কালের আয়নায়-বদরুদ্দীন উমরের একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে যদি ক্ষমতা হারায়, তাতে ড. ইউনূস ক্ষমতায় যাবেন সে সম্ভাবনা আমি দেখি না। কোনো পরাশক্তি বা সুশীল সমাজ চাইলেও নয়। বাংলাদেশে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের বাইরে তৃতীয় রাজনৈতিক দলের উত্থানের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমি এখনও তৈরি হয়নি।


ড. ইউনূস নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পরই রাজনৈতিক দল গঠন করতে গিয়ে দেখেছেন নোবেল পুরস্কারের মহিমাও তাকে রাজনৈতিক দল গঠনে জনসমর্থন এনে দেয়নি



লন্ডনের আকাশে ঘন মেঘ জমলেই ঝড়-বৃষ্টি যে হবেই তা কেউ বলতে পারে না। দেখা গেল, ঘন কালো মেঘ ঘনিয়ে আসার কিছুক্ষণ পরই মেঘ কেটে গেছে। চারদিকে ঝকঝকে রোদ। এ জন্যই বলা হয়, 'ব্রিটিশ ওয়েদার আনপ্রেডিকটেবল'। অর্থাৎ ব্রিটিশ আবহাওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশের ওয়েদার প্রেডিকটেবল। আকাশে ঘন কালো মেঘ জমলেই বৃষ্টি অথবা ঝড়সহ বৃষ্টি প্রায় নিশ্চিত।
এ জন্যই বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে এখন যে ঘনায়মান কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে, তাতে অনেকেই মনে করছেন একটা ঝড়-বৃষ্টি আসন্ন। কেউ কেউ বলছেন, দেশটা ব্যানানা রিপাবলিক হয়ে যাচ্ছে। সরকার প্রতিটি কাজে হোঁচট খাচ্ছে। অধিকাংশ মন্ত্রীর অদক্ষতা ও অযোগ্যতা প্রকট হয়ে উঠেছে। মন্ত্রিসভায় যে দু'চারজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ বলে পরিচিত, তাদের মধ্যে একজন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এমন সব কথাবার্তা বলছেন, যার ব্যাখ্যা আবার পরদিন দিতে হয়। অর্থের পরিমাণ দ্বারা অর্থমন্ত্রী দুর্নীতির সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে চাইছেন এবং লোক হাসাচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একা কত দিক সামলাবেন? অথচ এই অবস্থাটা তিনি নিজেই সৃষ্টি করেছেন। ক্ষমতায় বসার গোড়ায় এক দল অদক্ষ ও অনভিক্ষ লোককে কেবল আনুগত্যের ভিত্তিতে মন্ত্রী ও পারিষদ বানিয়ে আজ তিনি ঝড়ের মুখে নৌকা নিয়ে এগোতে পারছেন না। অনেক ভালো কাজ করেও ব্যর্থতার অভিযোগ কুড়াচ্ছেন। তার সুযোগ নিচ্ছে শুধু কোমর ভাঙা বিরোধী দল নয়; চক্রান্তের নীলনকশা বুননকারী দেশি-বিদেশি গণবিরোধী চক্রও। তাদের সম্মিলিত শক্তি দিন দিন বাড়ছে।
এখন সবার মুখেই প্রশ্ন, সামনে কী আছে? রাজনীতির আকাশে এত যে ঘনঘটা, তাতে কি ঝড়-বৃষ্টি আসন্ন? আর ঝড়-বৃষ্টি যদি আসেই তারপরে কী? আগামী নির্বাচনে কি বিএনপি-জামায়াতের অভিশপ্ত শাসন আবার ফিরে আসবেই? নাকি এক-এগারোর পুনরাবৃত্তি আবার ঘটবেই? বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্যে আবার কি দুর্ভাগ্য দেখা দেবে?
এসব প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব কারও জানা নেই। নানাজনে নানা কথা বলছেন। তার মধ্যে ৬ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবারের 'কালের কণ্ঠে' বদরুদ্দীন উমরের সাক্ষাৎকারটি চোখে পড়ল। তাতে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে তার বিশ্লেষণের সঙ্গে অনেকটাই সহমত পোষণ করি। তার মূল রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে আমার ঐকমত্য নেই। কিন্তু তার স্পষ্টবাদিতা আমি পছন্দ করি।
'কালের কণ্ঠে'র সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বদরুদ্দীন উমর কোনো 'ঢাকঢাক গুড়গুড়' ভাব দেখাননি। একটি প্রশ্নের জবাবে যা বলেছেন, তার মোদ্দা কথা হলো, দেশে সামরিক শাসন আসার শঙ্কা নেই। তবে ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের মতো কেউ আসতে পারে। ওরা ইউনূসকে ক্ষমতায় আনতে চায়। সে জন্যই হাসিনা তার পেছনে লেগেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। উমরের ধারণা, ড. ইউনূসকে ক্ষমতায় আনা হলে তা এক-এগারোর মতো সহজে যাবে না।
আমি বদরুদ্দীন উমরের বক্তব্যের প্রথম অংশ_ দেশে সামরিক শাসন আসার শঙ্কা নেই এবং ওরা (পশ্চিমা শক্তি) ড. ইউনূসকে বাংলাদেশে ক্ষমতায় বসাতে চায়_ এই বক্তব্যের সঙ্গে অনেকটা সহমত পোষণ করি। তবে এই কারণেই ড. ইউনূসের সঙ্গে শেখ হাসিনার বিরোধ কি-না সে সম্পর্কে উমরের মতো আমি নিঃসন্দেহ নই। আর ড. ইউনূসের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দূরের কথা, তিনি বহির্শক্তি এবং দেশের ভেতরের প্রতিক্রিয়াশীল দল ও গোষ্ঠীগুলোর সর্বাত্মক সহায়তা সত্ত্বেও ক্ষমতায় আসতে পারবেন কি-না সে সম্পর্কে আমার মনে দারুণ সন্দেহ রয়েছে। অবশ্য আমার অনুমান সঠিক নাও হতে পারে, সে কথাও আগেই কবুল করে রাখি।
আমি শেখ হাসিনার মনের কথা জানি না। তবে ব্যক্তি হাসিনা ও রাজনীতিক হাসিনার সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচিতির ফলে এ কথা বলতে পারি যে, তিনি ড. ইউনূসকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করেন না। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে ড. ইউনূসের কার্যকলাপ এবং বিভিন্ন সময়ে কখনও বিএনপি-জামায়াত এবং কখনও সামরিক শাসনের সমর্থক হিসেবে ড. ইউনূসের ভূমিকা গ্রহণে শেখ হাসিনা তার সম্পর্কে বিরূপ।
শেখ হাসিনা কেন ড. ইউনূসকে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে ভয় করতে যাবেন? প্রথম কথা, ড. ইউনূস চরিত্রে একজন রাজনীতিক ব্যক্তি নন, একজন সফল ব্যবসায়ী। তার পেছনে রাজনৈতিক সমর্থন নেই। বিপুল অর্থের মালিক এবং নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় বিপুল খ্যাতির অধিকারী হওয়ার পর রাজনৈতিক দল গঠন করতে গিয়ে ড. ইউনূস নিজেও এটা বুঝেছেন। তার শক্তির উৎস মার্কিন এস্টাবলিশমেন্ট, পশ্চিমা দাতা দেশ এবং তাদের অনুগ্রহভোগী একদল দেশীয় বুদ্ধিজীবী। এদের সমর্থন ছাড়া ড. ইউনূসের নিজস্ব কোনো অস্তিত্ব নেই। সুতরাং শেখ হাসিনা কেন তাকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করে তার পেছনে লাগতে যাবেন? হাসিনা নেতৃত্বে আর যত ত্রুটি থাকুক, তিনি নিজের শক্তিতে আস্থাবান।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনাকে প্রচণ্ড লড়াই করে টিকে থাকতে হয়েছে। তার জীবনের ওপরও হামলা হয়েছে বারবার। নির্বাচনে জয়-পরাজয় দুই-ই তার কপালে জুটেছে। তিনি এখন ভাঙা ঢোলের আওয়াজে ভয় পাবেন কেন? তার দলের ভেতরেই এক সময় ড. ইউনূসের চেয়েও শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল। তিনি ড. কামাল হোসেন। তিনি একাধারে খ্যাতনামা আইনজীবী, ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহকর্মী এবং তার মন্ত্রিসভায় প্রথমে আইন এবং পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর আস্থা ও সমর্থন অর্জন করেছিলেন। তথাপি তাকে ভয় না পেয়ে শেখ হাসিনা তাকে দেশের প্রেসিডেন্ট পদে দলের পক্ষ থেকে মনোনয়নও দিয়েছিলেন।
পরে ড. কামাল হোসেন যখন আওয়ামী লীগের ভেতরে শেখ হাসিনার বিরোধিতা শুরু করেন, তখনও শেখ হাসিনা তাকে দলে রেখেছেন; দল থেকে অপসারণের চেষ্টা করেননি। ড. কামাল হোসেন নিজেই দল থেকে বেরিয়ে গেছেন এবং নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। তখনও অনুমান করা হচ্ছিল, শেখ হাসিনা রাজনীতিতে গুরুত্ব হারাবেন এবং ড. কামাল হোসেন পশ্চিমা শক্তি ও দেশের সুশীল সমাজের সমর্থন নিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতায় উঠে আসবেন। এই আশায় কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙনের যুগে বাংলাদেশের বহু কমিউনিস্ট নেতা গণফোরামে যোগ দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে শুরু থেকেই ড. কামাল ও তার দল কোনো চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারেননি। বরং দেশের মূল রাজনীতির ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হিরো থেকে জিরো হয়ে গেছেন। এক সময় মনে হয়েছিল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে খ্যাত এবং বঙ্গবীর নামে কীর্তিত কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে ড. কামাল হোসেন ও ডা. বি. চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে মিলিত হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবেন। পরিণামে দেখা গেল, শূন্য যোগ শূন্য, যোগ আরও শূন্যের ফল যেমন মহাশূন্য, তেমনি কাদের সিদ্দিকীদের চ্যালেঞ্জও মহাশূন্যে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এসেছিল এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। শেখ হাসিনার রাজনীতি ও নেতৃত্ব নির্মূল করার লক্ষ্যে সুপরিকল্পিতভাবে মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয় এবং এর সমর্থনে দলের ভেতর প্রবীণ নেতাদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী সংস্কারপন্থি গোষ্ঠী তৈরি করা হয়। শেখ হাসিনাকে জেলহাজতে বন্দি রাখাসহ বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোরও চেষ্টা করা হয়। এই সময়েই বাংলাদেশে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করে কোনো সামরিক জেনারেলের বদলে ড. ইউনূসের গলায় নোবেল শাস্তি পুরস্কার ঝুলিয়ে দিয়ে তাকে দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা করা হয়। এমনকি তাকে ফখরুদ্দীন আহমদের আগে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদেও বসানোর চেষ্টা করা হয়। ফখরুদ্দীন তারই নমিনি।
এখন যারা গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত বিতর্কে (ড. কামাল হোসেনসহ দুটি মিডিয়া এবং একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী) সরকারের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়েছেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় এবং এক-এগারোর সময় এদের অধিকাংশকে হাসিনা ও আওয়ামী লীগবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা গেছে। এরা এখন সুযোগ পেয়ে আবার সংঘবদ্ধ হয়েছেন। এরা এবার ড. ইউনূসকে সঙ্গে পেয়ে আশাবাদী। ভাবছেন, এই নোবেলজয়ী যখন যুদ্ধে নেমেছেন এবং তার পেছনে পশ্চিমা সমর্থন আছে, তখন তার পেছনে জমায়েত হয়ে তারা এবার নিজেদের উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে পারবেন।
আমার ধারণা, শেখ হাসিনার এই চক্রকে ভয় করার কিছু নেই। তিনি তা করেন না। তার শঙ্কা পোষণ করা উচিত নিজের দল ও সরকারের ভেতর একশ্রেণীর মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও নেতার অযোগ্যতা, অনভিজ্ঞতা ও অদক্ষতাকে। অধিকাংশ সমস্যা মোকাবেলায় তারা অযোগ্যতার পরিচয় দেন, সমস্যাটি জটিল করে তোলেন এবং অবান্তর কথা বলেন (যেমন অর্থমন্ত্রী মুহিত)। তারা শত্রুপক্ষের হাতে আক্রমণ করার তীর তুলে দেন। জনসাধারণ তাদের সম্পর্কে ত্যক্ত-বিরক্ত। যদি আগামী নির্বাচন যথাসময়ে হয় এবং তাতে আওয়ামী লীগ সরকারের বিপর্যয় ঘটে, তাহলে সেই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী হবে আওয়ামী লীগই। যে বিরোধী দল রমজানের পর আন্দোলনের কর্মসূচি দেবে বলে তা দিতে পারে না, তারা নির্বাচনে সাফল্য দেখালে আওয়ামী লীগের জন্য হবে ঘোর লজ্জার বিষয়।
আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে যদি ক্ষমতা হারায়, তাতে ড. ইউনূস ক্ষমতায় যাবেন সে সম্ভাবনা আমি দেখি না। কোনো পরাশক্তি বা সুশীল সমাজ চাইলেও নয়। বাংলাদেশে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের বাইরে তৃতীয় রাজনৈতিক দলের উত্থানের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমি এখনও তৈরি হয়নি। ড. ইউনূস নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পরই রাজনৈতিক দল গঠন করতে গিয়ে দেখেছেন নোবেল পরস্কারের মহিমাও তাকে রাজনৈতিক দল গঠনে জনসমর্থন এনে দেয়নি। তারপরও তিনি যদি ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম গঠনের মতো নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতেন, তাহলে তাকে এতদিনে ডা. বি চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী, ফেরদৌস কোরেশীদের সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত করতে হতো। গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বিকল্প ধারা প্রভৃতি দলের মতো তার দল আরেকটি ব্যাঙের ছাতা দলে পরিণত হতো।
ড. ইউনূস যদি রাজনীতিতে আসতে চান, তাহলে তাকে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের একটিতে যোগ দিতে হবে। আওয়ামী লীগে তিনি আসবেন না, আসতে চানও না। এই দলটির মতাদর্শের তিনি যে সমর্থক নন, তা তার কথা ও কাজেই বোঝা যায়। তার মিল বিএনপির সঙ্গে। তিনি যোগ দিতে চাইলে বিএনপি তাকে সাদরে লুফে নেবে। ব্যারিস্টার মওদুদের কথাবার্তায় তা কি বোঝা যায় না? কিন্তু বিএনপিতে গেলে তাকে সর্বাগ্রে স্যালুট দিতে হবে তারেক রহমানকে। খালেদা জিয়া দলের নেতৃত্ব থেকে অবসর নিলেও তিনি সেখানে বসতে পারবেন না। তাকে তারেক রহমানের অধস্তন কোনো এক পর্যায়ের নেতা হতে হবে। দল ক্ষমতায় গেলে তারেক অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী হতে চাইবেন। ড. ইউনূসকে ভারতের প্রণব মুখার্জির মতো রাষ্ট্রপতিও করা হবে না; এমনকি ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর পদও নয়। সেখানে ব্যারিস্টার মওদুদ থেকে আরও অনেক প্রার্থীর ভিড়।
আরও একটি কথা, যে দিকটির কথা বদরুদ্দীন উমর কালের কণ্ঠকে দেওয়া তার সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেননি। আগামী নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ হারে, তাহলে বিএনপিও ক্ষমতায় আসবে না। আসবে বিএনপিকে উদরসাৎ করে জামায়াত। তারেক রহমানকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সামনে খাড়া রেখে তারা সরকার গঠন করবে। নিজেরা সরকারের শীর্ষ পদগুলো দখল করবে। সেখানে ড. ইউনূসের মনঃপূত স্থান কোথায়?
তাহলে আমেরিকাসহ পশ্চিমা শক্তিবর্গ কি তাদের অনুগৃহীত নেটিভ সুশীল সমাজ বা কিছু মিডিয়ার সমর্থনে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অনির্বাচিত সিভিল ডিকটেটরশিপ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে? অথবা উমরের বর্ণনামতো সেই সরকার দীর্ঘস্থায়ী হতে পারবে? এই ধরনের একটা চেষ্টা যে বাংলাদেশে চলছে সে সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমরের সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করি। কারণ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে একটি ব্যর্থ সরকার প্রমাণের জন্য সব ক্ষেত্রে একটা অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। সেই চেষ্টার পেছনে কিছু বিদেশি কূটনীতিক তাদের মন্তব্য দ্বারা রোজই ইন্ধন জোগাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের যদি কোনো বড় ব্যর্থতা থাকে, তাহলে তা হলো এই অরাজকতা সৃষ্টির চক্রান্ত মোকাবেলায় তাদের অদক্ষতা ও অসাফল্য।
কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের এই চক্রান্ত মোকাবেলায় অদক্ষতা ও ব্যর্থতা থাকা সত্ত্বেও এ চক্রান্ত সফল হবে কি? বাংলাদেশের জনজীবনের গভীর শিকড়ে প্রোথিত দুই প্রধান ধারার রাজনীতিকে এড়িয়ে গিয়ে তৃতীয় শক্তি হিসেবে একটি অনির্বাচিত সিভিল ডিকটেটরশিপকে গুড গভর্মেন্টের লেবাস পরিয়ে ক্ষমতায় বসানো সম্ভব হবে কি? সেই গভর্নমেন্টের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের নাম যারা ভাবেন তাদের চিন্তা ও প্রত্যাশা কতটা বাস্তব?
অতীতেও বাংলাদেশের সামরিক শক্তি ছাড়া কোনো সিভিল তৃতীয় শক্তির অভ্যুদয় সম্ভব হয়নি। ড. কামাল হোসেন থেকে শুরু করে ডা. বি চৌধুরী, ফেরদৌস কোরেশী প্রমুখ নানাজনকে দিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছে। পশ্চিমা দেশ, নেটিভ সুশীল সমাজের প্রভাবশালী অংশ নানা চেষ্টা-তদবির করেছে। কোনোটাই সফল হয়নি। বর্তমানেও হবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। পাকিস্তানে জারদারি এবং আফগানিস্তানে কারজাইকে ক্ষমতায় রাখার জন্য মার্কিন সেনাবাহিনীকে দুটি দেশেই অবস্থান নিতে হয়েছে। লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। বাংলাদেশে অনুরূপ কোনো অবস্থান গ্রহণের ইচ্ছা, সময় ও সুযোগ আমেরিকার আছে কি? আমেরিকার মূল ভীতি এখন চীন ও ইরান। আফগানিস্তান থেকে তারা পাততাড়ি গোটাতে চায়।
এটা আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধির ধারণা, বাংলাদেশ ও ড. ইউনূস সম্পর্কে একটা বাস্তব সত্য তারা জানেন, ড. ইউনূস আসলেই কোনো রাজনীতিক নন। তাকে দিয়ে কোনো রাজনৈতিক এক্সপেরিমেন্ট বাংলাদেশে সফল করা যাবে না। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরালে ক্ষমতায় আসবে জামায়াত। বিএনপিও নয়। তখন জামায়াতকে আবার মডারেট ইসলামপন্থি আখ্যা দিয়ে তাদের সঙ্গে ওয়াশিংটনকে আপসের চেষ্টা করতে হবে; যে চেষ্টা তারা চালাচ্ছে আফগানিস্তানে। তাতে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের তালেবানরাই লাভবান হবে।
এই সত্যটা জেনেই আমেরিকা ড. ইউনূসকে বাংলাদেশে আর ক্ষমতায় আনার সাম্প্রতিক অতীতের ইচ্ছাটা পোষণ করে কি-না আমার সন্দেহ আছে। আমার ধারণা, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তারা হাসিনা সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে অন্য উদ্দেশ্যে। সে উদ্দেশ্য বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সামুদ্রিক বন্দর নির্মাণ, টিফফা চুক্তি স্বাক্ষর ইত্যাদিতে বাংলাদেশকে সম্মত করানো। এ জন্য বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতা সংস্থাকেও তারা ব্যবহার করছে বলে অনেকের ধারণা। আমাদের অর্থমন্ত্রী জোড়া পাঁঠা বলি দিয়ে মা কালীর (বিশ্বব্যাংকের) মন জয় করতে চাইছেন। কিন্তু এই মন জয় করার আসল চাবিকাঠি কোথায়, কাদের হাতে সেই সত্যটি তিনি জানে কি-না আমি জানি না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখনও এই পরিস্থিতি সামাল দিতে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। এখনও সময় আছে। আপস দ্বারা তিনি আত্মরক্ষা করতে পারবেন না। ওরা (পশ্চিমা শক্তি) আত্মসমর্পণ চায়। আর ওদের সব শর্ত মানলেই পদ্মা সেতুর অর্থ জোয়ারের পানির মতো এসে যাবে তা ভাবলে ঠকতে হতে পারে। '৭১ সালে প্রতিশ্রুত গণসাহায্য সময়মতো এসেছিল কি?
আমি বদরুদ্দীন উমরের সঙ্গে সহমত পোষণ করি যে, ওরা এক সময় ড. ইউনূসকে বাংলাদেশে ক্ষমতায় বসিয়ে সুশীল সমাজের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, হয়তো এখনও চায়। কিন্তু তারা এখন এই সত্যটি জেনে গেছে, অতীতে ড. কামাল হোসেনদের নিয়ে তৃতীয় শক্তি গড়ার প্রচেষ্টার মতো ড. ইউনূসকে নিয়ে এই প্রচেষ্টাও তাদের সফল হওয়ার নয়। পেপার টাইগার দেখে হাসিনা যেন ভয় না পান।
লন্ডন, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১২, বৃহস্পতিবার
 

No comments

Powered by Blogger.