অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার ২০০৯ -সামাজিক মূলধন, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও উত্পাদন দক্ষতা by ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
উনিশ শ আশির দশকের শেষ দিকে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের নেতৃত্বে উন্নয়নশীল বিশ্বে বাজারমুখী সংস্কার প্রবর্তন করা হয়। যে উন্নয়নদর্শন এর পেছনে কাজ করেছে, পরবর্তী দুই দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে তাতে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। দেখা গেছে, বাজারমুখী সংস্কারের কার্যকরতা অনেকখানি নির্ভর করে একটি দেশের সামাজিক রীতিনীতি, আচার-আচরণ ও আর্থসামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈশিষ্ট্যের ওপর—উন্নয়ন অর্থনীতির তত্ত্বে এককথায় যাকে এখন বলা হয় সামাজিক মূলধন (social capital)। এ সামাজিক মূলধনকে বিবেচনায় না নিলে, শুধু দাতাগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া সংস্কার বা প্রকল্প হিতে বিপরীত হতে পারে।
নেপালের কৃষিতে সেচব্যবস্থার ওপর গবেষণা করতে গিয়ে এমন সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছিলেন ২০০৯ সালের অর্থনীতির অন্যতম নোবেল বিজয়ী এলিনর অস্ট্রম।
সনাতন ও আধুনিক পদ্ধতির সেচব্যবস্থার দক্ষতা তুলনা করতে গিয়ে তিনি একটি ধাঁধায় পড়েন। সনাতন পদ্ধতিতে কৃষকেরা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা পানির প্রবাহে মাটির বাঁধ দিয়ে এবং নালা খুঁড়ে জমিতে সেচ দেন। বলা বাহুল্য, এটি কোনো দক্ষ সেচব্যবস্থা নয়। অন্যদিকে যখন সরকারি ব্যয়ে সিমেন্ট-কংক্রিট দিয়ে বাঁধ ও সেচের নালা নির্মাণ করে আধুনিক পদ্ধতির সেচব্যবস্থা করা হলো, এর ফলাফল ভালো না হয়ে আরও খারাপ হলো। দেখা গেল, প্রকল্পের দায়িত্বে নিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে সেচের নালাগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অচিরেই অকার্যকর হয়ে পড়ে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সনাতন পদ্ধতির সেচব্যবস্থাতেই যদি কেবল সেচের নালাগুলো ইট-সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে কিছুটা উন্নতমানের করে দেওয়া যায়, তাহলেই কৃষির উত্পাদনে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়।
এলিনর অস্ট্রম এর ব্যাখ্যা খুঁজে পেলেন এভাবে—সনাতন পদ্ধতিতে কৃষকদের মধ্যে বাঁধ নির্মাণ ও সেচের নালার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটা অলিখিত চুক্তি কাজ করে। বাঁধের কাছাকাছি সেচের নালার মুখের দিকে সহজেই পানি আসে; কিন্তু সেখানকার কৃষকেরা যদি তাঁদের জমির ওপর দিয়ে যাওয়া নালার রক্ষণাবেক্ষণ না করেন, তাহলে দূরবর্তী জমিতে পানি যাবে না। তাঁরা যাতে এ কাজটি করেন, তার বিনিময়ে দূরবর্তী জমির মালিকেরা নিজেদের শ্রমে বাঁধটি তৈরি করে দেন (নিয়মটি হলো, যাঁর জমি যত দূরে, তিনি তত বেশি শ্রম দেবেন)। সরকারি খরচে বাঁধ তৈরি করার ফলে কৃষকদের স্বেচ্ছাশ্রমের আর প্রয়োজন হয় না, কাজেই সেচের নালার রক্ষণাবেক্ষণের অলিখিত চুক্তিটিও আর কার্যকর থাকে না। কিন্তু যেখানে কৃষকেরা নিজেরাই বাঁধটি তৈরি করেন এবং শুধু সেচের নালা বাঁধাই করে দেওয়া হয়, সেখানে একদিকে যেমন সেচের দক্ষতা কিছুটা বাড়ে, অন্যদিকে আবার সনাতন পদ্ধতির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থাটিও বজায় থাকে। এটিই ধাঁধার উত্তর।
নেপালের এ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষণীয় বিষয় কী? কৃষকদের বহুদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ প্রযুক্তি বনাম আধুনিক প্রযুক্তির উপযোগিতা নিয়ে সচরাচর যে বিতর্ক হয়, তার জন্য এটি জুতসই উদাহরণ নয়। এখানে মূল বিষয় হলো, বিদ্যমান সামাজিক মূলধনকে অগ্রাহ্য করে আধুনিক প্রযুক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বাইরে থেকে চাপিয়ে দিলে সুফল না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। উন্নয়ন প্রকল্পের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে স্থানীয় জনগণ, বিশেষত উপকারভোগীদের অংশগ্রহণের বিষয়টি কেন এত জরুরি, সেটাও এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়।
উনিশ শ নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনেক প্রকল্প পুনর্বাসনের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে বিশ্বব্যাংক একটি সমীক্ষা করেছিল। প্রকল্প এলাকার ৮০ শতাংশ মানুষের মতে, প্রকল্পগুলোর মূল উদ্দেশ্য ভালোই ছিল, কিন্তু এগুলোর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এর ফলে ত্রুটিপূর্ণ নকশার কারণে ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রকল্পগুলো স্থানীয় অর্থনীতির জন্য তেমন কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি। বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়নের ভিত্তিতে ৩৫টি প্রকল্পের মধ্যে মাত্র একটিকে সফলভাবে পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়েছিল। স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে এ সমস্যার একটা সমাধান খুঁজে বের করার হয়তো সুযোগ আছে।
দারিদ্র্য নিরসনে ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে, কিন্তু সামাজিক মূলধন তৈরিতে এর ভূমিকা নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। আমাদের ব্যাংকিং খাতের ঋণখেলাপির সংস্কৃতির বিপরীতে ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে যে এক ধরনের ঋণ পরিশোধের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে—এটাও এক ধরনের সামাজিক পুঁজি। প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থায় ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের বিষয়টি গোপনীয় বলে বিবেচনা করা হয়। আর সমিতিভিত্তিক ক্ষুদ্রঋণের বৈশিষ্ট্যই হলো একটি উন্মুক্ত সামাজিক পদ্ধতির মাধ্যমে ঋণ-কার্যক্রম পরিচালনা করা। লক্ষণীয়, এনজিওদের সম্বন্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও ক্ষুদ্রঋণের বিতরণ ও আদায়ের ক্ষেত্রে প্রতি সপ্তাহে যে কোটি কোটিবার অর্থের লেনদেন হয়, তা নিয়ে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির কথা শোনা যায় না। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের উদ্যোগে কৃষিব্যাংকের ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রেও ক্ষুদ্রঋণের আদলে একটি উন্মুক্ত সামাজিক পদ্ধতি গ্রহণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সামাজিক পুঁজি একবার তৈরি হলে সেটাকে যে নানাভাবে ব্যবহার করা যায়, এটি তার একটি উদাহরণ।
এ বছরের অর্থনীতিতে অপর নোবেল বিজয়ী অলিভার উইলিয়ামসনও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর দক্ষতা নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর তত্ত্ব অনুযায়ী ক্ষেত্রবিশেষে উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বাজারব্যবস্থার দক্ষতার বিকল্প হতে পারে। এ তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ আমাদের কৃষিতেও দেখা যায়। আমাদের দেশে কোনো কোনো কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে আজকাল চুক্তিভিত্তিক কৃষি উত্পাদনব্যবস্থা বা contract farming-এর প্রচলন হচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন কৃষকেরা উত্পাদিত পণ্যের বাজার দামের ওঠা-নামার ঝুঁকি এড়াতে পারেন, অন্যদিকে ক্রেতা-প্রতিষ্ঠানের জন্যও পণ্যের মান ও প্রয়োজনীয় পরিমাণের সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। উইলিয়ামসন অবশ্য তাঁর তত্ত্ব দিয়ে দেখিয়েছিলেন, বড় আকারের শিল্প-কারখানার উত্পাদিত পণ্যের যন্ত্রাংশ বাজার থেকে না কিনে নিজেদের কারখানায় উত্পাদন করাই বেশি লাভজনক হতে পারে। এ তত্ত্বের ভিত্তিতে তিনি বিশাল আকৃতির শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উত্থান এবং এদের মধ্যে অধিগ্রহণ ও একীভূত (takeover এবং merger) হওয়ার প্রবণতার যে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে তা বাস্তবে সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
আমাদের দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে শিল্প-বাণিজ্যের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিবেচনা তেমন গুরুত্ব পায়নি। অথচ পুঁজিবাজার ও ব্যাংকিং খাতের সংস্কার থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগ—এ সব ক্ষেত্রেই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো যত দিন কার্যত পারিবারিক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হবে, পুঁজিবাজার তত দিন সত্যিকার সুসংগঠিত হবে না। আবার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর যে বড় ধরনের পার্থক্য আছে, তা বিবেচনায় না নিয়ে এ খাতের জন্য কার্যকর সংস্কার কর্মসূচি তৈরি করা সম্ভব নয়।
একসময় আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংক উভয়ের ক্ষেত্রেই খেলাপি ঋণের সমস্যা সমানভাবে প্রকট ছিল। এখন অবশ্য বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর দুর্বলতার প্রধান উত্স হিসেবে বহুদিন ধরেই যে বিষয়গুলো চিহ্নিত হয়ে আসছে, এগুলো হলো ঋণ কার্যক্রমে রাজনৈতিক প্রভাব, কর্মকর্তাদের অদক্ষতা ও দায়িত্ব পালনে প্রণোদনার অভাব, এবং পরিচালনা পর্ষদের নিষ্ক্রিয়তা ও সরকারের প্রতি মুখাপেক্ষিতা। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ব্যাংক খোলার অনুমতি দেওয়ার পেছনে প্রধান যুক্তি ছিল, উদ্যোক্তা-পরিচালকেরা নিজেদের বিনিয়োগ থেকে মুনাফা লাভের তাগিদেই ব্যাংক পরিচালনার দক্ষতার বিষয়ে যত্নবান হবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, আর্থিক খাতের আইনকানুনের শিথিলতার সুযোগে নিজেদের ব্যাংক থেকে অবৈধ আর্থিক সুবিধা গ্রহণই উদ্যোক্তা-পরিচালকদের জন্য বেশি লাভজনক হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এসব অন্যায় কার্যকলাপ রোধে নানা বিধিনিষেধ আরোপ ও সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা-পরিচালকদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ফলেই বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। সেই সঙ্গে এ খাতে সত্যিকার উদ্যোক্তাসুলভ আচরণের সংস্কৃতি কমবেশি গড়ে উঠলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরোপিত বিধিনিষেধ ক্রমে শিথিল করা সম্ভব হবে।
বেসরকারি খাতে ব্যাংক স্থাপনের আরেকটি যুক্তি ছিল, প্রতিযোগিতার ফলে এ খাতের দক্ষতা বাড়বে এবং আমানত ও ঋণের সুদের হারের ব্যবধান কমে আসবে। বাস্তবে এ লক্ষ্য ততটা অর্জিত হয়নি। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনায় না গিয়ে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রণ-কাঠামোর (regulatory framework) সম্ভাব্য ইতিবাচক ভূমিকা সম্বন্ধে একটি উদাহরণ দিতে চাই। লক্ষ করা যায় যে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সুরম্য দালান-কোঠা ও অতিরিক্ত সাজসজ্জার পেছনে খরচ করার একটা প্রতিযোগিতা চলে। গ্রাহকদের আস্থা অর্জনের জন্য বিশ্বব্যাপী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এটি একটি বহুল প্রচলিত কৌশল। বলা বাহুল্য, এ ধরনের প্রতিযোগিতায় ব্যয় সাশ্রয়ের বদলে বরং অর্থের অপচয় হয়। এর বিকল্প হিসেবে যদি ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র গ্রাহকদের কাছে বোধগম্যভাবে তাদের প্রতিটি শাখায় বাধ্যতামূলক প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে দক্ষতা অর্জনের একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা হতে পারে। নব্বইয়ের দশকে গঠিত ব্যাংক-সংস্কার কমিটির পক্ষ থেকে এ রকম একটি সুপারিশ করা হয়েছিল। কমিটির অনেক সুপারিশ বাস্তবায়িত হলেও, এটি হয়নি।
বর্তমান সরকার সরকারি-বেসরকারি অংশীদারে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ, কিন্তু অংশীদারির ধরন কী হবে, সে সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা প্রয়োজন। যদি প্রস্তাবিত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে বিভিন্ন পক্ষের স্বার্থের সমন্বয়হীনতা (অর্থনীতির ভাষায়, incentive incompatibility) থাকে, তাহলে ব্যবস্থাপনার দক্ষতা অর্জন সম্ভব নয়। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো বিদেশি বিনিয়োগকারী ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ মালিকানায় স্থাপিত কর্ণফুলী সার কারখানা—সংক্ষেপে ‘কাফকো’।
কাফকোর ব্যর্থতার প্রধান কারণ হলো, এর মালিকানার যারা বিদেশি অংশীদার—যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও তাদের; তার ওপর প্রতিষ্ঠানটির একচেটিয়া ব্যবসারও সুযোগ আছে। আবার সরকার এ কারখানার সার উত্পাদনের মূল উপকরণ প্রাকৃতিক গ্যাসেরও একমাত্র জোগানদার। এ রকম জটিল অংশীদারির কাঠামোয় স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা প্রায় অবশ্যম্ভাবী।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির আরও কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণের শর্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিদেশি পরামর্শক কোম্পানির সঙ্গে সরকার চুক্তি করেছিল। এর ফলাফল নিয়ে সন্দেহ আছে। প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে যেসব চুক্তি করা হয়েছিল, সেগুলোর ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে বিচার-বিশ্লেষণের ঘাটতি ছিল কি না, তা দেখা দরকার। বর্তমান সরকার অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য কী ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর চিন্তাভাবনা করছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
এসব ক্ষেত্রে কী ধরনের চুক্তি থেকে বেশি সুফল আসবে, তা অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে; যেমন, উত্পাদিত সেবা বা পণ্যের বৈশিষ্ট্য, বাজারে প্রতিযোগিতার মাত্রা, পুঁজির উত্স, ব্যবস্থাপনার ধরন, যন্ত্রপাতি ও স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের গুরুত্ব, পরিবেশ দূষণ ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি, সরকারের নজরদারির ক্ষমতা ইত্যাদি। এ ধরনের প্রকল্পের প্রস্তাব মূল্যায়নের সময় এর কারিগরি দিকগুলো সংগত কারণেই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। আর্থিক লাভ-ক্ষতির হিসাবও করা হয়। কিন্তু প্রস্তাবিত প্রকল্পের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় বিভিন্ন পক্ষের স্বার্থ ও প্রণোদনা কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, এ বিষয়টি নিয়ে তেমন চিন্তাভাবনা করা হয় না। বড় ভুলটি হয় এখানেই। আর এ বছরের নোবেল বিজয়ী দুজন অর্থনীতিবিদের তত্ত্ব থেকে শেখার বিষয়টিও এ জায়গাতেই।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: অর্থনীতিবিদ, চেয়ারম্যান, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ।
নেপালের কৃষিতে সেচব্যবস্থার ওপর গবেষণা করতে গিয়ে এমন সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছিলেন ২০০৯ সালের অর্থনীতির অন্যতম নোবেল বিজয়ী এলিনর অস্ট্রম।
সনাতন ও আধুনিক পদ্ধতির সেচব্যবস্থার দক্ষতা তুলনা করতে গিয়ে তিনি একটি ধাঁধায় পড়েন। সনাতন পদ্ধতিতে কৃষকেরা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা পানির প্রবাহে মাটির বাঁধ দিয়ে এবং নালা খুঁড়ে জমিতে সেচ দেন। বলা বাহুল্য, এটি কোনো দক্ষ সেচব্যবস্থা নয়। অন্যদিকে যখন সরকারি ব্যয়ে সিমেন্ট-কংক্রিট দিয়ে বাঁধ ও সেচের নালা নির্মাণ করে আধুনিক পদ্ধতির সেচব্যবস্থা করা হলো, এর ফলাফল ভালো না হয়ে আরও খারাপ হলো। দেখা গেল, প্রকল্পের দায়িত্বে নিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে সেচের নালাগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অচিরেই অকার্যকর হয়ে পড়ে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সনাতন পদ্ধতির সেচব্যবস্থাতেই যদি কেবল সেচের নালাগুলো ইট-সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে কিছুটা উন্নতমানের করে দেওয়া যায়, তাহলেই কৃষির উত্পাদনে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়।
এলিনর অস্ট্রম এর ব্যাখ্যা খুঁজে পেলেন এভাবে—সনাতন পদ্ধতিতে কৃষকদের মধ্যে বাঁধ নির্মাণ ও সেচের নালার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটা অলিখিত চুক্তি কাজ করে। বাঁধের কাছাকাছি সেচের নালার মুখের দিকে সহজেই পানি আসে; কিন্তু সেখানকার কৃষকেরা যদি তাঁদের জমির ওপর দিয়ে যাওয়া নালার রক্ষণাবেক্ষণ না করেন, তাহলে দূরবর্তী জমিতে পানি যাবে না। তাঁরা যাতে এ কাজটি করেন, তার বিনিময়ে দূরবর্তী জমির মালিকেরা নিজেদের শ্রমে বাঁধটি তৈরি করে দেন (নিয়মটি হলো, যাঁর জমি যত দূরে, তিনি তত বেশি শ্রম দেবেন)। সরকারি খরচে বাঁধ তৈরি করার ফলে কৃষকদের স্বেচ্ছাশ্রমের আর প্রয়োজন হয় না, কাজেই সেচের নালার রক্ষণাবেক্ষণের অলিখিত চুক্তিটিও আর কার্যকর থাকে না। কিন্তু যেখানে কৃষকেরা নিজেরাই বাঁধটি তৈরি করেন এবং শুধু সেচের নালা বাঁধাই করে দেওয়া হয়, সেখানে একদিকে যেমন সেচের দক্ষতা কিছুটা বাড়ে, অন্যদিকে আবার সনাতন পদ্ধতির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থাটিও বজায় থাকে। এটিই ধাঁধার উত্তর।
নেপালের এ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষণীয় বিষয় কী? কৃষকদের বহুদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ প্রযুক্তি বনাম আধুনিক প্রযুক্তির উপযোগিতা নিয়ে সচরাচর যে বিতর্ক হয়, তার জন্য এটি জুতসই উদাহরণ নয়। এখানে মূল বিষয় হলো, বিদ্যমান সামাজিক মূলধনকে অগ্রাহ্য করে আধুনিক প্রযুক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বাইরে থেকে চাপিয়ে দিলে সুফল না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। উন্নয়ন প্রকল্পের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে স্থানীয় জনগণ, বিশেষত উপকারভোগীদের অংশগ্রহণের বিষয়টি কেন এত জরুরি, সেটাও এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়।
উনিশ শ নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনেক প্রকল্প পুনর্বাসনের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে বিশ্বব্যাংক একটি সমীক্ষা করেছিল। প্রকল্প এলাকার ৮০ শতাংশ মানুষের মতে, প্রকল্পগুলোর মূল উদ্দেশ্য ভালোই ছিল, কিন্তু এগুলোর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এর ফলে ত্রুটিপূর্ণ নকশার কারণে ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রকল্পগুলো স্থানীয় অর্থনীতির জন্য তেমন কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি। বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়নের ভিত্তিতে ৩৫টি প্রকল্পের মধ্যে মাত্র একটিকে সফলভাবে পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়েছিল। স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে এ সমস্যার একটা সমাধান খুঁজে বের করার হয়তো সুযোগ আছে।
দারিদ্র্য নিরসনে ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে, কিন্তু সামাজিক মূলধন তৈরিতে এর ভূমিকা নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। আমাদের ব্যাংকিং খাতের ঋণখেলাপির সংস্কৃতির বিপরীতে ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে যে এক ধরনের ঋণ পরিশোধের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে—এটাও এক ধরনের সামাজিক পুঁজি। প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থায় ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের বিষয়টি গোপনীয় বলে বিবেচনা করা হয়। আর সমিতিভিত্তিক ক্ষুদ্রঋণের বৈশিষ্ট্যই হলো একটি উন্মুক্ত সামাজিক পদ্ধতির মাধ্যমে ঋণ-কার্যক্রম পরিচালনা করা। লক্ষণীয়, এনজিওদের সম্বন্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও ক্ষুদ্রঋণের বিতরণ ও আদায়ের ক্ষেত্রে প্রতি সপ্তাহে যে কোটি কোটিবার অর্থের লেনদেন হয়, তা নিয়ে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির কথা শোনা যায় না। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের উদ্যোগে কৃষিব্যাংকের ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রেও ক্ষুদ্রঋণের আদলে একটি উন্মুক্ত সামাজিক পদ্ধতি গ্রহণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সামাজিক পুঁজি একবার তৈরি হলে সেটাকে যে নানাভাবে ব্যবহার করা যায়, এটি তার একটি উদাহরণ।
এ বছরের অর্থনীতিতে অপর নোবেল বিজয়ী অলিভার উইলিয়ামসনও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর দক্ষতা নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর তত্ত্ব অনুযায়ী ক্ষেত্রবিশেষে উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বাজারব্যবস্থার দক্ষতার বিকল্প হতে পারে। এ তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ আমাদের কৃষিতেও দেখা যায়। আমাদের দেশে কোনো কোনো কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে আজকাল চুক্তিভিত্তিক কৃষি উত্পাদনব্যবস্থা বা contract farming-এর প্রচলন হচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন কৃষকেরা উত্পাদিত পণ্যের বাজার দামের ওঠা-নামার ঝুঁকি এড়াতে পারেন, অন্যদিকে ক্রেতা-প্রতিষ্ঠানের জন্যও পণ্যের মান ও প্রয়োজনীয় পরিমাণের সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। উইলিয়ামসন অবশ্য তাঁর তত্ত্ব দিয়ে দেখিয়েছিলেন, বড় আকারের শিল্প-কারখানার উত্পাদিত পণ্যের যন্ত্রাংশ বাজার থেকে না কিনে নিজেদের কারখানায় উত্পাদন করাই বেশি লাভজনক হতে পারে। এ তত্ত্বের ভিত্তিতে তিনি বিশাল আকৃতির শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উত্থান এবং এদের মধ্যে অধিগ্রহণ ও একীভূত (takeover এবং merger) হওয়ার প্রবণতার যে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে তা বাস্তবে সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
আমাদের দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে শিল্প-বাণিজ্যের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিবেচনা তেমন গুরুত্ব পায়নি। অথচ পুঁজিবাজার ও ব্যাংকিং খাতের সংস্কার থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগ—এ সব ক্ষেত্রেই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো যত দিন কার্যত পারিবারিক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হবে, পুঁজিবাজার তত দিন সত্যিকার সুসংগঠিত হবে না। আবার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর যে বড় ধরনের পার্থক্য আছে, তা বিবেচনায় না নিয়ে এ খাতের জন্য কার্যকর সংস্কার কর্মসূচি তৈরি করা সম্ভব নয়।
একসময় আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংক উভয়ের ক্ষেত্রেই খেলাপি ঋণের সমস্যা সমানভাবে প্রকট ছিল। এখন অবশ্য বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর দুর্বলতার প্রধান উত্স হিসেবে বহুদিন ধরেই যে বিষয়গুলো চিহ্নিত হয়ে আসছে, এগুলো হলো ঋণ কার্যক্রমে রাজনৈতিক প্রভাব, কর্মকর্তাদের অদক্ষতা ও দায়িত্ব পালনে প্রণোদনার অভাব, এবং পরিচালনা পর্ষদের নিষ্ক্রিয়তা ও সরকারের প্রতি মুখাপেক্ষিতা। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ব্যাংক খোলার অনুমতি দেওয়ার পেছনে প্রধান যুক্তি ছিল, উদ্যোক্তা-পরিচালকেরা নিজেদের বিনিয়োগ থেকে মুনাফা লাভের তাগিদেই ব্যাংক পরিচালনার দক্ষতার বিষয়ে যত্নবান হবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, আর্থিক খাতের আইনকানুনের শিথিলতার সুযোগে নিজেদের ব্যাংক থেকে অবৈধ আর্থিক সুবিধা গ্রহণই উদ্যোক্তা-পরিচালকদের জন্য বেশি লাভজনক হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এসব অন্যায় কার্যকলাপ রোধে নানা বিধিনিষেধ আরোপ ও সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা-পরিচালকদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ফলেই বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। সেই সঙ্গে এ খাতে সত্যিকার উদ্যোক্তাসুলভ আচরণের সংস্কৃতি কমবেশি গড়ে উঠলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরোপিত বিধিনিষেধ ক্রমে শিথিল করা সম্ভব হবে।
বেসরকারি খাতে ব্যাংক স্থাপনের আরেকটি যুক্তি ছিল, প্রতিযোগিতার ফলে এ খাতের দক্ষতা বাড়বে এবং আমানত ও ঋণের সুদের হারের ব্যবধান কমে আসবে। বাস্তবে এ লক্ষ্য ততটা অর্জিত হয়নি। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনায় না গিয়ে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রণ-কাঠামোর (regulatory framework) সম্ভাব্য ইতিবাচক ভূমিকা সম্বন্ধে একটি উদাহরণ দিতে চাই। লক্ষ করা যায় যে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সুরম্য দালান-কোঠা ও অতিরিক্ত সাজসজ্জার পেছনে খরচ করার একটা প্রতিযোগিতা চলে। গ্রাহকদের আস্থা অর্জনের জন্য বিশ্বব্যাপী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এটি একটি বহুল প্রচলিত কৌশল। বলা বাহুল্য, এ ধরনের প্রতিযোগিতায় ব্যয় সাশ্রয়ের বদলে বরং অর্থের অপচয় হয়। এর বিকল্প হিসেবে যদি ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র গ্রাহকদের কাছে বোধগম্যভাবে তাদের প্রতিটি শাখায় বাধ্যতামূলক প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে দক্ষতা অর্জনের একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা হতে পারে। নব্বইয়ের দশকে গঠিত ব্যাংক-সংস্কার কমিটির পক্ষ থেকে এ রকম একটি সুপারিশ করা হয়েছিল। কমিটির অনেক সুপারিশ বাস্তবায়িত হলেও, এটি হয়নি।
বর্তমান সরকার সরকারি-বেসরকারি অংশীদারে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ, কিন্তু অংশীদারির ধরন কী হবে, সে সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা প্রয়োজন। যদি প্রস্তাবিত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে বিভিন্ন পক্ষের স্বার্থের সমন্বয়হীনতা (অর্থনীতির ভাষায়, incentive incompatibility) থাকে, তাহলে ব্যবস্থাপনার দক্ষতা অর্জন সম্ভব নয়। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো বিদেশি বিনিয়োগকারী ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ মালিকানায় স্থাপিত কর্ণফুলী সার কারখানা—সংক্ষেপে ‘কাফকো’।
কাফকোর ব্যর্থতার প্রধান কারণ হলো, এর মালিকানার যারা বিদেশি অংশীদার—যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও তাদের; তার ওপর প্রতিষ্ঠানটির একচেটিয়া ব্যবসারও সুযোগ আছে। আবার সরকার এ কারখানার সার উত্পাদনের মূল উপকরণ প্রাকৃতিক গ্যাসেরও একমাত্র জোগানদার। এ রকম জটিল অংশীদারির কাঠামোয় স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা প্রায় অবশ্যম্ভাবী।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির আরও কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণের শর্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিদেশি পরামর্শক কোম্পানির সঙ্গে সরকার চুক্তি করেছিল। এর ফলাফল নিয়ে সন্দেহ আছে। প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে যেসব চুক্তি করা হয়েছিল, সেগুলোর ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে বিচার-বিশ্লেষণের ঘাটতি ছিল কি না, তা দেখা দরকার। বর্তমান সরকার অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য কী ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর চিন্তাভাবনা করছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
এসব ক্ষেত্রে কী ধরনের চুক্তি থেকে বেশি সুফল আসবে, তা অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে; যেমন, উত্পাদিত সেবা বা পণ্যের বৈশিষ্ট্য, বাজারে প্রতিযোগিতার মাত্রা, পুঁজির উত্স, ব্যবস্থাপনার ধরন, যন্ত্রপাতি ও স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের গুরুত্ব, পরিবেশ দূষণ ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি, সরকারের নজরদারির ক্ষমতা ইত্যাদি। এ ধরনের প্রকল্পের প্রস্তাব মূল্যায়নের সময় এর কারিগরি দিকগুলো সংগত কারণেই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। আর্থিক লাভ-ক্ষতির হিসাবও করা হয়। কিন্তু প্রস্তাবিত প্রকল্পের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় বিভিন্ন পক্ষের স্বার্থ ও প্রণোদনা কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, এ বিষয়টি নিয়ে তেমন চিন্তাভাবনা করা হয় না। বড় ভুলটি হয় এখানেই। আর এ বছরের নোবেল বিজয়ী দুজন অর্থনীতিবিদের তত্ত্ব থেকে শেখার বিষয়টিও এ জায়গাতেই।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: অর্থনীতিবিদ, চেয়ারম্যান, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ।
No comments