গল্প- 'অলৌকিক উপাখ্যান' by হাসান মোস্তাফিজুর রহমান

সূর্য ডুবছে। ডিমের কুসুম আকৃতির সূর্যটা ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে সাগরজলে। বেড়ানোর মৌসুম নয় বলে তেমন একটা মানুষজন নেই সৈকতে।

তবে যারাই আছে এ মুহূর্তে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে সূর্যাস্ত দেখছে। কেউ কেউ স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত। বিশেষ করে দম্পতিরা। অদ্ভুত এক অপার্থিব মায়াবী আলোয় ছেয়ে আছে গোটা সৈকত। সে আলোয় সম্মোহিতের মতো ডুবে আছে সবাই। কেউ কোনো কথা বলছে না। কোথাও কোনো শব্দ নেই। অপার্থিব মায়াবী আলোয় সম্মোহিত হয়ে আছে চরাচর।
মানুষের জটলা থেকে খানিকটা দূরে একাকী দাঁড়িয়ে আছে সে। তাকিয়ে আছে সাগর আর আকাশ যেখানে মিশে গেছে সেদিকে। স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে সূর্যাস্ত দেখছে। কী যেন ভাবছে। ভাবতে ভাবতে একসময় জলে ভরে ওঠে তার দু'চোখ। কিন্তু সে চোখ মোছে না। জলেভরা চোখেই সেদিকে তাকিয়ে থেকে কী যেন ভাবতে থাকে।
এভাবে কতোক্ষণ কেটে গেছে বলতে পারবে না সে। সন্ধ্যেকে গিলে খেয়ে কখন মৃতু্যরূপে রাত্রি নেমে এসেছে বলতে পারবে না। সৈকত ছেড়ে সবাই একে একে কখন চলে গেছে তা-ও বলতে পারবে না। জোয়ার শুরু হয়ে গেছে অনেক আগেই। হঠাৎ পায়ে জলের ছোঁয়া পেয়ে বাস্তবে ফিরে আসে। কিন্তু একটুও চমকায় না। বাদুরের ডানার মতো মিশমিশে কালো আঁধারে নিজেকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় ডুবে থাকতে দেখেও একটুও চমকায় না। শুধু বুকের খুব গহীন থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে দীর্ঘশ্বাস সাগরের লোনা বাতাসের সঙ্গে মিশে কোথায় যে ভেসে যায়!
সাগর হাতের বাঁয়ে রেখে সৈকত ধরে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে সে। দেরি হয়ে গেছে অনেক। ভেবে হাঁটার গতি আরো বাড়িয়ে দেয়। জোয়ার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো ফুঁসে উঠছে সাগর। প্রচণ্ড গর্জন করে সৈকতে আছড়ে পড়ছে ঢেউয়ের পর ঢেউ। আঁধারে দেখা যায় না সে ঢেউ, শুধু ঝাপসাভাবে সাদা সাদা ফেনা দেখা যায় আর গর্জন শোনা যায়। কিন্তু সে এসবের কিছুই দেখে না কিছুই শোনে না। গন্তব্যে পেঁৗছানোর অস্থির তাড়নায় দ্রুত হাঁটতে থাকে সে, হাঁটতে থাকে।
একসময় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। চোখ ঠাওর করে নিশ্চিত হয়ে নিয়ে আড়াআড়িভাবে সৈকত পার হয়। এবার উপর দিকে উঠতে শুরু করে ঢাল বেয়ে। জায়গাটা সৈকত থেকে বেশ উপরে। লতাপাতা, ঝোপঝাড় আর গাছগাছালিতে ছাওয়া। সাগর একদম কাছেই। স্পষ্ট দেখা যায় এখান থেকে। ঝাকড়া, বড়ো একটা গাছের নিচে একটা কবর। সেদিকে এগিয়ে কবরের পাশে আস্তে করে বসে পড়ে সে।
'সরি, সোনা, একটু দেরি হয়ে গেলো আজ।' কৈফিয়ত দিয়ে কান খাড়া করে আছে সে উত্তর শোনার আশায়। কিন্তু কোনো উত্তর শুনতে পায় না। কবরের ভেতর থেকে কোনো উত্তর ভেসে আসে না।
'বুঝতে পারছি রাগ করেছো। রাগ করাটাই স্বাভাবিক। আমি হলেও করতাম। কিন্তু কেন আজ আসতে দেরি হয়ে গেলো জিজ্ঞেস করবে না?'
প্রশ্ন করে জবাবের জন্য অপেক্ষা করছে সে। কিন্তু এবারো কোনো জবাব শুনতে পায় না। আরো একটু অপেক্ষা করে সে বলে,'হুমম্! বুঝতে পারছি খুব রাগ করেছো। বাব্বাহ্, এতো রাগ? কী, কথা বলবে না আমার সঙ্গে?' কথা শেষ করে কবরের দিকে কিছুটা কাত হয়। কান পেতে আছে কিছু একটা শোনার আশায়। কিন্তু কিছুই শুনতে পায় না।
এবার কিছুটা বিরক্ত স্বরে সে বলে,'আরে বোকা মেয়ে, আজ তো তোমার জন্যই দেরি হয়ে গেছে আমার। সূর্যাস্ত দেখতে খুব ভালো লাগতো তোমার। তাই আমিও দেখছিলাম। দেখতে দেখতে তোমাকেই ভাবছিলাম। কতো কথা কতো স্মৃতি যে মনে পড়ছিলো! তারপর এক সময় হঠাৎ বুঝতে পারলাম অন্ধকার সৈকতে আমি একা। ব্যাস, পড়িমরি করে ছুটলাম তোমার কাছে। এই হলো ঘটনা। তো কথা বলো এবার। বলো? দেখো, সব জানার পরও যদি এভাবে চুপ করে থাকো আমি কিন্তু এক্ষুণি এখান থেকে চলে যাবো!'
কৃত্রিম হুমকি দিয়ে কবরের দিকে কাত হয়ে কানপেতে আছে সে। কানপেতেই আছে। এভাবে ক'মুহূর্ত কেটে গেছে বলতে পারবে না। তারপর হঠাৎ! হঁ্যা, হঠাৎ স্পষ্ট শুনতে পায়- রিনিঝিনি হাসির শব্দ ভেসে আসছে কবরের ভেতর থেকে! যে হাসিকে সে কাঁচভাঙা হাসি বলে।
হাসতে হাসতে কবরবাসিনী বলে, 'আমি আজ আদৌ কথা বলি কিনা ভেবে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলে, না?'
কৃত্রিম অভিমানের সুরে সে বলে, 'তো ভয় পাবো না? প্রায়ই এ রকম করো তুমি।'
'আরে গাধু, আমি তো এ রকম করি তুমি কী করো দেখার জন্য। কী যে মজা লাগে তোমার কাণ্ডকারখানা দেখতে! আরে আমি তো জানিই আসতে কেন দেরি হচ্ছে তোমার।'
'আমি এদিকে টেনশনে মরি আর ওদিকে তুমি মজা করো ? এভাবে চুপ করে থেকে আমাকে টেনশনে ফেললে আমি কিন্তু আর আসবো না, হুঁ।'
ফের কাঁচভাঙা হাসিতে ভেঙে পড়লো কবরবাসিনী। হাসতে হাসতে বললো, 'আহা রে আমার অভিমানী বালকটা আর আসবে না বলে ভয় দেখাচ্ছে। অ্যাই, না এসে পারবে তুমি?'
সে-ও হেসে ফেলে বললো, 'তা যে পারবো না খুব ভালো করেই জানেন আপনি। জানেন বলেই তো এভাবে মজা করার সাহস পান। সে যাহোক, আপনার এ হাসিকে কী হাসি বলে মনে আছে তো?'
'মনে থাকবে না আবার? এখনো তাহলে হাসিতে কাঁচ ভেঙে ভেঙে পড়ে?' বলে আরেক চোট হেসে নিয়ে কবরবাসিনী জিজ্ঞেস করে, 'আচ্ছা, বলো তো এ কথাটা কবে বলেছিলে আমাকে?'
'তোমার সঙ্গে ফোনে প্রথমবার কথা হবার কয়েকদিন পরই।'
'তোমার মাথা! ফোনে কথা হবার কিছুদিন পর ঠিক আছে। তবে এ কথা ফোনে বলোনি। চিঠিতে লিখেছিলে।'
'ওঃ হঁ্যা, তাই তো! একদম ভুলে গিয়েছিলাম!'
'ওঃ হঁ্যা, তাই তো!' হেসে তাকে ভ্যাঙচালো কবরবাসিনী।
লাজুক হাসলো সে। কিছু বললো না।
জোয়ার বাড়ার সঙ্গে পালস্না দিয়ে ঢেউয়ের গর্জনও বাড়ছে। প্রচণ্ড আক্রোশে ফুঁসে উঠে সৈকতে আছড়ে পড়ছে ঢেউয়ের পর ঢেউ। আর কোনো শব্দ নেই চারপাশে। শুধু ঢেউভাঙার শব্দ। কানপেতে সেই শব্দ শুনছে সে। তার সঙ্গিনীও কি শুনছে?
অনেকক্ষণ এভাবে কেটে যাবার পর এক সময় কবরবাসিনী দরদমাখানো কণ্ঠে বলে, 'আচ্ছা, এই যে তুমি প্রতিদিন রাতে এখানে আসো। আমার পাশে থাকো। কষ্ট হয় না তোমার?'
'এটা একটা কথা বললে? তোমার পাশে থাকতে কষ্ট হবে কেন! তাছাড়া কষ্ট হোক আর না হোক, তুমি ছাড়া কার পাশে থাকবো আমি? এখানে তুমি ছাড়া আর কে আছে আমার বলো? আমি তো শুধু তোমার জন্যই এখানে আছি। সারাটা দিন হোটেল রুমে থেকে আর রাস্তায় ঘুরে ঘুরে সময় কাটাই। অপেক্ষায় থাকি কখন রাত নামবে। কখন তোমার পাশে আসবো। তোমার সঙ্গে কথা বলবো। কষ্ট কেন, এ তো আমার আনন্দ।'
শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে কবরবাসিনী। তারপর মন কেমন করা কণ্ঠে বলে,'আচ্ছা, তোমাকে একটা কথা বলি?'
'একশোটা বলো।'
'রাগ করবে না তো?'
'তোমার উপর রাগ করবো আমি? কী যে বলো না!'
'প্রমিজ?'
'প্রমিজ।' 'তুমি ঢাকায় ফিরে যাও।'
শুনে হতবাক হয়ে যায় সে। মুখে কথা সরে না। ভুল শুনলো কিনা তাও নিশ্চিত নয়। ক'মুহূর্ত পর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,'কী বললে তুমি?'
'বললাম তুমি ঢাকায় ফিরে যাও।'
'এ রকম একটা কথা তুমি বলতে পারলে!' ক্ষোভ চাপা থাকে না তার কণ্ঠস্বরে।
'অ্যাই, তুমি কিন্তু রেগে গেছো। অথচ প্রমিজ করেছো রাগ করবে না।'
'আমি তো কল্পনাও করতে পারিনি এমন একটা ফালতু কথা বলবে। রাগ করবো না তো কী করবো? আমার জায়গায় তুমি হলেও তাই করতে।' 'আমি ফালতু কথা বলেছি?'
'না, না, আপনি খুব মহান একটা কথা বলেছেন। আরে ঢাকায় আমি কার কাছে ফিরে যাবো ? কে আছে ওখানে আমার?'
'কী যে একটা কথা বললে না! হাস্যকর। কে নেই সেটা বলো। আমার শাশুড়ি মানে তোমার মা আছেন, ভাইবোনরা আছে, তোমার শাশুড়ি মানে আমার আম্মু আছে।'
'হঁ্যা, আছে এরা। কিন্তু ওখানে কি তুমি আছো? নেই। তুমি নেই মানে ওখানে আমার কেউ নেই। সবাই থেকেও নেই। আর এখানে তুমি আছো। তুমি আছো মানে এখানে আমার সবাই আছে। সেই এখান থেকে তুমি আমাকে চলে যেতে বলছো!'
কবরবাসিনীর কাছ থেকে কোনো উত্তর শুনতে পায় না সে। নিজেও কিছু বলে না। মাঝরাতের পূর্ণ জোয়ার চলছে এখন। প্রচণ্ড শব্দে ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকতে। কানপেতে সেই ছন্দময় শব্দ শুনছে সে। শুক্লপক্ষের ক্ষীণকায় চাঁদ ঝুলে আছে আকাশে। তার ঝাপসা আলোয় এখান থেকে ঢেউয়ের সাদা ফেনা দেখতে পাচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ কেটে যায় এভাবে। কতোক্ষণ সে বলতে পারবে না। বলতে পারবে আকাশের ওই চাঁদ, সাগরের জলরাশি আর দীর্ঘশ্বাসের মতো শিস কেটে কেটে বইতে থাকা শোকাহত বাতাসেরা। এভাবে আরো অনেকক্ষণ কেটে যাবার পর ফিসফিস করে সে জানতে চায়, 'কী ব্যাপার, একদম চুপ হয়ে গেলে যে? কী ভাবছো?' প্রশ্ন করে সে উত্তর শোনার আশায় কান পাতে, কান পেতেই রয়। কিন্তু কবরের ভেতর থেকে কোনো উত্তর ভেসে আসে না।
এবার অধৈর্য কণ্ঠে সে বলে, 'তোমার এ ব্যাপারটা আমার একদম ভালো লাগে না। প্রতিদিন রাতে এভাবে প্রায়ই তুমি হঠাৎ চুপ হয়ে যাও। চুপ করে থাকো তো থাকোই। বারবার বলা সত্ত্বেও কথা বলো না। এটা একদম ঠিক না। কেন কষ্ট দাও এভাবে? কথা বলো, পিস্নজ!'
তার আর্তি শুনেও কবরবাসিনী কোনো কথা বলে না।
'তুমি এরকম করলে আমি কিন্তু এক্ষুণি এখান থেকে চলে যাবো! কী, কথা বলবে নাকি চলে যাবো?' বলে কাত হয়ে কবরের খুব কাছাকাছি কান নিয়ে কান পেতে রয়। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ থাকার পর হঠাৎ শুনতে পায় সে, স্পষ্ট শুনতে পায়,'পারবে তুমি আমার উপর রাগ করে চলে যেতে?' অনেকক্ষণ পর তার গলার আওয়াজ পেয়ে ভীষণ খুশি হয়ে ওঠে সে। হেসে ফেলে বলে, 'তা যে পারবো না ভালো করেই জানো তুমি, জানু।'
'জানু! কতোদিন পর বললে!' কাঁচভাঙা হাসি ভেসে আসে কবরের ভেতর থেকে।
'কান অবশ হয়ে যাচ্ছে রে! হাসি থামাও।'
'তাই নাকি? এখনো কান অবশ হয় তাহলে?'
'হবে না কেন? আজীবন হবে। কার হাসি দেখতে হবে না?'
'ওই দেখো, আবারো পাম্প দিচ্ছে।'
'পাম্প নহে নির্জলা সত্যি। সে যাহোক, আগের প্রসঙ্গে আসি। আর কখনো আমাকে ফিরে যেতে বলবে না। ঠিক আছে? বললে আমি কিন্তু রাগ করবো।'
'আহ্হা! কেন রাগ করবে বলো তো? আমি কি অযৌক্তিক কিছু বলেছি তোমাকে? সবাই তোমার জন্য কষ্ট পাচ্ছে।' 'কিন্তু আমার কষ্টটা কেউ বুঝতে চেষ্টা করছে না। ঢাকায় ফিরে গিয়ে কী করবো আমি? কাকে নিয়ে থাকবো?'
'কাকে নিয়ে থাকবে? উমমঃ আমি বলি কী, আবার বিয়ে করো তুমি। এভাবে জীবন নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।'
'এমন একটা বাজে কথা তুমি আমাকে বলতে পারলে! এখ্খন চলে যাবো আমি এখান থেকে!' বলে বসা থেকে উঠতে শুরু করে সে।
'পিস্নজ তুমি বসো! বোঝার চেষ্টা করো একটু।'
'কোন্ কচুটা বোঝাবে তুমি আমাকে? উই ডিপার্ট টু মিট অ্যাগেন। ওপারে গিয়েও অনন্তকাল একসঙ্গে থাকবো। আর কখনো আলাদা হবো না। এসব কথা তুমিই আমাকে শিখিয়েছো। এসব স্বপ্ন তুমিই আমাকে দেখিয়েছো। সেই তুমিই কিনা আবার বিয়ে করতে বলছো আমাকে! হাউ কুড! আমি আবার বিয়ে করলে সেই মেয়ে ভাগ বসাবে না আমাদের স্বপ্নে?'
'হায় হায় তাই তো! আমি তো বুঝতেই পারিনি যেঃ!'
হেসে ফেলে ভ্যাঙচালো সে, 'আমি তো বুঝতেই পারিনি যে! ছাগল!'
'জেনডার ঠিক করো, পিস্নজ! ছাগল নয়, বলো ছাগলি।' 'আসলেই তুমি একটা ছাগলি। এতো করে মানা করলাম ভাটার সময় সাগরে নেমো না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ছাগলির মতো লাফাতে লাফাতে পানিতে নেমে রামছাগলির মতো দাপাদাপি শুরু করলে। কতোবার বললাম উঠে আসতে উঠে এলে না। তারপর হঠাৎ এক ঢেউয়ের টানে কোথায় ভেসে গেলে! পাওয়া গেলো দু'দিন খোঁজাখুঁজির পর। ওদিকে আবার বলে রেখেছিলে এখানে মরে গেলে সৈকতের কাছেই যেন কবর দেয়া হয়। তাই সবার অমতে তোমার কথাই রাখলাম। সাগরপাড়েই রেখে দিলাম তোমাকে। বাধ্য হয়ে থেকে যেতে হলো আমাকেও। অথচ সেই ছাগলি এখন আমাকে বলছে ঢাকায় ফিরে গিয়ে আরেকটা নিকা মোবারক করতে! হায় রে নারীজাতি!'
'উহ্হু! সরি, বাবা! বললাম তো বুঝতে পারিনি! আই'ম রিয়েলি সরি! আই বেগ ইয়োর পারডন, পিস্নজ!'
'ঠিক আছে, ছাগলি, দিলাম তোকে মাফ করে। কিন্তু আরেকদিন এ ধরনের বাজে কথা বলবি তোঃ!'
শুনে ফের কাঁচভাঙা হাসিতে ভেঙে পড়ে কবরবাসিনী- স্পষ্ট শুনতে পায় সে। শুনতে শুনতে আবেশে কান অবশ হয়ে আসে তার। তারপর ফের কথা বলতে থাকে তারা, কথা বলতে থাকে। ওদিকে রাত গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। সাগর আরো ফুঁসে ওঠায় বাড়তে থাকে ঢেউয়ের গর্জন।
দুই
দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নিচে নামছে সে। চোখ নিচের দিকে। অন্য কোনো দিকে তাকাচ্ছে না। যেনবা স্বপ্নের ঘোরে হেঁটে হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে নামছে।
ডেস্কের পেছনে টুলে বসে ছিলেন হোটেল ম্যানেজার আশরাফ সাহেব। তাকে দেখে বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। আস্তে করে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দেন।
'কোথায় যাচ্ছেন, স্যার?'
'ব্যাংকে যাচ্ছি। দেখি ওরা অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিয়েছে কিনা। আপনারা তো অনেক টাকা পাওনা হয়ে গেছেন।'
'ছি! ছি! এটা কী বললেন, স্যার! আপনি তো আমাদের পারমানেন্ট ক্লায়েন্ট। সামান্য ওই টাকা নিয়ে ভাবছেন কেন? ইয়েঃ স্যার, দুপুর হয়ে গেছে। নাশতা করেননি এখনো। আমাদের রেস্তোরাঁয় এখনো নাশতা পাবেন। আপনার জন্য আমি বলে রেখেছি। নাশতা করে ব্যাংকে গেলে হয় না, স্যার?'
নিরাসক্ত কণ্ঠে সে বলে, 'ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু আমার যে খিদে নেই?' বলে ম্যানেজারকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দরোজার দিকে এগিয়ে যায়।
চোখে গভীর মমতা নিয়ে পেছন থেকে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন আশরাফ সাহেব। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক চিরে। কতোইবা বয়স হবে ছেলেটার। তার বড়ো ছেলের বয়সীই হবে। আহ্, স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে এসে কী দিয়ে কী হয়ে গেলো! জীবনটাই থমকে গেছে বেচারার। গোসল, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম- কিছুরই ঠিক-ঠিকানা নেই। সারারাত স্ত্রীর কবরের পাশে বসে থাকে। হোটেলে ফেরে ভোরের দিকে। রোদের মধ্যে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ায়। সেই ঝলমলে চেহারা আর স্বাস্থ্যের আজ কী করুণ অবস্থা! মাথায় একরাশ ঝাঁকড়া এলোমেলো চুল। পরনে জীর্ণ পোশাক। দেখে চেনার উপায় নেই বছরখানেক আগে স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে এসে এ হোটেলে ওঠা সেই ব্যক্তিই এই ব্যক্তি।
তিন
পশ্চিম আকাশে রক্তিম আভা। মেঘলা দিন বলে রক্তের মতো গাঢ় লাল রঙে ছেয়ে যায়নি আকাশ। ধীরে ধীরে সাগরজলে ডুব দিচ্ছে সূর্য। মেঘের কারণে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না সূর্যাস্ত। তবু একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে আছে সে। তাকিয়ে থেকে কী যেন ভাবছে। ঝুম বৃষ্টির মৌসুম বলে একজন পর্যটকও নেই আজ। পুরো সৈকতে সে একা।
এক সময় মেঘের আড়ালে আড়ালে সাগরজলে ডুব দিলো সূর্য। আকাশের গা বেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে রাত্রি নেমে এলো চরাচরে। জোয়ার শুরু হয়ে গেছে। একের পর এক ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে সৈকতে। সাগর হাতের বাঁয়ে রেখে সৈকত ধরে দ্রুত হাঁটছে সে। এগিয়ে চলেছে তার গন্তব্যের দিকে। তার অমোঘ নিয়তির দিকে।
=============================
গল্প- 'জয়মন্টপের জায়াজননী' by জামাল উদ্দীন  আলোচনা- 'তুর্গিয়েনেফ প্রসাদাৎ' by হায়াৎ মামুদ  গল্প- 'একটাই জীবন' by হাজেরা নজরুল  ফিচার- 'এটি একটি সংখ্যামাত্র' by রণজিৎ বিশ্বাস  গল্প- 'সোনালি চিল' by সৈয়দ মোফাজ্জেল হোসেন  গল্প- 'বোবা ইশারা' by মণীশ রায়  গল্প- 'চিরদিনের' by মঈনুল আহসান সাবের  স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ সাহিত্যের এক সর্বসত্তা  আলোচনা- 'বাংলা চর্চা পরিচর্যা ও ইংরেজি শেখা'  আলোচনা- 'আমার ছেলেবেলার ঈদ আর বুড়োবেলার ঈদ'  আলোচনা- 'নৈতিক চেতনা : ধর্ম ও মতাদর্শ' by আবুল কাসেম ফজলুল হক খবর- গণতান্ত্রিক সব শক্তির সঙ্গে কাজ করতে চাই: সু চি  ফিচার- ‘নিজের কথা : বেঁচে আছি' by হুমায়ূন আহমেদ  কবিতা- সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কবিতা  আলোচনা- 'মোস্লেম ভারত' পত্রিকায় চর্চিত মুসলিম ধর্ম- দর্শনের স্বরূপ  ইতিহাস- 'চারশ' বছরের ঢাকা লোক ঐতিহ্যের দশ-দিগন্ত' by আনিস আহমেদ  গল্পালোচনা- 'মৃত্যুর মুশায়রা' by সেলিনা হোসেন  গল্প- 'বৃষ্টি নেমেছিল' by ইমদাদুল হক মিলন  গল্প- 'সড়ক নভেল' by হাসনাত আবদুল হাই  গল্প- 'জানালার বাইরে' by অরহ্যান পামুক  স্মৃতি ও গল্প- 'কবির অভিষেক' by মহাদেব সাহা  ইতিহাস- 'ভাওয়ালগড়ের ষড়যন্ত্র' by তারিক হাসান


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ হাসান মোস্তাফিজুর রহমান


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.