তরুণেরাই বাংলাদেশকে বদলাতে পারবে by বদিউল আলম মজুমদার
‘তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহারই, যাহার শক্তি অপরিমাণ, গতিবেগ ঝঞ্ঝার ন্যায়, তেজ নির্মেঘ আষাঢ় মধ্যাহ্নের মার্তণ্ডপ্রায়, বিপুল যাহার আশা, ক্লান্তিহীন যাহার উত্সাহ, বিরাট যাহার ঔদার্য, অফুরন্ত যাহার প্রাণ, অটল যাহার সাধনা, মৃত্যু যাহার মুঠিতলে।’ এভাবেই তরুণ এবং তারুণ্যের বর্ণনা দিয়েছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর দুর্দিনের যাত্রী গ্রন্থের ‘যৌবনের গান’ প্রবন্ধে।
নিঃসন্দেহে তরুণেরা শক্তিমান ও দুঃসাহসী। কারণ, রূঢ় ‘বাস্তবতার’ শৃঙ্খলে তারা আবদ্ধ হয়ে যায়নি। ‘অভিজ্ঞতাহীনতার’ কারণেই তারা প্রথাগত চিন্তার দাসে পরিণত হয়নি। জীবনসংগ্রামের ঘাত-প্রতিঘাতের প্রভাবে তারা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েনি বা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা তাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। তাই তারা নীতি ও নৈতিকতা দ্বারা পরিচালিত হতে পারে। ঝুঁকি নিতে পারে। ‘লিপ ফরোয়ার্ড’ বা অনন্য সফলতা অর্জন করতে পারে। দুঃসাধ্য সাধন করতে পারে। বস্তুত, অসাধারণ অর্জন তাদের জন্য বহু ক্ষেত্রে সাধারণ ব্যাপারমাত্র। বায়ান্ন থেকে শুরু করে নব্বই পর্যন্ত জাতীয় জীবনের ক্রান্তিলগ্নে আমাদের তরুণেরাই বহুবার তা প্রমাণ করেছে।
পক্ষান্তরে, বয়স্করা সাধারণত বাস্তবতার বেড়াজালে আটকা পড়ে যায়। পরিবার-পরিজনের প্রতি কর্তব্যপরায়ণতা তাদের পরিধিকে অনেক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ করে তোলে। অভ্যস্ততা তাদের গণ্ডিবদ্ধ করে ফেলে। তাই ‘দায়িত্বশীলতা’র কারণেই তারা অনেক সময় ঝুঁকি নিতে পারে না। দুঃসাহসিকতা প্রদর্শন করা তাদের পক্ষে অনেক সময় দুরূহ হয়ে পড়ে। ‘ইক্রিমেন্টাল’ বা ক্ষুদ্র পরিবর্তনেই সাধারণত তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তাই তো উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের মতো বহু মনীষী বার্ধক্যকে ধিক্কার দিয়ে বারবার তারুণ্যের জয়গান গেয়েছেন।
আমাদের তরুণেরা বর্তমানে কী ভাবছে তা জানার জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিলের উদ্যোগে ‘ডেটা ইন্টারন্যাশনাল’ সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ: দ্য নেক্সট জেনারেশন’ বা বাংলাদেশের আগামী প্রজন্ম নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে। সারা দেশের ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়স্ক দুই হাজার ১৬৭ জন শহর ও গ্রামীণ ছেলেমেয়ে—যাদের ৯৮৩ জন (৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ) নারী, ৭১৪ জন (৩৩ শতাংশ) ছাত্রছাত্রী এবং এক হাজার ১৭ জন (৪৭ শতাংশ) রাজধানীর বাইরের—এতে অংশ নেয়। জরিপের ফলাফল অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য এবং এ সম্পর্কে আমার অনুভূতি চারটি বিশেষণ দিয়ে ব্যক্ত করা যায়: সুসংবাদ, দুঃসংবাদ, সম্ভাবনা ও ঝুঁকি।
জরিপ থেকে সবচেয়ে বড় সুসংবাদ হলো, ৮৮ শতাংশ তরুণ-তরুণী সুখী বা অত্যন্ত সুখী এবং ৭০ শতাংশ মনে করে, দেশ সঠিক পথেই চলছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুসংবাদ হলো, প্রায় সব উত্তরদাতাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী। কারণ, তাদের ৯৮ শতাংশ—ছেলে ৯৯ শতাংশ, মেয়ে ৯৭ শতাংশ—মনে করে, তরুণদের সমাজ গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া উচিত। আর ৯৫ শতাংশ উত্তরদাতা সমাজকর্মে যুক্ত হতে আগ্রহী। অর্থাৎ বাংলাদেশ সম্পর্কে তারা হাল ছেড়ে দেয়নি, তাই তারা একটি উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কাজে সম্পৃক্ত হতে প্রস্তুত। তবে এসব মতামত গ্রহণের বিষয়ে কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করা আবশ্যক। কারণ, ‘আপনি সুখী না অসুখী’ এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হলে নিজেকে অসুখী বলে দাবি করা ভালো দেখায় না। তাই এসব ক্ষেত্রে উত্তর অন্তত কিছুটা হলেও ‘বায়াসড’ বা প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তবু এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, সার্বিকভাবে বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের মনোভাব অত্যন্ত ইতিবাচক।
জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে একটি বড় দুঃসংবাদ হলো, যদিও প্রায় সব উত্তরদাতাই সমাজ উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে আগ্রহী, তবু মাত্র ৩০ শতাংশ—৪১ শতাংশ ছেলে এবং ১৮ শতাংশ মেয়ে—এসব কাজে জড়িত। এ ছাড়া যদিও ৩১ শতাংশ শহুরে উত্তরদাতা সমাজকর্মে জড়িত, শুধু ছয় শতাংশ গ্রামীণ উত্তরদাতা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ তরুণদের শক্তি ও সামর্থ্য বহুলাংশেই এখন অব্যবহূত। প্রসঙ্গত, তরুণদের দ্বারা পরিচালিত সমাজকর্ম বা আন্দোলনে জড়িত সংগঠনগুলো সম্পর্কে ৯৫ শতাংশ উত্তরদাতাই জানে না।
আরেকটি দুঃসংবাদ হলো, সমাজকর্মে নগণ্যসংখ্যক অংশগ্রহণকারীর অধিকাংশই প্রথাগত দান-খয়রাতমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত। দান-অনুদান প্রদান সৃজনশীল কার্যক্রম নয় এবং এগুলোতে তাদের মেধার পরিপূর্ণ ব্যবহার ও নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ ঘটে না। এর মাধ্যমে একটি আত্মনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার সুযোগও সৃষ্টি হবে না। কারণ, ভিক্ষা দিয়ে ভিক্ষুক সৃষ্টি করা যায়, কাউকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো যায় না।
আরেকটি নেতিবাচক সংবাদ হলো, উত্তরদাতাদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (৭৪ শতাংশ) রাজনীতির প্রতি বিমুখ। অর্থাৎ বিরাজমান নেতিবাচক ও দ্বন্দ্বাত্মক রাজনীতি তাদের আকর্ষণ করতে পারছে না এবং তারা এর সঙ্গে জড়িত হতে চায় না। নিঃসন্দেহে এটি একটি দুঃসংবাদ। কারণ, আমাদের রাজনীতির গুণগত মানে ভবিষ্যতে পরিবর্তন আনতে হলে তরুণদের এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। আরেকটি দুঃসংবাদ হলো, মাত্র ১৫ শতাংশ তরুণ ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করে।
জরিপের ফলাফল অনেক সম্ভাবনার কথাও বলে। আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশের তরুণদের প্রায় সবাই আগামী দিনের বাংলাদেশ গঠনের কাজে যুক্ত হতে প্রস্তুত, যদিও তাদের অতি ক্ষুদ্র অংশই বর্তমানে এ কাজের সঙ্গে জড়িত। আর তারুণ্যের এ আগ্রহকে কাজে লাগানো গেলে, তারাই বাংলাদেশকে বদলে দিতে পারবে। তারাই পারবে বাংলাদেশে এক অভূতপূর্ব ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে।
বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তরুণ। তাদের সংখ্যা আনুমানিক সাড়ে পাঁচ কোটি। এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে সমাজ গঠনমূলক কাজে নিয়মিত অংশগ্রহণের জন্য উজ্জীবিত করা গেলে সারা দেশে একটি বিরাট কর্মযজ্ঞ শুরু হতে পারে। আর এ ধরনের কর্মযজ্ঞ বাংলাদেশের জন্য একটি অমিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। কবি আজিজুল হাকিমের ভাষায়, ‘নিরুদ্ধ ব্যথা নয়নের জলে/রুখি যুগে যুগে তরুণেরা চলে/অতীত গড়েছে তারাই, তারা গড়িছে বর্তমান,/নতুন গড়িছে নতুন পৃথিবী ...’
আশার কথা যে আমাদের তরুণেরা এরই মধ্যে আগুয়ান হয়েছে—বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন ভবিষ্যৎ গড়তে তারা কাজ শুরু করে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, গত ৫ জুন ছাত্র-তরুণদের নেতৃত্বে পরিচালিত ‘ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গারে’র লক্ষাধিক সদস্যের মধ্য থেকে হাজারখানেক সাভারের গণস্বাস্থ্য মিলনায়তনে একত্র হয়। নিজেদের পকেটের অর্থ ব্যয় করে সারা দেশ থেকে আগত এসব ছাত্রছাত্রী অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, হামিদা হোসেনসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করে—তারা প্রতিদিন সমাজের জন্য অন্তত একটি ভালো কাজ করবে এবং এ লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে তারা একটি আন্দোলন গড়ে তুলছে।
প্রসঙ্গত, নিজেদের মেধা-সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ বিকাশ, ছাত্র-তরুণদের মধ্যে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার মানসিকতা সৃষ্টি এবং তাদের নেতৃত্বের ক্ষমতায়নের লক্ষ্য নিয়ে প্রায় ১৫ বছর আগে আমাদের প্রণোদনায় ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গারের সৃষ্টি এবং বাংলাদেশের অনেক বরেণ্য ব্যক্তিই তাদের সহযোগিতা করছেন। বর্তমানে ব্রিটিশ কাউন্সিলও এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গারের সদস্যরা তৃণমূল পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের সংগঠিত করে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজন, পাঠাগার ও বিজ্ঞান ক্লাব গঠন, গণশিক্ষা কার্যক্রম, ছাত্রী উত্ত্যক্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি, পরিবেশ সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
আমাদের জনসংখ্যায় তারুণ্যের আধিক্যের কারণে আরেকটি বিরাট সম্ভাবনার জায়গা হলো যে মানসম্মত শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করে তাদের যদি ‘ডিজিটাল হাইওয়েতে’ পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে আমরা এক অপ্রতিরোধ্য জাতিতে পরিণত হব। কারণ, ‘নলেজ এক্সপ্লোশন’ বা জ্ঞানের বিস্ফোরণের এ যুগে প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় মানবসম্পদই একটি জাতির উন্নতি-সমৃদ্ধির জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
জনসংখ্যায় তারুণ্যের আধিক্য জাতির জন্য চরম ঝুঁকিও সৃষ্টি করছে। তরুণদের গড়ে তুলতে এবং তাদের ইতিবাচক কাজের সঙ্গে জড়িত করতে না পারলে, তারা বখে যেতে পারে। তারা অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে পারে, যা সমাজে শুধু অস্থিরতাই নয়, বড় ধরনের প্রলয় সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি তারা উগ্রবাদের দিকেও ধাবিত হতে পারে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ব্যাপক দারিদ্র্য এবং তাদের প্রতি ক্রমবর্ধমান বঞ্চনার কারণে এ ভয়াবহ আশঙ্কার কথা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আমাদের তরুণদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বর্তমানে গ্রামে বসবাস করে। তারা মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। বর্তমান বাস্তবতায় তাদের অধিকাংশ বড়জোর পিয়ন-চাপরাশির চাকরির আশা করতে পারে। বিরাজমান তদবির ও উেকাচের সংস্কৃতির কারণে তাও আবার অনেকের জন্য সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। ফলে গ্রামীণ তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ তরুণদের একটি বিরাট অংশই এখন বেকার। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, বেকারদের বড় অংশই সাধারণত অসামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়।
আশার কথা যে আমাদের তরুণেরা এখনো বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছে এবং তারা সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে উত্সুক। তবে তাদের মধ্যেও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। তাদের প্রায় ৬০ শতাংশই এখন মনে করে যে আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশে দুর্নীতির অবস্থা আরও খারাপ হবে বা হতে পারে। অর্থাৎ বিরাজমান সর্বগ্রাসী ও সর্বব্যাপী দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে আমাদের অদূর ভবিষ্যতে মুক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা তারা দেখতে পায় না। তাদের প্রায় ৪২ শতাংশ বিদেশে পাড়ি জমাতে চায়, কারণ বর্তমান বাস্তবতায় সম্ভবত তারা নিজেদের মেধা ও কর্মোদ্যম কাজে লাগানোর সুযোগ খুঁজে পায় না।
অনেকে তরুণদের বিদেশে পাড়ি জমানোর আগ্রহের সঙ্গে নীতিবোধ ও দেশপ্রেমের সম্পর্ক দেখতে পান। তাঁদের পলায়নপর বলে আখ্যায়িত করতে চান। আমার মতে, এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ঠুনকো ‘জাতীয়তাবোধ’ থেকে উদ্ভূত। বর্তমানের বিশ্বায়নের যুগে এ ধরনের সস্তা আবেগের কোনো অবকাশ আছে বলে আমার মনে হয় না। বিশেষত, আমরা যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আর্থিক পুঁজির অবাধ চলাচলের সঙ্গে সঙ্গে মানবসম্পদের অবাধ চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ার দাবি করছি। কপাট-জানালা বন্ধ করার পরিবর্তে বিশ্বায়নের জন্য তরুণদের প্রস্তুত করা আজ আমাদের জন্য জরুরি।
ব্রিটিশ কাউন্সিল পরিচালিত জরিপের ফলাফল আমাদের নীতিনির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার খোরাক জোগাতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। আমি মনে করি যে জাতি হিসেবে আমরা একটি ‘ক্রস রোডে’র সামনাসামনি—আমাদের সামনে আজ দুটো বিপরীতমুখী পথ খোলা। একটি পথ হলো তরুণদের বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া এবং তাদের উত্পাদনশীল ও ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত করা। তাদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন ও তাদের বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। এ কাজটি হবে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের ভাষায়, তরুণদের জন্য যথাযথ ভবিষ্যৎ গড়তে না পারলেও কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের জন্য তাদের গড়ে তোলা। আর তা করা গেলে নিঃসন্দেহে জাতি হিসেবে আমরা এগিয়ে যাব এবং আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করার সুযোগ পাবে।
অপর পথটি হলো, তারুণ্যের সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করা। তাদের অবহেলা করা। তাদের সঠিক পথে অগ্রসর হতে সহায়তা না করা। বরং তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার অব্যাহত রাখা। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এ ধরনের উপেক্ষা ও অসহযোগিতার পরিণতি হবে ভয়াবহ। আজ আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কোন পথটি ধরে এগোবেন তা নির্ভর করবে তাঁদের প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার ওপর। আর তার ওপরই নির্ভর করবে জাতি হিসেবে আমাদের সম্মিলিত ভবিষ্যৎ।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর, দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশ।
নিঃসন্দেহে তরুণেরা শক্তিমান ও দুঃসাহসী। কারণ, রূঢ় ‘বাস্তবতার’ শৃঙ্খলে তারা আবদ্ধ হয়ে যায়নি। ‘অভিজ্ঞতাহীনতার’ কারণেই তারা প্রথাগত চিন্তার দাসে পরিণত হয়নি। জীবনসংগ্রামের ঘাত-প্রতিঘাতের প্রভাবে তারা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েনি বা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা তাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। তাই তারা নীতি ও নৈতিকতা দ্বারা পরিচালিত হতে পারে। ঝুঁকি নিতে পারে। ‘লিপ ফরোয়ার্ড’ বা অনন্য সফলতা অর্জন করতে পারে। দুঃসাধ্য সাধন করতে পারে। বস্তুত, অসাধারণ অর্জন তাদের জন্য বহু ক্ষেত্রে সাধারণ ব্যাপারমাত্র। বায়ান্ন থেকে শুরু করে নব্বই পর্যন্ত জাতীয় জীবনের ক্রান্তিলগ্নে আমাদের তরুণেরাই বহুবার তা প্রমাণ করেছে।
পক্ষান্তরে, বয়স্করা সাধারণত বাস্তবতার বেড়াজালে আটকা পড়ে যায়। পরিবার-পরিজনের প্রতি কর্তব্যপরায়ণতা তাদের পরিধিকে অনেক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ করে তোলে। অভ্যস্ততা তাদের গণ্ডিবদ্ধ করে ফেলে। তাই ‘দায়িত্বশীলতা’র কারণেই তারা অনেক সময় ঝুঁকি নিতে পারে না। দুঃসাহসিকতা প্রদর্শন করা তাদের পক্ষে অনেক সময় দুরূহ হয়ে পড়ে। ‘ইক্রিমেন্টাল’ বা ক্ষুদ্র পরিবর্তনেই সাধারণত তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তাই তো উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের মতো বহু মনীষী বার্ধক্যকে ধিক্কার দিয়ে বারবার তারুণ্যের জয়গান গেয়েছেন।
আমাদের তরুণেরা বর্তমানে কী ভাবছে তা জানার জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিলের উদ্যোগে ‘ডেটা ইন্টারন্যাশনাল’ সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ: দ্য নেক্সট জেনারেশন’ বা বাংলাদেশের আগামী প্রজন্ম নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে। সারা দেশের ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়স্ক দুই হাজার ১৬৭ জন শহর ও গ্রামীণ ছেলেমেয়ে—যাদের ৯৮৩ জন (৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ) নারী, ৭১৪ জন (৩৩ শতাংশ) ছাত্রছাত্রী এবং এক হাজার ১৭ জন (৪৭ শতাংশ) রাজধানীর বাইরের—এতে অংশ নেয়। জরিপের ফলাফল অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য এবং এ সম্পর্কে আমার অনুভূতি চারটি বিশেষণ দিয়ে ব্যক্ত করা যায়: সুসংবাদ, দুঃসংবাদ, সম্ভাবনা ও ঝুঁকি।
জরিপ থেকে সবচেয়ে বড় সুসংবাদ হলো, ৮৮ শতাংশ তরুণ-তরুণী সুখী বা অত্যন্ত সুখী এবং ৭০ শতাংশ মনে করে, দেশ সঠিক পথেই চলছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুসংবাদ হলো, প্রায় সব উত্তরদাতাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী। কারণ, তাদের ৯৮ শতাংশ—ছেলে ৯৯ শতাংশ, মেয়ে ৯৭ শতাংশ—মনে করে, তরুণদের সমাজ গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া উচিত। আর ৯৫ শতাংশ উত্তরদাতা সমাজকর্মে যুক্ত হতে আগ্রহী। অর্থাৎ বাংলাদেশ সম্পর্কে তারা হাল ছেড়ে দেয়নি, তাই তারা একটি উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কাজে সম্পৃক্ত হতে প্রস্তুত। তবে এসব মতামত গ্রহণের বিষয়ে কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করা আবশ্যক। কারণ, ‘আপনি সুখী না অসুখী’ এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হলে নিজেকে অসুখী বলে দাবি করা ভালো দেখায় না। তাই এসব ক্ষেত্রে উত্তর অন্তত কিছুটা হলেও ‘বায়াসড’ বা প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তবু এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, সার্বিকভাবে বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের মনোভাব অত্যন্ত ইতিবাচক।
জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে একটি বড় দুঃসংবাদ হলো, যদিও প্রায় সব উত্তরদাতাই সমাজ উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে আগ্রহী, তবু মাত্র ৩০ শতাংশ—৪১ শতাংশ ছেলে এবং ১৮ শতাংশ মেয়ে—এসব কাজে জড়িত। এ ছাড়া যদিও ৩১ শতাংশ শহুরে উত্তরদাতা সমাজকর্মে জড়িত, শুধু ছয় শতাংশ গ্রামীণ উত্তরদাতা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ তরুণদের শক্তি ও সামর্থ্য বহুলাংশেই এখন অব্যবহূত। প্রসঙ্গত, তরুণদের দ্বারা পরিচালিত সমাজকর্ম বা আন্দোলনে জড়িত সংগঠনগুলো সম্পর্কে ৯৫ শতাংশ উত্তরদাতাই জানে না।
আরেকটি দুঃসংবাদ হলো, সমাজকর্মে নগণ্যসংখ্যক অংশগ্রহণকারীর অধিকাংশই প্রথাগত দান-খয়রাতমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত। দান-অনুদান প্রদান সৃজনশীল কার্যক্রম নয় এবং এগুলোতে তাদের মেধার পরিপূর্ণ ব্যবহার ও নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ ঘটে না। এর মাধ্যমে একটি আত্মনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার সুযোগও সৃষ্টি হবে না। কারণ, ভিক্ষা দিয়ে ভিক্ষুক সৃষ্টি করা যায়, কাউকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো যায় না।
আরেকটি নেতিবাচক সংবাদ হলো, উত্তরদাতাদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (৭৪ শতাংশ) রাজনীতির প্রতি বিমুখ। অর্থাৎ বিরাজমান নেতিবাচক ও দ্বন্দ্বাত্মক রাজনীতি তাদের আকর্ষণ করতে পারছে না এবং তারা এর সঙ্গে জড়িত হতে চায় না। নিঃসন্দেহে এটি একটি দুঃসংবাদ। কারণ, আমাদের রাজনীতির গুণগত মানে ভবিষ্যতে পরিবর্তন আনতে হলে তরুণদের এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। আরেকটি দুঃসংবাদ হলো, মাত্র ১৫ শতাংশ তরুণ ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করে।
জরিপের ফলাফল অনেক সম্ভাবনার কথাও বলে। আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশের তরুণদের প্রায় সবাই আগামী দিনের বাংলাদেশ গঠনের কাজে যুক্ত হতে প্রস্তুত, যদিও তাদের অতি ক্ষুদ্র অংশই বর্তমানে এ কাজের সঙ্গে জড়িত। আর তারুণ্যের এ আগ্রহকে কাজে লাগানো গেলে, তারাই বাংলাদেশকে বদলে দিতে পারবে। তারাই পারবে বাংলাদেশে এক অভূতপূর্ব ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে।
বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তরুণ। তাদের সংখ্যা আনুমানিক সাড়ে পাঁচ কোটি। এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে সমাজ গঠনমূলক কাজে নিয়মিত অংশগ্রহণের জন্য উজ্জীবিত করা গেলে সারা দেশে একটি বিরাট কর্মযজ্ঞ শুরু হতে পারে। আর এ ধরনের কর্মযজ্ঞ বাংলাদেশের জন্য একটি অমিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। কবি আজিজুল হাকিমের ভাষায়, ‘নিরুদ্ধ ব্যথা নয়নের জলে/রুখি যুগে যুগে তরুণেরা চলে/অতীত গড়েছে তারাই, তারা গড়িছে বর্তমান,/নতুন গড়িছে নতুন পৃথিবী ...’
আশার কথা যে আমাদের তরুণেরা এরই মধ্যে আগুয়ান হয়েছে—বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন ভবিষ্যৎ গড়তে তারা কাজ শুরু করে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, গত ৫ জুন ছাত্র-তরুণদের নেতৃত্বে পরিচালিত ‘ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গারে’র লক্ষাধিক সদস্যের মধ্য থেকে হাজারখানেক সাভারের গণস্বাস্থ্য মিলনায়তনে একত্র হয়। নিজেদের পকেটের অর্থ ব্যয় করে সারা দেশ থেকে আগত এসব ছাত্রছাত্রী অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, হামিদা হোসেনসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করে—তারা প্রতিদিন সমাজের জন্য অন্তত একটি ভালো কাজ করবে এবং এ লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে তারা একটি আন্দোলন গড়ে তুলছে।
প্রসঙ্গত, নিজেদের মেধা-সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ বিকাশ, ছাত্র-তরুণদের মধ্যে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার মানসিকতা সৃষ্টি এবং তাদের নেতৃত্বের ক্ষমতায়নের লক্ষ্য নিয়ে প্রায় ১৫ বছর আগে আমাদের প্রণোদনায় ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গারের সৃষ্টি এবং বাংলাদেশের অনেক বরেণ্য ব্যক্তিই তাদের সহযোগিতা করছেন। বর্তমানে ব্রিটিশ কাউন্সিলও এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গারের সদস্যরা তৃণমূল পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের সংগঠিত করে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজন, পাঠাগার ও বিজ্ঞান ক্লাব গঠন, গণশিক্ষা কার্যক্রম, ছাত্রী উত্ত্যক্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি, পরিবেশ সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
আমাদের জনসংখ্যায় তারুণ্যের আধিক্যের কারণে আরেকটি বিরাট সম্ভাবনার জায়গা হলো যে মানসম্মত শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করে তাদের যদি ‘ডিজিটাল হাইওয়েতে’ পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে আমরা এক অপ্রতিরোধ্য জাতিতে পরিণত হব। কারণ, ‘নলেজ এক্সপ্লোশন’ বা জ্ঞানের বিস্ফোরণের এ যুগে প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় মানবসম্পদই একটি জাতির উন্নতি-সমৃদ্ধির জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
জনসংখ্যায় তারুণ্যের আধিক্য জাতির জন্য চরম ঝুঁকিও সৃষ্টি করছে। তরুণদের গড়ে তুলতে এবং তাদের ইতিবাচক কাজের সঙ্গে জড়িত করতে না পারলে, তারা বখে যেতে পারে। তারা অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে পারে, যা সমাজে শুধু অস্থিরতাই নয়, বড় ধরনের প্রলয় সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি তারা উগ্রবাদের দিকেও ধাবিত হতে পারে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ব্যাপক দারিদ্র্য এবং তাদের প্রতি ক্রমবর্ধমান বঞ্চনার কারণে এ ভয়াবহ আশঙ্কার কথা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আমাদের তরুণদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বর্তমানে গ্রামে বসবাস করে। তারা মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। বর্তমান বাস্তবতায় তাদের অধিকাংশ বড়জোর পিয়ন-চাপরাশির চাকরির আশা করতে পারে। বিরাজমান তদবির ও উেকাচের সংস্কৃতির কারণে তাও আবার অনেকের জন্য সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। ফলে গ্রামীণ তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ তরুণদের একটি বিরাট অংশই এখন বেকার। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, বেকারদের বড় অংশই সাধারণত অসামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়।
আশার কথা যে আমাদের তরুণেরা এখনো বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছে এবং তারা সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে উত্সুক। তবে তাদের মধ্যেও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। তাদের প্রায় ৬০ শতাংশই এখন মনে করে যে আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশে দুর্নীতির অবস্থা আরও খারাপ হবে বা হতে পারে। অর্থাৎ বিরাজমান সর্বগ্রাসী ও সর্বব্যাপী দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে আমাদের অদূর ভবিষ্যতে মুক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা তারা দেখতে পায় না। তাদের প্রায় ৪২ শতাংশ বিদেশে পাড়ি জমাতে চায়, কারণ বর্তমান বাস্তবতায় সম্ভবত তারা নিজেদের মেধা ও কর্মোদ্যম কাজে লাগানোর সুযোগ খুঁজে পায় না।
অনেকে তরুণদের বিদেশে পাড়ি জমানোর আগ্রহের সঙ্গে নীতিবোধ ও দেশপ্রেমের সম্পর্ক দেখতে পান। তাঁদের পলায়নপর বলে আখ্যায়িত করতে চান। আমার মতে, এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ঠুনকো ‘জাতীয়তাবোধ’ থেকে উদ্ভূত। বর্তমানের বিশ্বায়নের যুগে এ ধরনের সস্তা আবেগের কোনো অবকাশ আছে বলে আমার মনে হয় না। বিশেষত, আমরা যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আর্থিক পুঁজির অবাধ চলাচলের সঙ্গে সঙ্গে মানবসম্পদের অবাধ চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ার দাবি করছি। কপাট-জানালা বন্ধ করার পরিবর্তে বিশ্বায়নের জন্য তরুণদের প্রস্তুত করা আজ আমাদের জন্য জরুরি।
ব্রিটিশ কাউন্সিল পরিচালিত জরিপের ফলাফল আমাদের নীতিনির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার খোরাক জোগাতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। আমি মনে করি যে জাতি হিসেবে আমরা একটি ‘ক্রস রোডে’র সামনাসামনি—আমাদের সামনে আজ দুটো বিপরীতমুখী পথ খোলা। একটি পথ হলো তরুণদের বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া এবং তাদের উত্পাদনশীল ও ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত করা। তাদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন ও তাদের বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। এ কাজটি হবে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের ভাষায়, তরুণদের জন্য যথাযথ ভবিষ্যৎ গড়তে না পারলেও কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের জন্য তাদের গড়ে তোলা। আর তা করা গেলে নিঃসন্দেহে জাতি হিসেবে আমরা এগিয়ে যাব এবং আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করার সুযোগ পাবে।
অপর পথটি হলো, তারুণ্যের সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করা। তাদের অবহেলা করা। তাদের সঠিক পথে অগ্রসর হতে সহায়তা না করা। বরং তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার অব্যাহত রাখা। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এ ধরনের উপেক্ষা ও অসহযোগিতার পরিণতি হবে ভয়াবহ। আজ আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কোন পথটি ধরে এগোবেন তা নির্ভর করবে তাঁদের প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার ওপর। আর তার ওপরই নির্ভর করবে জাতি হিসেবে আমাদের সম্মিলিত ভবিষ্যৎ।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর, দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশ।
No comments