ইনসাফ ও স্বাধীনতা ব্য অরুন্ধতী রায়
সম্প্রতি প্রখ্যাত ভারতীয়লেখক অরুন্ধতী রায়েরকাশ্মীর বিষয়েকরা মন্তব্যনিয়েভারতে বিতর্ক চলছে। এমনকি তাঁকে গ্রেপ্তারের কথাও উঠেছে। এ বিষয়ে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে যে বক্তব্য দেন, এখানে তা প্রকাশ করা হলো।
লিখছি কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে। আজকের (মঙ্গলবার) সকালের পত্রিকাগুলো বলছে, কাশ্মীর বিষয়ে সম্প্রতি আমি প্রকাশ্যে যা বলেছি, তার জন্য জনগণকে উসকে দেওয়ার অভিযোগে আমাকে হয়তো গ্রেপ্তার করা হতে পারে। আমি যা বলেছি, তা এখানকার লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিনই বলে যাচ্ছে। আমি যা বলেছি, তা আমিসহ আরও অনেক লেখক ও ভাষ্যকার বছরের পর বছরজুড়ে বলে আসছেন।
কেউ যদি কষ্ট করে আমার বক্তৃতার শ্রুতিলিখন পড়েন তো দেখবেন, আসলে আমি যা বলেছি তা বুনিয়াদিভাবে সুবিচারের জন্য দাবি। আমি সেই কাশ্মীরি জনগণের জন্য সুবিচারের দাবি করেছি, যারা বিশ্বের অন্যতম নির্মম সামরিক দখলদারির মধ্যে বাস করে আসছে। আমি বলেছি কাশ্মীরি ব্রাম্মণ পণ্ডিতদের কথা, যাঁরা তাঁদের স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার করুণ বাস্তবতায় বাস করছেন। আমি বলেছি সেসব দলিত সৈন্যদের কথা, কাশ্মীরের সংঘাতে যাঁরা মারা গেছেন। আমি কুড্ডালোর গ্রামে তাঁদের কবর দেখতে গিয়েছিলাম। আবর্জনার স্তূপের নিচে সেসব কবর ঢাকা পড়েছে। আমি বলেছি ভারতের সেসব দরিদ্র মানুষের কথা, এই দখলদারির মূল্য যাঁদের দিতে হচ্ছে শরীর দিয়ে, জীবন দিয়ে। তাঁরা সবাই এখন ত্রাসের রাজত্বে বসবাস করা শিখছেন, যে রাজত্ব দিনকে দিন পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে উঠছে।
গতকাল (সোমবার) আমি আপেলের শহর শোপিয়ানে গিয়েছিলাম। ৪৭ দিন ধরে শহরবাসী আয়েশা ও নিলুফার নামের দুই তরুণীকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে শহরটিকে বন্ধ করে রেখেছে। তাঁদের লাশ পাওয়া গিয়েছিল তাঁদেরই বাড়ির ধারের এক চিকন নালার মধ্যে। এত দিন পার হয়ে গেলেও এখনো তাঁদের খুনিদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি।
আমি নিলুফারের স্বামী আয়েশার ভাই শাকিলের সঙ্গে দেখা করি। সেখানে আমাদের ঘিরে অজস্র ব্যথিত ও ক্রুদ্ধ নর-নারী দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভারতের কাছ থেকে তাঁরা কখনো ‘ইনসাফ’ পাবেন, এ আশা তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন। এখন তাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের একমাত্র আশার নাম হলো ‘আজাদি’—স্বাধীনতা। অল্পবয়সী ছেলেদের সঙ্গেও আমার দেখা হয়েছে। পাথর ছোড়ার অপরাধে তাদের চোখে গুলি করা হয়। যে তরুণের সঙ্গে আমি এখানে-সেখানে গিয়েছিলাম, তাঁর কাছ থেকে শোনা, কীভাবে তার তিন অল্পবয়সী বন্ধুকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাথর ছোড়ার শাস্তি হিসেবে আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল।
সংবাদপত্রে দেখলাম, কারও কারও অভিযোগ যে আমি নাকি ‘ঘৃণা ছড়ানো’ বক্তব্য দিচ্ছি। আমি নাকি চাই ভারত ভেঙে যাক। অথচ আমি উল্টোটাই চাই। আমি যা বলেছি, তার উৎস ভালোবাসা ও গৌরব। মানুষ গুলিতে মরুক কিংবা ধর্ষিত হোক কিংবা উপড়ে দেওয়া হোক তাদের আঙুলের নখ—এই চাওয়া থেকে তো আমি কিছু বলিনি। আমি বরং এর বিপরীত পরিবেশ চাওয়ার কথাই বলেছি। আমার কথাগুলোর জন্ম এমন এক সমাজে, যা এক ন্যায্য জীবন পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেই রাষ্ট্রকে আমার করুণা হয়, যা লেখকদের মনের কথা প্রকাশ করার পথ বন্ধ করে, তাঁদের নীরব করে দেয়। সেই রাষ্ট্রকে করুণা, যা সুবিচারপ্রার্থীদের জেলে ভরে আর সাম্প্রদায়িক ঘাতকদের, গণহত্যাকারীদের, করপোরেট নচ্ছারদের, লুটেরাদের, ধর্ষকদের এবং যারা গরিবস্য গরিবদের শিকার করে বেড়ায়, তাদের মুক্ত বিচরণে কোনো বাধা দেয় না।
ভারতের দ্য হিন্দু থেকে ভাষান্তর ফারুক ওয়াসিফ
অরুন্ধতী রায়: বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় লেখক ও অধিকারবাদী কর্মী।
লিখছি কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে। আজকের (মঙ্গলবার) সকালের পত্রিকাগুলো বলছে, কাশ্মীর বিষয়ে সম্প্রতি আমি প্রকাশ্যে যা বলেছি, তার জন্য জনগণকে উসকে দেওয়ার অভিযোগে আমাকে হয়তো গ্রেপ্তার করা হতে পারে। আমি যা বলেছি, তা এখানকার লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিনই বলে যাচ্ছে। আমি যা বলেছি, তা আমিসহ আরও অনেক লেখক ও ভাষ্যকার বছরের পর বছরজুড়ে বলে আসছেন।
কেউ যদি কষ্ট করে আমার বক্তৃতার শ্রুতিলিখন পড়েন তো দেখবেন, আসলে আমি যা বলেছি তা বুনিয়াদিভাবে সুবিচারের জন্য দাবি। আমি সেই কাশ্মীরি জনগণের জন্য সুবিচারের দাবি করেছি, যারা বিশ্বের অন্যতম নির্মম সামরিক দখলদারির মধ্যে বাস করে আসছে। আমি বলেছি কাশ্মীরি ব্রাম্মণ পণ্ডিতদের কথা, যাঁরা তাঁদের স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার করুণ বাস্তবতায় বাস করছেন। আমি বলেছি সেসব দলিত সৈন্যদের কথা, কাশ্মীরের সংঘাতে যাঁরা মারা গেছেন। আমি কুড্ডালোর গ্রামে তাঁদের কবর দেখতে গিয়েছিলাম। আবর্জনার স্তূপের নিচে সেসব কবর ঢাকা পড়েছে। আমি বলেছি ভারতের সেসব দরিদ্র মানুষের কথা, এই দখলদারির মূল্য যাঁদের দিতে হচ্ছে শরীর দিয়ে, জীবন দিয়ে। তাঁরা সবাই এখন ত্রাসের রাজত্বে বসবাস করা শিখছেন, যে রাজত্ব দিনকে দিন পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে উঠছে।
গতকাল (সোমবার) আমি আপেলের শহর শোপিয়ানে গিয়েছিলাম। ৪৭ দিন ধরে শহরবাসী আয়েশা ও নিলুফার নামের দুই তরুণীকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে শহরটিকে বন্ধ করে রেখেছে। তাঁদের লাশ পাওয়া গিয়েছিল তাঁদেরই বাড়ির ধারের এক চিকন নালার মধ্যে। এত দিন পার হয়ে গেলেও এখনো তাঁদের খুনিদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি।
আমি নিলুফারের স্বামী আয়েশার ভাই শাকিলের সঙ্গে দেখা করি। সেখানে আমাদের ঘিরে অজস্র ব্যথিত ও ক্রুদ্ধ নর-নারী দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভারতের কাছ থেকে তাঁরা কখনো ‘ইনসাফ’ পাবেন, এ আশা তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন। এখন তাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের একমাত্র আশার নাম হলো ‘আজাদি’—স্বাধীনতা। অল্পবয়সী ছেলেদের সঙ্গেও আমার দেখা হয়েছে। পাথর ছোড়ার অপরাধে তাদের চোখে গুলি করা হয়। যে তরুণের সঙ্গে আমি এখানে-সেখানে গিয়েছিলাম, তাঁর কাছ থেকে শোনা, কীভাবে তার তিন অল্পবয়সী বন্ধুকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাথর ছোড়ার শাস্তি হিসেবে আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল।
সংবাদপত্রে দেখলাম, কারও কারও অভিযোগ যে আমি নাকি ‘ঘৃণা ছড়ানো’ বক্তব্য দিচ্ছি। আমি নাকি চাই ভারত ভেঙে যাক। অথচ আমি উল্টোটাই চাই। আমি যা বলেছি, তার উৎস ভালোবাসা ও গৌরব। মানুষ গুলিতে মরুক কিংবা ধর্ষিত হোক কিংবা উপড়ে দেওয়া হোক তাদের আঙুলের নখ—এই চাওয়া থেকে তো আমি কিছু বলিনি। আমি বরং এর বিপরীত পরিবেশ চাওয়ার কথাই বলেছি। আমার কথাগুলোর জন্ম এমন এক সমাজে, যা এক ন্যায্য জীবন পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেই রাষ্ট্রকে আমার করুণা হয়, যা লেখকদের মনের কথা প্রকাশ করার পথ বন্ধ করে, তাঁদের নীরব করে দেয়। সেই রাষ্ট্রকে করুণা, যা সুবিচারপ্রার্থীদের জেলে ভরে আর সাম্প্রদায়িক ঘাতকদের, গণহত্যাকারীদের, করপোরেট নচ্ছারদের, লুটেরাদের, ধর্ষকদের এবং যারা গরিবস্য গরিবদের শিকার করে বেড়ায়, তাদের মুক্ত বিচরণে কোনো বাধা দেয় না।
ভারতের দ্য হিন্দু থেকে ভাষান্তর ফারুক ওয়াসিফ
অরুন্ধতী রায়: বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় লেখক ও অধিকারবাদী কর্মী।
No comments