গণতন্ত্রের রেলগাড়িটি কোন পথে by আব্দুল কাইয়ুম
বলা হয়েছিল, গণতন্ত্রের রেলগাড়িটি লাইনচ্যুত হয়ে গেছে। তাকে মেরামত করে লাইনে উঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হলো। ভালো নির্বাচন হলো। কয়েক মাস ভালো চলল। মানুষ আশা করেছিল যে এবার রাজনীতিতে কিছুটা হলেও সুস্থতা ফিরে আসবে। কিন্তু এখন মনে হয়, আগের ব্যাধিগুলো সব ফিরে আসছে। সেই একই চিত্র। রাস্তায় সহিংস আন্দোলন, ভাঙচুর, জ্বালাওপোড়াও। পুলিশের নির্মম লাঠিপেটা। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি। দুই নেত্রীর মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। রাজপথে গরম আন্দোলনের হুমকি। সরকার পতনের আন্দোলন বুঝি শুরু হয়ে গেল। এই কি ছিল কপালের লিখন? আমাদের গণতন্ত্র কি এভাবেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলবে?
অথচ সরকার, বিশেষত প্রধানমন্ত্রী চাইলে রাজনৈতিক অস্থিরতা অনেকখানিই শান্ত রাখা সম্ভব ছিল এবং এখনো সম্ভব। এ ব্যাপারে বিরোধী দলের প্রতি সরকারের সুবিবেচনাপ্রসূত অবস্থান বেশ সাহায্য করতে পারে। যেমন, পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের সহিংস আন্দোলনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে সরাসরি অভিযুক্ত করে বললেন, তিনি ‘উসকানি দিয়ে এই অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছেন’। এভাবে কথাটা না বলাই ভালো ছিল। খালেদা জিয়া যদি উসকানি দিয়ে থাকেন, তাহলে তো নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী সে কথা বলবেন, কিন্তু তার সাক্ষী-প্রমাণ লাগবে না? শুধু অনুমাননির্ভর কথা বললে তো মানুষের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হবে না। কারণ তিনি তো এর আগে দুইবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে এ রকম একটা গুরুতর অভিযোগ নিখুঁত হওয়া দরকার।
বিএনপি যে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চির-প্রতিপক্ষ! এ ধরনের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কথা বলার সময় শব্দ প্রয়োগে একটা রাজনৈতিক ব্যাকরণ অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়। আপনি ‘নাকে খত’ দিতে বললেই তো বিরোধী দল সুরসুর করে গিয়ে নাকে খত দেওয়া শুরু করবে না। বরং তারা আরও উৎসাহ নিয়ে মাঠে নেমে পড়বে। তাদের রাজপথ গরম করার প্ররোচনা দিয়ে লাভ কার হচ্ছে? প্রধানমন্ত্রী মাঝেমধ্যে বিরোধীদলীয় নেত্রীর প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে যে ভাষা ব্যবহার করেন, তা কিন্তু কোনো ব্যাকরণের মধ্যে পড়ে না। অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী। তাঁর কাছে মানুষ অনেক বেশি বিনয় ও নম্রতা আশা করে। সরকার গঠনের পরপর প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা ও কাজে যতটা নমনীয় মনোভাব নিয়ে চলছিলেন, তা সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছিল। এটা দুঃখজনক যে ধীরে ধীরে তিনি যেন সেই অবস্থান থেকে সরে আসছেন। রজনীতিতে সহনশীলতা ও ধৈর্যের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। বিশেষত ক্ষমতাসীন মহলের জন্য এটা অবশ্য পালনীয়। কিন্তু আজকাল এর দারুণ অভাব দেখা যায়।
নব্বই-উত্তর গণতন্ত্র এক বিরাট বিপদে পড়েছিল। এ জন্য দেশের ওপর দিয়ে বেশ বড় ধরনের ঝড় বয়ে গেছে। দুই বছর ‘সেনাসমর্থিত’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্টিম রোলার চলেছে। এই তিক্ত বাস্তবতার কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়ে বেশি আর কে জানে। তিনি নিজেও বিভিন্ন সময় বলেন, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় দেশে কি ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছিল। কীভাবে বিচারকদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে প্রভাবিত করার অপচেষ্টা করা হয়েছিল। কীভাবে ভুয়া ভোটার দিয়ে নির্বাচনে কারচুপির ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। সবাই জানে। এসব করা সম্ভব হয়েছিল সে সময়ের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, অর্থাৎ আওয়ামী লীগের ওপর চরম দমন-পীড়ন চালিয়ে, রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বল প্রয়োগে তাদের নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টার মাধ্যমে। গণতন্ত্রের জন্য সেটা ছিল সবচেয়ে বড় বিপদ। সেই দুঃসময় পার হয়ে আসা গেছে। এখন সামনে এগিয়ে যেতে হবে। প্রতিপক্ষের প্রতি সহনশীলতা বিসর্জন দিয়ে তা হবে না।
পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের অস্থিরতাকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। রাস্তায় শ্রমিকদের সহিংস আন্দোলন সুস্থ শাসনের লক্ষণ নয়। কিন্তু তারা তো পেটের দায়েই রাজপথে নেমেছে। তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য দরকার খেয়েপরে বেঁচে থাকার মতো মজুরি। ওরা তো নিজেরাই বলেছে, ‘মুরগি চাইলে ডিম পাব!’ এই বাস্তবতার আলোকে পাঁচ হাজার টাকা চেয়েছে। তিন হাজার তারা তো মেনেই নিয়েছে বলা যায়। কিন্তু সেটা কেন নভেম্বর থেকে, কেন চলতি মাস থেকে নয়? মামলা তো এক কথায় ডিশমিশ হয়ে যায়, যদি এ মাস থেকেই বর্ধিত মজুরি দেওয়া হয়। রাস্তায় শ্রমিকদের নামতে হয় না। আর যদি কোনো ‘ষড়যন্ত্রকারী’ থেকেও থাকে, তারা উসকানি দেওয়ার কোনো সুযোগও পায় না। প্রধানমন্ত্রী নিজেও পোশাকশ্রমিকদের অমানবিক অবস্থার কথা বলেছেন। তার পরও এই সামান্য ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে এত সময় লাগে কেন?
মালিকেরা বলছেন, আগের ক্রেতাদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী কাজ চলছে। কম দামে তৈরি পোশাক সরবরাহ করতে হবে। তাই এখন হবে না, তিন মাস পর থেকে বর্ধিত মজুরি কার্যকর করতে হবে। কিন্তু পোশাকশিল্পের মালিকেরা কি এতই গরিব যে মাত্র তিন মাসের অর্ডারের কাজে বাড়তি মুনাফা নিতে না পারলে শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে? সরকার তো একটা হিসাব করে দেখাতে পারত যে, তিন মাসের জন্য মালিকদের কত টাকা বেশি দিতে হবে, আর এ সময় তাদের মোট মুনাফা কত হবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, তিন মাসের জন্য মালিকদের পথে বসতে হবে না। কিন্তু শ্রমিকদের তো দেয়ালে পিঠ। এই তিন মাসে রোজা ও দুটি ঈদ যাবে। শ্রমিকদের মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য তাদের বেতন এ মাস থেকে বাড়ানো দরকার। সরকার এ কথাটি কেন জোর দিয়ে বলতে পারল না? নাকি বলতে চায় না?
শ্রমিকেরা রাজপথে নামবে, ভবিষ্যতেও এমন ঘটনা ঘটবে হয়তো। বিরোধী দল বিএনপি রাজপথে মিছিল করবে। তারা অনশন করতে চায়, সরকার পল্টন ময়দানের অনুমতি দেবে না। তাহলে গণমিছিল না করে তাদের উপায় কী? মিছিল থেকে যদি ভাঙচুর করা হয়, গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়, তাহলে পুলিশকে সক্রিয় হতে হবে। কিন্তু মিছিল যতক্ষণ শান্তিপূর্ণ থাকবে, ততক্ষণ পুলিশকেও শান্ত থাকতে হবে। মিছিলে উচ্ছৃঙ্খল লোকজন থাকে। তারা হয়তো বাড়াবাড়ি করে। কিন্তু এর প্রতিকার কি পুলিশ দিয়ে নির্মমভাবে লাঠিপেটা করে হবে? পুলিশের নতুন ট্রেনিং দরকার। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নির্মমভাবে পেটানো হতো। মাথা ফাটিয়ে রক্ত ঝরানো ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। সেই দুঃসময় পার করে এসে এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তারা কি সেই আগের মতো অবস্থায় ফিরে যাবে? নির্বিচার বলপ্রয়োগে রাজপথের আন্দোলন দমনের জন্য পুলিশকে ব্যবহার করার পরিণতি অতীতে কখনো শুভ হয়নি। বর্তমান সরকারের জন্যও তা সুফল দেবে না। এই সোজা সমীকরণটি সরকার কেন বোঝে না, তা এক বিরাট বিস্ময়। বিরোধী দলকে নিয়মতান্ত্রিক পথে আন্দোলনের সুযোগ দিতে হবে। না হলে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির আশঙ্কা থাকবে। স্বার্থান্বেষী মহল গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির এই উপাদানটি বিরোধী দলের হাতে তুলে দেওয়া উচিত কি না তা সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলকে ভেবে দেখতে হবে।
আপনি বিদ্যুৎ দিতে পারবেন না। রোজার মাসে ইফতার বা সেহরির কোনো একসময়ে লোডশেডিং হবেই—এই হলো আপনাদের কথা। ওদিকে ছাত্রলীগ-কর্মীদের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব চলবে, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব চলবে, ছিনতাই-রাহাজানি চলবে। তাহলে বিরোধী দলকে আন্দোলন করতে দেবেন না কেন? মানুষকে কিছু দেবেন না তা কী করে হয়? হয় এটা দিন, না হয় ওটা দিন। দুইটার একটাও দেবেন না, তা কী করে হয়? বিরোধী দলকে ঠান্ডা রাখতে হলে প্রথমে জনজীবনে স্বস্তি দিতে হবে।
দেশে হাজারটা সমস্যা। সরকার তো সব সমস্যার সমাধান একসঙ্গে দিতে পারবে না। কেউ সেটা আশাও করে না। কিন্তু এটা আশা করে যে মূল কয়েকটি সমস্যা সমাধানে সরকার কার্যকর ভূমিকা রাখবে। সে বিবেচনায় বলা যায়, সরকারের সামনে এখন তিনটি বড় দায়িত্ব। প্রথমে বিদ্যুৎ। অবারিত বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হবে। সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, সবাই জানে। কিন্তু দুই বছর পর যে সমস্যা থাকবে না তার নিশ্চয়তা কী? অন্তত এ পর্যন্ত সরকার এমন কোনো উদাহরণ দেখাতে পারেনি যে খুব শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান হতে যাচ্ছে। তাই উঠেপড়ে লেগে বিদ্যুতের ব্যাপারে মানুষকে আশ্বস্ত করাই হবে সরকারের প্রথম কাজ। দ্বিতীয়ত, দলের লোকজন, বিশেষত ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অভিযোগ যেন না ওঠে যে ক্ষমতাসীন মহল প্রতিকারহীনভাবে দুর্নীতি করে যাচ্ছে। আমাদের মতো শিথিল সমাজে দলীয় লোকজনকে দুর্নীতি থেকে দূরে রাখা কঠিন, কিন্তু কঠিন কাজটি করতে না পারলে দেশ চালানোও কঠিন। তৃতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার এক বিপজ্জনক পথে হাঁটছে। গুম-খুনের যে অভিযোগ উঠছে, তা খারাপ লক্ষণ। গণতন্ত্র আর গুম-খুন একসঙ্গে যায় না। এখন আদালত রায় দিয়েছেন। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু আর চলতে দেওয়া যাবে না।
মাত্র এই তিনটি সমস্যার সমাধানে সক্রিয় উদ্যোগ নিলে একদিকে যেমন অন্য অনেক সমস্যা সমাধানের দরজা খুলে যাবে, তেমনি বিরোধী দলের রাজপথে নামার সুযোগও সীমিত করা যাবে। পুলিশি ব্যবস্থার চেয়ে এটা উত্তম। গণতন্ত্রের রেলগাড়িটা ঠিকভাবে চালানোর জন্য এর চেয়ে ভালো ওষুধ আর হয় না।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
অথচ সরকার, বিশেষত প্রধানমন্ত্রী চাইলে রাজনৈতিক অস্থিরতা অনেকখানিই শান্ত রাখা সম্ভব ছিল এবং এখনো সম্ভব। এ ব্যাপারে বিরোধী দলের প্রতি সরকারের সুবিবেচনাপ্রসূত অবস্থান বেশ সাহায্য করতে পারে। যেমন, পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের সহিংস আন্দোলনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে সরাসরি অভিযুক্ত করে বললেন, তিনি ‘উসকানি দিয়ে এই অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছেন’। এভাবে কথাটা না বলাই ভালো ছিল। খালেদা জিয়া যদি উসকানি দিয়ে থাকেন, তাহলে তো নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী সে কথা বলবেন, কিন্তু তার সাক্ষী-প্রমাণ লাগবে না? শুধু অনুমাননির্ভর কথা বললে তো মানুষের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হবে না। কারণ তিনি তো এর আগে দুইবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে এ রকম একটা গুরুতর অভিযোগ নিখুঁত হওয়া দরকার।
বিএনপি যে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চির-প্রতিপক্ষ! এ ধরনের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কথা বলার সময় শব্দ প্রয়োগে একটা রাজনৈতিক ব্যাকরণ অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়। আপনি ‘নাকে খত’ দিতে বললেই তো বিরোধী দল সুরসুর করে গিয়ে নাকে খত দেওয়া শুরু করবে না। বরং তারা আরও উৎসাহ নিয়ে মাঠে নেমে পড়বে। তাদের রাজপথ গরম করার প্ররোচনা দিয়ে লাভ কার হচ্ছে? প্রধানমন্ত্রী মাঝেমধ্যে বিরোধীদলীয় নেত্রীর প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে যে ভাষা ব্যবহার করেন, তা কিন্তু কোনো ব্যাকরণের মধ্যে পড়ে না। অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী। তাঁর কাছে মানুষ অনেক বেশি বিনয় ও নম্রতা আশা করে। সরকার গঠনের পরপর প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা ও কাজে যতটা নমনীয় মনোভাব নিয়ে চলছিলেন, তা সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছিল। এটা দুঃখজনক যে ধীরে ধীরে তিনি যেন সেই অবস্থান থেকে সরে আসছেন। রজনীতিতে সহনশীলতা ও ধৈর্যের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। বিশেষত ক্ষমতাসীন মহলের জন্য এটা অবশ্য পালনীয়। কিন্তু আজকাল এর দারুণ অভাব দেখা যায়।
নব্বই-উত্তর গণতন্ত্র এক বিরাট বিপদে পড়েছিল। এ জন্য দেশের ওপর দিয়ে বেশ বড় ধরনের ঝড় বয়ে গেছে। দুই বছর ‘সেনাসমর্থিত’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্টিম রোলার চলেছে। এই তিক্ত বাস্তবতার কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়ে বেশি আর কে জানে। তিনি নিজেও বিভিন্ন সময় বলেন, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় দেশে কি ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছিল। কীভাবে বিচারকদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে প্রভাবিত করার অপচেষ্টা করা হয়েছিল। কীভাবে ভুয়া ভোটার দিয়ে নির্বাচনে কারচুপির ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। সবাই জানে। এসব করা সম্ভব হয়েছিল সে সময়ের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, অর্থাৎ আওয়ামী লীগের ওপর চরম দমন-পীড়ন চালিয়ে, রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বল প্রয়োগে তাদের নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টার মাধ্যমে। গণতন্ত্রের জন্য সেটা ছিল সবচেয়ে বড় বিপদ। সেই দুঃসময় পার হয়ে আসা গেছে। এখন সামনে এগিয়ে যেতে হবে। প্রতিপক্ষের প্রতি সহনশীলতা বিসর্জন দিয়ে তা হবে না।
পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের অস্থিরতাকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। রাস্তায় শ্রমিকদের সহিংস আন্দোলন সুস্থ শাসনের লক্ষণ নয়। কিন্তু তারা তো পেটের দায়েই রাজপথে নেমেছে। তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য দরকার খেয়েপরে বেঁচে থাকার মতো মজুরি। ওরা তো নিজেরাই বলেছে, ‘মুরগি চাইলে ডিম পাব!’ এই বাস্তবতার আলোকে পাঁচ হাজার টাকা চেয়েছে। তিন হাজার তারা তো মেনেই নিয়েছে বলা যায়। কিন্তু সেটা কেন নভেম্বর থেকে, কেন চলতি মাস থেকে নয়? মামলা তো এক কথায় ডিশমিশ হয়ে যায়, যদি এ মাস থেকেই বর্ধিত মজুরি দেওয়া হয়। রাস্তায় শ্রমিকদের নামতে হয় না। আর যদি কোনো ‘ষড়যন্ত্রকারী’ থেকেও থাকে, তারা উসকানি দেওয়ার কোনো সুযোগও পায় না। প্রধানমন্ত্রী নিজেও পোশাকশ্রমিকদের অমানবিক অবস্থার কথা বলেছেন। তার পরও এই সামান্য ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে এত সময় লাগে কেন?
মালিকেরা বলছেন, আগের ক্রেতাদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী কাজ চলছে। কম দামে তৈরি পোশাক সরবরাহ করতে হবে। তাই এখন হবে না, তিন মাস পর থেকে বর্ধিত মজুরি কার্যকর করতে হবে। কিন্তু পোশাকশিল্পের মালিকেরা কি এতই গরিব যে মাত্র তিন মাসের অর্ডারের কাজে বাড়তি মুনাফা নিতে না পারলে শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে? সরকার তো একটা হিসাব করে দেখাতে পারত যে, তিন মাসের জন্য মালিকদের কত টাকা বেশি দিতে হবে, আর এ সময় তাদের মোট মুনাফা কত হবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, তিন মাসের জন্য মালিকদের পথে বসতে হবে না। কিন্তু শ্রমিকদের তো দেয়ালে পিঠ। এই তিন মাসে রোজা ও দুটি ঈদ যাবে। শ্রমিকদের মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য তাদের বেতন এ মাস থেকে বাড়ানো দরকার। সরকার এ কথাটি কেন জোর দিয়ে বলতে পারল না? নাকি বলতে চায় না?
শ্রমিকেরা রাজপথে নামবে, ভবিষ্যতেও এমন ঘটনা ঘটবে হয়তো। বিরোধী দল বিএনপি রাজপথে মিছিল করবে। তারা অনশন করতে চায়, সরকার পল্টন ময়দানের অনুমতি দেবে না। তাহলে গণমিছিল না করে তাদের উপায় কী? মিছিল থেকে যদি ভাঙচুর করা হয়, গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়, তাহলে পুলিশকে সক্রিয় হতে হবে। কিন্তু মিছিল যতক্ষণ শান্তিপূর্ণ থাকবে, ততক্ষণ পুলিশকেও শান্ত থাকতে হবে। মিছিলে উচ্ছৃঙ্খল লোকজন থাকে। তারা হয়তো বাড়াবাড়ি করে। কিন্তু এর প্রতিকার কি পুলিশ দিয়ে নির্মমভাবে লাঠিপেটা করে হবে? পুলিশের নতুন ট্রেনিং দরকার। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নির্মমভাবে পেটানো হতো। মাথা ফাটিয়ে রক্ত ঝরানো ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। সেই দুঃসময় পার করে এসে এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তারা কি সেই আগের মতো অবস্থায় ফিরে যাবে? নির্বিচার বলপ্রয়োগে রাজপথের আন্দোলন দমনের জন্য পুলিশকে ব্যবহার করার পরিণতি অতীতে কখনো শুভ হয়নি। বর্তমান সরকারের জন্যও তা সুফল দেবে না। এই সোজা সমীকরণটি সরকার কেন বোঝে না, তা এক বিরাট বিস্ময়। বিরোধী দলকে নিয়মতান্ত্রিক পথে আন্দোলনের সুযোগ দিতে হবে। না হলে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির আশঙ্কা থাকবে। স্বার্থান্বেষী মহল গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির এই উপাদানটি বিরোধী দলের হাতে তুলে দেওয়া উচিত কি না তা সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলকে ভেবে দেখতে হবে।
আপনি বিদ্যুৎ দিতে পারবেন না। রোজার মাসে ইফতার বা সেহরির কোনো একসময়ে লোডশেডিং হবেই—এই হলো আপনাদের কথা। ওদিকে ছাত্রলীগ-কর্মীদের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব চলবে, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব চলবে, ছিনতাই-রাহাজানি চলবে। তাহলে বিরোধী দলকে আন্দোলন করতে দেবেন না কেন? মানুষকে কিছু দেবেন না তা কী করে হয়? হয় এটা দিন, না হয় ওটা দিন। দুইটার একটাও দেবেন না, তা কী করে হয়? বিরোধী দলকে ঠান্ডা রাখতে হলে প্রথমে জনজীবনে স্বস্তি দিতে হবে।
দেশে হাজারটা সমস্যা। সরকার তো সব সমস্যার সমাধান একসঙ্গে দিতে পারবে না। কেউ সেটা আশাও করে না। কিন্তু এটা আশা করে যে মূল কয়েকটি সমস্যা সমাধানে সরকার কার্যকর ভূমিকা রাখবে। সে বিবেচনায় বলা যায়, সরকারের সামনে এখন তিনটি বড় দায়িত্ব। প্রথমে বিদ্যুৎ। অবারিত বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হবে। সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, সবাই জানে। কিন্তু দুই বছর পর যে সমস্যা থাকবে না তার নিশ্চয়তা কী? অন্তত এ পর্যন্ত সরকার এমন কোনো উদাহরণ দেখাতে পারেনি যে খুব শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান হতে যাচ্ছে। তাই উঠেপড়ে লেগে বিদ্যুতের ব্যাপারে মানুষকে আশ্বস্ত করাই হবে সরকারের প্রথম কাজ। দ্বিতীয়ত, দলের লোকজন, বিশেষত ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অভিযোগ যেন না ওঠে যে ক্ষমতাসীন মহল প্রতিকারহীনভাবে দুর্নীতি করে যাচ্ছে। আমাদের মতো শিথিল সমাজে দলীয় লোকজনকে দুর্নীতি থেকে দূরে রাখা কঠিন, কিন্তু কঠিন কাজটি করতে না পারলে দেশ চালানোও কঠিন। তৃতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার এক বিপজ্জনক পথে হাঁটছে। গুম-খুনের যে অভিযোগ উঠছে, তা খারাপ লক্ষণ। গণতন্ত্র আর গুম-খুন একসঙ্গে যায় না। এখন আদালত রায় দিয়েছেন। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু আর চলতে দেওয়া যাবে না।
মাত্র এই তিনটি সমস্যার সমাধানে সক্রিয় উদ্যোগ নিলে একদিকে যেমন অন্য অনেক সমস্যা সমাধানের দরজা খুলে যাবে, তেমনি বিরোধী দলের রাজপথে নামার সুযোগও সীমিত করা যাবে। পুলিশি ব্যবস্থার চেয়ে এটা উত্তম। গণতন্ত্রের রেলগাড়িটা ঠিকভাবে চালানোর জন্য এর চেয়ে ভালো ওষুধ আর হয় না।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments