আওয়ামী লীগ-বিএনপির দ্বন্দ্ব নিরসন নাকি নতুন বিকল্প by শফিকুল ইসলাম
এই শিরোনামে ৫ ডিসেম্বর দৈনিক প্রথম আলোয় একটি লেখা ছাপা হয়েছে। লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ। শিক্ষকতার এই পরিচয়ের পাশাপাশি আকাশের অন্য পরিচিতিও আছে। ছাত্রজীবনে তিনি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সারির নেতা ছিলেন। এখন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেতা তিনি। লেখাটির বিষয়বস্তু সময়োপযোগী এবং এতে আকাশের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও মতামত ভাবনার উদ্রেককারী।
দেশের রাজনীতি বলতে এখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিদলীয় রাজনীতিকেই বুঝে থাকে জনগণ। অপরাপর ছোটখাটো দল-গোষ্ঠীর উপস্থিতি অত্যন্ত ক্ষীণ। এবং এদের অস্তিত্ব মূলতই ওই দুটি দলের প্রভাব-বলয়াধীন। এমনকি বামপন্থীদের ক্ষুদ্র অপভ্রংশগুলোর রাজনীতিও সময়োত্তীর্ণ নয়—গতানুগতিকই। কাজেই দেশের রাজনৈতিক চরিত্র বা সংস্কৃতি মানেই কেবল বৃহত্ দুটি দলের আচার-আচরণ ভিন্ন অন্য কিছু নয়।
এ দুই দলের আচরণে জনগণ অতিষ্ঠ, দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি স্তিমিত-ম্রিয়মাণ। প্রায় দুই দশক ধরে পালাক্রমে এ দুটি দল রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। তাদের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়াই প্রথম ও শেষ কথা। ‘ক্ষমতা-দখল’ রাজনীতির একটা বিষয় হতেই পারে। কিন্তু এ দুটি দল রাজনীতির নামে, ক্ষমতার প্রশ্নে যা করছে, তার সঙ্গে জনস্বার্থের কিংবা জাতীয় কল্যাণের লক্ষ্যে কোনো আদর্শ বা কর্মসূচি বাস্তবায়নের সংযোগ-সম্পর্ক নেই। দলীয় স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর লালন-পালন ও আখের গোছানোই তাদের এই ক্ষমতা দখলের একমাত্র উদ্দেশ্য। দলের মধ্যে আদর্শ বা গণতন্ত্রচর্চার মাধ্যমে স্থিতিশীল-কার্যকর রাষ্ট্রগঠন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যত্ বিনির্মাণে তাদের কোনো দায়-দায়িত্ব আছে বলে জনমনে একটুও প্রতিভাত হয় না। তাদের ক্ষমতা দখলের এ রকম লড়াই চর দখলের লাঠিয়ালি বিবাদের শামিল। যেখানে জনগণ নয়, অস্ত্র-পেশিশক্তি এবং সেই সঙ্গে বিদেশি শক্তিধরদের আনুকূল্য লাভই মূল কথা। এ রকম দাঙ্গাটে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নিমজ্জমান আমরা ভুলতেই বসেছি, এ জাতির গৌরব করার মতো একটি সংগ্রামী ঐতিহ্য ও আদর্শ আছে। এই আদর্শে বলীয়ান হয়েই একাত্তরে সশস্ত্র যুদ্ধে জয়ী হয়ে দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের বঙ্গবন্ধুর সরকার সেই আদর্শের ভিত্তিতে দেশ গঠনে ব্যর্থ হয়। রণাঙ্গনে শত্রুপক্ষকে পর্যুদস্ত করা আর বিজিতপক্ষের আদর্শের মূলোচ্ছেদ করে ফেলা যে এক কথা নয়, সেই বাস্তব সত্যটি বুঝতে সক্ষম হলেন না বঙ্গবন্ধু নিজে, তাঁর দল ও সরকার। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যেই বিজয়ের সবটুকু অর্জন করে ফেলার মানসিকতা দেখানো হলো, যা ছিল চরম ভুল।
এম এম আকাশ ঠিকই বলেছেন, পাকিস্তান রাষ্ট্র এ জাতির আবহমানকালের ধারার আদর্শের পরিপূরক হলে দ্বি-জাতিতত্ত্বভিত্তিক পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রয়োজন হতো না। দ্বি-জাতিতত্ত্বের কৃত্রিম ঘোর কাটতে ও এই তত্ত্বের অসারতা প্রমাণে নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধই যথেষ্ট ছিল না, প্রয়োজন ছিল নিরবচ্ছিন্ন আদর্শিক সংগ্রামের। আর এটি ছিল সমগ্র জাতির ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। কিন্তু শাসকদল সেই আদর্শগত সংগ্রামের বদলে জাতির ঐক্যহননের পথে পা দেয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অপরাপর দল-গোষ্ঠী এমনকি আওয়ামী লীগেরই ভেতরকার শুভবুদ্ধি ও ধী-শক্তিসম্পন্ন নেতৃত্বকে দূরে ঠেলে দেওয়া হলো। করা হলো চরমভাবে তাদের অবমূল্যায়ন-বিতাড়ন। ফলে যে জাতি একাত্তরে ছিল ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ, শেখ মুজিব বলতে যে জাতি ছিল অন্ধ, যাঁর অঙ্গুলি হেলনে জাতি চরম সংগ্রামে মেতে উঠেছিল, যাঁর মুখ আর জাতির বুক হয়ে গিয়েছিল একাকার—সেই শেখ মুজিব, সেই বঙ্গবন্ধুর ওপর থেকে সব আস্থা-বিশ্বাস হারিয়ে ফেলল সেই জাতি। খণ্ড-বিখণ্ড হলো ঐক্য, অবিশ্বাস আর ষড়যন্ত্রের চারণভূমিতে পরিণত হলো প্রিয় আমাদের এই স্বদেশ, বাংলাদেশ। অন্যদিকে পরাজিত শক্তি স্বাভাবিকভাবেই বসে থাকল না। সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার করে আওয়ামী লীগেরই একাংশের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ৭৫-এর ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটানো হলো। তাঁদের অপরিণামদর্শিতার কারণে দলগতভাবে আওয়ামী লীগও ক্ষতিগ্রস্ত হলো। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো এই দেশ, এই জাতি, পিছিয়ে গেল অগ্রগতির ধারা—যার করুণ পরিণতি গোনার দিন শেষ হয়নি আজও।
বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটি আজ আওয়ামী লীগের সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত। অথচ দলটির জন্ম হওয়ারই কথা ছিল না। বিএনপির জন্ম, বিকাশ এবং এক যুগেরও বেশি ধরে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার সুযোগ আসলে করে দিয়েছে আওয়ামী লীগই। এখানে দায়ভার নিতে হবে বামপন্থার দলগুলোকেও। নতুন দেশের উপযোগী নতুন রাজনীতির ধারা প্রবর্তনে তারাও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বাম নামধারী কিছু দলের ভূমিকাও এখানে সমানভাবে দায়ী। এম এম আকাশের বিবেচনায় এ দিকটিকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল।
এখন অবস্থা এমন, রাজনীতির প্রতি কারও কোনো বিশ্বাস নেই। দলগুলোর মধ্যে আদর্শ বা গণতন্ত্রের বিন্দুমাত্র চর্চা হয় না। নেতৃত্বের গুণাবলি সুস্থ প্রতিযোগিতার বদলে শীর্ষ নেতৃত্বকে তোয়াজ আর মোসাহেবিই এখানে মূল কথা। যে যার মতো করে আত্মরক্ষা আর সম্পদ অর্জনের চেষ্টা করছে। এরূপ তমসাচ্ছন্ন বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক অবস্থা যে কী রকম দুর্বিপাক ডেকে আনতে পারে, তা ভাবা যায় কি? কাজেই এ রাজনীতির বদল হওয়া জরুরি, প্রয়োজন নতুন ধারার রাজনীতির প্রবর্তন।
এম এম আকাশ সংকট-উত্তরণে সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরাচারী শক্তিগুলোর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে জনগণ-নির্ভর দুটো পরস্পর প্রতিযোগী বুর্জোয়া দলের সম্ভাবনার পাশাপাশি ক্রমবিলীয়মান বিএনপির স্থলে অপেক্ষাকৃত রেডিক্যাল বামদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের অভ্যুদয়ের কথা বলেছেন। আমরা আশা করি, এই প্রস্তাবনার ওপর বিস্তর আলোচনা হবে এবং এর মধ্য দিয়ে ভালো কিছু বেরিয়ে আসবে।
আমরা নতুন ধারার রাজনীতির পক্ষপাতী। বিদ্যমান দলগুলোর মধ্যে নতুন সমীকরণ খোঁজার বদলে জোর দিতে চাই রাজনীতিকে বদলে দেওয়ার ওপর। বলতে চাই একেবারে খোলনলচে বদলে দেওয়ার কথা। এ কথা আশা করি আমরা সবাই স্বীকার করব, জাতির সামনে কোনো আলোকবর্তিকা নেই, নেই কোনো আস্থা ও ভরসাস্থল। জনগণ রাজনীতিকে নিজের ভালো-মন্দের কোনো কাজ বলে মনে করে না, মনে করে রাজনীতি কিছু লোকের ব্যবসার ধান্ধা। কাজেই জাতির আস্থা সৃষ্টিতে সক্ষম এমন একটি কর্মসূচি দরকার সবার আগে। তা না হলে কোনো উদ্যোগই সাফল্যের মুখ দেখবে না। অতীতে পুরোনো ধারায় দল গঠনের সব উদ্যোগ-আয়োজন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের বাকশাল হলো না, কাদের সিদ্দিকীর জনতা লীগও দাঁড়াল না, ড. কামাল হোসেন বা ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী বা কর্নেল অলি-ফেরদৌস কোরেশীরাও সফল হননি। জনগণের আস্থা অর্জনে তাঁদের এই ব্যর্থতার প্রধানতম কারণ, এসবের মধ্যে জনগণ নতুন কিছু দেখেনি। তাই গতানুগতিক এসব উদ্যোগে সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না জনগণ। সুতরাং সাবেকি, সনাতনী কোনো পন্থায় জনগণকে জাগানো সম্ভব হবে না। সে কারণেই ভাবতে হবে নতুনভাবে-নতুন ধারায়। এ উদ্যোগ হিসেবে জাতির সামনে একগুচ্ছ নেতাকে হাজির করলেই চলবে না। নতুন এই উদ্যোগের ব্যাপারে জাতির ভাবনার ঐক্য তৈরি করতে হবে এবং জাতির সামনে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি দিতে হবে। আমাদের ধারণা, বিশ্বাসযোগ্য এমন কোনো জায়গা তৈরি হলে জনগণ সাড়া দেবেই।
শফিকুল ইসলাম: সাবেক সাংসদ।
দেশের রাজনীতি বলতে এখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিদলীয় রাজনীতিকেই বুঝে থাকে জনগণ। অপরাপর ছোটখাটো দল-গোষ্ঠীর উপস্থিতি অত্যন্ত ক্ষীণ। এবং এদের অস্তিত্ব মূলতই ওই দুটি দলের প্রভাব-বলয়াধীন। এমনকি বামপন্থীদের ক্ষুদ্র অপভ্রংশগুলোর রাজনীতিও সময়োত্তীর্ণ নয়—গতানুগতিকই। কাজেই দেশের রাজনৈতিক চরিত্র বা সংস্কৃতি মানেই কেবল বৃহত্ দুটি দলের আচার-আচরণ ভিন্ন অন্য কিছু নয়।
এ দুই দলের আচরণে জনগণ অতিষ্ঠ, দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি স্তিমিত-ম্রিয়মাণ। প্রায় দুই দশক ধরে পালাক্রমে এ দুটি দল রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। তাদের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়াই প্রথম ও শেষ কথা। ‘ক্ষমতা-দখল’ রাজনীতির একটা বিষয় হতেই পারে। কিন্তু এ দুটি দল রাজনীতির নামে, ক্ষমতার প্রশ্নে যা করছে, তার সঙ্গে জনস্বার্থের কিংবা জাতীয় কল্যাণের লক্ষ্যে কোনো আদর্শ বা কর্মসূচি বাস্তবায়নের সংযোগ-সম্পর্ক নেই। দলীয় স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর লালন-পালন ও আখের গোছানোই তাদের এই ক্ষমতা দখলের একমাত্র উদ্দেশ্য। দলের মধ্যে আদর্শ বা গণতন্ত্রচর্চার মাধ্যমে স্থিতিশীল-কার্যকর রাষ্ট্রগঠন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যত্ বিনির্মাণে তাদের কোনো দায়-দায়িত্ব আছে বলে জনমনে একটুও প্রতিভাত হয় না। তাদের ক্ষমতা দখলের এ রকম লড়াই চর দখলের লাঠিয়ালি বিবাদের শামিল। যেখানে জনগণ নয়, অস্ত্র-পেশিশক্তি এবং সেই সঙ্গে বিদেশি শক্তিধরদের আনুকূল্য লাভই মূল কথা। এ রকম দাঙ্গাটে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নিমজ্জমান আমরা ভুলতেই বসেছি, এ জাতির গৌরব করার মতো একটি সংগ্রামী ঐতিহ্য ও আদর্শ আছে। এই আদর্শে বলীয়ান হয়েই একাত্তরে সশস্ত্র যুদ্ধে জয়ী হয়ে দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের বঙ্গবন্ধুর সরকার সেই আদর্শের ভিত্তিতে দেশ গঠনে ব্যর্থ হয়। রণাঙ্গনে শত্রুপক্ষকে পর্যুদস্ত করা আর বিজিতপক্ষের আদর্শের মূলোচ্ছেদ করে ফেলা যে এক কথা নয়, সেই বাস্তব সত্যটি বুঝতে সক্ষম হলেন না বঙ্গবন্ধু নিজে, তাঁর দল ও সরকার। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যেই বিজয়ের সবটুকু অর্জন করে ফেলার মানসিকতা দেখানো হলো, যা ছিল চরম ভুল।
এম এম আকাশ ঠিকই বলেছেন, পাকিস্তান রাষ্ট্র এ জাতির আবহমানকালের ধারার আদর্শের পরিপূরক হলে দ্বি-জাতিতত্ত্বভিত্তিক পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রয়োজন হতো না। দ্বি-জাতিতত্ত্বের কৃত্রিম ঘোর কাটতে ও এই তত্ত্বের অসারতা প্রমাণে নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধই যথেষ্ট ছিল না, প্রয়োজন ছিল নিরবচ্ছিন্ন আদর্শিক সংগ্রামের। আর এটি ছিল সমগ্র জাতির ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। কিন্তু শাসকদল সেই আদর্শগত সংগ্রামের বদলে জাতির ঐক্যহননের পথে পা দেয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অপরাপর দল-গোষ্ঠী এমনকি আওয়ামী লীগেরই ভেতরকার শুভবুদ্ধি ও ধী-শক্তিসম্পন্ন নেতৃত্বকে দূরে ঠেলে দেওয়া হলো। করা হলো চরমভাবে তাদের অবমূল্যায়ন-বিতাড়ন। ফলে যে জাতি একাত্তরে ছিল ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ, শেখ মুজিব বলতে যে জাতি ছিল অন্ধ, যাঁর অঙ্গুলি হেলনে জাতি চরম সংগ্রামে মেতে উঠেছিল, যাঁর মুখ আর জাতির বুক হয়ে গিয়েছিল একাকার—সেই শেখ মুজিব, সেই বঙ্গবন্ধুর ওপর থেকে সব আস্থা-বিশ্বাস হারিয়ে ফেলল সেই জাতি। খণ্ড-বিখণ্ড হলো ঐক্য, অবিশ্বাস আর ষড়যন্ত্রের চারণভূমিতে পরিণত হলো প্রিয় আমাদের এই স্বদেশ, বাংলাদেশ। অন্যদিকে পরাজিত শক্তি স্বাভাবিকভাবেই বসে থাকল না। সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার করে আওয়ামী লীগেরই একাংশের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ৭৫-এর ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটানো হলো। তাঁদের অপরিণামদর্শিতার কারণে দলগতভাবে আওয়ামী লীগও ক্ষতিগ্রস্ত হলো। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো এই দেশ, এই জাতি, পিছিয়ে গেল অগ্রগতির ধারা—যার করুণ পরিণতি গোনার দিন শেষ হয়নি আজও।
বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটি আজ আওয়ামী লীগের সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত। অথচ দলটির জন্ম হওয়ারই কথা ছিল না। বিএনপির জন্ম, বিকাশ এবং এক যুগেরও বেশি ধরে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার সুযোগ আসলে করে দিয়েছে আওয়ামী লীগই। এখানে দায়ভার নিতে হবে বামপন্থার দলগুলোকেও। নতুন দেশের উপযোগী নতুন রাজনীতির ধারা প্রবর্তনে তারাও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বাম নামধারী কিছু দলের ভূমিকাও এখানে সমানভাবে দায়ী। এম এম আকাশের বিবেচনায় এ দিকটিকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল।
এখন অবস্থা এমন, রাজনীতির প্রতি কারও কোনো বিশ্বাস নেই। দলগুলোর মধ্যে আদর্শ বা গণতন্ত্রের বিন্দুমাত্র চর্চা হয় না। নেতৃত্বের গুণাবলি সুস্থ প্রতিযোগিতার বদলে শীর্ষ নেতৃত্বকে তোয়াজ আর মোসাহেবিই এখানে মূল কথা। যে যার মতো করে আত্মরক্ষা আর সম্পদ অর্জনের চেষ্টা করছে। এরূপ তমসাচ্ছন্ন বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক অবস্থা যে কী রকম দুর্বিপাক ডেকে আনতে পারে, তা ভাবা যায় কি? কাজেই এ রাজনীতির বদল হওয়া জরুরি, প্রয়োজন নতুন ধারার রাজনীতির প্রবর্তন।
এম এম আকাশ সংকট-উত্তরণে সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরাচারী শক্তিগুলোর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে জনগণ-নির্ভর দুটো পরস্পর প্রতিযোগী বুর্জোয়া দলের সম্ভাবনার পাশাপাশি ক্রমবিলীয়মান বিএনপির স্থলে অপেক্ষাকৃত রেডিক্যাল বামদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের অভ্যুদয়ের কথা বলেছেন। আমরা আশা করি, এই প্রস্তাবনার ওপর বিস্তর আলোচনা হবে এবং এর মধ্য দিয়ে ভালো কিছু বেরিয়ে আসবে।
আমরা নতুন ধারার রাজনীতির পক্ষপাতী। বিদ্যমান দলগুলোর মধ্যে নতুন সমীকরণ খোঁজার বদলে জোর দিতে চাই রাজনীতিকে বদলে দেওয়ার ওপর। বলতে চাই একেবারে খোলনলচে বদলে দেওয়ার কথা। এ কথা আশা করি আমরা সবাই স্বীকার করব, জাতির সামনে কোনো আলোকবর্তিকা নেই, নেই কোনো আস্থা ও ভরসাস্থল। জনগণ রাজনীতিকে নিজের ভালো-মন্দের কোনো কাজ বলে মনে করে না, মনে করে রাজনীতি কিছু লোকের ব্যবসার ধান্ধা। কাজেই জাতির আস্থা সৃষ্টিতে সক্ষম এমন একটি কর্মসূচি দরকার সবার আগে। তা না হলে কোনো উদ্যোগই সাফল্যের মুখ দেখবে না। অতীতে পুরোনো ধারায় দল গঠনের সব উদ্যোগ-আয়োজন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের বাকশাল হলো না, কাদের সিদ্দিকীর জনতা লীগও দাঁড়াল না, ড. কামাল হোসেন বা ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী বা কর্নেল অলি-ফেরদৌস কোরেশীরাও সফল হননি। জনগণের আস্থা অর্জনে তাঁদের এই ব্যর্থতার প্রধানতম কারণ, এসবের মধ্যে জনগণ নতুন কিছু দেখেনি। তাই গতানুগতিক এসব উদ্যোগে সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না জনগণ। সুতরাং সাবেকি, সনাতনী কোনো পন্থায় জনগণকে জাগানো সম্ভব হবে না। সে কারণেই ভাবতে হবে নতুনভাবে-নতুন ধারায়। এ উদ্যোগ হিসেবে জাতির সামনে একগুচ্ছ নেতাকে হাজির করলেই চলবে না। নতুন এই উদ্যোগের ব্যাপারে জাতির ভাবনার ঐক্য তৈরি করতে হবে এবং জাতির সামনে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি দিতে হবে। আমাদের ধারণা, বিশ্বাসযোগ্য এমন কোনো জায়গা তৈরি হলে জনগণ সাড়া দেবেই।
শফিকুল ইসলাম: সাবেক সাংসদ।
No comments