প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা: কিছু বিবেচনা by মনজুর আহমদ
দেশব্যাপী প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফল নিয়ে সংগতভাবেই উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন ও শিশুর স্বার্থ রক্ষায় এ পদক্ষেপ যেন বাধা না হয়, সে বিষয়ে সচেতন থাকা প্রয়োজন।
প্রথম আলোর প্রতিবেদক শরিফুজ্জামান তাঁর বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে (প্রথম আলো, ২৩ ডিসেম্বর) সমাপনী পরীক্ষার কিছু দিক তুলে ধরেছেন। পরীক্ষায় অকৃতকার্য ১১ শতাংশ এবং নাম লিখিয়েও পরীক্ষায় না আসা ৮ শতাংশ মিলে প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে একজন অকৃতকার্যের স্তরে পড়ছে। মনে রাখতে হবে, পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে প্রায় অর্ধেকসংখ্যক শিশু ঝরে পড়ে।
পরীক্ষার মাধ্যমে কৃতকার্য শিশুদের প্রথম থেকে তৃতীয়—এই তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। ২০ শতাংশ কৃতকার্য শিশু তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত হয়েছে। শিক্ষাবিদ ও মূল্যায়ন বিষয়ে ওয়াকিবহাল অনেকে এ ব্যাপারে আপত্তি করেছিলেন। সারা জীবনের জন্য বিপুলসংখ্যক শিশুকে তৃতীয় শ্রেণীর মার্কা লাগিয়ে দেওয়ার কোনো যুক্তি বা প্রয়োজনীয়তা আছে কি? এ শিশুদের পরীক্ষার ফল প্রধানত শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা ও সমস্যার নির্দশন। এ ছাড়া ধরে নেওয়া হচ্ছে, সমাপনী পরীক্ষাটি শিশুর দক্ষতা ও জ্ঞান নির্ণয়ে এমনই অব্যর্থ যে নির্দ্বিধায় শিশুদের বিভিন্ন দক্ষতা ও যোগ্যতার স্তরে ফেলে দেওয়া যায়। যথেষ্ট সুযোগ ও সহায়তা পেলে তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত অনেকেই সাফল্য দেখাতে পারবে। কিন্তু ব্যর্থতার ছাপ অতি অল্প বয়সে লাগিয়ে দিলে সেই সম্ভাবনা দুরূহ। অগ্রসর শিক্ষাব্যবস্থাসম্পন্ন কোনো দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ রকম শ্রেণীবিভাগ করা হয় না।
সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এটি প্রাথমিক শিক্ষায় অর্জিত দক্ষতা ও যোগ্যতা কতখানি করতে পারে। এ ব্যাপারে শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে ২০০৬ ও ২০০৮ সালে নমুনা জরিপ করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে বিভিন্ন বিষয়ে পঞ্চম শ্রেণীর শিশুদের মধ্যে নির্ধারিত দক্ষতা (শিক্ষাক্রম অনুযায়ী) অর্জনের হার ছিল বাংলা ১৪ শতাংশ, ইংরেজি ২, গণিত ৩, সমাজপাঠ ২ ও বিজ্ঞান ২ শতাংশ। নির্ধারিত দক্ষতা পরিমাপক পরীক্ষাটির বিষয়, পরিমাপের মানদণ্ড ও প্রক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। কিন্তু শিক্ষা অধিদপ্তরের নিজস্ব জরিপ ও সমাপনী পরীক্ষার ফলের মধ্যে বিরাট ব্যবধান প্রণিধানযোগ্য।
সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এগুলো অতিমাত্রায় পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তুনির্ভর। অর্থাত্ পাঠ্যপুস্তকে যা লেখা আছে এবং অনুশীলনী হিসেবে যে প্রশ্ন আছে, সেগুলোই পরীক্ষার প্রশ্নে স্থান পেয়েছে। ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তকের কিছু নির্বাচিত অংশ মুখস্থ করে সেই ভাষায় উত্তর দিতে উত্সাহিত করা হচ্ছে। প্রকৃত যোগ্যতা ও দক্ষতার যাচাই বা পরিমাপ এভাবে হতে পারে না।
সমাপনী পরীক্ষাকে শিক্ষার্থীর প্রকৃত জ্ঞান ও দক্ষতা নির্ণয় এবং বিদ্যালয় ও শিক্ষকসহ শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকরতা নিরূপণের উপায় হিসেবে কাজে লাগাতে হলে নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করা দরকার।
১. পাঠ্যপুস্তকভিত্তিক বার্ষিক পরীক্ষার আদল থেকে সরে গিয়ে এ পরীক্ষাকে প্রকৃত যোগ্যতা ও দক্ষতাভিত্তিক মূল্যায়নে রূপান্তর করা দরকার। এ কারণে প্রতি বিষয়ের জন্য দুই ঘণ্টা ধরে ছয়টি পরীক্ষা না নিয়ে বাংলা, গণিত এবং সমাজ ও পরিবেশ বিষয়ে তিনটি দুই ঘণ্টার পরীক্ষাই যথেষ্ট। মাতৃভাষা ও গণিতের দক্ষতার ভিত্তি তৈরি করা প্রাথমিক পর্যায়ের প্রধান দায়িত্ব। ন্যূনতম এ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতা সমগ্র প্রাথমিক শিক্ষার ব্যর্থতা।
২. দক্ষতাভিত্তিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি ও উত্তর মূল্যায়ন প্রক্রিয়া যথার্থ হতে হবে; এটি প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার নয়। এ জন্য একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একটি বিশেষজ্ঞ দলকে সার্বক্ষণিক কাজ করতে হবে। প্রশ্নপত্রের ধরন, কাঠামো ও উত্তর যাচাইয়ের যথার্থতা নিশ্চিত করতে এগুলো নিয়ে ক্রমাগত পরীক্ষামূলক কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
৩. কৃতকার্য শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার সনদে শ্রেণীর উল্লেখ থাকা মোটেই সংগত নয়।
৪. ক্রমাগত পরীক্ষার যথার্থতা ও নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য এটির প্রমিতকরণ নিয়ে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন যোগ্যতার ক্ষেত্রে ফলাফলের ভিত্তিতে শিক্ষাক্রম, বিদ্যালয়, শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকরতা সম্পর্কে ফলাফলের তাত্পর্য নিয়ে অব্যাহতভাবে বিশ্লেষণ ও গবেষণা করতে হবে। এ জন্য একটি একাডেমিক প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বিশেষজ্ঞ দলকে স্থায়ীভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করতে হবে।
সমাপনী পরীক্ষাকে সুযোগের সমতাসহ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এ পরীক্ষা নতুন সমস্যার জন্ম দেবে।
ড. মনজুর আহমদ: ব্র্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা।
প্রথম আলোর প্রতিবেদক শরিফুজ্জামান তাঁর বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে (প্রথম আলো, ২৩ ডিসেম্বর) সমাপনী পরীক্ষার কিছু দিক তুলে ধরেছেন। পরীক্ষায় অকৃতকার্য ১১ শতাংশ এবং নাম লিখিয়েও পরীক্ষায় না আসা ৮ শতাংশ মিলে প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে একজন অকৃতকার্যের স্তরে পড়ছে। মনে রাখতে হবে, পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে প্রায় অর্ধেকসংখ্যক শিশু ঝরে পড়ে।
পরীক্ষার মাধ্যমে কৃতকার্য শিশুদের প্রথম থেকে তৃতীয়—এই তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। ২০ শতাংশ কৃতকার্য শিশু তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত হয়েছে। শিক্ষাবিদ ও মূল্যায়ন বিষয়ে ওয়াকিবহাল অনেকে এ ব্যাপারে আপত্তি করেছিলেন। সারা জীবনের জন্য বিপুলসংখ্যক শিশুকে তৃতীয় শ্রেণীর মার্কা লাগিয়ে দেওয়ার কোনো যুক্তি বা প্রয়োজনীয়তা আছে কি? এ শিশুদের পরীক্ষার ফল প্রধানত শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা ও সমস্যার নির্দশন। এ ছাড়া ধরে নেওয়া হচ্ছে, সমাপনী পরীক্ষাটি শিশুর দক্ষতা ও জ্ঞান নির্ণয়ে এমনই অব্যর্থ যে নির্দ্বিধায় শিশুদের বিভিন্ন দক্ষতা ও যোগ্যতার স্তরে ফেলে দেওয়া যায়। যথেষ্ট সুযোগ ও সহায়তা পেলে তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত অনেকেই সাফল্য দেখাতে পারবে। কিন্তু ব্যর্থতার ছাপ অতি অল্প বয়সে লাগিয়ে দিলে সেই সম্ভাবনা দুরূহ। অগ্রসর শিক্ষাব্যবস্থাসম্পন্ন কোনো দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ রকম শ্রেণীবিভাগ করা হয় না।
সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এটি প্রাথমিক শিক্ষায় অর্জিত দক্ষতা ও যোগ্যতা কতখানি করতে পারে। এ ব্যাপারে শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে ২০০৬ ও ২০০৮ সালে নমুনা জরিপ করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে বিভিন্ন বিষয়ে পঞ্চম শ্রেণীর শিশুদের মধ্যে নির্ধারিত দক্ষতা (শিক্ষাক্রম অনুযায়ী) অর্জনের হার ছিল বাংলা ১৪ শতাংশ, ইংরেজি ২, গণিত ৩, সমাজপাঠ ২ ও বিজ্ঞান ২ শতাংশ। নির্ধারিত দক্ষতা পরিমাপক পরীক্ষাটির বিষয়, পরিমাপের মানদণ্ড ও প্রক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। কিন্তু শিক্ষা অধিদপ্তরের নিজস্ব জরিপ ও সমাপনী পরীক্ষার ফলের মধ্যে বিরাট ব্যবধান প্রণিধানযোগ্য।
সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এগুলো অতিমাত্রায় পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তুনির্ভর। অর্থাত্ পাঠ্যপুস্তকে যা লেখা আছে এবং অনুশীলনী হিসেবে যে প্রশ্ন আছে, সেগুলোই পরীক্ষার প্রশ্নে স্থান পেয়েছে। ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তকের কিছু নির্বাচিত অংশ মুখস্থ করে সেই ভাষায় উত্তর দিতে উত্সাহিত করা হচ্ছে। প্রকৃত যোগ্যতা ও দক্ষতার যাচাই বা পরিমাপ এভাবে হতে পারে না।
সমাপনী পরীক্ষাকে শিক্ষার্থীর প্রকৃত জ্ঞান ও দক্ষতা নির্ণয় এবং বিদ্যালয় ও শিক্ষকসহ শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকরতা নিরূপণের উপায় হিসেবে কাজে লাগাতে হলে নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করা দরকার।
১. পাঠ্যপুস্তকভিত্তিক বার্ষিক পরীক্ষার আদল থেকে সরে গিয়ে এ পরীক্ষাকে প্রকৃত যোগ্যতা ও দক্ষতাভিত্তিক মূল্যায়নে রূপান্তর করা দরকার। এ কারণে প্রতি বিষয়ের জন্য দুই ঘণ্টা ধরে ছয়টি পরীক্ষা না নিয়ে বাংলা, গণিত এবং সমাজ ও পরিবেশ বিষয়ে তিনটি দুই ঘণ্টার পরীক্ষাই যথেষ্ট। মাতৃভাষা ও গণিতের দক্ষতার ভিত্তি তৈরি করা প্রাথমিক পর্যায়ের প্রধান দায়িত্ব। ন্যূনতম এ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতা সমগ্র প্রাথমিক শিক্ষার ব্যর্থতা।
২. দক্ষতাভিত্তিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি ও উত্তর মূল্যায়ন প্রক্রিয়া যথার্থ হতে হবে; এটি প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার নয়। এ জন্য একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একটি বিশেষজ্ঞ দলকে সার্বক্ষণিক কাজ করতে হবে। প্রশ্নপত্রের ধরন, কাঠামো ও উত্তর যাচাইয়ের যথার্থতা নিশ্চিত করতে এগুলো নিয়ে ক্রমাগত পরীক্ষামূলক কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
৩. কৃতকার্য শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার সনদে শ্রেণীর উল্লেখ থাকা মোটেই সংগত নয়।
৪. ক্রমাগত পরীক্ষার যথার্থতা ও নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য এটির প্রমিতকরণ নিয়ে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন যোগ্যতার ক্ষেত্রে ফলাফলের ভিত্তিতে শিক্ষাক্রম, বিদ্যালয়, শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকরতা সম্পর্কে ফলাফলের তাত্পর্য নিয়ে অব্যাহতভাবে বিশ্লেষণ ও গবেষণা করতে হবে। এ জন্য একটি একাডেমিক প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বিশেষজ্ঞ দলকে স্থায়ীভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করতে হবে।
সমাপনী পরীক্ষাকে সুযোগের সমতাসহ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এ পরীক্ষা নতুন সমস্যার জন্ম দেবে।
ড. মনজুর আহমদ: ব্র্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা।
No comments