রাজনৈতিক দলের ভেতর গণতন্ত্র by কুলদীপ নায়ার
আগামী দুই মাসের মধ্যে সোনিয়া গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি পুনর্নির্বাচিত হলে তিনি হবেন দলটির সবচেয়ে দীর্ঘকাল ধরে সভাপতির দায়িত্বে থাকা নেতা। ভারতের সবচেয়ে পুরোনো ও সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলটিতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র যে নেই, এই ব্যাপার থেকে তা আবারও দেখা যাচ্ছে। ধরে নেওয়া যায়, দলের সদস্যরা তাঁর পক্ষেই ভোট দেবেন। এর পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করে যতটা না রাজতান্ত্রিক ক্ষমতার প্রতি তাঁদের আচ্ছন্নতা, তার চেয়ে বেশি সরকার ও দলে তাঁর অবিসংবাদী ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার বাস্তবতা।
আসলে ভারতের প্রধান দুই দল কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে দ্বন্দ্বের জায়গা যা-ই হোক না কেন, দুই দলই একই স্বার্থগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যখন যেখানেই রাজ্য নির্বাচন হোক না কেন দেখা যায়, একক কোনো ব্যক্তি অথবা অভিন্ন স্বার্থের ব্যক্তিবর্গের সমষ্টির হাতেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। তিনি বা তাঁর পছন্দের ব্যক্তিদের মধ্যে নির্বাচনের টিকিট বিলি করেন। নির্বাচিত ব্যক্তিরা হাইকমান্ডের (কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বোঝানোর জন্য এ শব্দটি তৈরি করা হয়েছিল) ব্যাপারে এতটাই শঙ্কিত থাকেন যে তাঁরা নিজেরাই তাঁদের মাথা নত করে দেন। নিজেরা রাজ্যনেতৃত্ব নির্বাচন না করে, বরং এ কাজটিও করার ভার হাইকমান্ডের ওপর ছেড়ে দেন।
আমরা দিল্লি, রাজস্তান, হরিয়ানা ও মিজোরামে দেখেছি কত সহজে নেতা বাছাইয়ের কাজটি সোনিয়া গান্ধীর ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে জিতেছে বিজেপি। সেখানে নেতা নির্বাচনের জন্য এল কে আদভানির দ্বারস্থ হয়েছে দলটি। বোঝাই যায়, তিনি এ ব্যাপারে বিজেপির চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ আরএসএসের সঙ্গেই আলোচনা করবেন।
দিল্লির নির্বাচনে কংগ্রেস বিজয়ী হওয়ার পর সোনিয়া গান্ধীকে নেতা নির্বাচনে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। তবু কিছু সময় উদ্বিগ্ন অবস্থায় পার করতে হয়েছে শিলা দীক্ষিতকে। তখন গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে শিলা যদি তৃতীয়বারের মতো দিল্লিতে কংগ্রেসের বিজয় ঘটাতে পারেন তাহলে তাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীও করা হতে পারে। এ গুজবের ফলে যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে সে বিষয়ে তিনি ঘাবড়ে গিয়ে বললেন যে এটা রটনা মাত্র। বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলকে তিনি জানালেন, তাঁর কিছু বিরোধীরা এই মিথ্যা রটনা ছড়াচ্ছে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর প্রাপ্য পদ পেয়েছিলেন। তবে অশোক গেহলটের ক্ষেত্রে বাছাই কাজটা একটু কঠিনই ছিল, কেননা কয়েকজন নেতৃত্বের দাবিদার দিল্লির স্বার্থগোষ্ঠীদের কথামতো কাজ করতেন। রাজস্তানের ভোটাররা অশোকের কারণেই কংগ্রেসের দিকে ফিরে এসেছেন। তবু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সোনিয়া গান্ধীর ওপরই ছেড়ে দেওয়া হলো। অশোক মুখ্যমন্ত্রীর কুরসি পেলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁকে সোনিয়ার হুকুম মেনে দুজন ডেপুটি মুখ্যমন্ত্রী নিতে হলো। আর হরিয়ানার ভূপিন্দর সিং হোড়া তো অল্পের জন্য পার পেয়ে গেলেন। সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য দিল্লিতে তিনি তাঁবু গেড়ে অশেষ প্রতীক্ষায় বসেছিলেন। চন্ডিগড় ও রাজধানীর মধ্যে কয়েকবার আনাগোনার পর অবশেষে তাঁকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়।
রাজ্যসভার নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও দল নয়, ব্যক্তি সোনিয়া গান্ধীকে প্রভাব ফেলতে দেখা যায়। রাজিব গান্ধীর উপদেষ্টা সতিশ শর্মা পুনর্নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে কারও মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। হঠাৎ করে পেট্রলপাম্প ইজারাসংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে অভিযুক্ত করেন। আদালত কর্তৃক সাবেক মন্ত্রীদের জরিমানা করার ঘটনা তেমন দেখা যায় না, কিন্তু শর্মার ক্ষেত্রে জরিমানা করা হয়। কিন্তু এবারও প্রার্থী করার ক্ষেত্রে সোনিয়ার কাছে বিবেচ্য নিষ্ঠা নয়, আনুগত্য।
সোনিয়া কিংবা তাঁর ১০ জনপথের বাসভবন এখন ক্ষমতার সমার্থক। তাঁর অনুমোদন ছাড়া সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত বা কোন বিষয়ে অবস্থান নেওয়া হয় না। তিনি এমন এক প্রধানমন্ত্রী পেয়েছেন, যিনি তাঁর সব কথা শোনেন।
কংগ্রেসের ইতিহাসে বহু নজির আছে, যেখানে দলের সভাপতি ও দেশের প্রধানমন্ত্রী সমান্তরাল কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন। জওহরলাল নেহরু দলের সভাপতিকে পূর্ণ শ্রদ্ধা করতেন। সভাপতির কথাকেই তিনি চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করতেন। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও ইন্দিরা গান্ধী উভয়েই, বিশেষ করে ইন্দিরা, কংগ্রেস সভাপতিকে নামিয়ে নিয়ে এসেছিলেন, সঞ্জিব রেড্ডির ভাষায়, ‘চাপরাশি’র স্তরে।
কেরালায় ই এম এস নাম্বুড়িরিপাদের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট সরকারকে বরখাস্ত করা হোক, সেটা নেহরু চাননি। কিন্তু কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি ইন্দিরা গান্ধী তাঁর দলের রাজনৈতিক স্বার্থে বরখাস্ত করার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন। ইন্দিরার নিজস্ব স্বতন্ত্র পন্থা ছিল, নেহরুর কন্যা হিসেবে নয়, যে কংগ্রেস নেহরুকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেছিল, সেটির সভাপতি হিসেবেই। নেহরু চাইলে নিজস্ব পন্থা করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি নিয়ম ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থাতেই অটল ছিলেন।
তাঁর উত্তরসূরি শাস্ত্রী মনে করতেন, তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি কে কামারাজ তাঁকে দমিয়ে রাখেন। যদিও কামারাজ শাস্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রীর কুরসিতে বসতে সহায়তা করেছিলেন, কিন্তু শাস্ত্রী তাঁকে গুরুত্বহীন করে তোলেন। রাষ্ট্রপতির কাছে মন্ত্রীদের যে তালিকা শাস্ত্রী প্রেরণ করেন তা কামারাজকে তিনি দেখাননি। তবে ইন্দিরা গান্ধীর মতো নির্মম ছিলেন না শাস্ত্রী। তিনি কামারাজের সম্মানহানি হতে দেননি।
কামারাজের সহায়তায় ইন্দিরা গান্ধী যখন ক্ষমতাসীন হলেন তখনো কামারাজ কংগ্রেসের সভাপতি। ইন্দিরা তাঁকে ও তাঁর সিন্ডিকেটকে পথের বাধা হিসেবে গণ্য করলেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিক প্রার্থী সঞ্জীব রেড্ডিকে হারিয়ে ভি ভি গিরিকে জয়ী করার মাধ্যমে তিনি তাঁদের পরাজিত করেন। পরবর্তীকালে তিনি দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী পদে একই ব্যক্তি আসীন হওয়ার চল করলেন। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন তাঁর ছেলে রাজিব গান্ধী।
সোনিয়া গান্ধী এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তাঁর সুবিধা হলো, তাঁর নেতৃত্বেই কংগ্রেস আবার ক্ষমতাসীন হতে পারবে, এ কথা দলটির নেতারা মেনে নিয়েছিলেন। আর তিনি সেটা করেছেনও। সভাপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি দলের ভেতর নেতৃত্বের বিরোধিতা একেবারে কমিয়ে এনেছেন। এখন যে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য তাঁর ছেলে রাহুল গান্ধীকে বাছাই করেছেন, সে কারণে যত দিন পর্যন্ত না রাহুল প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসতে পারেন, তত দিন পর্যন্ত তিনি মনমোহন সিংকে দিয়েই চালিয়ে নেবেন। দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তো বলেই দিয়েছেন যে তিনি রাহুল গান্ধীর জন্য সরে যেতে প্রস্তুত থাকবেন।
বিজেপির ক্ষেত্রে, আরএসএস তাদের চাওয়া স্পষ্ট করার পর নিতিন গড়করিকে দলীয় প্রধান ‘নির্বাচিত’ করতে হয়েছে। কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির পার্থক্য শুধু এই যে বিজেপির রিমোট কন্ট্রোল আরএসএসের প্রধান কার্যালয় নাগপুরে আর সোনিয়া গান্ধী নিজেই নিজের নিয়ন্তা।
কংগ্রেস ও বিজেপিদলীয় আইনপ্রণেতারা এখন এমন পর্যায়ে নেমে গেছেন যে, তাঁরা অন্যের স্বার্থে ব্যবহূত হন। অতীতে এমন অবস্থা ছিল না। তাঁরা এখন দাবার পটে বড়ের ভূমিকায়, যাদের নিয়ে দলীয় প্রধানেরা দক্ষতার সঙ্গে খেলে চলেন। এসব নির্বাচিত সদস্যদের কথা বলার কোনো জায়গা নেই। চূড়ান্ত রায় আসবে হাইকমান্ড থেকেই, হাইকমান্ডই পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকারী। কংগ্রেসের সোনিয়া আর বিজেপির আরএসএস-সমর্থিত আদভানির ওপরই যদি প্রার্থী নির্বাচন পুরোপুরি নির্ভর করে, তবে কেন আর যোগ্যতর প্রার্থীর দাবি তোলা?
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
আসলে ভারতের প্রধান দুই দল কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে দ্বন্দ্বের জায়গা যা-ই হোক না কেন, দুই দলই একই স্বার্থগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যখন যেখানেই রাজ্য নির্বাচন হোক না কেন দেখা যায়, একক কোনো ব্যক্তি অথবা অভিন্ন স্বার্থের ব্যক্তিবর্গের সমষ্টির হাতেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। তিনি বা তাঁর পছন্দের ব্যক্তিদের মধ্যে নির্বাচনের টিকিট বিলি করেন। নির্বাচিত ব্যক্তিরা হাইকমান্ডের (কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বোঝানোর জন্য এ শব্দটি তৈরি করা হয়েছিল) ব্যাপারে এতটাই শঙ্কিত থাকেন যে তাঁরা নিজেরাই তাঁদের মাথা নত করে দেন। নিজেরা রাজ্যনেতৃত্ব নির্বাচন না করে, বরং এ কাজটিও করার ভার হাইকমান্ডের ওপর ছেড়ে দেন।
আমরা দিল্লি, রাজস্তান, হরিয়ানা ও মিজোরামে দেখেছি কত সহজে নেতা বাছাইয়ের কাজটি সোনিয়া গান্ধীর ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে জিতেছে বিজেপি। সেখানে নেতা নির্বাচনের জন্য এল কে আদভানির দ্বারস্থ হয়েছে দলটি। বোঝাই যায়, তিনি এ ব্যাপারে বিজেপির চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ আরএসএসের সঙ্গেই আলোচনা করবেন।
দিল্লির নির্বাচনে কংগ্রেস বিজয়ী হওয়ার পর সোনিয়া গান্ধীকে নেতা নির্বাচনে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। তবু কিছু সময় উদ্বিগ্ন অবস্থায় পার করতে হয়েছে শিলা দীক্ষিতকে। তখন গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে শিলা যদি তৃতীয়বারের মতো দিল্লিতে কংগ্রেসের বিজয় ঘটাতে পারেন তাহলে তাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীও করা হতে পারে। এ গুজবের ফলে যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে সে বিষয়ে তিনি ঘাবড়ে গিয়ে বললেন যে এটা রটনা মাত্র। বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলকে তিনি জানালেন, তাঁর কিছু বিরোধীরা এই মিথ্যা রটনা ছড়াচ্ছে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর প্রাপ্য পদ পেয়েছিলেন। তবে অশোক গেহলটের ক্ষেত্রে বাছাই কাজটা একটু কঠিনই ছিল, কেননা কয়েকজন নেতৃত্বের দাবিদার দিল্লির স্বার্থগোষ্ঠীদের কথামতো কাজ করতেন। রাজস্তানের ভোটাররা অশোকের কারণেই কংগ্রেসের দিকে ফিরে এসেছেন। তবু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সোনিয়া গান্ধীর ওপরই ছেড়ে দেওয়া হলো। অশোক মুখ্যমন্ত্রীর কুরসি পেলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁকে সোনিয়ার হুকুম মেনে দুজন ডেপুটি মুখ্যমন্ত্রী নিতে হলো। আর হরিয়ানার ভূপিন্দর সিং হোড়া তো অল্পের জন্য পার পেয়ে গেলেন। সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য দিল্লিতে তিনি তাঁবু গেড়ে অশেষ প্রতীক্ষায় বসেছিলেন। চন্ডিগড় ও রাজধানীর মধ্যে কয়েকবার আনাগোনার পর অবশেষে তাঁকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়।
রাজ্যসভার নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও দল নয়, ব্যক্তি সোনিয়া গান্ধীকে প্রভাব ফেলতে দেখা যায়। রাজিব গান্ধীর উপদেষ্টা সতিশ শর্মা পুনর্নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে কারও মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। হঠাৎ করে পেট্রলপাম্প ইজারাসংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে অভিযুক্ত করেন। আদালত কর্তৃক সাবেক মন্ত্রীদের জরিমানা করার ঘটনা তেমন দেখা যায় না, কিন্তু শর্মার ক্ষেত্রে জরিমানা করা হয়। কিন্তু এবারও প্রার্থী করার ক্ষেত্রে সোনিয়ার কাছে বিবেচ্য নিষ্ঠা নয়, আনুগত্য।
সোনিয়া কিংবা তাঁর ১০ জনপথের বাসভবন এখন ক্ষমতার সমার্থক। তাঁর অনুমোদন ছাড়া সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত বা কোন বিষয়ে অবস্থান নেওয়া হয় না। তিনি এমন এক প্রধানমন্ত্রী পেয়েছেন, যিনি তাঁর সব কথা শোনেন।
কংগ্রেসের ইতিহাসে বহু নজির আছে, যেখানে দলের সভাপতি ও দেশের প্রধানমন্ত্রী সমান্তরাল কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন। জওহরলাল নেহরু দলের সভাপতিকে পূর্ণ শ্রদ্ধা করতেন। সভাপতির কথাকেই তিনি চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করতেন। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও ইন্দিরা গান্ধী উভয়েই, বিশেষ করে ইন্দিরা, কংগ্রেস সভাপতিকে নামিয়ে নিয়ে এসেছিলেন, সঞ্জিব রেড্ডির ভাষায়, ‘চাপরাশি’র স্তরে।
কেরালায় ই এম এস নাম্বুড়িরিপাদের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট সরকারকে বরখাস্ত করা হোক, সেটা নেহরু চাননি। কিন্তু কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি ইন্দিরা গান্ধী তাঁর দলের রাজনৈতিক স্বার্থে বরখাস্ত করার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন। ইন্দিরার নিজস্ব স্বতন্ত্র পন্থা ছিল, নেহরুর কন্যা হিসেবে নয়, যে কংগ্রেস নেহরুকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেছিল, সেটির সভাপতি হিসেবেই। নেহরু চাইলে নিজস্ব পন্থা করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি নিয়ম ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থাতেই অটল ছিলেন।
তাঁর উত্তরসূরি শাস্ত্রী মনে করতেন, তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি কে কামারাজ তাঁকে দমিয়ে রাখেন। যদিও কামারাজ শাস্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রীর কুরসিতে বসতে সহায়তা করেছিলেন, কিন্তু শাস্ত্রী তাঁকে গুরুত্বহীন করে তোলেন। রাষ্ট্রপতির কাছে মন্ত্রীদের যে তালিকা শাস্ত্রী প্রেরণ করেন তা কামারাজকে তিনি দেখাননি। তবে ইন্দিরা গান্ধীর মতো নির্মম ছিলেন না শাস্ত্রী। তিনি কামারাজের সম্মানহানি হতে দেননি।
কামারাজের সহায়তায় ইন্দিরা গান্ধী যখন ক্ষমতাসীন হলেন তখনো কামারাজ কংগ্রেসের সভাপতি। ইন্দিরা তাঁকে ও তাঁর সিন্ডিকেটকে পথের বাধা হিসেবে গণ্য করলেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিক প্রার্থী সঞ্জীব রেড্ডিকে হারিয়ে ভি ভি গিরিকে জয়ী করার মাধ্যমে তিনি তাঁদের পরাজিত করেন। পরবর্তীকালে তিনি দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী পদে একই ব্যক্তি আসীন হওয়ার চল করলেন। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন তাঁর ছেলে রাজিব গান্ধী।
সোনিয়া গান্ধী এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তাঁর সুবিধা হলো, তাঁর নেতৃত্বেই কংগ্রেস আবার ক্ষমতাসীন হতে পারবে, এ কথা দলটির নেতারা মেনে নিয়েছিলেন। আর তিনি সেটা করেছেনও। সভাপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি দলের ভেতর নেতৃত্বের বিরোধিতা একেবারে কমিয়ে এনেছেন। এখন যে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য তাঁর ছেলে রাহুল গান্ধীকে বাছাই করেছেন, সে কারণে যত দিন পর্যন্ত না রাহুল প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসতে পারেন, তত দিন পর্যন্ত তিনি মনমোহন সিংকে দিয়েই চালিয়ে নেবেন। দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তো বলেই দিয়েছেন যে তিনি রাহুল গান্ধীর জন্য সরে যেতে প্রস্তুত থাকবেন।
বিজেপির ক্ষেত্রে, আরএসএস তাদের চাওয়া স্পষ্ট করার পর নিতিন গড়করিকে দলীয় প্রধান ‘নির্বাচিত’ করতে হয়েছে। কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির পার্থক্য শুধু এই যে বিজেপির রিমোট কন্ট্রোল আরএসএসের প্রধান কার্যালয় নাগপুরে আর সোনিয়া গান্ধী নিজেই নিজের নিয়ন্তা।
কংগ্রেস ও বিজেপিদলীয় আইনপ্রণেতারা এখন এমন পর্যায়ে নেমে গেছেন যে, তাঁরা অন্যের স্বার্থে ব্যবহূত হন। অতীতে এমন অবস্থা ছিল না। তাঁরা এখন দাবার পটে বড়ের ভূমিকায়, যাদের নিয়ে দলীয় প্রধানেরা দক্ষতার সঙ্গে খেলে চলেন। এসব নির্বাচিত সদস্যদের কথা বলার কোনো জায়গা নেই। চূড়ান্ত রায় আসবে হাইকমান্ড থেকেই, হাইকমান্ডই পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকারী। কংগ্রেসের সোনিয়া আর বিজেপির আরএসএস-সমর্থিত আদভানির ওপরই যদি প্রার্থী নির্বাচন পুরোপুরি নির্ভর করে, তবে কেন আর যোগ্যতর প্রার্থীর দাবি তোলা?
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
No comments