মাথার চুল নয়, মগজই মূল্যবান -সহজিয়া কড়চা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
রমজানের রোজার শেষে ঈদ এল এবং চলেও গেল। ঈদ মুসলমানদের খুশির উত্সব। সব মুসলমান অবশ্য খুশি-আনন্দ করেনি। সেটা সম্ভবও নয়। তবে কেউ কেউ খুব বেশি করেছে। যেমন ব্রুনাই দারুস সালামের সুলতান। ঈদের আনন্দ করতে গেলে অর্থের দরকার। সেই অর্থ অনেক মুসলমানের মতো তাঁর আছে। এমনকি এই দীন-দুনিয়ায় অন্য কোনো মানুষ বা শাসকের যে ক্ষমতা নেই, ব্রুনাইয়ের মহামান্য সুলতানের তা আছে।
মুসলিম উম্মার কারও কারও কীর্তি দেখে একজন মুসলমান হিসেবে মাঝেমধ্যে গর্বে বুক ১০ হাত উঁচু হয়। অন্য কোনো ধর্মের কোনো ব্যক্তি বা শাসক যা পারেন না, একজন মুসলমান তা পারেন। সে জন্যই আমাদের অহঙ্কার। ব্রুনাইয়ের সুলতান বিশ্বের বিরাট শাসনকর্তা। তাঁর প্রাসাদের মতো প্রাসাদ স্পেনের মুসলমান শাসকদের তাঁদের সেই স্বর্ণকালেও ছিল না। শত শত প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট প্রাসাদের হাম্মামখানার পানির কলগুলো খাঁটি গিনি সোনার; কোনো কমদামি ধাতুর নয়।
প্রধান ধর্মীয় উত্সবের আগে মানুষ চুল-দাড়ি ছেঁটে ছিমছাম পরিপাটি হয়। ছোটবেলায় আমরা দেখেছি, ঈদের দু-চার দিন আগে নাপিত খেউরি করার জন্য আমাদের বাড়ি আসত। ক্ষৌরকারও ছিল বংশানুক্রমিক। কোনো সময় তাদের খানিকটা জমি দিয়ে দেওয়া হতো, বিনিময়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা বাড়িশুদ্ধ লোকের চুল কাটত। তবে ঈদ বা পূজার সময় নাপিত একখানা ধুতি এবং তার স্ত্রীর জন্য একটা সস্তা শাড়ি পেত। এখন আর সেই সামাজিক অবস্থা নেই। এখন সেলুনে গিয়ে মানুষ চুল কেটে আসে। ইচ্ছা হলে বকশিশ দেয়। তবে বাংলাদেশের মতো দেশে ১০-১২ টাকা দিয়ে বাটিছাঁট দেওয়ার মানুষই বেশি। সেলুনে স্বাভাবিক ছাঁট ৪০ টাকা। কেউ যদি ঘাড়-গর্দান দাবিয়ে মাথাটা বানিয়ে নেয়, তার শখানেক টাকা খরচা হতে পারে।
তবে রাজা-বাদশা, আমির-সুলতানদের চুল কাটায় একটু বেশি ব্যয় হবে, তাতে সন্দেহ কী? কিন্তু সেটাই বা কত? দু-চার পাঁচ হাজার টাকা হওয়া স্বাভাবিক।
মুসলিম উম্মার ধনী দেশ ব্রুনাইয়ের সুলতান ঈদের আগে চুল কাটান। দেশীয় নাপিতের চুল ছাঁটা তাঁর পছন্দ নয়। বিলেত থেকে নাপিত আনান। নরসুন্দরের নাম কেন মোডেস্তু (Ken Modestu)। ধর্মে ইহুদি না খ্রিষ্টান, প্রোটেস্ট্যান্ট না ক্যাথলিক জানা যায়নি। তার মজুরি ১৫ হাজার পাউন্ড-স্টার্লিং অর্থাত্ বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৬ লাখ টাকা। কিন্তু তার পেছনে সুলতানের ব্যয় হয়েছে আরও বেশি। সে জন্য সুলতান নন, সোয়াইন ফ্লু দায়ী। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে প্রথম শ্রেণীতে তাঁর টিকিট কেনা হয়েছিল। সুলতানের সভাসদেরা বললেন, হে আলমপনা, সুলতানাতের মালিক, আমাদের সন্দেহ হচ্ছে ওই ফ্লাইটে মি. মোডেস্তুর আশপাশের কোনো আসনে যদি সোয়াইন ফ্লুর রোগী থাকে, তাহলে ওই সংক্রামক ব্যাধির জীবাণু আপনার শরীরেও প্রবেশ করতে পারে। আপনার চুলও বড় হয়ে যাচ্ছে, সামনে ঈদ, এখন কী উপায়?
এয়ারলাইনসের বড় কর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করায় তিনি বললেন, কোনো সমস্যা নেই। সুলতানের জীবন রক্ষায় আমরা যেকোনো ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত। সুলতানের নাপিতের জন্য বিমানে একটি বিশেষ কেবিন করে দেওয়া হবে, যার মধ্যে সোয়াইন ফ্লুর জীবাণুর বাবারও সাধ্য নেই ঢোকে। সে জন্য বাড়তি কিছু টাকা দিতে হবে। ১১ হাজার পাউন্ড-স্টার্লিং অর্থাত্ বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২ লাখ টাকা। সুলতানাতের ওমরাওরা বলেন, এ তো সামান্য টাকা। ওষুধ-টষুধ ছিটিয়ে নাপিতকে ওই কেবিনেই বসিয়ে আনা হোক। অর্থাত্ নরসুন্দরের পেছনে লন্ডন থেকে দারুস সালাম পৌঁছানোর খরচ ২৮ লাখ টাকা। সাত তারা হোটেলে থাকা-খাওয়া, বকশিশ ইত্যাদি বাবদ সবসুদ্ধ এবার ঈদে সুলতানের চুল ছাঁটায় ব্যয় হয়েছে ৫০ লাখ টাকার ওপর।
বিশ্বমিডিয়ায় এ খবর জানার পর থেকে একজন মুসলমান হিসেবে যেমন আনন্দে আত্মহারা হয়েছি, তেমনি ব্যক্তিগতভাবে ধিক্কার জন্মেছে নিজের ওপর। ভাবছি, দিনের পর দিন কলাম রচনায় কলম না গুঁতিয়ে যদি কাঁচি চালিয়ে চুল কাটতে শিখতাম, তাহলে হয়তো কোনো দিন কোনো মুসলমান শাসকের খেউরি করার সুযোগ পেলেও পেতে পারতাম। কোনো সুলতান বা বাদশার বছর দুই চুল কাটতে পারলে ছয় পুরুষ বসে বসে খেতে পারত।
আরেকটি কথাও মনে পড়ছে। ব্রুনাইয়ের সুলতানের চুল কাটতে একেকবারে ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হলে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের খরচ হওয়ার কথা পাঁচ কোটি ডলার, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর (যদি তিনি শিখ না হন) ব্যয় হওয়া উচিত এক কোটি রুপি, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর এক মিলিয়ন পাউন্ড, জার্মান চ্যান্সেলর যদি পুরুষ হন তাঁর হতে পারে ১০ মিলিয়ন মার্ক। সৌদি বাদশার চুল কাটায় কী রকম খরচ হয়, সে সম্পর্কে আমি অনুমান করতে পারব না। তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন, যাঁরা পবিত্র ওমরাহ ও রাজনৈতিক কারণে বছরে কয়েকবার সে দেশে যান।
চুল কাটার ব্যয়ের কথা যাক। এখন বাংলাদেশে ব্রুনাইয়ের সুলতানের ছোট সংস্করণ আছেন অন্তত কয়েক লাখ। তাই জলবায়ুর বৈশ্বিক উষ্ণতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঈদের আগে গরম হয়ে ওঠে দেশের কাপড়চোপড় ও খাদ্যদ্রব্যের বাজার। ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, জাপান, তাইওয়ান থেকে আসা কাপড়চোপড়ে বাংলাদেশের বাজার প্লাবিত। ভারতের শাড়ি, লেহেঙ্গা, সালোয়ার-কামিজ; থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের ব্রা প্রভৃতি; তাইয়ান ও থাইল্যান্ডের জুতা-স্যান্ডেল ছাড়া ঈদ হয় না। ভারতের কোনো কোনো মেয়েদের পোশাক নাকি ২৫ হাজার থেকে এক লাখ ২৫ হাজার টাকায় দেদার বিক্রি হয়েছে। অমিতাভ বচ্চনের পুত্রবধূ অ্যাশ (ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন) যে রকম দামি কাপড় পরেন, ওই রকম কাপড় পরার শখ আমাদের বালিকা থেকে বুড়ির। দুই দোকানদার বললেন, ২৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা রেঞ্জের মধ্যেই শাড়ি ও সালোয়ার-কামিজ বেশি চলেছে।
ঈদের আনন্দ কত রকম, তা বাংলাদেশে জন্মের পর থেকেই দেখছি। ঘটনাক্রমে কয়েকটি ঈদের দিন আমি ছিলাম কলকাতা, দিল্লি, কুয়ালালামপুর, করাচি ও সিঙ্গাপুর। কলকাতা ও দিল্লির দুটি ঈদের দিন আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। সকালবেলা পিলপিল করে যাচ্ছে অগণিত মানুষ ঈদের জামাতে। আমার বারবার মনে হচ্ছিল এই প্রাণীগুলোর নাম নাকি আশরাফুল মুখলুকাত! ধারণা করি, আসল মুসলমান ও সাচ্চা আশরাফুল মুখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব ব্রুনাইয়ের সুলতান ও মধ্যপ্রাচ্যের আমির-ওমরাও-বাদশারা। তাঁদের সঙ্গে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের নতুন আমির-ওমরাওরা।
বাংলাদেশে রোজার ঈদের আনন্দ মাথা থেকে পা পর্যন্ত; কোরবানির ঈদের আনন্দ মুখ ও পেটে। ওই ঈদেও কাপড়চোপড়ের কমতি নেই। সেগুলো পার্শ্ববর্তী সব দেশ থেকেই আসে। কিন্তু আসল জিনিসটা আসে ভারত থেকে; থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা তাইওয়ান থেকে নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ইউরোপের এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেমন জার্মান সৈন্যদল মার্চ করত, তেমনি ভারত থেকে মার্চ করে আসতে থাকে গরু। ১০টি যদি আসে আইন মোতাবেক, ৯০টি আসে স্বাধীনভাবে। ওই গরুগুলোকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলত, ‘আমরা কোনো সীমান্ত মানি না। আমার মানুষ নই। গরুর আবার পাসপোর্ট ভিসা কী?’ ওপার থেকে লেজে মোচড় দিয়ে ওগুলোকে যারা এপার পাঠায় এবং এপারে রাংতার মালা দিয়ে যারা ওদের সাদরে বরণ করে, তারাও সমস্বরে বলে উঠত, ‘আমরাও গরুগুলোর বক্তব্যের সঙ্গে একমত।’
দেশে গবাদিপশুর সংখ্যা এখন সর্বকালের সবচেয়ে কম। কিন্তু ৫০ হাজার থেকে এক লাখ-সোয়া লাখ টাকা দিয়ে কোরবানি দেওয়ার মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। গতবার দেখলাম, ধানমন্ডি মাঠ থেকে ৮৫ হাজার টাকায় একজন একটি প্রকাণ্ড ষাঁড় কিনে জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যে শুধু ধর্মপরায়ণ নন, একজন বড় ধরনের দেশপ্রেমিক, তা-ই হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন। আমি সাহস করে গরুওয়ালাকে কিছু না বলে দুঃসাহস করে র্যাবের সদস্যদের বললাম, ভদ্রলোককে বলুন গরুটির শরীর থেকে জাতীয় পতাকা সরিয়ে ফেলতে। র্যাব পরে কালো কাপড়, আমি পরি সাদা, তারা আমার কথা গ্রাহ্য করবে কেন?
প্রায় প্রতিবার বকরি ঈদের পরদিন থেকে আমাকে দৌড়াতে হয় বিভিন্ন হূদরোগ হাসপাতালে। গিয়ে দেখি, সেখানে মেঝেতেও ঠাঁই নেই। অতি ভরাট পাকস্থলীর চাপে হূদযন্ত্র বিকল। তবু খাওয়া চাই। কারণ ঈদ, মানে আনন্দ।
আমদানিনির্ভর বাংলাদেশ। চাল-চিনি-গম তো হতেই পারে, পরোটা পর্যন্ত আমদানি হচ্ছে মালয়েশিয়া থেকে। ভারত থেকে ডিম। মিয়ানমার থেকে কৃত্রিম ডিম। পাকিস্তান থেকে সেমাই। তবে ভুনা-গোশত ও কাবাবের সব উপাদান ভারত থেকে আসে। শেষ পর্যন্ত ভারত গরু ও উট সাপ্লাই দিয়ে কুলিয়ে উঠবে না। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ডেনমার্ক থেকে শুধু গুঁড়ো দুধ নয়, বিরাট বিরাট কার্গো বিমানে কোরবানির গরু আসা শুরু হলো বলে!
তবে কোরবানির ঈদের একটি লাভজনক দিকও আছে। বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত হয়তো একটি জিনিসই রফতানি করবে। তা হলো কোরবানির গরুর অণ্ডকোষ। শুনেছি, কোরবানির ষাঁড়ের অণ্ডকোষ রপ্তানির পরিমাণ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেড়েছে। ওই জিনিসটির সুপ নাকি ব্যাংকক-হংকংয়ের হোটেল-রেস্তোরাঁর খদ্দেরদের বেজায় প্রিয়। ষাঁড়ের অণ্ডকোষের সুপের নাম শুনলে তাদের জিভে পানি আসে।
মুসলমানদের সঙ্গে খানাপিনা, কাপড়চোপড়, ভোগবিলাস ও অপচয়ে আর কোনো সম্প্রদায় পাল্লা দিয়ে পারবে? আগে কাপড়, খাদ্য ও বিলাসদ্রব্যে ব্যয় করত। এখন যার টাকা আছে সে মাথার চুল ছাঁটতে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে। মুসলমান ধর্মশাস্ত্রে বলা হয়েছে, যে অপব্যয় করে, সে শয়তানের ভাই। এখন তো দেখছি শয়তানের ভাইবেরাদারের সংখ্যা মুসলিম উম্মাতেও কম নেই। মুসলমানপ্রধান দেশগুলোয় প্রাকৃতিক সম্পদ প্রচুর। শিল্পোন্নত দেশগুলোকে সস্তায় কাঁচামাল সরবরাহ করে তারাই। অথচ দুনিয়ায় সবচেয়ে গরিব হলো মুসলমানেরাই—বিত্তে ও বিদ্যায়, ধনে ও জ্ঞানে। বিত্ত নেই, জ্ঞানের চর্চা নেই বলে আজ তারা নির্যাতিত, নিপীড়িত, পদানত।
মুসলমানেরা তো এমনটি ছিল না। সাত থেকে চৌদ্দ শতক পর্যন্ত তারা ছিল শিল্প-সংস্কৃতি-সভ্যতায় সবচেয়ে অগ্রসর। ১৯৫২ সালে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ স্যার আর্নল্ড টোয়েনবি বিবিসিতে দেওয়া তাঁর দেওয়া রীথ বক্তৃতায় (Reith Lectures) ‘ইসলাম অ্যান্ড দ্য ওয়েস্ট’-এ বলেন, ‘কমিউনিজমকে বলা হয় খ্রিষ্টধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী মত। ইসলামও ছিল খ্রিষ্টধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী। কমিউনিজমের মতো ইসলামও তার প্রথম দিকের কর্মসূচিতে তত্কালীন খ্রিষ্টজগতের দুর্নীতি ও অনাচার উচ্ছেদের ভূমিকা গ্রহণ করে সাধারণ মানুষের মন জয় করেছিল। ইসলামের প্রথম যুগের সাফল্য থেকে এটাই প্রমাণিত যে সংস্কারকামী বিরুদ্ধ ধর্ম অন্য ধর্মের গোঁড়ামির ভিত্তিতে আঘাত হেনে কতটা দুর্বার গতিতে সফল হতে পারে, কারণ আক্রান্ত ধর্ম নিজের পথ পরিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়ে টিকে থাকতে পারে না। খ্রিষ্টীয় সাত শতক থেকে আরবের মুসলমানেরা সিরিয়া থেকে উত্তর আফ্রিকা ও স্পেন পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ডকে খ্রিষ্টান গ্রেকো-রোমান আধিপত্য থেকে মুক্তি দিয়েছিল। মহাবীর আলেকজান্ডার যখন পারস্য সাম্রাজ্য জয় করেন এবং রোমানরা কার্থেজ অধিকার করে, তখন থেকে প্রায় হাজার বছর এসব দেশ গ্রিক বা রোমানদের অধিকারে ছিল। তার পর ১১ থেকে ১৬ শতকের মধ্যে মুসলমানেরা গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ জয় করে। ইসলাম ধর্মও শান্তিপূর্ণভাবে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে পরে ইন্দোনেশিয়া ও চীন মহাদেশ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে আফ্রিকার দেশগুলোতে। আমরা দেখেছি, মধ্যযুগের শেষের দিকে রাশিয়াও সাময়িকভাবে মুসলমানদের হস্তগত হয়েছিল। এবং পূর্ব ইউরোপের খ্রিষ্টরাজ্য তুরস্ক ওসমানীয় শাসনে চলে যায়।’
প্রথম পাঁচ-সাত শ বছরের মুসলমানদের সম্পর্কে অমুসলমান ইতিহাসবিদেরা আরও অনেক কথাই লিখেছেন। মুসলমানেরা শুধু ঘোড়া দাবড়িয়ে দেশ জয় করেনি, করেছে অনেক কিছু। বাগদাদে মুসলমানেরা যে সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল, এখনো আমেরিকা সে পর্যায়ে যায়নি। বিশ্বের ইতিহাসে মুসলমানেরাই প্রথম সবচেয়ে বড় পাবলিক লাইব্রেরি গড়ে তোলে বাগদাদে। মুসলমানেরাই প্রথম হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা। চীন ও ভারতবর্ষে ধর্মভিত্তিক বিদ্যাপ্রতিষ্ঠান ছিল, কিন্তু আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনক মুসলমানেরা। আব্বাসীয় খলিফা মামুনের (৮১৩—৩৩) সময় থেকে মুসলমানেরা যে বিজ্ঞান ও দর্শনের চর্চা শুরু করে, তা অব্যাহত ছিল ইতালীয় রেনেসাঁর আগ পর্যন্ত।
আল কিন্দি, আল ফারাবি, আল রাজি, ইবনে সিনা, আল গাজ্জালিদের মতো অসংখ্য দার্শনিক-বিজ্ঞানী; সমরখন্দের আল খোয়ারিজমি বা আল কাশির মতো গণিতবিদ; ওমর খৈয়াম বা নাসিরউদ্দিন আত তুসির মতো কবি ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ইবনে আল হায়তামের মতো পানিবিজ্ঞানী আজ কোথায় মুসলমান দেশগুলোয়?
১৮ শতকের শেষার্ধ থেকে মুসলিম দেশগুলো খ্রিষ্টীয় ইউরোপ দখল করতে থাকে। বাংলায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও জাভায় ডাচ্ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এসে বসে যায়। ওদিকে মিসর, সুদান, মালয়, তিউনিশিয়া, মরোক্কো প্রভৃতি দেশের কোথাও ইংরেজ, কোথাও ওলন্দাজ, কোথাও ফরাসি, কোথাও স্পেনিয়ার্ডরা গিয়ে গ্যাট হয়ে বসে। ২০ শতক থেকে তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে আমেরিকার নয়া সাম্রাজ্যবাদ।
তবে মুসলমানদের ক্ষতি অমুসলমানেরা যত না করেছে, তার চেয়ে ঢের বেশি করেছে মুসলমান শাসকেরা নিজেরাই। তাঁদের কাছে মাথার চুলই গুরুত্বপূর্ণ, মগজ নয়। তাই লন্ডন থেকে নাপিত এনে প্রতিবার ৫০ লাখ টাকা করে বছরে তিন কোটি টাকা চুল কাটায় ব্যয় করেন। তা না করে লন্ডন থেকে প্রকাশিত বার্নার্ড লুইস লিখিত-সম্পাদিত ইসলাম-এর মতো একটি বই যদি কোনো মুসলমান দেশ প্রকাশ করত, তার শাসককে কুর্নিশ করতাম। বিজ্ঞান, চিকিত্সা বিজ্ঞান বা শিল্পচর্চায় মুসলিম দেশগুলো পিছিয়ে। অনেক দিন থেকেই মুসলমানজগতে তত্ত্বজ্ঞানী নেই, দার্শনিক নেই, পদার্থবিজ্ঞানী নেই, বড় শিল্পী-সাহিত্যিক নেই। এখন দেখছি ভালো নাপিত পর্যন্ত নেই। বিত্তবান মুসলমানদের বিমারি হলে তার চিকিত্সা করে অমুসলমান হেকিম, চুল বড় হলে কাটে অমুসলমান নাপিত। মুসলমানেরা জানে না, মাথার সুন্দর চুলের চেয়ে ভালো মগজটার মূল্য বেশি। এই স্বভাবের বদল না হলে মুসলমানদের ধ্বংস অনিবার্য।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
মুসলিম উম্মার কারও কারও কীর্তি দেখে একজন মুসলমান হিসেবে মাঝেমধ্যে গর্বে বুক ১০ হাত উঁচু হয়। অন্য কোনো ধর্মের কোনো ব্যক্তি বা শাসক যা পারেন না, একজন মুসলমান তা পারেন। সে জন্যই আমাদের অহঙ্কার। ব্রুনাইয়ের সুলতান বিশ্বের বিরাট শাসনকর্তা। তাঁর প্রাসাদের মতো প্রাসাদ স্পেনের মুসলমান শাসকদের তাঁদের সেই স্বর্ণকালেও ছিল না। শত শত প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট প্রাসাদের হাম্মামখানার পানির কলগুলো খাঁটি গিনি সোনার; কোনো কমদামি ধাতুর নয়।
প্রধান ধর্মীয় উত্সবের আগে মানুষ চুল-দাড়ি ছেঁটে ছিমছাম পরিপাটি হয়। ছোটবেলায় আমরা দেখেছি, ঈদের দু-চার দিন আগে নাপিত খেউরি করার জন্য আমাদের বাড়ি আসত। ক্ষৌরকারও ছিল বংশানুক্রমিক। কোনো সময় তাদের খানিকটা জমি দিয়ে দেওয়া হতো, বিনিময়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা বাড়িশুদ্ধ লোকের চুল কাটত। তবে ঈদ বা পূজার সময় নাপিত একখানা ধুতি এবং তার স্ত্রীর জন্য একটা সস্তা শাড়ি পেত। এখন আর সেই সামাজিক অবস্থা নেই। এখন সেলুনে গিয়ে মানুষ চুল কেটে আসে। ইচ্ছা হলে বকশিশ দেয়। তবে বাংলাদেশের মতো দেশে ১০-১২ টাকা দিয়ে বাটিছাঁট দেওয়ার মানুষই বেশি। সেলুনে স্বাভাবিক ছাঁট ৪০ টাকা। কেউ যদি ঘাড়-গর্দান দাবিয়ে মাথাটা বানিয়ে নেয়, তার শখানেক টাকা খরচা হতে পারে।
তবে রাজা-বাদশা, আমির-সুলতানদের চুল কাটায় একটু বেশি ব্যয় হবে, তাতে সন্দেহ কী? কিন্তু সেটাই বা কত? দু-চার পাঁচ হাজার টাকা হওয়া স্বাভাবিক।
মুসলিম উম্মার ধনী দেশ ব্রুনাইয়ের সুলতান ঈদের আগে চুল কাটান। দেশীয় নাপিতের চুল ছাঁটা তাঁর পছন্দ নয়। বিলেত থেকে নাপিত আনান। নরসুন্দরের নাম কেন মোডেস্তু (Ken Modestu)। ধর্মে ইহুদি না খ্রিষ্টান, প্রোটেস্ট্যান্ট না ক্যাথলিক জানা যায়নি। তার মজুরি ১৫ হাজার পাউন্ড-স্টার্লিং অর্থাত্ বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৬ লাখ টাকা। কিন্তু তার পেছনে সুলতানের ব্যয় হয়েছে আরও বেশি। সে জন্য সুলতান নন, সোয়াইন ফ্লু দায়ী। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে প্রথম শ্রেণীতে তাঁর টিকিট কেনা হয়েছিল। সুলতানের সভাসদেরা বললেন, হে আলমপনা, সুলতানাতের মালিক, আমাদের সন্দেহ হচ্ছে ওই ফ্লাইটে মি. মোডেস্তুর আশপাশের কোনো আসনে যদি সোয়াইন ফ্লুর রোগী থাকে, তাহলে ওই সংক্রামক ব্যাধির জীবাণু আপনার শরীরেও প্রবেশ করতে পারে। আপনার চুলও বড় হয়ে যাচ্ছে, সামনে ঈদ, এখন কী উপায়?
এয়ারলাইনসের বড় কর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করায় তিনি বললেন, কোনো সমস্যা নেই। সুলতানের জীবন রক্ষায় আমরা যেকোনো ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত। সুলতানের নাপিতের জন্য বিমানে একটি বিশেষ কেবিন করে দেওয়া হবে, যার মধ্যে সোয়াইন ফ্লুর জীবাণুর বাবারও সাধ্য নেই ঢোকে। সে জন্য বাড়তি কিছু টাকা দিতে হবে। ১১ হাজার পাউন্ড-স্টার্লিং অর্থাত্ বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২ লাখ টাকা। সুলতানাতের ওমরাওরা বলেন, এ তো সামান্য টাকা। ওষুধ-টষুধ ছিটিয়ে নাপিতকে ওই কেবিনেই বসিয়ে আনা হোক। অর্থাত্ নরসুন্দরের পেছনে লন্ডন থেকে দারুস সালাম পৌঁছানোর খরচ ২৮ লাখ টাকা। সাত তারা হোটেলে থাকা-খাওয়া, বকশিশ ইত্যাদি বাবদ সবসুদ্ধ এবার ঈদে সুলতানের চুল ছাঁটায় ব্যয় হয়েছে ৫০ লাখ টাকার ওপর।
বিশ্বমিডিয়ায় এ খবর জানার পর থেকে একজন মুসলমান হিসেবে যেমন আনন্দে আত্মহারা হয়েছি, তেমনি ব্যক্তিগতভাবে ধিক্কার জন্মেছে নিজের ওপর। ভাবছি, দিনের পর দিন কলাম রচনায় কলম না গুঁতিয়ে যদি কাঁচি চালিয়ে চুল কাটতে শিখতাম, তাহলে হয়তো কোনো দিন কোনো মুসলমান শাসকের খেউরি করার সুযোগ পেলেও পেতে পারতাম। কোনো সুলতান বা বাদশার বছর দুই চুল কাটতে পারলে ছয় পুরুষ বসে বসে খেতে পারত।
আরেকটি কথাও মনে পড়ছে। ব্রুনাইয়ের সুলতানের চুল কাটতে একেকবারে ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হলে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের খরচ হওয়ার কথা পাঁচ কোটি ডলার, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর (যদি তিনি শিখ না হন) ব্যয় হওয়া উচিত এক কোটি রুপি, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর এক মিলিয়ন পাউন্ড, জার্মান চ্যান্সেলর যদি পুরুষ হন তাঁর হতে পারে ১০ মিলিয়ন মার্ক। সৌদি বাদশার চুল কাটায় কী রকম খরচ হয়, সে সম্পর্কে আমি অনুমান করতে পারব না। তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন, যাঁরা পবিত্র ওমরাহ ও রাজনৈতিক কারণে বছরে কয়েকবার সে দেশে যান।
চুল কাটার ব্যয়ের কথা যাক। এখন বাংলাদেশে ব্রুনাইয়ের সুলতানের ছোট সংস্করণ আছেন অন্তত কয়েক লাখ। তাই জলবায়ুর বৈশ্বিক উষ্ণতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঈদের আগে গরম হয়ে ওঠে দেশের কাপড়চোপড় ও খাদ্যদ্রব্যের বাজার। ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, জাপান, তাইওয়ান থেকে আসা কাপড়চোপড়ে বাংলাদেশের বাজার প্লাবিত। ভারতের শাড়ি, লেহেঙ্গা, সালোয়ার-কামিজ; থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের ব্রা প্রভৃতি; তাইয়ান ও থাইল্যান্ডের জুতা-স্যান্ডেল ছাড়া ঈদ হয় না। ভারতের কোনো কোনো মেয়েদের পোশাক নাকি ২৫ হাজার থেকে এক লাখ ২৫ হাজার টাকায় দেদার বিক্রি হয়েছে। অমিতাভ বচ্চনের পুত্রবধূ অ্যাশ (ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন) যে রকম দামি কাপড় পরেন, ওই রকম কাপড় পরার শখ আমাদের বালিকা থেকে বুড়ির। দুই দোকানদার বললেন, ২৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা রেঞ্জের মধ্যেই শাড়ি ও সালোয়ার-কামিজ বেশি চলেছে।
ঈদের আনন্দ কত রকম, তা বাংলাদেশে জন্মের পর থেকেই দেখছি। ঘটনাক্রমে কয়েকটি ঈদের দিন আমি ছিলাম কলকাতা, দিল্লি, কুয়ালালামপুর, করাচি ও সিঙ্গাপুর। কলকাতা ও দিল্লির দুটি ঈদের দিন আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। সকালবেলা পিলপিল করে যাচ্ছে অগণিত মানুষ ঈদের জামাতে। আমার বারবার মনে হচ্ছিল এই প্রাণীগুলোর নাম নাকি আশরাফুল মুখলুকাত! ধারণা করি, আসল মুসলমান ও সাচ্চা আশরাফুল মুখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব ব্রুনাইয়ের সুলতান ও মধ্যপ্রাচ্যের আমির-ওমরাও-বাদশারা। তাঁদের সঙ্গে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের নতুন আমির-ওমরাওরা।
বাংলাদেশে রোজার ঈদের আনন্দ মাথা থেকে পা পর্যন্ত; কোরবানির ঈদের আনন্দ মুখ ও পেটে। ওই ঈদেও কাপড়চোপড়ের কমতি নেই। সেগুলো পার্শ্ববর্তী সব দেশ থেকেই আসে। কিন্তু আসল জিনিসটা আসে ভারত থেকে; থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা তাইওয়ান থেকে নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ইউরোপের এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেমন জার্মান সৈন্যদল মার্চ করত, তেমনি ভারত থেকে মার্চ করে আসতে থাকে গরু। ১০টি যদি আসে আইন মোতাবেক, ৯০টি আসে স্বাধীনভাবে। ওই গরুগুলোকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলত, ‘আমরা কোনো সীমান্ত মানি না। আমার মানুষ নই। গরুর আবার পাসপোর্ট ভিসা কী?’ ওপার থেকে লেজে মোচড় দিয়ে ওগুলোকে যারা এপার পাঠায় এবং এপারে রাংতার মালা দিয়ে যারা ওদের সাদরে বরণ করে, তারাও সমস্বরে বলে উঠত, ‘আমরাও গরুগুলোর বক্তব্যের সঙ্গে একমত।’
দেশে গবাদিপশুর সংখ্যা এখন সর্বকালের সবচেয়ে কম। কিন্তু ৫০ হাজার থেকে এক লাখ-সোয়া লাখ টাকা দিয়ে কোরবানি দেওয়ার মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। গতবার দেখলাম, ধানমন্ডি মাঠ থেকে ৮৫ হাজার টাকায় একজন একটি প্রকাণ্ড ষাঁড় কিনে জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যে শুধু ধর্মপরায়ণ নন, একজন বড় ধরনের দেশপ্রেমিক, তা-ই হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন। আমি সাহস করে গরুওয়ালাকে কিছু না বলে দুঃসাহস করে র্যাবের সদস্যদের বললাম, ভদ্রলোককে বলুন গরুটির শরীর থেকে জাতীয় পতাকা সরিয়ে ফেলতে। র্যাব পরে কালো কাপড়, আমি পরি সাদা, তারা আমার কথা গ্রাহ্য করবে কেন?
প্রায় প্রতিবার বকরি ঈদের পরদিন থেকে আমাকে দৌড়াতে হয় বিভিন্ন হূদরোগ হাসপাতালে। গিয়ে দেখি, সেখানে মেঝেতেও ঠাঁই নেই। অতি ভরাট পাকস্থলীর চাপে হূদযন্ত্র বিকল। তবু খাওয়া চাই। কারণ ঈদ, মানে আনন্দ।
আমদানিনির্ভর বাংলাদেশ। চাল-চিনি-গম তো হতেই পারে, পরোটা পর্যন্ত আমদানি হচ্ছে মালয়েশিয়া থেকে। ভারত থেকে ডিম। মিয়ানমার থেকে কৃত্রিম ডিম। পাকিস্তান থেকে সেমাই। তবে ভুনা-গোশত ও কাবাবের সব উপাদান ভারত থেকে আসে। শেষ পর্যন্ত ভারত গরু ও উট সাপ্লাই দিয়ে কুলিয়ে উঠবে না। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ডেনমার্ক থেকে শুধু গুঁড়ো দুধ নয়, বিরাট বিরাট কার্গো বিমানে কোরবানির গরু আসা শুরু হলো বলে!
তবে কোরবানির ঈদের একটি লাভজনক দিকও আছে। বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত হয়তো একটি জিনিসই রফতানি করবে। তা হলো কোরবানির গরুর অণ্ডকোষ। শুনেছি, কোরবানির ষাঁড়ের অণ্ডকোষ রপ্তানির পরিমাণ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেড়েছে। ওই জিনিসটির সুপ নাকি ব্যাংকক-হংকংয়ের হোটেল-রেস্তোরাঁর খদ্দেরদের বেজায় প্রিয়। ষাঁড়ের অণ্ডকোষের সুপের নাম শুনলে তাদের জিভে পানি আসে।
মুসলমানদের সঙ্গে খানাপিনা, কাপড়চোপড়, ভোগবিলাস ও অপচয়ে আর কোনো সম্প্রদায় পাল্লা দিয়ে পারবে? আগে কাপড়, খাদ্য ও বিলাসদ্রব্যে ব্যয় করত। এখন যার টাকা আছে সে মাথার চুল ছাঁটতে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে। মুসলমান ধর্মশাস্ত্রে বলা হয়েছে, যে অপব্যয় করে, সে শয়তানের ভাই। এখন তো দেখছি শয়তানের ভাইবেরাদারের সংখ্যা মুসলিম উম্মাতেও কম নেই। মুসলমানপ্রধান দেশগুলোয় প্রাকৃতিক সম্পদ প্রচুর। শিল্পোন্নত দেশগুলোকে সস্তায় কাঁচামাল সরবরাহ করে তারাই। অথচ দুনিয়ায় সবচেয়ে গরিব হলো মুসলমানেরাই—বিত্তে ও বিদ্যায়, ধনে ও জ্ঞানে। বিত্ত নেই, জ্ঞানের চর্চা নেই বলে আজ তারা নির্যাতিত, নিপীড়িত, পদানত।
মুসলমানেরা তো এমনটি ছিল না। সাত থেকে চৌদ্দ শতক পর্যন্ত তারা ছিল শিল্প-সংস্কৃতি-সভ্যতায় সবচেয়ে অগ্রসর। ১৯৫২ সালে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ স্যার আর্নল্ড টোয়েনবি বিবিসিতে দেওয়া তাঁর দেওয়া রীথ বক্তৃতায় (Reith Lectures) ‘ইসলাম অ্যান্ড দ্য ওয়েস্ট’-এ বলেন, ‘কমিউনিজমকে বলা হয় খ্রিষ্টধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী মত। ইসলামও ছিল খ্রিষ্টধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী। কমিউনিজমের মতো ইসলামও তার প্রথম দিকের কর্মসূচিতে তত্কালীন খ্রিষ্টজগতের দুর্নীতি ও অনাচার উচ্ছেদের ভূমিকা গ্রহণ করে সাধারণ মানুষের মন জয় করেছিল। ইসলামের প্রথম যুগের সাফল্য থেকে এটাই প্রমাণিত যে সংস্কারকামী বিরুদ্ধ ধর্ম অন্য ধর্মের গোঁড়ামির ভিত্তিতে আঘাত হেনে কতটা দুর্বার গতিতে সফল হতে পারে, কারণ আক্রান্ত ধর্ম নিজের পথ পরিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়ে টিকে থাকতে পারে না। খ্রিষ্টীয় সাত শতক থেকে আরবের মুসলমানেরা সিরিয়া থেকে উত্তর আফ্রিকা ও স্পেন পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ডকে খ্রিষ্টান গ্রেকো-রোমান আধিপত্য থেকে মুক্তি দিয়েছিল। মহাবীর আলেকজান্ডার যখন পারস্য সাম্রাজ্য জয় করেন এবং রোমানরা কার্থেজ অধিকার করে, তখন থেকে প্রায় হাজার বছর এসব দেশ গ্রিক বা রোমানদের অধিকারে ছিল। তার পর ১১ থেকে ১৬ শতকের মধ্যে মুসলমানেরা গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ জয় করে। ইসলাম ধর্মও শান্তিপূর্ণভাবে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে পরে ইন্দোনেশিয়া ও চীন মহাদেশ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে আফ্রিকার দেশগুলোতে। আমরা দেখেছি, মধ্যযুগের শেষের দিকে রাশিয়াও সাময়িকভাবে মুসলমানদের হস্তগত হয়েছিল। এবং পূর্ব ইউরোপের খ্রিষ্টরাজ্য তুরস্ক ওসমানীয় শাসনে চলে যায়।’
প্রথম পাঁচ-সাত শ বছরের মুসলমানদের সম্পর্কে অমুসলমান ইতিহাসবিদেরা আরও অনেক কথাই লিখেছেন। মুসলমানেরা শুধু ঘোড়া দাবড়িয়ে দেশ জয় করেনি, করেছে অনেক কিছু। বাগদাদে মুসলমানেরা যে সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল, এখনো আমেরিকা সে পর্যায়ে যায়নি। বিশ্বের ইতিহাসে মুসলমানেরাই প্রথম সবচেয়ে বড় পাবলিক লাইব্রেরি গড়ে তোলে বাগদাদে। মুসলমানেরাই প্রথম হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা। চীন ও ভারতবর্ষে ধর্মভিত্তিক বিদ্যাপ্রতিষ্ঠান ছিল, কিন্তু আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনক মুসলমানেরা। আব্বাসীয় খলিফা মামুনের (৮১৩—৩৩) সময় থেকে মুসলমানেরা যে বিজ্ঞান ও দর্শনের চর্চা শুরু করে, তা অব্যাহত ছিল ইতালীয় রেনেসাঁর আগ পর্যন্ত।
আল কিন্দি, আল ফারাবি, আল রাজি, ইবনে সিনা, আল গাজ্জালিদের মতো অসংখ্য দার্শনিক-বিজ্ঞানী; সমরখন্দের আল খোয়ারিজমি বা আল কাশির মতো গণিতবিদ; ওমর খৈয়াম বা নাসিরউদ্দিন আত তুসির মতো কবি ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ইবনে আল হায়তামের মতো পানিবিজ্ঞানী আজ কোথায় মুসলমান দেশগুলোয়?
১৮ শতকের শেষার্ধ থেকে মুসলিম দেশগুলো খ্রিষ্টীয় ইউরোপ দখল করতে থাকে। বাংলায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও জাভায় ডাচ্ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এসে বসে যায়। ওদিকে মিসর, সুদান, মালয়, তিউনিশিয়া, মরোক্কো প্রভৃতি দেশের কোথাও ইংরেজ, কোথাও ওলন্দাজ, কোথাও ফরাসি, কোথাও স্পেনিয়ার্ডরা গিয়ে গ্যাট হয়ে বসে। ২০ শতক থেকে তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে আমেরিকার নয়া সাম্রাজ্যবাদ।
তবে মুসলমানদের ক্ষতি অমুসলমানেরা যত না করেছে, তার চেয়ে ঢের বেশি করেছে মুসলমান শাসকেরা নিজেরাই। তাঁদের কাছে মাথার চুলই গুরুত্বপূর্ণ, মগজ নয়। তাই লন্ডন থেকে নাপিত এনে প্রতিবার ৫০ লাখ টাকা করে বছরে তিন কোটি টাকা চুল কাটায় ব্যয় করেন। তা না করে লন্ডন থেকে প্রকাশিত বার্নার্ড লুইস লিখিত-সম্পাদিত ইসলাম-এর মতো একটি বই যদি কোনো মুসলমান দেশ প্রকাশ করত, তার শাসককে কুর্নিশ করতাম। বিজ্ঞান, চিকিত্সা বিজ্ঞান বা শিল্পচর্চায় মুসলিম দেশগুলো পিছিয়ে। অনেক দিন থেকেই মুসলমানজগতে তত্ত্বজ্ঞানী নেই, দার্শনিক নেই, পদার্থবিজ্ঞানী নেই, বড় শিল্পী-সাহিত্যিক নেই। এখন দেখছি ভালো নাপিত পর্যন্ত নেই। বিত্তবান মুসলমানদের বিমারি হলে তার চিকিত্সা করে অমুসলমান হেকিম, চুল বড় হলে কাটে অমুসলমান নাপিত। মুসলমানেরা জানে না, মাথার সুন্দর চুলের চেয়ে ভালো মগজটার মূল্য বেশি। এই স্বভাবের বদল না হলে মুসলমানদের ধ্বংস অনিবার্য।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments