গল্প- 'একটাই জীবন' by হাজেরা নজরুল

সিঁড়ি তিনটে করে একধাপে ভাঙ্গে সুরমা। লম্বা দুটো বেণী সাপের মত পিঠে লাফাতে থাকে। একটার প্রান্ত ধরে আমিন টান দেয়- কি ব্যাপার- খুকুমণি- কোথায় চলেছে?

কেউ দেখে ফেলবে।
দেখুক, তুমি আমার বিবাহিতা স্ত্রী।
শোন লক্ষ্মীটি আমার, এখন ক্লাস আছেঃ
আজ ভার্সিটির ক্লাস বন্ধ। আজ আমার ক্লাস করবে। বুঝলে?
দুুপুর তিনটে। দেরি হয়ে গেছে বাসায় যেয়ে খেয়ে আসতে। সুরমাকে নামতে হয়। নিচে আমিনের ফিয়ট দাঁড়িয়ে।
সোজা গুলশান। নির্জন গুলশানে ওরা একটু যেন আড়াল খোঁজে। তেমন বাড়িঘর উঠেনি। দু' একটি বাড়ি উঠেছে। কোথাও জমিতে ইট-বালু জমেছে। গাছে গাছে খেঁজুরের থোকা। গাড়িটা থামায় আমিন। নেমে দু'জনে ঘাসের ওপর বসে। হাতের প্যাকেট খুলে পরোটা কাবাব বের করে আমিন।
হাসপাতাল থেকে ফিরছি। ভীষণ খিদে। খাও।
না-গো আমি পারবো না। এই মাত্র খেয়ে এসেছি। মা তোমার জন্য খুব দুঃখ প্রকাশ করছিলেন। যা সুন্দর মুড়োঘন্ট রেঁধেছেনঃনানী বলেছে তোমাকে পেলে নাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যেতে-
কেন- ফোনে ডাকা যায়নি-বাসি ঘন্ট আমি খাবো না।
ফোন তো কাল থেকে নষ্ট। দুঃখ করো না। আব্বা আগামীকাল রাতে তোমাকে খাবার জন্য বলতে যাবেন। নিজের কানে শুনেছি। জামাই আদর ঠিক আছে, বুঝলে? আজ না হয় আমিই ধরে নিয়ে যাবো। কেন আমার বুঝি ডাকবার অধিকার নেই?
পকেট হতে ষ্টেডিয়ামের বরফ-পান বের করে আমিন। লাল লাল সুপারি কুচি, নারকেল কোরা। জড়িয়ে ধরে সুরমা-ইউ আর গ্রেট।
আস্তে সুন্দরী-কেউ দেখে ফেলবে। পান মুখে আবেগ জড়ানো কণ্ঠে সুরমা বলে- দেখুক গিয়ে। নিজের হাতে পরোটা ছিঁড়ে খাইয়ে দেয় আমিনকে।
আমিন চেয়ে চেয়ে দেখে- আস্বাদ করে ওর আদরকে। মাঝে মাঝে আঙ্গুল কামড়ে দেয়। উঃ বলে হাত টেনে নিয়ে হেসে ভেঙ্গে পড়ে সুরমা। বুড়ো বয়সেও এমনি করে খাইয়ে দেবে, তাই না?
চিরদিন আমরা এমন যেন থাকি। হ্যাঁ-গো বল থাকবো না।
আমিন সুরমাকে কাছে টেনে নেয় গভীর ভালবাসায়-অবশ্যই। আমি মনে করি আমৃতু্য আমরা এমনি প্রাণবন্ত, এমনি জীবন্ত থাকবো।
আচ্ছা আমরা যখন বুড়ো হবো কেমন লাগবে আমাদের দু'জনকে দেখতে?
সুরমার গাল দু'আঙ্গুলে টিপে দেয় আমিন চাপাভাঙ্গা বুড়ি। আর আমি হবো-গাল ভাঙ্গা লাঠি ভর করে হাঁটা, বলে চোখ কুঁচকায়-ঠুনঠুনে বুড়ো দাদা। নাতি-নাতনীটাকে হাত বুলিয়ে আদর করবে।
দু'জনের হাসি ছড়িয়ে পড়ে নির্জন গুলশানের প্রান্তরে।
আচ্ছা-পরবর্তী পস্ন্যান কি তোমার?
সিনেমা!
সিনেমা! ইস-কোথায়?
নাজে। সোফিয়া লরেনের একটা বই এসেছে।
এক্সিলেন্ট। আজ রাতে কিন্তু আমি আব্বার বাসায় থাকবো। কাল একটা ক্লাস টেষ্ট। পড়ার বেশ চাপ আছে।
জ্বী না মহারানী। তোমাকে সোজা আমাদের বাড়ি নেবো। টেষ্ট ওখানেই দেবে।
সুরমার সুখ উপচে পড়ে। কানায়-কানায়। এখনো ছাত্রী। তাই কোন দিন বাবার বাড়ি কোনদিন শ্বশুর বাড়ি। বাবা-মায়ের পছন্দের বিয়ে কিন্তু মনে হয় দু'জনে যেন দু'জনের জন্য বসেছিল এতকাল। ডাক্তার আমিন একবারেই পাস করেছে এবং একবারের দেখাতেই পছন্দ করেছে সুরমাকে।
পাখির হালকা পালক দিনগুলো সুন্দর ছন্দে বয়ে যায়।
সুরমার পড়া হয় না। আমিনের সাথে যেতে হয় মধ্যপ্রাচ্যে। তমাল তুন তুরাগ। তিনটি সুন্দর সন্তান যেন একটি শিল্পীর চিত্রকে করেছে পরিপূর্ণ। ওদের সবাই যেন সবার পরিপূরক। পিতার মত শান্ত ধীর অথচ সূক্ষ্ম দৃষ্টিসম্পন্ন তমাল এক চান্সেই ডাক্তার হয় আর বাবা মায়ের সম্মতিতে বিয়ে করে সহপাঠিনী কেয়াকে। শ্যামলা ক্ষীণদেহী মেয়েটিকে তেমন পছন্দ না হলেও ছেলের পছন্দকে মেনে নেয় দু'জন।
তন্বী স্কলার মেয়ে। কিন্তু সেও খুব শান্ত লাজুক প্রকৃতির। পড়া ছাড়া কিছু বোঝে না। যুগের সাথে বেমানান অতিমাত্রায় রক্ষণশীল এবং বেশভুষায় মার্জিত ও শালীন। আকৃষ্ট করে পাশের বাড়ির ইঞ্জিনিয়ার কামালকে। মুগ্ধ হয়ে তিন বছর অপেক্ষা করে কামাল এবং এক সময় রাজী করায় সুরমা এবং আমিনকে।
আমিনের তবুও আপত্তি ছিল। ছেলে ভালো। স্বাস্থ্যবান, শিক্ষিত এবং বনেদী ঘরের। কিন্তু ওদের বাড়ির চালচলন একটু ফার্ষ্ট। অত্যন্ত ঘরোয়া টাইপের তনু হয়তো খাপ খাওয়াতে পারবে না।
কামাল হাসে-ও অত্যন্ত এডজাস্টেবল মেয়ে। মাটির মত নরম। ওকে আমার মনের মত করে নেবো। আপনারা ভাববেন না।
ইঞ্জিনিয়ার কামালের কনসাল্টিং ফার্ম ছিল। গার্মেন্ট ইন্ডাষ্ট্রি। ক্রমশ এক্সপানশন ঘটে কামালের ব্যবসায়। তনুকে নিয়ে আজ ব্যাংকক কাল জাপান। তনু এডাজাস্ট করে নেয়। সালোয়ার কামিজ-ম্যাক্সি-টপস সব কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কোমড় পর্যন্ত ছড়ানো চুল ছেঁটে ঝামেলা ঝেড়ে ফেলে। ফেসিয়াল করে। জিমে যায়। ভ্রু পস্নাক করে। শেরাটন-সোনারগাঁ নিত্যদিন পার্টি। তনুর এক ভিন্ন জীবন।
ক্লান্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে টলটলে চেহারার সুরমা বিস্মিত প্রশ্ন করে সুখে আছিস স্মার্ট হচ্ছিস-চেহারায় ক্লান্তি কেন?
তোমার জামাই খুব উঁচু মহলে চলাফেরা করে। সেখানে ম্যাচ করে আমাকেও চলতে হয় মা। এমনকি আমি আজকাল ড্রিঙ্ক করি।
তুই ড্রিঙ্ক করিস। ছিঁ ছিঁ। কিন্তু কেন?
এসব ফ্যাশন মা। যুগের সাথে তাল মেলাতে হয়।
এবার একটা বাচ্চা-টাচ্চা হোক। মা না হলে মেয়ে মানুষ পূর্ণ হয় না।
সেটা তোমাদের যুগের কথা। এখন কেউই মা হতে চায় না। ইটস এ পানিসমেন্ট। আমি ওসব বিয়ার করতে পারব না।
নিজের মেয়েকে অচেনা মনে হয়। তুই কত বদলে গেছিস তনু।
তুরাগ স্কলারশীপ নিয়ে জার্মানী চলে যায়। চিঠি আসে -মা অপূর্ব রেজাষ্ট করছি। সব ভালো। কিন্তু তোমার হাতের রান্না ভুলতে পারি না। কবে খিচুড়ি খাওয়াবে মা। চিঠি পড়ে তৃপ্তির কান্নায় ভাসে সুরমা।
কামাল আসে। বিষণ্ন কণ্ঠে শ্বশুরের সাথে কথা বলে। প্রথমে আমিন সুরমাকে কিছু বলে না। সুরমা বোঝে কিছু ঘটছে কিন্তু ও জানে আমিন এক সময় নিজে থেকেই বলবে, তাই অপেক্ষা করে।
আমিন এক সময় সব বলে। শুনে ব্যাকুল সুরমা মেয়ের কাছে ছুটে যায়। ড্রাগ খেয়ে তনু তখন এক রঙিন দুনিয়ায়। কোন কথার উত্তর মেলে না।
সেই প্রথম ষ্ট্রোক হয় সুরমার। দালানের ইটগুলো খুলছে। স্বামীর বুকে মাথা রেখে কাঁদে। এমন হলো কেন।
তমাল এখন প্রতিদিন রাত করে বাড়ি ফেরে। বৌ কেয়া চুপচাপ খুকুকে নিয়ে নিমগ্ন থাকে। বৌমা-তমাল ফেরেনি।
না মা। ছোট্ট খুকুকে ঘুম পাড়ায় নতমুখী বৌ। শাশুড়ীর সাথে সবসময় কেমন যেন একটা দূরত্ব কেয়ার। উদার মনা সুরমা এসব নিয়ে কখনো ভাবে না। তবুও এক সময় ভাবতে হয়।
বৌমা-কাল সারারাত তোমরা ঘুমাওনি। আমি টের পেয়েছি। কি হয়েছে তোমাদের খুলে বল।
মুখে থমথমে স্তব্ধতা। দু'চোখের দৃষ্টি অস্পষ্ট। মা আপনার ছেলে এখন বদলে গেছে। কেয়া ক্ষীণদেহী কিন্তু কণ্ঠস্বর বেশ ধারালো।
কিন্তু কেন? জবাব মেলে না। ছেলে বৌ দু'জনেই ওদের প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যায়।
পিতামাতা সচেতন হয়। আমিন তমালকে সরাসরি প্রশ্ন করে -তোমার বোন অসুস্থ-তোমার মায়ের মন খারাপ, এই দুঃসময়ে কি তোমাদের এমন ব্যবহার সাজে?
জায়নামাজে বসে কাঁদে সুরমা-খোদা তুমি তো বলেছ কোন অন্যায় কোন পাপ করলে শাস্তি পেতে হয়। এ কোন পাপের শাস্তি আমার? কোন পূর্ব পুরুষের অন্যায়ের শাস্তি আমাদেরকে বহন করতে হচ্ছে? কিন্তু কেন আমরা অন্যের অন্যায়ের শাস্তি ভোগ করবো?
টেলিফোন আসে। তনু হাসপাতালে। ড্রাগ ওকে সম্পূর্ণ গ্রাস করেছে।
তনু -মা চোখ খুলে তাকায়। সুরমা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
তমাল বোনকে জড়িয়ে ধরে-তনু তোর অনেক সম্পদ। এমন করে অপব্যয় করিস না। তুই না গল্প লিখতি। চল আবার লেখবি।
তনু তাকায়। আচ্ছন্ন দৃষ্টি। হাসে। অস্পষ্ট দুর্বোধ্য সে হাসি।
সুরমার দ্বিতীয়বার স্ট্রোক হয়। আমিনকে ডায়াবেটিসে আর হার্টের প্রবলেম এক সাথে আক্রমণ করে।
তমাল পিতা-মাতাকে কষ্ট দিতে চায় না। তাই একদিন সব কিছু প্রকাশ পায়। বৌ-এর সাথে ওর বনিবনা হয়নি। তমালের মত শান্ত প্রকৃতির মানুষ ওর পছন্দ নয়। তমালের বিশ্বস্ত বন্ধু হাবীবের সাথে গোপন অভিসার ধরা পড়ার পর দু'জনের মধ্যে কথা বিনিময় হয়েছে।
ঠিক আছে। তোমার আমার মধ্যেই এটা নিস্পত্তি করে ফেলো। এ ঘটনা ওদের জানানো যাবে না। এটা আমার অনুরোধ। তমাল মা-বাবাকে জানাতে চায়নি। গোপনে স্ত্রীকে ফেরাতে চেয়েছে। কিন্তু পারেনি। কেয়ার এক কথা। জীবন একটাই। এমন অপচয় করা চলবে না। হাবীবকে ও যথার্থ ভালোবাসে। তমালের প্রতি মোহগ্রস্থ হয়েছিল কিন্তু হাবীবের প্রতি এটা ওর সত্যিকারের প্রেম।
তুরাগের চিঠি আসে। শীতের পিঠে কবে খাবো? তোমরা দু'জনে এসে বেড়িয়ে যাও। খুকুমনি কাকু ডাকতে পারে কি? তনুর খবর কি? মামা হবো কবে?
মায়ের প্রাণ, সকল দুঃসংবাদ লুকাতে হয়। যত্ন করে গুছিয়ে শুধু ভালো খবর দিয়ে চিঠি লেখে। তবু দূরে একটু শান্তিতে থাকুক তুরাগ।
সন্তান সুখে থাকুক। সব পিতা-মাতার একটা স্বপ্ন।
মা তোমার জন্য সেলাই মেশিন। নতুন ডিজাইন। আব্বার জন্য একটা ভিসিআর। তুরাগ ঘন ঘন চিঠি লিখে।
মেঘাচ্ছন্ন আকাশ যেন রোদের ছোঁয়া।
বাঁচার ইঙ্গিত। দু'জনে ছোট্ট তুরাগকে নিয়ে বাঁচার নতুন স্বপ্ন দেখে।
তমাল একা। মেয়েকে নিয়ে সবসময় ব্যস্ত।
তমাল-বাবা আমার, চল তোর আবার বিয়ে দেবো আমরা। ব্যথিত মায়ের দরদী মমত্ব সমাধান খুঁজতে চায়।
না মা। তা হয় না।
তুই বৌমাকে ভুলে যা।
বিয়ে একবার হয় মা।
সুরমা বৌমার কাছে যায়।
বৌমা-তুমি ঘরে ফিরে চল। তমাল তোমাকে ভালোবাসে।
আমি ওকে ডিভোর্স লেটার দিয়েছি।
কিন্তু কেন। কি অপরাধ ওর।
আপনারা সেকেলে যুগের মানুষ এসব বুঝবেন না। আমরা দু'জনেই ডাক্তার। পারসোনালিটি ক্ল্যাস। এটা আপনি বুঝবেন না।
তমাল-আমাদের বংশের একটা সুনাম আছে। এ পরিবারে কখনো বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়নি।
মা, টেক ইট ইজি। হয়নি বলে হবে না। এটা ভাবা ঠিক না মা। এখন ঘরে ঘরে এসব আকসার ঘটছে। এটা শরৎচন্দ্রের যুগ নয়। এখন দু'জনেরই ব্যক্তিত্ব, পছন্দ-অপছন্দ কাজ করে। জবরদস্তি করে দু'জনকে এক ঘরে বাস করালেই ঘর করা হয় না।
বিচ্ছিন্ন হলে কি শান্তি হবে?
অন্তত অশান্তিময় জীবন-যাপন হবে না।
কেমন যেন থমকে যায় সুরমা। সব বদলে যাচ্ছে। আমিন শান্ত মানুষ। এবার অস্থির হয় -পাশ্চাত্যের অভিশাপ। আমরা শিক্ষিত হচ্ছি-প্রগ্রতিশীল হচ্ছি-ঘর ভেঙ্গে আমরা ঘর বাঁধছি-কোথায়ও কোন বিবেকের পীড়ন নেই। সমাজিক দায়িত্ব নেই।
আমিন শেষ চেষ্টা করে। সমাজকে এভাবে কুলষিত করিস না তমাল। বৌমার সাথে কম্প্রোমাইজ কর।
না বাবা, এ ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করো না। তোমাদের সমাজ গঠন আর বর্তমান সমাজের ফ্রেম এক নয়। তখন ছিল এক রকম সমাজ ব্যবস্থা এখন এক রকম। বাবা এটা বিংশ শতাব্দী।
নিজের পিতার চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকায় কেয়া। পছন্দ করেছিলাম, বিয়ে করেছিলাম। ঘর করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। ঘর করে দেখালাম ওর অনেক ড্রব্যাক। আমার সাথে অনেক গরমিল। আমি ওর বন্ধু হাবীবকে বিয়ে করবো। ওর সাথে আমার অনেক মানসিক মিল রয়েছে।
যদি কয়েকদিন পর মনে হয় এখানেও ভুল করেছিস?
মেনে নেবো। তোমাদের কাছে আসব না। তবে মনে রেখো, তখন ইমম্যাচুয়োর ছিলাম। এখন জীবন দৃষ্টি অনেক পরিণত। ভুল করব না।
জেদী মেয়ের কাছে হেরে যেতে হয় পিতাকে।
একদিন তমালের বাড়ি থেকে খুকুকে নিয়ে যায় কেয়া। কোন বাধা মানে না।
আমার মেয়ে আমার কাছে থাকবে।
অফিসার্স ক্লাবে ছেলের বিয়েতে আমিন সুরমা অনেক খরচ করেছিলো। ঢাকা শহরের প্রায় সবাইকে দাওয়াত করেছিল। একটা খাতা তৈরি করে পুরোনো বিস্মৃতপ্রায় বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনকে এক করেছিলো দু'জন। সেদিন মেহমান হয়ে সবাই দোয়া করেছিলেন। সাধের বিয়ে। সাধের নাতি। কিন্তু সেই বিয়ের এই পরিণতি হবে স্বপ্নেও কেউ কি ওরা ভেবেছিল?
সুরমা অসহায় কণ্ঠে অনুরোধ জানায়-আমার নাতনীটাকে রেখে দাও গো।
বৌমা দেবে না। আইনেও পাবে না এখন।
কিন্তু বৌমা তো পরের ঘরে চলে যাবে-খুকুর সেখানে অবমাননা হবে। এখন বৌমা দিচ্ছে না, ও তো মা। না দিক। ধৈর্য ধরো। চিন্তা করো না। সময় হলে নিজেই দিয়ে যাবে।
বুকের বাঁদিকে ব্যথা হয়। সর্বংসহা ধরিত্রীর মত সুরমা স্বামীকে ভাত বেড়ে দেয়।
ভাত খাও। চারদিকে এসব ঘটবে। আমরা কিছু করতে পারব না। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবো। আমিন স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেয়।
ভাত খেয়ে ঘুমায় আমিন। ঘুমায় সুরমাও। ঘুম ভাঙ্গে বিকালে।
নাস্তা দেয় কাজের বুয়া।
তোমার আম্মা কোথায়?
বাথরুমে পইড়া গেছিল। ভাইজান হাসপাতালে নিয়া গেছে। আপার খবর পাইছেন তো?
আপার কি হয়েছে? কি আশ্চর্য এত গভীর ঘুম কোথা হতে এলো। এত ঘটনা ঘটলো অথচ কিছু জানল না আমিন?
ভয় পায় বুয়া। খবর শুনে একজন হাসপাতালে। যদি সায়েবও ফিট হয়।
আমি কইবার পারি না।
ফোন ঘুরায়। জামাই ধরে। কামালের কণ্ঠে বেদনা। তনু নেই।
কিন্তু কেন? কেন?
তুমি-তুমিই আমার মেয়েকে মেরে ফেলেছ। আমার মেয়েকে তুমি অস্বাভাবিক বানাতে চেয়েছিলে।
মেনে নেয়। মেনে নিতে হয়। হুইল চেয়ারে সুরমা। নিশ্চুপ অবশ। বাকশক্তি নেই। দু'টি হাত সক্রিয়। জড়িয়ে জড়িয়ে অস্পষ্ট কথা -কিছু বোঝা যায় না। ডাক্তার বলে ভালো হতেও পারে। নাও পারে।
আমিন আবার অনুরোধ করে। তবুও তমাল আবার বিয়েতে রাজী হয় না।
বাবা তুমি দুঃখ পাবে তাই বলিনি। ভেবে দেখলাম বলে ফেলা ভালো, তুমি কষ্ট পাচ্ছ। কষ্ট আমিও পাচ্ছি। এত কষ্ট আমাদের কিন্তু কেন, কেন?
তনু মারা যাবার আগে একটা চিঠিতে লিখেছিলো-আমি পরিবারের জন্য নিজেকে দহন করছি। আমার বিবাহিত স্বামী আমাকে যেভাবে চান আমি তেমন পরিবারের নই-তেমন মানসিকতারও নই। কিন্তু ওকে ধরে রাখবার জন্য-ওকে বেঁধে রাখবার জন্য ওর ইচ্ছের পুতুল হয়েছিলাম। কিন্তু পারলাম না। আত্মগোপনের জন্য ড্রাগ ধরলাম। এখন কিছু ভালো লাগে না। ডির্ভোস করলে আব্বা-মা দুঃখ পাবেন তাই-
আমিন প্রয়াত মেয়ের শেষ চিঠিটা পড়ে। তারপর সুরমাকে চিঠিটা এগিয়ে দেয়। দু'চোখে বেয়ে পানি ঝরে সুরমার।
তমাল মায়ের চোখ মুছিয়ে দেয়। পিতার কাছে এসে বসে। পিতার কোলে মাথা রেখে শিশুর মত এই প্রথম কাঁদে পরাজিত তমাল। আমিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তমালের মাথায় হাত বুলায়।
বাবা-আমার বন্ধু হাবীবের সাথে ওর বিয়ে হয়ে গেছে। আমি এবার খুকুকে নিয়ে আসবো। ওকে নিয়েই বাঁচবো। তুমি চিন্তা করো না। আমি মেনে নিয়েছি। আমি তো তোমারই ছেলে।
সংসার চলে। সার্বক্ষণিক দু'জন কাজের মানুষ। একজন সুরমা এবং খুকুর জন্য। একজন সংসার এবং আমিনের জন্য।
চিঠি আসে এবার তুরাগের। বিদেশিনী সুহাসিনী স্ত্রীর পাশে প্রাণবন্ত সুখী তুরাগ।
মা ক্ষমা করো। নোরা খুব ভালো মেয়ে। ওকে ছাড়া আমার পৃথিবী অর্থহীন। ও পোলাও রাঁধতে শিখেছে। তোমরা কেমন আছো জানিও। ছবি পাঠিও।
সুরমা চলৎশক্তিহীন কিন্তু অনুভূতিহীন হয়নি। হুইল চেয়ার টেনে আমিনের কাছে এসে স্বামীর হাতে হাত রাখে। নিঃশব্দে দুই ব্যথিত হূদয় ভাব বিনিময় করে। দু'চোখে ধারা। তমাল এলে মুছে ফেলে।
খুকু এসে দাদু দাদু করে আবার বাড়িটা প্রাণময় করে তোলে।
তমাল হাসে-মা বাবা ভাই-বোনের মাঝে এ ভাঙ্গা গড়ার খেলা। মেনে নাও। যেমন আমি নিয়েছি।
তুরাগকে, খুকুকে আশ্রয় করে আবার সবাই স্বপ্ন দেখে।
আমিনের বাড়িতেই চেম্বার। মাঝে মাঝে পুরানো রোগী আসে। বন্ধু-বান্ধব আসে। নানা প্রসঙ্গে আলাপ চলে। সবাই সযত্নে এড়িয়ে যায় তনুর প্রসঙ্গ। তমালের দুর্ঘটনা। আমিন নাতনী প্রসঙ্গে বিচরণ করে। তুরাগের পরীক্ষায় কৃতিত্ব এবং সুখী জীবনের ছবিগুলো বার বার সবাইকে দেখায়।
সুরমার ঘুম কম। ঘুম পেলে ঘুমাতে হয় হুইল চেয়ারেই। রাত্রে দু'জন ঝি তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়। ঘুম হয় না। সারারাত প্রায় জেগে থাকে। নিজেকে নিয়ে সবাইকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে। কিন্তু ওরা জানে না সুরমার অনুভূতি এখন আরো তীক্ষ্ন আরো স্পর্শকাতর। আঘাতের পর আঘাত ওকে এখন কিছুটা ভারসাম্যহীন করেছে। চিরদিনের নিয়ন্ত্রিত চরিত্র ওর কিন্তু অবস্থানের অসহায়ত্ত সুরমার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আজকের নিষ্প্রাণ সুরমার মাঝে সেদিনের তরুণী সুখী সরমার কোন ছায়া নেই।
ঝিম ধরা বিকেল। হুইল চেয়ারে জানালার পাশে সুরমা চুপ করে বসে। খুকু এসে জড়িয়ে ধরে দাদী-আজ পয়লা বৈশাখ। আমি মেলায় যাবো। বুয়াকে নিয়ে যাই? আব্বুর সাথে যাচ্ছি।
তমাল এসে মায়ের মাথায় হাত বুলায়। মা আজ পয়লা বৈশাখ। বাংলা একাডেমী মেলায় ওকে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি সাবধানে থেকো।
হাত নেড়ে নাতনীকে বিদায় দেয় সুরমা। আমিন নিচতলায় চেম্বারে। ঝি'টা নিচতলায় রান্না ঘরে কাজে ব্যস্ত। একা নির্জন দোতলায় জানালার পাশে সুরমা। হঠাৎ ঝড়ো বাতাস শুরু হয়। সুরমার ঝি'টা খুকুর সাথে গেছে। কেউ ধারে কাছে নেই যে দৌড়ে এসে জানালাটা বন্ধ করবে। সুরমা জানালার কাছেই বসে থাকে। সুরমার শাশুড়ীর হাতে লাগানো আম গাছে অনেক আম ধরেছে। কয়েকটা পড়ে গেল। গেট দিয়ে ছুটে ঢুকল একপাল বাচ্চা। মারামারি করে কুড়াতে শুরু করে। বৃষ্টি নামে। খেয়াল নেই। এক সময় তনু কুড়াতা। কুড়াতে কুড়াতে মায়ের বকুনি খেত। তনু যত না কুড়ায় তত হৈচৈ। জানে এ বাড়িতে কেউ ধরতে আসবে না তাই নিশ্চিন্ত সাহস। এসব দিনে সুরমাদের দেশের বাড়িতে সুরমার সাথে ওর নানীও লাঠি হাতে ছুটে যেতো। দ্রুত আম কুড়াতো। ফোকলা দাঁতে হাসতো-খাঁটি জিনিশ খাইতো-তাই তোর চাইতে বেশি আম কুড়াইছি। মরা হাতি লাখ টাকা বুঝলি।
দু'এক ফোঁটা বৃষ্টি এসে চোখে-মুখে লাগে। প্রথমে ভালোই লাগে। চোখ বুঁজে প্রথম বৃষ্টির স্বাদ নেয় সুরমা। এরপর বাতাসের বেগের সঙ্গে বৃষ্টির কণাগুলোর গতিও ধারালো হয়ে উঠে। সুরমা ভিজে যায়।
হঠাৎ একটা শব্দ। দ্রুত বেগে উপরে উঠেছিলো আমিন-বোধ হয়। সুরমার জানালা বন্ধ করবার জন্য - পা পিছলে পড়ে গেছে। সিঁড়ির দিকে নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকে সুরমা। সিঁড়ির উঠার মুখে তৃতীয় ধাপে আমিন নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে। দু'হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে সুরমা। কেউ শুনতে পায় না। নিঃশব্দ আমিন পড়ে থাকে। শুধু সুরমার মুখ দিয়ে জড়ানো শব্দ ছড়িয়ে পড়ে। আর দুচাখে পানি ঝরে।
===================
ফিচার- 'এটি একটি সংখ্যামাত্র' by রণজিৎ বিশ্বাস  গল্প- 'সোনালি চিল' by সৈয়দ মোফাজ্জেল হোসেন  গল্প- 'বোবা ইশারা' by মণীশ রায়  গল্প- 'চিরদিনের' by মঈনুল আহসান সাবের  স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ সাহিত্যের এক সর্বসত্তা  আলোচনা- 'বাংলা চর্চা পরিচর্যা ও ইংরেজি শেখা'  আলোচনা- 'আমার ছেলেবেলার ঈদ আর বুড়োবেলার ঈদ'  আলোচনা- 'নৈতিক চেতনা : ধর্ম ও মতাদর্শ' by আবুল কাসেম ফজলুল হক খবর- গণতান্ত্রিক সব শক্তির সঙ্গে কাজ করতে চাই: সু চি  ফিচার- ‘নিজের কথা : বেঁচে আছি' by হুমায়ূন আহমেদ  কবিতা- সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কবিতা  আলোচনা- 'মোস্লেম ভারত' পত্রিকায় চর্চিত মুসলিম ধর্ম- দর্শনের স্বরূপ  ইতিহাস- 'চারশ' বছরের ঢাকা লোক ঐতিহ্যের দশ-দিগন্ত' by আনিস আহমেদ  গল্পালোচনা- 'মৃত্যুর মুশায়রা' by সেলিনা হোসেন  গল্প- 'বৃষ্টি নেমেছিল' by ইমদাদুল হক মিলন  গল্প- 'সড়ক নভেল' by হাসনাত আবদুল হাই  গল্প- 'জানালার বাইরে' by অরহ্যান পামুক  স্মৃতি ও গল্প- 'কবির অভিষেক' by মহাদেব সাহা  ইতিহাস- 'ভাওয়ালগড়ের ষড়যন্ত্র' by তারিক হাসান  আলোচনা- 'বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা' by বেলাল চৌধুরী  আলোচনা- 'শিল্প সৃষ্টি ও নান্দনিকতা' by আহমদ রফিক  আলোচনা- ''স্বর্ণকণা শোভে শত শত' মদির গন্ধভরা কণ্টকফল by মুহম্মদ সবুর  বিশেষ রচনা :ওমর খৈয়াম by ড. শামসুল আলম সাঈদ


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ হাজেরা নজরুল


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.