ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও সাংবাদিকের নৈতিকতা by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যম মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কতটা উন্মুক্ত করার অধিকার রাখে, তা নিয়ে সম্প্রতি ভারতে এক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিতর্কের সূচনা করেছেন ভারতের প্রখ্যাত টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার রতন টাটা। সম্প্রতি ভারতে টু জি মোবাইল ফোনের লাইসেন্স ও রেডিও এয়ারওয়েবের বরাদ্দ নিয়ে বড় ধরনের অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের খবর উন্মোচিত হয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে ভারতের অন্যতম প্রধান শিল্পগোষ্ঠী ‘টাটার’ নাম জড়িয়ে গেছে। পরিণামে টেলিকমমন্ত্রী এ রাজাকে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। অভিযোগ: মন্ত্রী টাটা গ্রুপকে বিনা টেন্ডারে প্রায় পানির দামে টু জি মোবাইল ফোনের লাইসেন্স দিয়েছেন। এতে ভারত সরকারের পৌনে দুই লাখ কোটি রুপির ক্ষতি হয়েছে। এই কেলেঙ্কারির জন্য প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকেও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। লোকসভায় হয়েছে উত্তপ্ত বিতর্ক।
টু জি স্পেকট্রাম-বিষয়ক এই অভিযোগের সূত্র ধরে রতন টাটার সঙ্গে তাঁরই অফিসের ‘করপোরেট লবিস্ট’ নীরা রাডিয়ার সঙ্গে টেলিফোন আলাপের বিস্তারিত বিবরণ ভারতের বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। রতন টাটা বলেছেন, এটা তাঁর ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ওপর গণমাধ্যমের হস্তক্ষেপ। গত ২৯ নভেম্বর রতন টাটা এই অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছেন। তিনি তাঁর আবেদনে বলেছেন: ‘ওই কথোপকথন ফাঁসের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’ ঘটনাচক্রে কে বা কারা কিসের স্বার্থে ওই তথ্য সংবাদমাধ্যমে ফাঁস করেছে, তা খতিয়ে দেখার জন্য ইনটেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি) এবং সেন্ট্রাল বোর্ড অব ডাইরেক্ট ট্যাক্সেসকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব জি কে পিল্লাই।
রতন টাটার মতে, সরকার তদন্তের স্বার্থে তাঁর টেলিফোন কথোপকথন ব্যবহার করতেই পারে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে তা ফাঁস করে দেওয়ায় তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারকেও এই মামলায় একটি পক্ষ হিসেবে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
মি. টাটা আরও বলেছেন, নীরা রাডিয়ার সঙ্গে তাঁর কথোপকথনে এমন কিছু ব্যক্তিগত তথ্য রয়েছে, যা কোনোভাবেই তদন্তের কাজে লাগার কথা নয়। তবে একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকার তাঁর কথোপকথন রেকর্ড করলেও সরকারের সঙ্গে তাঁর কোনো মতানৈক্য নেই। কিন্তু একই সঙ্গে গোপনীয়তা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের ওপরেই বর্তায় বলে জানিয়েছেন তিনি। কথোপকথনের আর কোনো টেপ যাতে ফাঁস না হয়, সে জন্যও আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছেন রতন টাটা। পাশাপাশি, ফাঁস হওয়া টেপ উদ্ধারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ও তার তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেওয়ার জন্যও শীর্ষ আদালতকে অনুরোধ করেছেন টাটা। (দৈনিক বর্তমান, কলকাতা, ৩০ নভেম্বর ২০১০)
এই মামলার পরিণতি কী হয়, তা জানার অপেক্ষায় থাকলাম। কিন্তু তার আগে কিছু বিষয় আলোচনা করা যেতে পারে।
রতন টাটা খুব মূল্যবান দুটি কথা বলেছেন। ১. সরকার তদন্তের স্বার্থে তাঁর কথোপকথন ব্যবহার করতেই পারে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে তা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। ২. গোপনীয়তা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়।
সাংবাদিকতা পেশার আলোকে আমরা এখানে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারি। ‘সাংবাদিকতা’ পেশা বাংলাদেশের কোনো একক পেশা নয়। এটা আন্তর্জাতিক পেশা। কাজেই সাংবাদিকতায় আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, নৈতিকতা আমাদেরও মেনে চলতে হয়। সব সাংবাদিকের জন্যই এটা প্রযোজ্য।
এই প্রসঙ্গে কলকাতার পাক্ষিক দেশ-এর কলামিস্ট জয়শ্রী রায় লিখেছেন: ‘দুর্নীতি প্রকাশের দায় থেকে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত পরিসর, চিন্তাভাবনা, মৌখিক আলাপচারিতাকে প্রকাশ্যে বেআব্রু করা কতখানি যুক্তিযুক্ত, তা ভাবার বিষয় বৈকি! আমাদের দেশে (ভারত) রাইট টু প্রিভেসি (প্রাইভেসি) কোনো স্বতন্ত্র সাংবিধানিক অধিকার নয়, জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারের মধ্যেই এটা অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু কোনো ব্যক্তিমানুষের রাইট টু প্রিভেসিতে হাত দেওয়া যাবে অ্যাকর্ডিং টু প্রসিডিউর এস্টাবলিস্ট বাই ল। অর্থাৎ এই অধিকার একমাত্র দেশের বিচার বিভাগের। সাংবাদিকের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে সীমা নির্ধারণের। সাংবাদিকের সঙ্গে করপোরেট দুনিয়ার সংযোগ এখন সুবিদিত এবং কালের নিয়মে অপরিহার্যও বটে। কিন্তু একজন সাংবাদিক কেন খবর প্রকাশের সময় তাঁর এথিক্যাল গ্রাউন্ডের দিকটা উপেক্ষা করে যাবেন, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। স্বচ্ছ সাংবাদিকতার নিয়ম
হওয়া উচিত এই যে, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, বক্তব্যের প্রতিলিপি, মৌখিক আলাপচারিতা বা ব্যক্তিগত কোনো বিষয় জনসমক্ষে আনা যাবে না, যদি না দেশের বা দশের স্বার্থের সঙ্গে বিষয়টির কোনো প্রত্যক্ষ সংযোগ থাকে।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, তেমনটি হয়নি। অভিযোগ প্রমাণের আগেই সরকারি তদন্তাধীন তথ্যপ্রমাণ সরকারের হেফাজত থেকে সংবাদমাধ্যমের নাগালে আসা যেমন এক প্রশ্ন, তেমনই সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা ভুলে গিয়ে অন্যের ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে পড়ে তাঁর গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারকে খর্ব করাও অনৈতিক।’ (দেশ, ১৭ ডিসেম্বর, ১০)
জয়শ্রী রায়ের এই বিশ্লেষণ খুবই চিন্তা উদ্দীপক। তিনি রতন টাটার মামলা এবং ভারতবর্ষের পটভূমিতে এই মন্তব্য করলেও তা বাংলাদেশের সমাজ ও সাংবাদিকতার জন্যও প্রযোজ্য। আমরা ঢাকার বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ‘খবরে’ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আদালতে নিয়ে যাওয়া ও আসার যে টানাহেঁচড়ার চিত্র দেখি, তা খুবই আপত্তিকর। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট আজকাল নানা ব্যাপারে নির্দেশনা দিচ্ছেন। টিভি ক্যামেরার ব্যাপারেও একটা নির্দেশনা তাঁরা দিতে পারেন। অভিযোগ প্রমাণ ও মামলার রায়ের আগে তারা যেন সচিত্র কোনো কিছু প্রচার না করে। মনে রাখতে হবে, আদালত একটি ভিন্ন জায়গা। এখানে ন্যায়-অন্যায় বিচার হয়। আদালতের পরিবেশকে অকৃত্রিম ও শান্তিপূর্ণ রাখা সবার দায়িত্ব। টিভি বা সংবাদপত্রের ক্যামেরা দিয়ে জনমত প্রভাবিত করা যায়। আদালত যদিও জনমতের ওপর নির্ভরশীল নয়, আদালত যুক্তি ও প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল। ১/১১-এর সময়ে আদালত, জবানবন্দি, রিমান্ড, সিডি প্রকাশ, একতরফা বক্তব্য ইত্যাদি নিয়ে আদালত ও গণমাধ্যমজগৎ কলুষিত হয়েছিল। আমরা সাংবাদিকেরা প্রায় বিনা প্রতিবাদে তা মেনে নিয়েছিলাম। অনেকে উৎসাহের সঙ্গে এসব অনৈতিক কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। আর যেন এ ধরনের অনৈতিক কাজে এ দেশের মিডিয়া যুক্ত হতে বাধ্য না হয়, সে জন্য কিছু একটা কৌশল বের করা দরকার।
রতন টাটার মামলার সূত্র ধরে আমরা মিডিয়া জগতে একটা আলোচনার সূচনা করতে পারি। গণমাধ্যম ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে কতটা দায়িত্বশীল, তা পর্যালোচনা করা দরকার। বাংলাদেশের সংবাদপত্র থেকে কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরে আলোচনা হলে সাংবাদিকেরা উপকৃত হবেন। রতন টাটা-নীরা রাডিয়ার টেলিফোন কথোপকথনের মতো সিডি পাওয়া গেলে আমরা সংবাদপত্রের পৃষ্ঠাজুড়ে তা কি প্রকাশ করব? এ ব্যাপারে সংবাদপত্রের অবস্থান কী? ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা ‘প্রাইভেসি’ বলতে সাংবাদিকেরা কী বোঝেন, তা গভীরভাবে আলোচনা হওয়া দরকার।
অনেক সাংবাদিক ব্যক্তিগত গোপনীয়তা প্রসঙ্গে বলে থাকেন, ‘পাবলিক ফিগারের আবার প্রাইভেসি কী?’ এটাও একটা ভুল ধারণা। এই ধারণা নিয়েও আলোচনা করা দরকার। এ ধরনের ইস্যু নিয়ে আলোচনা প্রশিক্ষণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়া উচিত। কারণ, আজকের তরুণ সাংবাদিক একদিন সংবাদপত্র, টিভি বা বেতারে নীতিনির্ধারণী পদে যাবেন। তাঁকে বুঝতে হবে সাংবাদিকের নৈতিকতা কী।
ধনী লোক বা বড় শিল্পপতি, বিখ্যাত ব্যক্তি, বড় তারকা কোনো বিপদে পড়লে অনেক সাংবাদিক উল্লসিত হন। তাঁদের সেই উল্লাস প্রতিফলিত হয় তাঁদের লেখায়। এটা সাংবাদিকের বিকৃত মানসিকতা। অসুস্থ মানসিকতা। এ ধরনের মানসিকতা সাংবাদিকতা পেশার জন্য উপযুক্ত নয়। সাংবাদিকের দৃষ্টি হবে বস্তুনিষ্ঠ। তথ্য, প্রমাণ দিয়ে তিনি লিখবেন। উভয় পক্ষের বক্তব্য প্রকাশ করা তাঁর প্রধান শর্ত।
প্রত্যেক রিপোর্টারের একটি প্রিয় চরিত্র হলো: সোর্স। তাঁর সংবাদ সূত্র। সোর্স ছাড়া একজন রিপোর্টার অচল। নানা কারণে সোর্স রিপোর্টারকে সহায়তা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেই সোর্স বেশি। কারণ, খবরের প্রধান উৎস সরকারি অফিস বা মন্ত্রণালয়। শোনা যায়, অনেক সময় সরকারি অফিসের কেউ কেউ টাকার বিনিময়েও খবরের উপাদান সরবরাহ করে থাকেন। এটা দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে।
আমি আবার রতন টাটার মামলা বিষয়ে ফিরে আসছি। এই মামলার রায় কী হবে, তা আমি জানি না। কেউই জানেন না। কিন্তু রতন টাটা ও নীরা রাডিয়ার ফোনালাপের বিষয়বস্তু যার মাধ্যমে সংবাদপত্রে বা টিভিতে এসেছে, আমি মনে করি তাকে শনাক্ত করে শাস্তি দেওয়া উচিত। তাকে শনাক্ত করা তো কঠিন কাজ নয়। টেপগুলো নিশ্চয় কোনো সরকারি কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে ছিল। তিনিই অপরাধী হবেন, সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? কাজেই অন্য কোনো উপায়ে টেপগুলো সংবাদপত্রে পৌঁছালেও শাস্তি হওয়া উচিত, যাঁর তত্ত্বাবধানে ছিল, তাঁর। কারণ, তিনি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। রতন টাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে এই মামলায় একটি অভিযুক্ত পক্ষ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন সংগতভাবেই।
ভারতে কোনো সরকারি সংস্থা স্বরাষ্ট্রসচিবের ‘অনুমোদনক্রমে’ যেকোনো ব্যক্তির ফোন টেপ করতে পারে অনূর্ধ্ব দুই মাসের জন্য। কিন্তু সেই ফোনালাপ শুধু কোনো মামলার তদন্তের স্বার্থেই ব্যবহার করতে হবে। সংবাদমাধ্যমে বা অন্যত্র তা ব্যবহূত হতে পারে না। রতন টাটা এই পয়েন্টেই মামলা করেছেন।
আমাদের দেশে এখনো অনেক সংবাদপত্র ও টিভি সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুসরণ করে না। সাংবাদিকতা পেশায় তারা হয় মতলববাজ, নয় অদক্ষ। এদের হাত থেকে সাংবাদিকতা পেশাকে রক্ষা করতে হবে। ভারতে রতন টাটার প্রাইভেসি-বিষয়ক এই মামলা আমাদের সাংবাদিক সমাজের জন্য একটা শিক্ষণীয় বিষয় হতে পারে।
নতুনকে স্বাগত। ঢাকা থেকে ফার্স্ট নিউজ নামে ইংরেজি ভাষায় একটি সংবাদ ম্যাগাজিনের প্রকাশনা শুরু হয়েছে কয়েক মাস আগে। সম্পাদক: মোহাম্মদ বদরুল আহসান। ইংরেজি ভাষায় এর আগে সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ছিল না, তা নয়। তবে সেগুলো তেমন মানসম্পন্ন ছিল না। পেশাদারির অভাবও ছিল। ফার্স্ট নিউজ সেই দিক থেকে আকর্ষণীয় ও মানসম্পন্ন। ভারত, পাকিস্তান বা থাইল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ইংরেজি সংবাদ ম্যাগাজিনগুলোর পাশে এটিকে রাখা যায়। এটা কম কৃতিত্ব নয়। বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে ইংরেজি পত্রিকার পাঠক কম। ফার্স্ট নিউজ কতটা পাঠক আকর্ষণ করতে পারবে, বলা মুশকিল। তবে পাঠক বৃদ্ধির জন্য এবং বাংলাদেশকে বিদেশে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য এ রকম একটি মানসম্পন্ন ইংরেজিভাষী সংবাদ ম্যাগাজিনের খুব প্রয়োজন ছিল। প্রকাশক ও সম্পাদককে অভিনন্দন।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
টু জি স্পেকট্রাম-বিষয়ক এই অভিযোগের সূত্র ধরে রতন টাটার সঙ্গে তাঁরই অফিসের ‘করপোরেট লবিস্ট’ নীরা রাডিয়ার সঙ্গে টেলিফোন আলাপের বিস্তারিত বিবরণ ভারতের বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। রতন টাটা বলেছেন, এটা তাঁর ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ওপর গণমাধ্যমের হস্তক্ষেপ। গত ২৯ নভেম্বর রতন টাটা এই অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছেন। তিনি তাঁর আবেদনে বলেছেন: ‘ওই কথোপকথন ফাঁসের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’ ঘটনাচক্রে কে বা কারা কিসের স্বার্থে ওই তথ্য সংবাদমাধ্যমে ফাঁস করেছে, তা খতিয়ে দেখার জন্য ইনটেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি) এবং সেন্ট্রাল বোর্ড অব ডাইরেক্ট ট্যাক্সেসকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব জি কে পিল্লাই।
রতন টাটার মতে, সরকার তদন্তের স্বার্থে তাঁর টেলিফোন কথোপকথন ব্যবহার করতেই পারে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে তা ফাঁস করে দেওয়ায় তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারকেও এই মামলায় একটি পক্ষ হিসেবে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
মি. টাটা আরও বলেছেন, নীরা রাডিয়ার সঙ্গে তাঁর কথোপকথনে এমন কিছু ব্যক্তিগত তথ্য রয়েছে, যা কোনোভাবেই তদন্তের কাজে লাগার কথা নয়। তবে একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকার তাঁর কথোপকথন রেকর্ড করলেও সরকারের সঙ্গে তাঁর কোনো মতানৈক্য নেই। কিন্তু একই সঙ্গে গোপনীয়তা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের ওপরেই বর্তায় বলে জানিয়েছেন তিনি। কথোপকথনের আর কোনো টেপ যাতে ফাঁস না হয়, সে জন্যও আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছেন রতন টাটা। পাশাপাশি, ফাঁস হওয়া টেপ উদ্ধারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ও তার তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেওয়ার জন্যও শীর্ষ আদালতকে অনুরোধ করেছেন টাটা। (দৈনিক বর্তমান, কলকাতা, ৩০ নভেম্বর ২০১০)
এই মামলার পরিণতি কী হয়, তা জানার অপেক্ষায় থাকলাম। কিন্তু তার আগে কিছু বিষয় আলোচনা করা যেতে পারে।
রতন টাটা খুব মূল্যবান দুটি কথা বলেছেন। ১. সরকার তদন্তের স্বার্থে তাঁর কথোপকথন ব্যবহার করতেই পারে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে তা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। ২. গোপনীয়তা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়।
সাংবাদিকতা পেশার আলোকে আমরা এখানে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারি। ‘সাংবাদিকতা’ পেশা বাংলাদেশের কোনো একক পেশা নয়। এটা আন্তর্জাতিক পেশা। কাজেই সাংবাদিকতায় আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, নৈতিকতা আমাদেরও মেনে চলতে হয়। সব সাংবাদিকের জন্যই এটা প্রযোজ্য।
এই প্রসঙ্গে কলকাতার পাক্ষিক দেশ-এর কলামিস্ট জয়শ্রী রায় লিখেছেন: ‘দুর্নীতি প্রকাশের দায় থেকে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত পরিসর, চিন্তাভাবনা, মৌখিক আলাপচারিতাকে প্রকাশ্যে বেআব্রু করা কতখানি যুক্তিযুক্ত, তা ভাবার বিষয় বৈকি! আমাদের দেশে (ভারত) রাইট টু প্রিভেসি (প্রাইভেসি) কোনো স্বতন্ত্র সাংবিধানিক অধিকার নয়, জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারের মধ্যেই এটা অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু কোনো ব্যক্তিমানুষের রাইট টু প্রিভেসিতে হাত দেওয়া যাবে অ্যাকর্ডিং টু প্রসিডিউর এস্টাবলিস্ট বাই ল। অর্থাৎ এই অধিকার একমাত্র দেশের বিচার বিভাগের। সাংবাদিকের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে সীমা নির্ধারণের। সাংবাদিকের সঙ্গে করপোরেট দুনিয়ার সংযোগ এখন সুবিদিত এবং কালের নিয়মে অপরিহার্যও বটে। কিন্তু একজন সাংবাদিক কেন খবর প্রকাশের সময় তাঁর এথিক্যাল গ্রাউন্ডের দিকটা উপেক্ষা করে যাবেন, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। স্বচ্ছ সাংবাদিকতার নিয়ম
হওয়া উচিত এই যে, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, বক্তব্যের প্রতিলিপি, মৌখিক আলাপচারিতা বা ব্যক্তিগত কোনো বিষয় জনসমক্ষে আনা যাবে না, যদি না দেশের বা দশের স্বার্থের সঙ্গে বিষয়টির কোনো প্রত্যক্ষ সংযোগ থাকে।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, তেমনটি হয়নি। অভিযোগ প্রমাণের আগেই সরকারি তদন্তাধীন তথ্যপ্রমাণ সরকারের হেফাজত থেকে সংবাদমাধ্যমের নাগালে আসা যেমন এক প্রশ্ন, তেমনই সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা ভুলে গিয়ে অন্যের ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে পড়ে তাঁর গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারকে খর্ব করাও অনৈতিক।’ (দেশ, ১৭ ডিসেম্বর, ১০)
জয়শ্রী রায়ের এই বিশ্লেষণ খুবই চিন্তা উদ্দীপক। তিনি রতন টাটার মামলা এবং ভারতবর্ষের পটভূমিতে এই মন্তব্য করলেও তা বাংলাদেশের সমাজ ও সাংবাদিকতার জন্যও প্রযোজ্য। আমরা ঢাকার বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ‘খবরে’ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আদালতে নিয়ে যাওয়া ও আসার যে টানাহেঁচড়ার চিত্র দেখি, তা খুবই আপত্তিকর। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট আজকাল নানা ব্যাপারে নির্দেশনা দিচ্ছেন। টিভি ক্যামেরার ব্যাপারেও একটা নির্দেশনা তাঁরা দিতে পারেন। অভিযোগ প্রমাণ ও মামলার রায়ের আগে তারা যেন সচিত্র কোনো কিছু প্রচার না করে। মনে রাখতে হবে, আদালত একটি ভিন্ন জায়গা। এখানে ন্যায়-অন্যায় বিচার হয়। আদালতের পরিবেশকে অকৃত্রিম ও শান্তিপূর্ণ রাখা সবার দায়িত্ব। টিভি বা সংবাদপত্রের ক্যামেরা দিয়ে জনমত প্রভাবিত করা যায়। আদালত যদিও জনমতের ওপর নির্ভরশীল নয়, আদালত যুক্তি ও প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল। ১/১১-এর সময়ে আদালত, জবানবন্দি, রিমান্ড, সিডি প্রকাশ, একতরফা বক্তব্য ইত্যাদি নিয়ে আদালত ও গণমাধ্যমজগৎ কলুষিত হয়েছিল। আমরা সাংবাদিকেরা প্রায় বিনা প্রতিবাদে তা মেনে নিয়েছিলাম। অনেকে উৎসাহের সঙ্গে এসব অনৈতিক কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। আর যেন এ ধরনের অনৈতিক কাজে এ দেশের মিডিয়া যুক্ত হতে বাধ্য না হয়, সে জন্য কিছু একটা কৌশল বের করা দরকার।
রতন টাটার মামলার সূত্র ধরে আমরা মিডিয়া জগতে একটা আলোচনার সূচনা করতে পারি। গণমাধ্যম ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে কতটা দায়িত্বশীল, তা পর্যালোচনা করা দরকার। বাংলাদেশের সংবাদপত্র থেকে কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরে আলোচনা হলে সাংবাদিকেরা উপকৃত হবেন। রতন টাটা-নীরা রাডিয়ার টেলিফোন কথোপকথনের মতো সিডি পাওয়া গেলে আমরা সংবাদপত্রের পৃষ্ঠাজুড়ে তা কি প্রকাশ করব? এ ব্যাপারে সংবাদপত্রের অবস্থান কী? ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা ‘প্রাইভেসি’ বলতে সাংবাদিকেরা কী বোঝেন, তা গভীরভাবে আলোচনা হওয়া দরকার।
অনেক সাংবাদিক ব্যক্তিগত গোপনীয়তা প্রসঙ্গে বলে থাকেন, ‘পাবলিক ফিগারের আবার প্রাইভেসি কী?’ এটাও একটা ভুল ধারণা। এই ধারণা নিয়েও আলোচনা করা দরকার। এ ধরনের ইস্যু নিয়ে আলোচনা প্রশিক্ষণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়া উচিত। কারণ, আজকের তরুণ সাংবাদিক একদিন সংবাদপত্র, টিভি বা বেতারে নীতিনির্ধারণী পদে যাবেন। তাঁকে বুঝতে হবে সাংবাদিকের নৈতিকতা কী।
ধনী লোক বা বড় শিল্পপতি, বিখ্যাত ব্যক্তি, বড় তারকা কোনো বিপদে পড়লে অনেক সাংবাদিক উল্লসিত হন। তাঁদের সেই উল্লাস প্রতিফলিত হয় তাঁদের লেখায়। এটা সাংবাদিকের বিকৃত মানসিকতা। অসুস্থ মানসিকতা। এ ধরনের মানসিকতা সাংবাদিকতা পেশার জন্য উপযুক্ত নয়। সাংবাদিকের দৃষ্টি হবে বস্তুনিষ্ঠ। তথ্য, প্রমাণ দিয়ে তিনি লিখবেন। উভয় পক্ষের বক্তব্য প্রকাশ করা তাঁর প্রধান শর্ত।
প্রত্যেক রিপোর্টারের একটি প্রিয় চরিত্র হলো: সোর্স। তাঁর সংবাদ সূত্র। সোর্স ছাড়া একজন রিপোর্টার অচল। নানা কারণে সোর্স রিপোর্টারকে সহায়তা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেই সোর্স বেশি। কারণ, খবরের প্রধান উৎস সরকারি অফিস বা মন্ত্রণালয়। শোনা যায়, অনেক সময় সরকারি অফিসের কেউ কেউ টাকার বিনিময়েও খবরের উপাদান সরবরাহ করে থাকেন। এটা দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে।
আমি আবার রতন টাটার মামলা বিষয়ে ফিরে আসছি। এই মামলার রায় কী হবে, তা আমি জানি না। কেউই জানেন না। কিন্তু রতন টাটা ও নীরা রাডিয়ার ফোনালাপের বিষয়বস্তু যার মাধ্যমে সংবাদপত্রে বা টিভিতে এসেছে, আমি মনে করি তাকে শনাক্ত করে শাস্তি দেওয়া উচিত। তাকে শনাক্ত করা তো কঠিন কাজ নয়। টেপগুলো নিশ্চয় কোনো সরকারি কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে ছিল। তিনিই অপরাধী হবেন, সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? কাজেই অন্য কোনো উপায়ে টেপগুলো সংবাদপত্রে পৌঁছালেও শাস্তি হওয়া উচিত, যাঁর তত্ত্বাবধানে ছিল, তাঁর। কারণ, তিনি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। রতন টাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে এই মামলায় একটি অভিযুক্ত পক্ষ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন সংগতভাবেই।
ভারতে কোনো সরকারি সংস্থা স্বরাষ্ট্রসচিবের ‘অনুমোদনক্রমে’ যেকোনো ব্যক্তির ফোন টেপ করতে পারে অনূর্ধ্ব দুই মাসের জন্য। কিন্তু সেই ফোনালাপ শুধু কোনো মামলার তদন্তের স্বার্থেই ব্যবহার করতে হবে। সংবাদমাধ্যমে বা অন্যত্র তা ব্যবহূত হতে পারে না। রতন টাটা এই পয়েন্টেই মামলা করেছেন।
আমাদের দেশে এখনো অনেক সংবাদপত্র ও টিভি সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুসরণ করে না। সাংবাদিকতা পেশায় তারা হয় মতলববাজ, নয় অদক্ষ। এদের হাত থেকে সাংবাদিকতা পেশাকে রক্ষা করতে হবে। ভারতে রতন টাটার প্রাইভেসি-বিষয়ক এই মামলা আমাদের সাংবাদিক সমাজের জন্য একটা শিক্ষণীয় বিষয় হতে পারে।
নতুনকে স্বাগত। ঢাকা থেকে ফার্স্ট নিউজ নামে ইংরেজি ভাষায় একটি সংবাদ ম্যাগাজিনের প্রকাশনা শুরু হয়েছে কয়েক মাস আগে। সম্পাদক: মোহাম্মদ বদরুল আহসান। ইংরেজি ভাষায় এর আগে সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ছিল না, তা নয়। তবে সেগুলো তেমন মানসম্পন্ন ছিল না। পেশাদারির অভাবও ছিল। ফার্স্ট নিউজ সেই দিক থেকে আকর্ষণীয় ও মানসম্পন্ন। ভারত, পাকিস্তান বা থাইল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ইংরেজি সংবাদ ম্যাগাজিনগুলোর পাশে এটিকে রাখা যায়। এটা কম কৃতিত্ব নয়। বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে ইংরেজি পত্রিকার পাঠক কম। ফার্স্ট নিউজ কতটা পাঠক আকর্ষণ করতে পারবে, বলা মুশকিল। তবে পাঠক বৃদ্ধির জন্য এবং বাংলাদেশকে বিদেশে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য এ রকম একটি মানসম্পন্ন ইংরেজিভাষী সংবাদ ম্যাগাজিনের খুব প্রয়োজন ছিল। প্রকাশক ও সম্পাদককে অভিনন্দন।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
No comments