ইতিহাসের নতুন শুরু -বার্লিন প্রাচীর পতন by সরাফ আহমেদ
‘জার্মান জাতির গৌরব করার তেমন কিছু নেই। তবে বার্লিন প্রাচীরের পতন এবং জার্মান জাতির একত্রকরণ নিয়ে আমরা সবাই গর্বিত।’
বার্লিন প্রাচীর পতনের কুড়ি বছর পূর্তিতে ওই ঘটনার অনুঘটক আরও দুই বিশ্ব রাজনীতিক মিখাইল গর্বাচেভ এবং জর্জ বুশ সিনিয়রকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এ কথা বলেছেন জার্মান জাতির ঐক্য প্রক্রিয়ার প্রধান স্থপতি সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট কোহল। আত্মসমালোচনা মানুষকে, জাতিকে ছোট করে না, বরং তাদের সম্বন্ধে মানুষের সমীহ আর সম্মানই বাড়িয়েই দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে জার্মানি প্রায় সমগ্র ইউরোপ দখল করে নিয়েছিল, তাদের নিয়ে মানুষের ভীতি ও সংশয় থাকারই কথা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব এডলফ হিটলারের স্বপ্ন ছিল নিষ্কলুষ তৃতীয় রাইখ গড়ার, জার্মানদের পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার। প্রায় ছয় কোটি মানুষের মৃত্যু এবং ইউরোপজুড়ে ধ্বংসলীলার চিহ্ন রেখে যুদ্ধে হেরে যায় জার্মানি। বিজয়ী মিত্রশক্তি ৪৫ বছর জার্মানিকে দ্বিখণ্ডিত রেখেছিল। দ্বিখণ্ডিত এই জার্মানির প্রতীক ছিল বিশ্বখ্যাত বার্লিন প্রাচীর। ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর পূর্ব বার্লিনের হাজার হাজার মানুষের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে এই প্রাচীর ভেঙে ফেলা হয়। এক বছর পর ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর আবার একত্র হয় জার্মানি। কুড়ি বছর আগেও জার্মানি তথা পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের রাজনীতির আমূল পরিবর্তন অভাবনীয় ছিল। কিন্তু জনগণই রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির অনেক হিসাব গরমিল করে দেয়।
১৯৪৫ সালের যুদ্ধে জার্মান জাতির পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে জার্মানি বিভাগের মাধ্যমে দুটি অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থা চালু হয়েছিল—পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র। আর দুই জার্মানি তাদের পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ধারা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছিল।
তবে আশির দশকের শেষে সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভের শুরু করা গ্লাসনস্ত আর পেরস্ত্রোইকা কর্মসূচির হাত ধরে, পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে অধিকতর গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলনের ঢেউ লাগে সাবেক পূর্ব জার্মানিতেও। ১৯৮৯ সালের শেষের দিকে সাবেক পূর্ব জার্মানির বড় শহরগুলোতে প্রচণ্ড ঠান্ডা উপেক্ষা করে নাগরিক আন্দোলন এবং চার্চের ব্যানারে হাজার হাজার লোক রাস্তায় নেমে আসে। তারা গণতন্ত্র আর রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি জানাতে থাকে।
৯ অক্টোবর পূর্ব জার্মানির লাইপজিগে নাগরিক আন্দোলনের ডাকে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। সেটাই ছিল পূর্ব জার্মানির সমাজতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তম নাগরিক বিদ্রোহ। এরপর শুধু লাইপজিগ নয়, ছোট-বড় শহরসহ আন্দোলনের ঢেউ লাগে রাজধানী পূর্ব বার্লিনেও। ৪ নভেম্বর পূর্ব বার্লিনের প্রাণকেন্দ্র আলেকজান্ডার স্কয়ারে প্রায় ১০ লাখ মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। নানা অস্থিরতার মাঝে পূর্ব জার্মানির চ্যান্সেলর এরিখ হোনিকার পদত্যাগ করেন। ধস নামতে শুরু করে কমিউনিস্ট সরকারের অভ্যন্তরে, ৮ নভেম্বর পদত্যাগ করেন পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা। ৯ নভেম্বর ধসিয়ে দেওয়া হয় ২৮ বছর আগে গড়া বার্লিন প্রাচীর। প্রাচীর ভাঙার ধ্বংসযজ্ঞ চলছিল দুই রাত ধরে। প্রাচীর ভাঙার আনন্দে কেউ হেসেছে, কেউ কেঁদেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে প্রাচীর গোটা জার্মানিকেই মানসিকভাবে দ্বিখণ্ডিত করে রেখেছিল, প্রাচীর ভাঙার আনন্দে হাজার হাজার পূর্ব আর পশ্চিমের বার্লিনবাসী প্রাচীর পেরিয়ে একে অপরকে আলিঙ্গন করেছিল। সেই সময় জার্মানরা আবারও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, জার্মানরা আবার এক হবে। বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল বিশ্ববাসীও। প্রাচীর পতন-পরবর্তী ঘটনাগুলো আরও দ্রুত, আরও নাটকীয়।
পূর্ব জার্মানির চ্যান্সেলর এরিখ হোনিকারের পর ক্ষমতায় আসেন এরিখ কেনু ক্রেঞ্জ। তাঁকেও সরে দাঁড়াতে হয়। গঠিত হয় পূর্ব জার্মানির সংস্কারপন্থীদের তত্ত্বাবধায়ক ধাঁচের সরকার, যার প্রধান হন গর্বাচেভপন্থী হিসেবে পরিচিত হ্যানস মদরোভ। এই সরকারের আওতায় সার্বভৌম নির্বাচনে পশ্চিমের মতো পূর্বেও ক্ষমতায় আসেন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটরা। চ্যান্সেলর হন লোথার ডে মিজিয়ার।
পূর্ব আর পশ্চিমে একই রাজনৈতিক মতাদর্শের সরকার থাকার কারণে পূর্বের ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটরা পশ্চিমের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন। কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী ৪৫ বছর ধরে জার্মানি দেশ ও জাতির ওপর মিত্রশক্তিদের (সোভিয়েট ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন) সৈন্য ও ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ থাকায় তারা ঐকবদ্ধ জার্মানি হওয়ার পথে বাদ সাধে। মিত্রশক্তির নেতাদের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে জার্মানি ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা চালাতে থাকেন পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানির নেতারা। আর এই আলোচনার ফলে ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর জার্মান জাতির ঐক্যপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
সেই সময় জার্মান রাজনীতিকেরা, মিত্র চার শক্তি তথা ইউরোপের দেশগুলোকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে জার্মানি ইউরোপ তথা বিশ্ব ঐক্য ও শান্তির পথে কাজ করে যাবে। সেই কাজটি জার্মান রাজনীতিকেরা সার্বিকভাবেই করছেন বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। তবে প্রাচীর পতনের কুড়ি বছরেও যে সাবেক দুই জার্মানির মধ্যে সব বৈষম্য-সংশয়-অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা প্রবৃদ্ধি সমভাবে ঘটেছে, তা বলা যাবে না।
৪৫ বছরের বিপরীতধর্মী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো পূর্বে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পশ্চিমের মতো করে পুঁজিবাদী অর্থনীতি সহসাই সম্ভব নয়। বিগত কুড়ি বছরে পূর্বের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেও বাস্তবতার কারণে অনেক কিছুই সম্ভব হয়নি, ফলে সামাজিক সমস্যা ও সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতাও রয়েছে দুই দিকের মাঝে।
বার্লিনের প্রাণকেন্দ্র প্যারিসার স্কয়ারে অনুষ্ঠিত হবে ‘শান্তির জন্য গান’ শীর্ষক কনসার্ট। কনসার্ট মঞ্চে বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে উপস্থিত হবেন হিলারি ক্লিনটন, নিকোলাই সারকোজি, গর্ডন ব্রাউন, দিমিত্রি মেদভেদেভ। আর এই বিশ্বনেতাদের পাশে থাকবেন শান্তিতে বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
প্রাচীর পতনের কুড়ি বছর পূর্তিতে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, জার্মানি এগোচ্ছে, সময় লাগলেও পূর্ব-পশ্চিমের অর্থনৈতিক, সামাজিক বৈষম্যের দেয়াল ভাঙছে, বেকারত্বের হারও কমছে। বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানির নতুন প্রজন্মের রাজনীতিকেরা জার্মান জাতি সম্পর্কে বিশ্ববাসীর অবিশ্বাস, ভয়-ভীতি-সংশয়কে পেছনে ফেলে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঐক্যবদ্ধ জার্মানিকে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলো’র প্রতিনিধি, হ্যানোভার, জার্মানি।
Suaraf.ahmed@gmx.net
বার্লিন প্রাচীর পতনের কুড়ি বছর পূর্তিতে ওই ঘটনার অনুঘটক আরও দুই বিশ্ব রাজনীতিক মিখাইল গর্বাচেভ এবং জর্জ বুশ সিনিয়রকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এ কথা বলেছেন জার্মান জাতির ঐক্য প্রক্রিয়ার প্রধান স্থপতি সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট কোহল। আত্মসমালোচনা মানুষকে, জাতিকে ছোট করে না, বরং তাদের সম্বন্ধে মানুষের সমীহ আর সম্মানই বাড়িয়েই দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে জার্মানি প্রায় সমগ্র ইউরোপ দখল করে নিয়েছিল, তাদের নিয়ে মানুষের ভীতি ও সংশয় থাকারই কথা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব এডলফ হিটলারের স্বপ্ন ছিল নিষ্কলুষ তৃতীয় রাইখ গড়ার, জার্মানদের পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার। প্রায় ছয় কোটি মানুষের মৃত্যু এবং ইউরোপজুড়ে ধ্বংসলীলার চিহ্ন রেখে যুদ্ধে হেরে যায় জার্মানি। বিজয়ী মিত্রশক্তি ৪৫ বছর জার্মানিকে দ্বিখণ্ডিত রেখেছিল। দ্বিখণ্ডিত এই জার্মানির প্রতীক ছিল বিশ্বখ্যাত বার্লিন প্রাচীর। ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর পূর্ব বার্লিনের হাজার হাজার মানুষের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে এই প্রাচীর ভেঙে ফেলা হয়। এক বছর পর ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর আবার একত্র হয় জার্মানি। কুড়ি বছর আগেও জার্মানি তথা পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের রাজনীতির আমূল পরিবর্তন অভাবনীয় ছিল। কিন্তু জনগণই রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির অনেক হিসাব গরমিল করে দেয়।
১৯৪৫ সালের যুদ্ধে জার্মান জাতির পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে জার্মানি বিভাগের মাধ্যমে দুটি অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থা চালু হয়েছিল—পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র। আর দুই জার্মানি তাদের পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ধারা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছিল।
তবে আশির দশকের শেষে সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভের শুরু করা গ্লাসনস্ত আর পেরস্ত্রোইকা কর্মসূচির হাত ধরে, পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে অধিকতর গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলনের ঢেউ লাগে সাবেক পূর্ব জার্মানিতেও। ১৯৮৯ সালের শেষের দিকে সাবেক পূর্ব জার্মানির বড় শহরগুলোতে প্রচণ্ড ঠান্ডা উপেক্ষা করে নাগরিক আন্দোলন এবং চার্চের ব্যানারে হাজার হাজার লোক রাস্তায় নেমে আসে। তারা গণতন্ত্র আর রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি জানাতে থাকে।
৯ অক্টোবর পূর্ব জার্মানির লাইপজিগে নাগরিক আন্দোলনের ডাকে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। সেটাই ছিল পূর্ব জার্মানির সমাজতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তম নাগরিক বিদ্রোহ। এরপর শুধু লাইপজিগ নয়, ছোট-বড় শহরসহ আন্দোলনের ঢেউ লাগে রাজধানী পূর্ব বার্লিনেও। ৪ নভেম্বর পূর্ব বার্লিনের প্রাণকেন্দ্র আলেকজান্ডার স্কয়ারে প্রায় ১০ লাখ মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। নানা অস্থিরতার মাঝে পূর্ব জার্মানির চ্যান্সেলর এরিখ হোনিকার পদত্যাগ করেন। ধস নামতে শুরু করে কমিউনিস্ট সরকারের অভ্যন্তরে, ৮ নভেম্বর পদত্যাগ করেন পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা। ৯ নভেম্বর ধসিয়ে দেওয়া হয় ২৮ বছর আগে গড়া বার্লিন প্রাচীর। প্রাচীর ভাঙার ধ্বংসযজ্ঞ চলছিল দুই রাত ধরে। প্রাচীর ভাঙার আনন্দে কেউ হেসেছে, কেউ কেঁদেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে প্রাচীর গোটা জার্মানিকেই মানসিকভাবে দ্বিখণ্ডিত করে রেখেছিল, প্রাচীর ভাঙার আনন্দে হাজার হাজার পূর্ব আর পশ্চিমের বার্লিনবাসী প্রাচীর পেরিয়ে একে অপরকে আলিঙ্গন করেছিল। সেই সময় জার্মানরা আবারও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, জার্মানরা আবার এক হবে। বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল বিশ্ববাসীও। প্রাচীর পতন-পরবর্তী ঘটনাগুলো আরও দ্রুত, আরও নাটকীয়।
পূর্ব জার্মানির চ্যান্সেলর এরিখ হোনিকারের পর ক্ষমতায় আসেন এরিখ কেনু ক্রেঞ্জ। তাঁকেও সরে দাঁড়াতে হয়। গঠিত হয় পূর্ব জার্মানির সংস্কারপন্থীদের তত্ত্বাবধায়ক ধাঁচের সরকার, যার প্রধান হন গর্বাচেভপন্থী হিসেবে পরিচিত হ্যানস মদরোভ। এই সরকারের আওতায় সার্বভৌম নির্বাচনে পশ্চিমের মতো পূর্বেও ক্ষমতায় আসেন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটরা। চ্যান্সেলর হন লোথার ডে মিজিয়ার।
পূর্ব আর পশ্চিমে একই রাজনৈতিক মতাদর্শের সরকার থাকার কারণে পূর্বের ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটরা পশ্চিমের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন। কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী ৪৫ বছর ধরে জার্মানি দেশ ও জাতির ওপর মিত্রশক্তিদের (সোভিয়েট ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন) সৈন্য ও ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ থাকায় তারা ঐকবদ্ধ জার্মানি হওয়ার পথে বাদ সাধে। মিত্রশক্তির নেতাদের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে জার্মানি ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা চালাতে থাকেন পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানির নেতারা। আর এই আলোচনার ফলে ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর জার্মান জাতির ঐক্যপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
সেই সময় জার্মান রাজনীতিকেরা, মিত্র চার শক্তি তথা ইউরোপের দেশগুলোকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে জার্মানি ইউরোপ তথা বিশ্ব ঐক্য ও শান্তির পথে কাজ করে যাবে। সেই কাজটি জার্মান রাজনীতিকেরা সার্বিকভাবেই করছেন বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। তবে প্রাচীর পতনের কুড়ি বছরেও যে সাবেক দুই জার্মানির মধ্যে সব বৈষম্য-সংশয়-অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা প্রবৃদ্ধি সমভাবে ঘটেছে, তা বলা যাবে না।
৪৫ বছরের বিপরীতধর্মী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো পূর্বে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পশ্চিমের মতো করে পুঁজিবাদী অর্থনীতি সহসাই সম্ভব নয়। বিগত কুড়ি বছরে পূর্বের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেও বাস্তবতার কারণে অনেক কিছুই সম্ভব হয়নি, ফলে সামাজিক সমস্যা ও সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতাও রয়েছে দুই দিকের মাঝে।
বার্লিনের প্রাণকেন্দ্র প্যারিসার স্কয়ারে অনুষ্ঠিত হবে ‘শান্তির জন্য গান’ শীর্ষক কনসার্ট। কনসার্ট মঞ্চে বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে উপস্থিত হবেন হিলারি ক্লিনটন, নিকোলাই সারকোজি, গর্ডন ব্রাউন, দিমিত্রি মেদভেদেভ। আর এই বিশ্বনেতাদের পাশে থাকবেন শান্তিতে বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
প্রাচীর পতনের কুড়ি বছর পূর্তিতে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, জার্মানি এগোচ্ছে, সময় লাগলেও পূর্ব-পশ্চিমের অর্থনৈতিক, সামাজিক বৈষম্যের দেয়াল ভাঙছে, বেকারত্বের হারও কমছে। বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানির নতুন প্রজন্মের রাজনীতিকেরা জার্মান জাতি সম্পর্কে বিশ্ববাসীর অবিশ্বাস, ভয়-ভীতি-সংশয়কে পেছনে ফেলে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঐক্যবদ্ধ জার্মানিকে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলো’র প্রতিনিধি, হ্যানোভার, জার্মানি।
Suaraf.ahmed@gmx.net
No comments