কোদালকে কোদাল বলুন by হাসান ফেরদৌস
একুশে আগস্টের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ পড়ে আমার মনে হয়েছে, আমরা বোধ হয় কোদালকে কোদাল বলা ভুলে গেছি। তাকে অন্য কোনো নামে, যেমন লাউ বা কাঁঠাল বলতেই যেন আমাদের আনন্দ। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও চার জাতীয় নেতার কারান্তরালে হত্যার পর এত বড় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড আমাদের ইতিহাসে ঘটেনি। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী কে, তার তদন্ত ও বিচার এখনো শেষ হয়নি। কিন্তু একটা কথা তো স্পষ্ট, এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের আমলে। সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নের জন্য সব দায়দায়িত্ব বহন করে ক্ষমতাসীন সরকার। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সে সরকারের সাফল্য বা ব্যর্থতার দায়ভার অন্য কারও নয়, খোদ প্রধানমন্ত্রীর। অথচ আজ পর্যন্ত কোথাও দেখিনি এই সহজ সত্যটি তুলে কেউ খালেদা জিয়ার ভূমিকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলেছে।
তিনি এ বিষয়ে কী জানতেন, কখন জানতে পেরেছেন এবং জানার পর সে ব্যাপারে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন?
গত ২১ আগস্ট প্রথম আলো তার প্রথম পাতায় ২০০৪ সালের একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনার একটি তাত্পর্যপূর্ণ বিশ্লেষণ ছেপেছে। লিখেছেন সম্পাদক নিজে। সে মন্তব্য প্রতিবেদনের শিরোনাম: দায় এড়াতে পারে না বিএনপি নেতৃত্ব। পড়ে একটু হোঁচট খেলাম। বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল। তাহলে কি এই দলের প্রধান বা তার মহাসচিবের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে? প্রতিবেদনের কোথাও অবশ্য দলপ্রধান বা তার মহাসচিব—কারও নামই উচ্চারিত হয়নি। দেশের অন্যান্য পত্রপত্রিকাতেও একই বিষয়ে নানা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও রয়েছে। অথচ কোথাও তত্কালীন সরকারপ্রধানের নাম উচ্চারিত হয়নি, তাঁর ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্নও তোলেনি কেউ।
সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান একটি কথা জনপ্রিয় করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘সরকারের সব সিদ্ধান্ত আমার গোচরে রেখেই নেওয়া হয়, আমার অসম্মতিতে কোনো সিদ্ধান্ত হয় না। ফলে সব দায়দায়িত্ব আমার।’ ‘দি বাক স্টপস উইথ মি’—এই কথাটা নিজেকে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি নিজের কাজ করার টেবিলে ওই কথা লেখা একটি ‘সাইন’ রেখে দিতেন। রাজনৈতিক ভাষণে অনেকবার নিজের দায়িত্ব উল্লেখ করে তিনি সে কথা স্মরণও করেছেন। ১৯৫৩ সালে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব থেকে বিদায় নেওয়ার সময় যে ভাষণ দেন, তাতেও বলেছিলেন, ‘ভালো-মন্দের সব দায়দায়িত্ব ছিল আমার। প্রেসিডেন্ট অর্থাৎ সরকারপ্রধান যিনি, তাঁকেই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। তিনি চাইলেও অন্য কারও ওপর দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে পারেন না। সিদ্ধান্ত তাঁকে নিতে হবে, দায়দায়িত্বও তাঁর।’
২০০৮ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ট্রুম্যানের ওই ‘দি বাক স্টপস উইথ মি’ কথাটা ফের নতুন করে উঠেছিল। হিলারি ক্লিনটন ও বারাক ওবামার মধ্যে তখন ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে। হিলারি দাবি করেছিলেন, তিনি নানা অভিজ্ঞতায় ধনী। রাত তিনটার সময় যখন জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত সিদ্ধান্তের জন্য লাল ফোন বেজে উঠবে, তার জবাব দেওয়ার জন্য অধিক প্রস্তুত কে—তিনি, না বারাক ওবামা? তাঁর মন্ত্রিসভায় অভিজ্ঞ ও ঝানু লোকজনের অভাব হবে না, তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ বা মতবিনিময়ের সুযোগও তাঁর থাকবে। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব দায়দায়িত্ব তাঁর একার, সাফল্য বা ব্যর্থতার দায়ভারও তাঁর। রাত তিনটার টেলিফোনের কথা তুলে হিলারি সেই কথাটাই বলতে চেয়েছিলেন। পরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে নিজের দায়ভারের কথা উল্লেখ করে ওবামাও বলেছিলেন ‘দি বাক স্টপস উইথ মি’—সব দায়দায়িত্ব আমার। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ডেট্রয়েটে নাইজেরীয় নাগরিক ওমর ফারুক আবদুল মুত্তালিব বোমা নিয়ে বিমানে উঠেছিলেন। ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারত, কিন্তু বিমানযাত্রীদের সচেতনতার কারণে বোমা বিস্ফোরণের আগেই ওমরকে ধরে ফেলা হয়। গোয়েন্দা বিভাগের বিভিন্ন শাখার সমন্বয়ের অভাবে ওমর বিমানে ওঠার সুযোগ পেয়েছিলেন। এটি জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থার একটি ব্যর্থতা। ঘটনার প্রাথমিক তদন্তের পর প্রেসিডেন্ট ওবামা সে কথা স্বীকার করে জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে বলেছিলেন, এই ব্যর্থতার সব দায়দায়িত্ব তাঁর। কারণ, ‘দি বাক স্টপস উইথ মি।’
২০০৪ সালের একুশে আগস্টের সন্ত্রাসী গ্রেনেড হামলা রোধে ব্যর্থতা তত্কালীন সরকারের। সে সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে কি কেউ প্রশ্ন করেছিলেন, এই ব্যর্থতার দায়িত্ব থেকে আপনি কি অব্যাহতি পেতে পারেন?
এই খুন ধামাচাপা দিতে যে নাটক ফাঁদা হয়েছিল, তা এখন আমাদের সবার জানা হয়ে গেছে। দুটি সম্পূর্ণ নিরীহ মানুষ—জজ মিয়া ও পার্থ, তাদের ঘাড়ে এই সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব চাপাতে চেষ্টা করা হয়েছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, এই নাটকের গপ্পো কি আপনি জানতেন? অথবা সে গপ্পের সত্যাসত্য জানার কোনো চেষ্টা কি আপনি করেছিলেন? করে থাকলে তা কী? এসবই অতি ন্যায়সংগত প্রশ্ন। কই, খালেদা জিয়া নিজে কখনো এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন বলে তো মনে হয় না। আইনের শাসন আছে, এমন দেশে পরিকল্পিত এই মিথ্যাচারের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা-মোকদ্দমা হতো। না, বাংলাদেশে এসবের কিছুই হয়নি। সেই দরিদ্র জজ মিয়া এখন পথের ভিখারি, তাঁর বিধবা মা নিজের শেষ সম্বল এক টুকরো জমি বিক্রি করে সংসার চালিয়েছেন। অথচ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন বলে পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে যিনি প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিয়েছিলেন, তাঁর কিছুই হয়নি। এমনকি সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণও তাঁকে সহ্য করতে হয়নি।
কেন? দেশের সাংবাদিক ভাইয়েরা কি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ভয় করেন?
দায়দায়িত্বের কথা উঠল বলে খালেদার জন্মদিনের কেচ্ছাটাও ফের মনে করতে হচ্ছে। একুশে আগস্টের সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ডের ষষ্ঠ বার্ষিকীর এক সপ্তাহ আগে বেগম জিয়া তাঁর ৬৬তম জন্মদিন পালন করলেন ১৫ আগস্ট। ব্যাপারটা নিন্দনীয়, তাঁর নিজের দলের লোকেরাই পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘ম্যাডাম, জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের দিনটিতে ঘটা করে জন্মদিন পালন করবেন না।’ তিনি সে কথা শোনেননি। যথারীতি কেক কেটেছেন, একটি নয়, চার-চারটি কেক; যেগুলো তাঁর দলের সদস্য-সমর্থকেরা বয়ে এনেছিলেন। তিনি হাসিমুখে সে কেক নিজে খেয়েছেন, অন্যদেরও খেতে দিয়েছেন। খালেদা জিয়ার জন্মদিন নিয়ে বিস্তর কেচ্ছা-কাহিনি শুনেছি, তাঁর পাসপোর্টের কপি থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষার সার্টিফিকেটও দেখেছি। প্রসঙ্গত বলে নিই, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জন্মস্থান ও তারিখ নিয়েও বিস্তর তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। তিনি আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করেননি, এমন অভিযোগ নানা মহল থেকে উঠেছে। হাস্যকর অভিযোগ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তা করা হয়েছে, এসবই জানা কথা। কিন্তু সে প্রশ্নের জবাব ওবামাকে দিতে হয়েছে। নিজের জন্ম সনদের (বার্থ সার্টিফিকেট) কপি তাঁকে নিজের ওয়েবসাইটে ছেপে দিয়ে বলতে হয়েছে, ‘দেখো, আমি কোথায় কবে জন্মগ্রহণ করেছি, এই তার প্রমাণ।’ কই, খালেদা জিয়ার কাছে তাঁর ১৫ আগস্টের জন্ম সনদের প্রমাণ চেয়ে কেউ কোনো দিন প্রশ্ন তুলেছেন? তাঁর একটি নয়, তিন-তিনটি জন্মদিনের সার্টিফিকেটের কপি আমরা দেখেছি। সবগুলো তো সত্যি হতে পারে না। কেউ কি কখনো খালেদা জিয়াকে প্রশ্ন করেছেন, ‘ম্যাডাম, সত্যি করে বলুন তো, আপনার জন্মদিন কবে? এই তিন সার্টিফিকেটের একটিতেও তো ১৫ আগস্টের নামগন্ধ নেই!’
(যাঁরা সেসব সার্টিফিকেটের কপি নিজ চোখে দেখতে চান, তাঁদের ইন্টারনেটে এই ঠিকানায় ঘুরে আসতে অনুরোধ করি: http://rezwanul.blogspot.com/2009/08/15th-of-august.html)
রাজনীতিবিদেরা মিথ্যা বলে পার পেয়েছেন, এ কোনো নতুন ব্যাপার নয়। কিন্তু মিথ্যা বলে হাতেনাতে ধরাও পড়েছেন, মুখ্যত তথ্যমাধ্যম সজাগ থাকার কারণে, সে কথাও আমরা জানি। উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তানের একটি সাম্প্রতিক ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছি। বেশি দিন আগের কথা নয়, এ বছর জুন মাসে লাহোর হাইকোর্ট মুদাসসির কাইয়ুম নাইহার নামে পাকিস্তান মুসলিম লীগের একজন সাংসদের সদস্যপদ বাতিল ঘোষণা করেন। কারণ? ভদ্রলোক নির্বাচন কমিশনের কাছে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মিথ্যা সার্টিফিকেট দাখিল করেছিলেন। ব্যাপারটা ফাঁস হতে না হতেই পত্রপত্রিকায় এক তুলকালাম কাণ্ড। রাজনীতিবিদেরা ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন। এক মন্ত্রী এমন কথাও বলেছিলেন, সার্টিফিকেট, সত্যি আর মিথ্যা হোক, একটা হলেই হলো। ব্যস, আর যায় কোথায়। ব্যাপারটা হয়তো ধামাচাপা পড়েই যেত, কিন্তু তথ্যমাধ্যমের কারণেই শেষমেশ তা আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
এটি হয়তো দেশ-জাতির ভাগ্যনিয়ন্ত্রিত হয় এমন কোনো ব্যাপার নয়। খালেদা জিয়ার জন্মদিনের ব্যাপারটিও তাই। কিন্তু একটি ছোট মিথ্যা বলে তিনি যদি এমন অনায়াসে পার পেয়ে যান, তাহলে বড় কোনো মিথ্যা বলা তাঁকে ঠেকাবে কে? অন্য কেউ নয়, দেশের সরকারপ্রধানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বলেই এত কথা বলা। দেশের প্রধানমন্ত্রী, তা বর্তমানের হন বা প্রাক্তন—তিনি সে দেশের নৈতিক মানদণ্ডের প্রতীক। সে কারণে শুধু রাষ্ট্রীয় দায়দায়িত্বের ক্ষেত্রেই নয়, তাঁর ব্যক্তিগত আচরণও আমরা খুঁটিয়ে দেখি। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের একটি ব্যক্তিগত স্খলন নিয়ে যে কী কাণ্ড হয়েছিল, তা আমাদের ভোলার কথা নয়। নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের উদ্দেশেই প্রতিপক্ষ রিপাবলিকানরা সে স্খলনকে ব্যবহার করেছিল, কিন্তু নিজের ব্যবহারের জন্য ক্লিনটনকে জবাবদিহি ঠিকই করতে হয়েছিল।
আমাদের নেতা-নেত্রীরা নিজে থেকে তাঁদের ব্যর্থতার কোনো জবাবদিহি করবেন না, তা আমরা জানি।
জবাবদিহি আমাদের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিতেই নেই, কারণ গণতন্ত্র ব্যাপারটাকে তাঁরা স্লোগান ছাড়া আর কিছু ভাবেন বলে মনে হয় না। কিন্তু আমরা, যারা তাঁদের হাতে ক্ষমতার রশি তুলে দিই, তারা অবশ্যই সে দাবি তুলব। আমাদের কণ্ঠস্বরকে শ্রুতিগোচর করার দায়িত্ব দেশের তথ্যমাধ্যমের। অনেক সময় এমন কথা বলতে শুনেছি, গত ২০ বছরে আমাদের গণতান্ত্রিক উদ্যাপনের অন্যতম বড় প্রমাণ নাকি দেশের মুক্ত তথ্যব্যবস্থা। কিন্তু এ কেমন ‘মুক্ত ব্যবস্থা’, যেখানে কঠিন প্রশ্ন করতে আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরা এত দ্বিধান্বিত?
গণতন্ত্রের ভিত মজবুত হয় অব্যাহত গণতান্ত্রিক চর্চার ভেতর দিয়ে। মুক্ত তথ্যব্যবস্থার জন্যও চাই ক্রমাগত মুক্ত সাংবাদিকতার চর্চা। কোদালকে কোদাল বলা সে চর্চারই অংশ। আসুন না, বলেই দেখি কী হয়।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
তিনি এ বিষয়ে কী জানতেন, কখন জানতে পেরেছেন এবং জানার পর সে ব্যাপারে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন?
গত ২১ আগস্ট প্রথম আলো তার প্রথম পাতায় ২০০৪ সালের একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনার একটি তাত্পর্যপূর্ণ বিশ্লেষণ ছেপেছে। লিখেছেন সম্পাদক নিজে। সে মন্তব্য প্রতিবেদনের শিরোনাম: দায় এড়াতে পারে না বিএনপি নেতৃত্ব। পড়ে একটু হোঁচট খেলাম। বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল। তাহলে কি এই দলের প্রধান বা তার মহাসচিবের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে? প্রতিবেদনের কোথাও অবশ্য দলপ্রধান বা তার মহাসচিব—কারও নামই উচ্চারিত হয়নি। দেশের অন্যান্য পত্রপত্রিকাতেও একই বিষয়ে নানা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও রয়েছে। অথচ কোথাও তত্কালীন সরকারপ্রধানের নাম উচ্চারিত হয়নি, তাঁর ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্নও তোলেনি কেউ।
সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান একটি কথা জনপ্রিয় করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘সরকারের সব সিদ্ধান্ত আমার গোচরে রেখেই নেওয়া হয়, আমার অসম্মতিতে কোনো সিদ্ধান্ত হয় না। ফলে সব দায়দায়িত্ব আমার।’ ‘দি বাক স্টপস উইথ মি’—এই কথাটা নিজেকে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি নিজের কাজ করার টেবিলে ওই কথা লেখা একটি ‘সাইন’ রেখে দিতেন। রাজনৈতিক ভাষণে অনেকবার নিজের দায়িত্ব উল্লেখ করে তিনি সে কথা স্মরণও করেছেন। ১৯৫৩ সালে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব থেকে বিদায় নেওয়ার সময় যে ভাষণ দেন, তাতেও বলেছিলেন, ‘ভালো-মন্দের সব দায়দায়িত্ব ছিল আমার। প্রেসিডেন্ট অর্থাৎ সরকারপ্রধান যিনি, তাঁকেই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। তিনি চাইলেও অন্য কারও ওপর দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে পারেন না। সিদ্ধান্ত তাঁকে নিতে হবে, দায়দায়িত্বও তাঁর।’
২০০৮ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ট্রুম্যানের ওই ‘দি বাক স্টপস উইথ মি’ কথাটা ফের নতুন করে উঠেছিল। হিলারি ক্লিনটন ও বারাক ওবামার মধ্যে তখন ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে। হিলারি দাবি করেছিলেন, তিনি নানা অভিজ্ঞতায় ধনী। রাত তিনটার সময় যখন জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত সিদ্ধান্তের জন্য লাল ফোন বেজে উঠবে, তার জবাব দেওয়ার জন্য অধিক প্রস্তুত কে—তিনি, না বারাক ওবামা? তাঁর মন্ত্রিসভায় অভিজ্ঞ ও ঝানু লোকজনের অভাব হবে না, তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ বা মতবিনিময়ের সুযোগও তাঁর থাকবে। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব দায়দায়িত্ব তাঁর একার, সাফল্য বা ব্যর্থতার দায়ভারও তাঁর। রাত তিনটার টেলিফোনের কথা তুলে হিলারি সেই কথাটাই বলতে চেয়েছিলেন। পরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে নিজের দায়ভারের কথা উল্লেখ করে ওবামাও বলেছিলেন ‘দি বাক স্টপস উইথ মি’—সব দায়দায়িত্ব আমার। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ডেট্রয়েটে নাইজেরীয় নাগরিক ওমর ফারুক আবদুল মুত্তালিব বোমা নিয়ে বিমানে উঠেছিলেন। ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারত, কিন্তু বিমানযাত্রীদের সচেতনতার কারণে বোমা বিস্ফোরণের আগেই ওমরকে ধরে ফেলা হয়। গোয়েন্দা বিভাগের বিভিন্ন শাখার সমন্বয়ের অভাবে ওমর বিমানে ওঠার সুযোগ পেয়েছিলেন। এটি জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থার একটি ব্যর্থতা। ঘটনার প্রাথমিক তদন্তের পর প্রেসিডেন্ট ওবামা সে কথা স্বীকার করে জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে বলেছিলেন, এই ব্যর্থতার সব দায়দায়িত্ব তাঁর। কারণ, ‘দি বাক স্টপস উইথ মি।’
২০০৪ সালের একুশে আগস্টের সন্ত্রাসী গ্রেনেড হামলা রোধে ব্যর্থতা তত্কালীন সরকারের। সে সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে কি কেউ প্রশ্ন করেছিলেন, এই ব্যর্থতার দায়িত্ব থেকে আপনি কি অব্যাহতি পেতে পারেন?
এই খুন ধামাচাপা দিতে যে নাটক ফাঁদা হয়েছিল, তা এখন আমাদের সবার জানা হয়ে গেছে। দুটি সম্পূর্ণ নিরীহ মানুষ—জজ মিয়া ও পার্থ, তাদের ঘাড়ে এই সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব চাপাতে চেষ্টা করা হয়েছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, এই নাটকের গপ্পো কি আপনি জানতেন? অথবা সে গপ্পের সত্যাসত্য জানার কোনো চেষ্টা কি আপনি করেছিলেন? করে থাকলে তা কী? এসবই অতি ন্যায়সংগত প্রশ্ন। কই, খালেদা জিয়া নিজে কখনো এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন বলে তো মনে হয় না। আইনের শাসন আছে, এমন দেশে পরিকল্পিত এই মিথ্যাচারের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা-মোকদ্দমা হতো। না, বাংলাদেশে এসবের কিছুই হয়নি। সেই দরিদ্র জজ মিয়া এখন পথের ভিখারি, তাঁর বিধবা মা নিজের শেষ সম্বল এক টুকরো জমি বিক্রি করে সংসার চালিয়েছেন। অথচ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন বলে পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে যিনি প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিয়েছিলেন, তাঁর কিছুই হয়নি। এমনকি সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণও তাঁকে সহ্য করতে হয়নি।
কেন? দেশের সাংবাদিক ভাইয়েরা কি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ভয় করেন?
দায়দায়িত্বের কথা উঠল বলে খালেদার জন্মদিনের কেচ্ছাটাও ফের মনে করতে হচ্ছে। একুশে আগস্টের সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ডের ষষ্ঠ বার্ষিকীর এক সপ্তাহ আগে বেগম জিয়া তাঁর ৬৬তম জন্মদিন পালন করলেন ১৫ আগস্ট। ব্যাপারটা নিন্দনীয়, তাঁর নিজের দলের লোকেরাই পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘ম্যাডাম, জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের দিনটিতে ঘটা করে জন্মদিন পালন করবেন না।’ তিনি সে কথা শোনেননি। যথারীতি কেক কেটেছেন, একটি নয়, চার-চারটি কেক; যেগুলো তাঁর দলের সদস্য-সমর্থকেরা বয়ে এনেছিলেন। তিনি হাসিমুখে সে কেক নিজে খেয়েছেন, অন্যদেরও খেতে দিয়েছেন। খালেদা জিয়ার জন্মদিন নিয়ে বিস্তর কেচ্ছা-কাহিনি শুনেছি, তাঁর পাসপোর্টের কপি থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষার সার্টিফিকেটও দেখেছি। প্রসঙ্গত বলে নিই, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জন্মস্থান ও তারিখ নিয়েও বিস্তর তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। তিনি আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করেননি, এমন অভিযোগ নানা মহল থেকে উঠেছে। হাস্যকর অভিযোগ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তা করা হয়েছে, এসবই জানা কথা। কিন্তু সে প্রশ্নের জবাব ওবামাকে দিতে হয়েছে। নিজের জন্ম সনদের (বার্থ সার্টিফিকেট) কপি তাঁকে নিজের ওয়েবসাইটে ছেপে দিয়ে বলতে হয়েছে, ‘দেখো, আমি কোথায় কবে জন্মগ্রহণ করেছি, এই তার প্রমাণ।’ কই, খালেদা জিয়ার কাছে তাঁর ১৫ আগস্টের জন্ম সনদের প্রমাণ চেয়ে কেউ কোনো দিন প্রশ্ন তুলেছেন? তাঁর একটি নয়, তিন-তিনটি জন্মদিনের সার্টিফিকেটের কপি আমরা দেখেছি। সবগুলো তো সত্যি হতে পারে না। কেউ কি কখনো খালেদা জিয়াকে প্রশ্ন করেছেন, ‘ম্যাডাম, সত্যি করে বলুন তো, আপনার জন্মদিন কবে? এই তিন সার্টিফিকেটের একটিতেও তো ১৫ আগস্টের নামগন্ধ নেই!’
(যাঁরা সেসব সার্টিফিকেটের কপি নিজ চোখে দেখতে চান, তাঁদের ইন্টারনেটে এই ঠিকানায় ঘুরে আসতে অনুরোধ করি: http://rezwanul.blogspot.com/2009/08/15th-of-august.html)
রাজনীতিবিদেরা মিথ্যা বলে পার পেয়েছেন, এ কোনো নতুন ব্যাপার নয়। কিন্তু মিথ্যা বলে হাতেনাতে ধরাও পড়েছেন, মুখ্যত তথ্যমাধ্যম সজাগ থাকার কারণে, সে কথাও আমরা জানি। উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তানের একটি সাম্প্রতিক ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছি। বেশি দিন আগের কথা নয়, এ বছর জুন মাসে লাহোর হাইকোর্ট মুদাসসির কাইয়ুম নাইহার নামে পাকিস্তান মুসলিম লীগের একজন সাংসদের সদস্যপদ বাতিল ঘোষণা করেন। কারণ? ভদ্রলোক নির্বাচন কমিশনের কাছে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মিথ্যা সার্টিফিকেট দাখিল করেছিলেন। ব্যাপারটা ফাঁস হতে না হতেই পত্রপত্রিকায় এক তুলকালাম কাণ্ড। রাজনীতিবিদেরা ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন। এক মন্ত্রী এমন কথাও বলেছিলেন, সার্টিফিকেট, সত্যি আর মিথ্যা হোক, একটা হলেই হলো। ব্যস, আর যায় কোথায়। ব্যাপারটা হয়তো ধামাচাপা পড়েই যেত, কিন্তু তথ্যমাধ্যমের কারণেই শেষমেশ তা আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
এটি হয়তো দেশ-জাতির ভাগ্যনিয়ন্ত্রিত হয় এমন কোনো ব্যাপার নয়। খালেদা জিয়ার জন্মদিনের ব্যাপারটিও তাই। কিন্তু একটি ছোট মিথ্যা বলে তিনি যদি এমন অনায়াসে পার পেয়ে যান, তাহলে বড় কোনো মিথ্যা বলা তাঁকে ঠেকাবে কে? অন্য কেউ নয়, দেশের সরকারপ্রধানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বলেই এত কথা বলা। দেশের প্রধানমন্ত্রী, তা বর্তমানের হন বা প্রাক্তন—তিনি সে দেশের নৈতিক মানদণ্ডের প্রতীক। সে কারণে শুধু রাষ্ট্রীয় দায়দায়িত্বের ক্ষেত্রেই নয়, তাঁর ব্যক্তিগত আচরণও আমরা খুঁটিয়ে দেখি। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের একটি ব্যক্তিগত স্খলন নিয়ে যে কী কাণ্ড হয়েছিল, তা আমাদের ভোলার কথা নয়। নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের উদ্দেশেই প্রতিপক্ষ রিপাবলিকানরা সে স্খলনকে ব্যবহার করেছিল, কিন্তু নিজের ব্যবহারের জন্য ক্লিনটনকে জবাবদিহি ঠিকই করতে হয়েছিল।
আমাদের নেতা-নেত্রীরা নিজে থেকে তাঁদের ব্যর্থতার কোনো জবাবদিহি করবেন না, তা আমরা জানি।
জবাবদিহি আমাদের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিতেই নেই, কারণ গণতন্ত্র ব্যাপারটাকে তাঁরা স্লোগান ছাড়া আর কিছু ভাবেন বলে মনে হয় না। কিন্তু আমরা, যারা তাঁদের হাতে ক্ষমতার রশি তুলে দিই, তারা অবশ্যই সে দাবি তুলব। আমাদের কণ্ঠস্বরকে শ্রুতিগোচর করার দায়িত্ব দেশের তথ্যমাধ্যমের। অনেক সময় এমন কথা বলতে শুনেছি, গত ২০ বছরে আমাদের গণতান্ত্রিক উদ্যাপনের অন্যতম বড় প্রমাণ নাকি দেশের মুক্ত তথ্যব্যবস্থা। কিন্তু এ কেমন ‘মুক্ত ব্যবস্থা’, যেখানে কঠিন প্রশ্ন করতে আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরা এত দ্বিধান্বিত?
গণতন্ত্রের ভিত মজবুত হয় অব্যাহত গণতান্ত্রিক চর্চার ভেতর দিয়ে। মুক্ত তথ্যব্যবস্থার জন্যও চাই ক্রমাগত মুক্ত সাংবাদিকতার চর্চা। কোদালকে কোদাল বলা সে চর্চারই অংশ। আসুন না, বলেই দেখি কী হয়।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments