁদের কাছে থেকে দেখার বা যাঁদের সানি্নধ্যে আসার সুযোগ হয়েছিল তাঁরা হলেন- সৈয়দ আবদুস শাকুর, এস এ সামাদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, ফারুক আলমগীর, বুলবুল খান মাহাবুব, হায়াৎ সাইফ, রফিক আজাদ, ইমরুল চৌধুরী প্রমুখ। জাতীয় পর্যায়ের অনেক শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকের সঙ্গেও আমার পরিচয় হয়।
ছাত্র ইউনিয়নের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে কাজ করে আমি বছর দুয়েকের মধ্যে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় সারির নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করি। স্নাতক তৃতীয় বর্ষে আমি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল বার্ষিকীর সম্পাদক এবং স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় হল সংসদের নির্বাচিত জেনারেল সেক্রেটারি পদে অধিষ্ঠিত হই। তখন আমি বাম রাজনীতিতে সম্পূর্ণরূপে দীক্ষিত। কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা ইশারা-ইঙ্গিতে আমাকে দলে ভর্তি হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টি এবং ছাত্র ইউনিয়ন উভয়ই তখন রাশিয়া এবং চীনপন্থী- এই দুই ভাগে বিভক্ত। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সবাই আমরা চীনপন্থী মেনন গ্রুপের সদস্য। ছাত্রফ্রন্টে রাশেদ খান মেনন, কমিউনিস্ট ফ্রন্টে কাজী জাফর ও আনোয়ার জাহিদ এবং জাতীয় রাজনৈতিক ফ্রন্টে মওলানা ভাসানী আমাদের নেতা। আমরা তাঁদের অন্ধ অনুসারী ভক্ত। তাঁদের নির্দেশে যেকোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত। ইতিহাসের চাকাকে এগিয়ে নিতে, প্রগতির ধারাকে প্রবহমান রাখতে, শ্রমিকের ঝাণ্ডাকে সমুন্নত রাখতে এবং ভুখা-নাঙ্গা-মেহনতি মানুষের সংগ্রাম জয়ী করতে যেকোনো স্বার্থত্যাগের ঘোষণা আমরা কথায় কথায় বাংলা-ইংরেজিতে উচ্চারণ করতাম। এর কিছু অংশ বোধ হয় মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতাম। হয়তো বা সে কারণেই সিএসএসএর লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার পরও আমরা ঊনসত্তরের আন্দোলনে রাস্তায় শোভাযাত্রা করেছি। তেজগাঁও বিমানবন্দরে মওলানা ভাসানীকে দলেবলে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাঁকে নিয়ে মিছিল করে শহীদ মিনারে এসেছি, তাঁর বক্তৃতা শুনেছি। মজার ব্যাপার, শহীদ মিনারে বক্তৃতা চলাকালেই আইয়ুব খানের পদত্যাগ, ইয়াহিয়া খান কর্তৃক মার্শাল ল জারির খবর এলে মিটিং শেষ হয়ে যায় এবং আমরা নীলক্ষেত বাজার থেকে ডিম আর আলু কিনে বাসায় ফিরে আসি। লিখিত পরীক্ষার ধারাবাহিকতায় মৌখিক পরীক্ষা শেষ করি এবং কয়েক মাসের মধ্যে সিএসপি ক্যাডারে চাকরি পেয়ে যাই। ঊনসত্তরের অক্টোবরে ফেরারি নেতা কাজী জাফরের গোপন আস্তানায় ভূরিভোজে আপ্যায়িত হয়ে তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে লাহোর একাডেমীতে যোগদানের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করি।
ছাত্ররাজনীতির যে প্রভাব আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়েছে তা হলো, গণমানুষের অধিকার ও স্বার্থের প্রতি সচেতন শ্রদ্বাবোধ জাগরূক রাখা। ফলে চাকরিজীবনে আমি কোনো গণদ্রোহী কাজ করিনি। কিন্তু দীর্ঘদিন সরকার পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে, সরকার প্রধান এবং মন্ত্রিসভার সদস্যদের খুব কাছে থেকে দেখে, তাঁদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজকর্ম করে বিভিন্ন শাসক দলের রাজনৈতিক 'আইডিওলজি' এবং তাদের প্রশাসনব্যবস্থার সংযোগহীনতা প্রকটভাবে চোখে পড়েছে, যা আমার পূর্বলালিত চিন্তাচেতনাকে ভয়ানকভাবে নাড়া দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বে যত রকম সরকার ব্যবস্থা চিন্তা করা যায়, একমাত্র নিখাদ রাজতন্ত্র ছাড়া অন্য প্রায় সব ধরনের সরকার বাংলাদেশে কোনো না কোনো সময় চালু ছিল। ধর্মীয় এবং বাম- এই ধারার কয়েকটি চরমপন্থী দল ছাড়া অন্যান্য দলের প্রায় সব নামকরা নেতা রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, মন্ত্রী বা উপদেষ্টা হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। শাসনব্যবস্থা বা প্রশাসনিক কর্মে তাঁদের 'আইডিওলজির' কোনো স্বতন্ত্র, সুস্পষ্ট ছাপ দেখা যায়নি। ডান, বাম, ধর্মীয় কিংবা উদার গণতান্ত্রিক দল- নির্বিশেষে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত সবাই একই প্রশাসনিক সংস্কৃতি লালন করেছেন। ব্যক্তিগত আচার-আচরণে সামান্য তারতম্য দেখা গেলেও একটি উন্নতমানের নতুন প্রশাসনিক ধারা সৃষ্টিতে তা লক্ষণীয় কোনো অবদান রাখতে পারেনি। দীর্ঘদিনের অভ্যাস বশত তাঁরা 'আইডিওলজির' কথা বলছেন, বিশ্বের নতুন বাস্তবতায় প্রকৃতপক্ষে যার কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই।
গত দুই দশকে বিশ্বে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বড় রকমের পরিবর্তন এসেছে। মৌল সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এখন কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না। নতুনভাবে এরূপ ব্যবস্থা কোনো দেশে সাম্প্রতিককালে প্রচলিত হয়নি। সমাজতান্ত্রিক খ্যাতিতে পরিচিত দেশগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত উৎপাদনী ইউনিটগুলোর পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানাধীন অজস্র ইউনিট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে পরিচালিত এসব ইউনিটের মালিকরা লাভের অর্থ উপভোগ করছে এবং নিজেদের সহায়-সম্পদ বৃদ্ধি করছে। এসব দেশের অর্থনীতিকে বড়জোর মিশ্র অর্থনীতি বলা যেতে পারে। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রায় সব বৈশিষ্ট্যই এ ক্ষেত্রে বিরাজমান। নিখাদ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ডাক দিয়ে বর্তমান সময়ে কোনো আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। একইভাবে রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার দিক থেকে শ্রমিক শাসন, বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল, চূড়ান্ত নীতি-নির্ধারণী পলিটব্যুরো, বিপ্লবী জনকমান্ড, শূরা কাউন্সিল গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা এখন নেই বললেই চলে। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো বা সরকার উৎখাত করা এখনো একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে সরকার পতনের পর পরই এরূপ ক্ষেত্রে নির্বাচনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়। সামরিক আইন জারি করে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল না করলে কোনো দেশে অগণতান্ত্রিক সরকার এমনকি 'পিপল পাওয়ার'-এর ভিত্তিতে গঠিত সরকারও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে পারে না। অগণতান্ত্রিকভাবে যেসব রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাদের অনেকেই এখন ক্ষমতাসীন রয়েছে। তবে নতুনভাবে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সামরিক শাসকগোষ্ঠী ছাড়া অন্য কোনো দলের অগণতান্ত্রিক উপায়ে দীর্ঘমেয়াদের জন্য শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠান বা অবস্থান বর্তমান বিশ্বে আর সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। যেকোনো দলকে দীর্ঘমেয়াদের জন্য ক্ষমতায় যেতে হলে একমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমেই যেতে হবে, সে নির্বাচন যত নিম্নমানেরই হোক না কেন। নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো চরমপন্থা বা শুধু সশস্ত্র সংগ্রাম দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় আরোহণের কৌশল হিসেবে অকার্যকর, এমনটি বললে অত্যুক্তি হবে না। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের বাম রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো স্লোগান নিয়ে এগোতে পারছে না। সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে বড় সফল সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে নেপালের মাওবাদী কমিউনিস্ট দল। কিন্তু তাদেরও সরকার গঠনের জন্য সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠান এবং দীর্ঘমেয়াদে অবস্থানের জন্য সামরিক শাসক ছাড়া সব দল বা গোষ্ঠীকে চূড়ান্ত বিবেচনায় উদার গণতান্ত্রিক পন্থা (Liberal Democretic System) অবলম্বন করতে হবে। সরকার পদ্ধতি যা-ই হোক না কেন, তাদের কোনো না কোনো উপায়ে সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। নির্বাচনে ভালো ফল করার কৌশল তাদের রপ্ত করতে হবে। সে কৌশল হিসেবে 'আইডিওলজির' আবরণে কোনো স্লোগান, নিজেদের উল্লেখযোগ্য কোনো পরিচিতি, ভাবাবেগ আপ্লুত করার উপযোগী কোনো দাবি, এমনকি ধর্মীয় আবেদন এবং আঞ্চলিকতাকেও কোনো কোনো দল ব্যবহার করতে পারে। ভোটার বা জনগণ একেক সময় একেক স্লোগানে আকৃষ্ট হয়। ভোটের পর নতুন দলের শাসনব্যবস্থা প্রচলিত হলে তারা প্রায়ই প্রতারিত হয়। তারা দেখতে পায়, সরবে ঘোষিত আবেগ-উদ্দীপক ও চিত্তাকর্ষক 'আইডিওলজি' বাষ্পীয় উপাদানে পর্যবসিত হয়েছে। তবুও সাধারণ নির্বাচন সরকারের বৈধতা দেয়, যা উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় শক্তি। সরকার গঠনের জন্য সাধারণ নির্বাচনের বিকল্প অন্য ব্যবস্থা কোনো দেশের জনগণ মেনে নিতে রাজি নয়।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ডান, বাম, মধ্যকেন্দ্রিক, চরমপন্থী, এমনকি সামরিক শাসক অথবা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার- সবাইকে প্রায় একই ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হয়। ভোটার বা জনগণ চায় রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানি, খাদ্যসামগ্রী, জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা, জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি, দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়যুগ এবং দক্ষ প্রশাসন। তারা চায় জবাবদিহিতা, শান্তি এবং স্বস্তি সহযোগে সমৃদ্ধি; একই সঙ্গে অসহনীয় আয় ও সম্পদবৈষমের অবসান। এসব নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন একমাত্র 'সুশাসন'। এ ক্ষেত্রে সুশাসনকে ব্যাপক অর্থে বোঝানো হচ্ছে। বাংলাদেশে সুশাসন বলতে গণতান্ত্রিক চর্চা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা, প্রতিহিংসা এবং সংস্কারমুক্ত মানসিকতা, জবাবদিহিতা, মানবাধিকারের প্রতি উচ্চ অগ্রাধিকার, সর্বক্ষেত্রে ন্যায়ানুগ আচরণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ অন্তর্ভুক্ত হবে।
একটি দলের বিঘোষিত স্বতন্ত্র 'আইডিওলজি' না থাকলেও যদি তারা সুশাসনের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি দিতে পারে এবং তাদের প্রতিভাবান সংগঠক থাকে, তবে সে দল জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে। তাদের সাহস করে বলতে হবে, তাদের একমাত্র অঙ্গীকার হচ্ছে সুশাসন ও জনকল্যাণ। ক্ষমতায় আরোহণের পর যদি তারা উপরোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি সযত্ন দৃষ্টি রেখে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, তবে জনগণ কোনো দিন তাদের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবে না, তাদের হতাশ করবে না। তাদের জন্য ক্ষণিক চাঞ্চল্যকর স্লোগান বা গণচিত্তাকর্ষক ফাঁকা প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন হবে না। কর্মই হবে তাদের সাফল্যের চাবিকাঠি। তবে যে বর্ম তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে, সেটি হচ্ছে নিশ্ছিদ্র এবং অলঙ্ঘনীয়
গণতান্ত্রিক পরিবেশ।
লেখক : পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
ঢাকায় এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম এবং সাউথ হোস্টেলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে কলেজজীবন শুরু করলাম। প্রথম বছর মূলত পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছু করেছি বলে মনে হয় না। তখন প্রতিবছর ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যেত। প্রথম বছরের পরীক্ষার ফল খুবই ভালো হলো, আমি রীতিমতো 'লাইমলাইটে' চলে এলাম। এতে আমার মনে হলো, এবার পড়াশোনা ছাড়াও অন্যান্য কর্মকাণ্ডে আমি অংশ নিতে পারি। দ্বিতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষায় মোটামুটি ফল করলেই আমি আইএসসিতে প্রথম ১০-১২ জনের মধ্যে স্থান পেয়ে যাব।
এ সময় ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে ক্লাস বন্ধ থাকছে। ছাত্র ধর্মঘট। দু-একজন বয়স্ক সতীর্থের সঙ্গে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার মিটিংয়ে গেলাম। এক দিন, দুই দিন, তিন দিন এবং আরো কয়েক দিন। মিটিংয়ে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা উপস্থিত। অগ্নিঝরা বক্তৃতা দিতেন শাহ মোয়াজ্জেম, কাজী জাফর, ফজলুল হক মনি, এনায়েতুর রহমান, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো প্রমুখ। এরপর শোভাযাত্রা হতো। দু-এক দিন আমরা শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছি। আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠল। সরকার ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়ে তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স দুই বছর করে দিল। যেসব ছাত্র থার্ড ইয়ারে পড়ছিল, তারা রাতারাতি অটো-গ্র্যাজুয়েট হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ক্লাসে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেল। আমাদের নুরুল ইসলাম ভাই, পরবর্তীকালে বড় মাপের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও গণতন্ত্রী পার্টির প্রেসিডেন্ট তাঁদের একজন। তিনি ঢাকা কলেজ হোস্টেল ছেড়ে ইকবাল হলে (বর্তমানে জহুরুল হক হল) চলে গেলেন। এরই মধ্যে কাকতালীয়ভাবে আলাউদ্দিন আল-আজাদের লেখা 'জেগে আছি ধানকন্যা' বইটি আমার হাতে আসে। এ বইটি আসলে দুটি বইয়ের একক সংকলন। বইটি আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। বলা যায়, এর মাধ্যমে আমার চেতনার উন্মেষ ঘটে। আমি সমাজতান্ত্রিক ধারায় মানসিকভাবে গ্রথিত হই।
আমতলার মিটিং এবং শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতির প্রতি আমি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। বড় নেতাদের মতো চিত্তাকর্ষক বক্তৃতা দেওয়ার ইচ্ছা আমাকে পেয়ে বসে। আমি মন স্থির করে ফেললাম, আইএসসি পাসের পর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি না হয়ে ইকোনমিকসে ভর্তি হব এবং চুটিয়ে ছাত্ররাজনীতি করব। যেই চিন্তা সেই কাজ। পরের বছরই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অনার্স কোর্সে ভর্তি হলাম, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (EPSU) তখন একীভূত ছিল। আমি ইপসুর কর্মী হিসেবে নিজেকে তালিকাভুক্ত করলাম। হলে সিট পেতে তখন মাস তিনেক সময় লাগত। এ সময় আমি মান্নান ভূঁইয়ার রুমে 'ডাবলিং' করতাম। মান্নান ভূঁইয়া বেশির ভাগ সময়, এমনকি মাঝেমধ্যে রাতেও হলের বাইরে থাকতেন। ফলে তাঁর বিছানায় ঘুমানো এবং তাঁর টেবিলে পড়াশোনা করা সম্ভব হতো।
এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাম ধারার ছাত্রনেতা, বিভিন্ন বিভাগের মেধাবী সেরা ছাত্র, তরুণ কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। তাঁদের সাহচর্য এবং উৎসাহে বাম ধারার বহু গুরুত্বপূর্ণ বই পড়ে ফেলি। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইপসুর কর্তৃত্বাধীন ছিল। যেসব ছাত্রনেতা এ হলে অবস্থান করতেন বা ঘন ঘন আসা-যাওয়া করতেন, তাঁরা হলেন- কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, মান্নান ভূঁইয়া, গিয়াস কামাল চৌধুরী এবং আইয়ুব রেজা চৌধুরী। মেধাবী সেরা ছাত্র হিসেবে যাঁদের কাছে পেয়েছি তাঁরা হলেন- ড. এস এ সামাদ, ড. ফরাসউদ্দিন আহমেদ, ড. আকবর আলি খান, এ কে এম জালাল উদ্দিন, শাহ হাসান ইমাম, ড. কামাল সিদ্দিকী, ড. শফি উল্লাহ, ড. মান্নান, ড. মাহবুব উল্লাহ, জিশান হুসাইন, ড. জাইদী সাত্তার, মাহবুব হুসেন খান এবং হায়দার আনোয়ার খান জুনো। তরুণ কবি-সাহিত্যিক- যাঁদের কাছে থেকে দেখার বা যাঁদের সানি্নধ্যে আসার সুযোগ হয়েছিল তাঁরা হলেন- সৈয়দ আবদুস শাকুর, এস এ সামাদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, ফারুক আলমগীর, বুলবুল খান মাহাবুব, হায়াৎ সাইফ, রফিক আজাদ, ইমরুল চৌধুরী প্রমুখ। জাতীয় পর্যায়ের অনেক শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকের সঙ্গেও আমার পরিচয় হয়।
ছাত্র ইউনিয়নের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে কাজ করে আমি বছর দুয়েকের মধ্যে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় সারির নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করি। স্নাতক তৃতীয় বর্ষে আমি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল বার্ষিকীর সম্পাদক এবং স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় হল সংসদের নির্বাচিত জেনারেল সেক্রেটারি পদে অধিষ্ঠিত হই। তখন আমি বাম রাজনীতিতে সম্পূর্ণরূপে দীক্ষিত। কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা ইশারা-ইঙ্গিতে আমাকে দলে ভর্তি হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টি এবং ছাত্র ইউনিয়ন উভয়ই তখন রাশিয়া এবং চীনপন্থী- এই দুই ভাগে বিভক্ত। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সবাই আমরা চীনপন্থী মেনন গ্রুপের সদস্য। ছাত্রফ্রন্টে রাশেদ খান মেনন, কমিউনিস্ট ফ্রন্টে কাজী জাফর ও আনোয়ার জাহিদ এবং জাতীয় রাজনৈতিক ফ্রন্টে মওলানা ভাসানী আমাদের নেতা। আমরা তাঁদের অন্ধ অনুসারী ভক্ত। তাঁদের নির্দেশে যেকোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত। ইতিহাসের চাকাকে এগিয়ে নিতে, প্রগতির ধারাকে প্রবহমান রাখতে, শ্রমিকের ঝাণ্ডাকে সমুন্নত রাখতে এবং ভুখা-নাঙ্গা-মেহনতি মানুষের সংগ্রাম জয়ী করতে যেকোনো স্বার্থত্যাগের ঘোষণা আমরা কথায় কথায় বাংলা-ইংরেজিতে উচ্চারণ করতাম। এর কিছু অংশ বোধ হয় মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতাম। হয়তো বা সে কারণেই সিএসএসএর লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার পরও আমরা ঊনসত্তরের আন্দোলনে রাস্তায় শোভাযাত্রা করেছি। তেজগাঁও বিমানবন্দরে মওলানা ভাসানীকে দলেবলে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাঁকে নিয়ে মিছিল করে শহীদ মিনারে এসেছি, তাঁর বক্তৃতা শুনেছি। মজার ব্যাপার, শহীদ মিনারে বক্তৃতা চলাকালেই আইয়ুব খানের পদত্যাগ, ইয়াহিয়া খান কর্তৃক মার্শাল ল জারির খবর এলে মিটিং শেষ হয়ে যায় এবং আমরা নীলক্ষেত বাজার থেকে ডিম আর আলু কিনে বাসায় ফিরে আসি। লিখিত পরীক্ষার ধারাবাহিকতায় মৌখিক পরীক্ষা শেষ করি এবং কয়েক মাসের মধ্যে সিএসপি ক্যাডারে চাকরি পেয়ে যাই। ঊনসত্তরের অক্টোবরে ফেরারি নেতা কাজী জাফরের গোপন আস্তানায় ভূরিভোজে আপ্যায়িত হয়ে তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে লাহোর একাডেমীতে যোগদানের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করি।
ছাত্ররাজনীতির যে প্রভাব আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়েছে তা হলো, গণমানুষের অধিকার ও স্বার্থের প্রতি সচেতন শ্রদ্বাবোধ জাগরূক রাখা। ফলে চাকরিজীবনে আমি কোনো গণদ্রোহী কাজ করিনি। কিন্তু দীর্ঘদিন সরকার পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে, সরকার প্রধান এবং মন্ত্রিসভার সদস্যদের খুব কাছে থেকে দেখে, তাঁদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজকর্ম করে বিভিন্ন শাসক দলের রাজনৈতিক 'আইডিওলজি' এবং তাদের প্রশাসনব্যবস্থার সংযোগহীনতা প্রকটভাবে চোখে পড়েছে, যা আমার পূর্বলালিত চিন্তাচেতনাকে ভয়ানকভাবে নাড়া দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বে যত রকম সরকার ব্যবস্থা চিন্তা করা যায়, একমাত্র নিখাদ রাজতন্ত্র ছাড়া অন্য প্রায় সব ধরনের সরকার বাংলাদেশে কোনো না কোনো সময় চালু ছিল। ধর্মীয় এবং বাম- এই ধারার কয়েকটি চরমপন্থী দল ছাড়া অন্যান্য দলের প্রায় সব নামকরা নেতা রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, মন্ত্রী বা উপদেষ্টা হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। শাসনব্যবস্থা বা প্রশাসনিক কর্মে তাঁদের 'আইডিওলজির' কোনো স্বতন্ত্র, সুস্পষ্ট ছাপ দেখা যায়নি। ডান, বাম, ধর্মীয় কিংবা উদার গণতান্ত্রিক দল- নির্বিশেষে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত সবাই একই প্রশাসনিক সংস্কৃতি লালন করেছেন। ব্যক্তিগত আচার-আচরণে সামান্য তারতম্য দেখা গেলেও একটি উন্নতমানের নতুন প্রশাসনিক ধারা সৃষ্টিতে তা লক্ষণীয় কোনো অবদান রাখতে পারেনি। দীর্ঘদিনের অভ্যাস বশত তাঁরা 'আইডিওলজির' কথা বলছেন, বিশ্বের নতুন বাস্তবতায় প্রকৃতপক্ষে যার কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই।
গত দুই দশকে বিশ্বে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বড় রকমের পরিবর্তন এসেছে। মৌল সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এখন কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না। নতুনভাবে এরূপ ব্যবস্থা কোনো দেশে সাম্প্রতিককালে প্রচলিত হয়নি। সমাজতান্ত্রিক খ্যাতিতে পরিচিত দেশগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত উৎপাদনী ইউনিটগুলোর পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানাধীন অজস্র ইউনিট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে পরিচালিত এসব ইউনিটের মালিকরা লাভের অর্থ উপভোগ করছে এবং নিজেদের সহায়-সম্পদ বৃদ্ধি করছে। এসব দেশের অর্থনীতিকে বড়জোর মিশ্র অর্থনীতি বলা যেতে পারে। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রায় সব বৈশিষ্ট্যই এ ক্ষেত্রে বিরাজমান। নিখাদ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ডাক দিয়ে বর্তমান সময়ে কোনো আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। একইভাবে রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার দিক থেকে শ্রমিক শাসন, বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল, চূড়ান্ত নীতি-নির্ধারণী পলিটব্যুরো, বিপ্লবী জনকমান্ড, শূরা কাউন্সিল গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা এখন নেই বললেই চলে। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো বা সরকার উৎখাত করা এখনো একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে সরকার পতনের পর পরই এরূপ ক্ষেত্রে নির্বাচনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়। সামরিক আইন জারি করে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল না করলে কোনো দেশে অগণতান্ত্রিক সরকার এমনকি 'পিপল পাওয়ার'-এর ভিত্তিতে গঠিত সরকারও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে পারে না। অগণতান্ত্রিকভাবে যেসব রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাদের অনেকেই এখন ক্ষমতাসীন রয়েছে। তবে নতুনভাবে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সামরিক শাসকগোষ্ঠী ছাড়া অন্য কোনো দলের অগণতান্ত্রিক উপায়ে দীর্ঘমেয়াদের জন্য শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠান বা অবস্থান বর্তমান বিশ্বে আর সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। যেকোনো দলকে দীর্ঘমেয়াদের জন্য ক্ষমতায় যেতে হলে একমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমেই যেতে হবে, সে নির্বাচন যত নিম্নমানেরই হোক না কেন। নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো চরমপন্থা বা শুধু সশস্ত্র সংগ্রাম দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় আরোহণের কৌশল হিসেবে অকার্যকর, এমনটি বললে অত্যুক্তি হবে না। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের বাম রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো স্লোগান নিয়ে এগোতে পারছে না। সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে বড় সফল সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে নেপালের মাওবাদী কমিউনিস্ট দল। কিন্তু তাদেরও সরকার গঠনের জন্য সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠান এবং দীর্ঘমেয়াদে অবস্থানের জন্য সামরিক শাসক ছাড়া সব দল বা গোষ্ঠীকে চূড়ান্ত বিবেচনায় উদার গণতান্ত্রিক পন্থা (Liberal Democretic System) অবলম্বন করতে হবে। সরকার পদ্ধতি যা-ই হোক না কেন, তাদের কোনো না কোনো উপায়ে সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। নির্বাচনে ভালো ফল করার কৌশল তাদের রপ্ত করতে হবে। সে কৌশল হিসেবে 'আইডিওলজির' আবরণে কোনো স্লোগান, নিজেদের উল্লেখযোগ্য কোনো পরিচিতি, ভাবাবেগ আপ্লুত করার উপযোগী কোনো দাবি, এমনকি ধর্মীয় আবেদন এবং আঞ্চলিকতাকেও কোনো কোনো দল ব্যবহার করতে পারে। ভোটার বা জনগণ একেক সময় একেক স্লোগানে আকৃষ্ট হয়। ভোটের পর নতুন দলের শাসনব্যবস্থা প্রচলিত হলে তারা প্রায়ই প্রতারিত হয়। তারা দেখতে পায়, সরবে ঘোষিত আবেগ-উদ্দীপক ও চিত্তাকর্ষক 'আইডিওলজি' বাষ্পীয় উপাদানে পর্যবসিত হয়েছে। তবুও সাধারণ নির্বাচন সরকারের বৈধতা দেয়, যা উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় শক্তি। সরকার গঠনের জন্য সাধারণ নির্বাচনের বিকল্প অন্য ব্যবস্থা কোনো দেশের জনগণ মেনে নিতে রাজি নয়।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ডান, বাম, মধ্যকেন্দ্রিক, চরমপন্থী, এমনকি সামরিক শাসক অথবা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার- সবাইকে প্রায় একই ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হয়। ভোটার বা জনগণ চায় রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানি, খাদ্যসামগ্রী, জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা, জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি, দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়যুগ এবং দক্ষ প্রশাসন। তারা চায় জবাবদিহিতা, শান্তি এবং স্বস্তি সহযোগে সমৃদ্ধি; একই সঙ্গে অসহনীয় আয় ও সম্পদবৈষমের অবসান। এসব নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন একমাত্র 'সুশাসন'। এ ক্ষেত্রে সুশাসনকে ব্যাপক অর্থে বোঝানো হচ্ছে। বাংলাদেশে সুশাসন বলতে গণতান্ত্রিক চর্চা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা, প্রতিহিংসা এবং সংস্কারমুক্ত মানসিকতা, জবাবদিহিতা, মানবাধিকারের প্রতি উচ্চ অগ্রাধিকার, সর্বক্ষেত্রে ন্যায়ানুগ আচরণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ অন্তর্ভুক্ত হবে।
একটি দলের বিঘোষিত স্বতন্ত্র 'আইডিওলজি' না থাকলেও যদি তারা সুশাসনের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি দিতে পারে এবং তাদের প্রতিভাবান সংগঠক থাকে, তবে সে দল জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে। তাদের সাহস করে বলতে হবে, তাদের একমাত্র অঙ্গীকার হচ্ছে সুশাসন ও জনকল্যাণ। ক্ষমতায় আরোহণের পর যদি তারা উপরোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি সযত্ন দৃষ্টি রেখে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, তবে জনগণ কোনো দিন তাদের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবে না, তাদের হতাশ করবে না। তাদের জন্য ক্ষণিক চাঞ্চল্যকর স্লোগান বা গণচিত্তাকর্ষক ফাঁকা প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন হবে না। কর্মই হবে তাদের সাফল্যের চাবিকাঠি। তবে যে বর্ম তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে, সেটি হচ্ছে নিশ্ছিদ্র এবং অলঙ্ঘনীয়
গণতান্ত্রিক পরিবেশ।
লেখক : পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
No comments