চারদিক -স্মৃতিময় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিঘর by বিশ্বজ্যোতি চৌধুরী
১৯৭১ সালের ঘটনা। দেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের ৪২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের শ্রীমঙ্গল উপজেলার অগ্নিঝরা দিনগুলোর কিছু টুকরোচিত্র। নয় মাসে জীবন, সম্ভ্রম, সম্পদ—সবকিছু হারানো ইতিহাসের খণ্ডিত কিছু আলোকচিত্র। দুঃসাহসী কিছু মুক্তিপাগল যুবকের দীপ্ত অঙ্গীকারনামা। নিরপরাধ নর-নারীর কঙ্কালের অংশ। পাঁচ-সাতটি বধ্যভূমির পবিত্র মাটি। যে মাটির বুকে শুয়ে আছে লাখো তাজা প্রাণ। যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহূত কিছু সামগ্রী। কয়েকটি শহীদ পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের হাল-হকিকত। সবই রয়েছে এখানে। টুকরো টুকরো ইতিহাসের প্রতিচ্ছবির মালা গেঁথে এভাবেই সাজানো হয়েছে তিনটি কক্ষের দেয়াল ও মেঝে। এ যেন নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের আদ্যোপান্ত।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আয়োজিত ‘স্মৃতিময় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিঘর’ প্রদর্শনীর কথা বলছিলাম। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের প্রথম দিন থেকে শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী চলবে মাসব্যাপী। চিফ হুইপ মো. আব্দুস শহীদ এর উদ্বোধন করেন। মহতী এ আয়োজনের উদ্যোক্তা শ্রীমঙ্গলের তরুণ সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী।
প্রতিদিন সকাল নয়টায় প্রদর্শনীটি সবার জন্য খুলে দেওয়া হয়। নানা শ্রেণী-পেশার বিভিন্ন বয়সী দর্শনার্থীর ভিড়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মানুষের আগ্রহ, ভালোবাসা, বিনম্র শ্রদ্ধার কথাই মনে করিয়ে দেয়। অন্যদিকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি হানাদারের দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনীর পৈশাচিকতা-নৃশংসতার প্রতি মানুষের ঘৃণা ও ধিক্কার।
প্রদর্শনীর শুরু থেকেই শিশুদের ভিড় লক্ষণীয়। বিদ্যালয় ছুটির পর কিংবা পরীক্ষা শেষে শিশুরা দলবেঁধে প্রদর্শনীটি দেখছে। এ রকম একটি আয়োজনে শিশুদের আগমন ঘটছে দলে দলে। ভাবতে ভালোই লাগে। কেননা, ওদের জন্যই তো এ আয়োজন। এসব শিশুকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে দিলে তারা বুঝতে পারবে, কী অপরিসীম মূল্যে কেনা আমাদের এই পবিত্র মাতৃভূমি—বাংলাদেশ। আরও ভালো লাগল এই ভেবে—এই প্রজন্মের এক তরুণ দায়িত্ববোধে কী সমৃদ্ধ! চেতনায় কী উদ্দীপ্ত!
প্রদর্শনীতে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহূত কয়েকটি স্মৃতিময় স্থানের ছবি রয়েছে। রয়েছে সেসব স্থানের পরিচিতি। এতে রয়েছে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের উত্তাল দিন, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে ষোলই ডিসেম্বরে তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের প্রায় ২০০ আলোকচিত্র।
এখানে রয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মুকিত লস্করের ব্যবহূত একটি পাঞ্জাবি, যিনি ১৯৭১ সালে মৌলভীবাজারের শেরপুর ও সিলেটের সাদিপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধজয়ের একজন অগ্রসেনানী। নায়েক সুবেদার আবদুল হাশেমের নেতৃত্বে সিলেটের জেল ভেঙে বন্দীদের মুক্ত করার অপারেশনে যাওয়ার পথে জেলসংলগ্ন কৃষি অফিসের সামনে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন তিনি। নির্যাতন শেষে তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
এখানে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা আলী আকবরের ব্যবহূত বেল্ট ও টুপি। এগুলো দেখে প্রদর্শনীতে আসা সহযোদ্ধাদের অনেকেই যুদ্ধদিনের বিভীষিকাময় মুহূর্তকে আলিঙ্গনে বাধ্য হন। ফিরে যান তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া সেসব দিনের কোনো এক ঘটনায়। স্মৃতির সমুদ্রস্নানে অবগাহন করে তাঁদেরই একজন তুলে আনেন কিছু শারীরিক যন্ত্রণা কিংবা মানসিক কষ্টের কথা। কেউ বা তুলে আনেন বীরত্বগাথা, কেউ বা বিরহের কোনো কাহিনি, হানাদার নিধনের গল্প। এসব সত্য কাহিনি, যন্ত্রণা, বীরত্বগাথা আর মানসিক কষ্টের যোগফলই তো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের অহংকার।
বিকুল চক্রবর্তী জানালেন, গত নভেম্বরে ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক রিপোর্টিং’ কর্মশালায় অংশ নিয়ে তিনি এ রকম একটি প্রদর্শনীর আয়োজনে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। নিজের এলাকার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতেই তাঁর এ উদ্যোগ। এলাকার প্রতিটি শহীদ পরিবার, এই অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক তাঁর এই আয়োজনে সহযোগিতা করেছেন। তাঁর বিশ্বাস, আয়োজন ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও দেশমাতৃকার সঙ্গে প্রদর্শনীতে আসা শিশু-কিশোরদের সেতুবন্ধ শক্ত ভিতের ওপর রচিত হবে।
ষোলই ডিসেম্বর বিজয়ের দিনে স্মৃতিময় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিঘরের তিনটি কক্ষ ঘুরে দেখছিলাম। নিজেকে সামলে নিতে বড়ই কষ্ট হচ্ছিল। কী এক অজানা শিহরণে মনটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ল। অথচ সেই ১৯৭১ সালে আমি চন্দ্রনাথ বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিলাম। সেসব দিনের স্মৃতি বলতে আমার কাছে কিছু মিছিল, শরণার্থী হয়ে ভারতে যাওয়া, ত্রিপুরার নিলামবাজারে এক দাদুর বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া, রেডিওতে (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র) পরিবারের অন্যদের সঙ্গে ‘ঠেটামালেক্যা-বিচ্চু’ কাহিনী (এম. আর. আখতার মুকুলের চরমপত্র) শোনা ছাড়া আর কিছুই মনে নেই।
কক্ষগুলো ঘুরে বারান্দায় বেরোতেই ছোট্ট শিশু পাপ্পু ও ইয়ামিন দুটি খাতা আমার সামনে মেলে ধরল। একটিতে দেখলাম, এ পর্যন্ত ১৫ হাজার ২১৬ জনের স্বাক্ষর রয়েছে। অন্য খাতাটিও ভরে গেছে বিশিষ্টজনদের মন্তব্যে।
মন্তব্যের খাতা হাতে নিয়ে লিখতে শুরু করলাম, ‘কলমসৈনিক, তোমার বিশ্বাস আরও শাণিত হোক। আয়োজন সার্থক হোক। তোমার এই মহান উদ্যোগের পাশে আরও ১০ জনের কৃতজ্ঞতাবোধ শামিল হোক। তোমার এই সাহসী উদ্যোগকে আমার সালাম।’
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আয়োজিত ‘স্মৃতিময় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিঘর’ প্রদর্শনীর কথা বলছিলাম। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের প্রথম দিন থেকে শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী চলবে মাসব্যাপী। চিফ হুইপ মো. আব্দুস শহীদ এর উদ্বোধন করেন। মহতী এ আয়োজনের উদ্যোক্তা শ্রীমঙ্গলের তরুণ সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী।
প্রতিদিন সকাল নয়টায় প্রদর্শনীটি সবার জন্য খুলে দেওয়া হয়। নানা শ্রেণী-পেশার বিভিন্ন বয়সী দর্শনার্থীর ভিড়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মানুষের আগ্রহ, ভালোবাসা, বিনম্র শ্রদ্ধার কথাই মনে করিয়ে দেয়। অন্যদিকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি হানাদারের দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনীর পৈশাচিকতা-নৃশংসতার প্রতি মানুষের ঘৃণা ও ধিক্কার।
প্রদর্শনীর শুরু থেকেই শিশুদের ভিড় লক্ষণীয়। বিদ্যালয় ছুটির পর কিংবা পরীক্ষা শেষে শিশুরা দলবেঁধে প্রদর্শনীটি দেখছে। এ রকম একটি আয়োজনে শিশুদের আগমন ঘটছে দলে দলে। ভাবতে ভালোই লাগে। কেননা, ওদের জন্যই তো এ আয়োজন। এসব শিশুকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে দিলে তারা বুঝতে পারবে, কী অপরিসীম মূল্যে কেনা আমাদের এই পবিত্র মাতৃভূমি—বাংলাদেশ। আরও ভালো লাগল এই ভেবে—এই প্রজন্মের এক তরুণ দায়িত্ববোধে কী সমৃদ্ধ! চেতনায় কী উদ্দীপ্ত!
প্রদর্শনীতে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহূত কয়েকটি স্মৃতিময় স্থানের ছবি রয়েছে। রয়েছে সেসব স্থানের পরিচিতি। এতে রয়েছে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের উত্তাল দিন, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে ষোলই ডিসেম্বরে তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের প্রায় ২০০ আলোকচিত্র।
এখানে রয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মুকিত লস্করের ব্যবহূত একটি পাঞ্জাবি, যিনি ১৯৭১ সালে মৌলভীবাজারের শেরপুর ও সিলেটের সাদিপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধজয়ের একজন অগ্রসেনানী। নায়েক সুবেদার আবদুল হাশেমের নেতৃত্বে সিলেটের জেল ভেঙে বন্দীদের মুক্ত করার অপারেশনে যাওয়ার পথে জেলসংলগ্ন কৃষি অফিসের সামনে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন তিনি। নির্যাতন শেষে তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
এখানে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা আলী আকবরের ব্যবহূত বেল্ট ও টুপি। এগুলো দেখে প্রদর্শনীতে আসা সহযোদ্ধাদের অনেকেই যুদ্ধদিনের বিভীষিকাময় মুহূর্তকে আলিঙ্গনে বাধ্য হন। ফিরে যান তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া সেসব দিনের কোনো এক ঘটনায়। স্মৃতির সমুদ্রস্নানে অবগাহন করে তাঁদেরই একজন তুলে আনেন কিছু শারীরিক যন্ত্রণা কিংবা মানসিক কষ্টের কথা। কেউ বা তুলে আনেন বীরত্বগাথা, কেউ বা বিরহের কোনো কাহিনি, হানাদার নিধনের গল্প। এসব সত্য কাহিনি, যন্ত্রণা, বীরত্বগাথা আর মানসিক কষ্টের যোগফলই তো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের অহংকার।
বিকুল চক্রবর্তী জানালেন, গত নভেম্বরে ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক রিপোর্টিং’ কর্মশালায় অংশ নিয়ে তিনি এ রকম একটি প্রদর্শনীর আয়োজনে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। নিজের এলাকার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতেই তাঁর এ উদ্যোগ। এলাকার প্রতিটি শহীদ পরিবার, এই অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক তাঁর এই আয়োজনে সহযোগিতা করেছেন। তাঁর বিশ্বাস, আয়োজন ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও দেশমাতৃকার সঙ্গে প্রদর্শনীতে আসা শিশু-কিশোরদের সেতুবন্ধ শক্ত ভিতের ওপর রচিত হবে।
ষোলই ডিসেম্বর বিজয়ের দিনে স্মৃতিময় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিঘরের তিনটি কক্ষ ঘুরে দেখছিলাম। নিজেকে সামলে নিতে বড়ই কষ্ট হচ্ছিল। কী এক অজানা শিহরণে মনটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ল। অথচ সেই ১৯৭১ সালে আমি চন্দ্রনাথ বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিলাম। সেসব দিনের স্মৃতি বলতে আমার কাছে কিছু মিছিল, শরণার্থী হয়ে ভারতে যাওয়া, ত্রিপুরার নিলামবাজারে এক দাদুর বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া, রেডিওতে (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র) পরিবারের অন্যদের সঙ্গে ‘ঠেটামালেক্যা-বিচ্চু’ কাহিনী (এম. আর. আখতার মুকুলের চরমপত্র) শোনা ছাড়া আর কিছুই মনে নেই।
কক্ষগুলো ঘুরে বারান্দায় বেরোতেই ছোট্ট শিশু পাপ্পু ও ইয়ামিন দুটি খাতা আমার সামনে মেলে ধরল। একটিতে দেখলাম, এ পর্যন্ত ১৫ হাজার ২১৬ জনের স্বাক্ষর রয়েছে। অন্য খাতাটিও ভরে গেছে বিশিষ্টজনদের মন্তব্যে।
মন্তব্যের খাতা হাতে নিয়ে লিখতে শুরু করলাম, ‘কলমসৈনিক, তোমার বিশ্বাস আরও শাণিত হোক। আয়োজন সার্থক হোক। তোমার এই মহান উদ্যোগের পাশে আরও ১০ জনের কৃতজ্ঞতাবোধ শামিল হোক। তোমার এই সাহসী উদ্যোগকে আমার সালাম।’
No comments