একটি রেফারেন্স ও প্রজাতন্ত্রে মেধার দৈন্য by মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী,পেনসিলভানিয়া,যুক্তরাষ্ট্র
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে নারকীয় হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কিত ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে নিসন্দেহে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষী এবং তাদের মদদদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিটি জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়। কিন্তু বিদ্রোহীদের বিচার বিডিআর, সেনা আইন, নাকি প্রচলিত সাধারণ আইনে হবে, তা নিয়ে দেশব্যাপী সৃষ্টি হয় এক অনাকাঙ্ক্ষিত ধূম্রজালের। এই উদ্ভূত পরিস্থিতির জটিলতা এড়ানোর প্রয়াসে সরকার রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টে রেফারেন্স পাঠিয়ে মতামত চান এবং সুপ্রিম কোর্ট ১১ জন এমিকাস কিউরির মতামতের ভিত্তিতে প্রচলিত আইনে বিচারের পক্ষে মত দেন।
মিজানুর রহমান খান ২৮ সেপ্টেম্বরের প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে ‘রাষ্টপতির রেফারেন্স ও সেকেলে সামরিক বিচার’ শীর্ষক সরল গরল নিবন্ধে যে ব্যাপক তথ্য-উপাত্ত, উদাহরণ ও উদ্বৃতির সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন, তাকে এককথায় চমত্কারই বলতে হয়। তিনি রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সের অপরিপক্বতা, এমিকাস কিউরিদের ঔপনিবেশিক আমলে চাপিয়ে দেওয়া সেনা আইনের যুগোপযোগিতা অনুধাবনের অক্ষমতা কিংবা জবরদস্তিমূলক কাঠামোর প্রতি আনুগত্য, বিডিআর আইনের অসম্পূর্ণতা, প্রজাতন্ত্রের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত কর্মচারীদের মানবাধিকারের প্রশ্ন তুলে পুরো সিস্টেমের অন্তর্নিহিত গলদকে যথার্থই পরস্ফুিট করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি ব্রিটিশ প্রণীত সেনা আইনের অমানবিক চরিত্র উদ্ঘাটন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘২৫০ বছরের পুরোনো সেনা আইনটির উত্স ছিল বিদ্রোহ দমন। ভারতবর্ষ ও দক্ষিণ আটলান্টিক সমুদ্রের দ্বীপ হেলেনার জন্য তা প্রযোজ্য ছিল। ইউরোপীয় ভাবধারায় প্রণীত আমাদের সেনা আইনের গায়ে ঔপনিবেশিক শাসনের গন্ধ তাই প্রকট।’ স্বাধীনতা অর্জন করলেও আমরা ঔপনিবেশিক আমলের চাপিয়ে দেওয়া আইনেই দেশ পরিচালনা করছি।
মিজানুর রহমান খান মূলত পিলখানা হত্যাকাণ্ডে দোষীদের বিচারের ক্ষেত্রে ‘প্রিন্সিপল অব ন্যাচারাল জাস্টিস’ বাস্তবায়নে রাষ্ট্র কতটুকু আন্তরিক, তার চিত্র উন্মোচন করতে গিয়ে বিদ্যমান মানবতাবিরোধী কোর্ট মার্শালের যুক্তিহীনতা তুলে ধরেছেন। কারণ, প্রচলিত সেনা আইনের আলোকে বিডিআর বিদ্রোহীদের বিচারের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টে অজ্ঞতায় পরিপূর্ণ রেফারেন্স পাঠিয়েছিলেন, যা ছিল পরস্পরবিরোধী। সেনা আইনে বিচার করা না গেলে সেনা আইনের ৫(২) ধারায় প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়ে মতামত চাওয়াটা সর্বতোভাবে দণ্ডবিধি সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচায়ক। তা ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট নিয়োজিত এমিকাস কিউরিরা কর্তৃক বিদ্যমান সেনা আইনের যুগ অনুপযোগিতা বিবেচনায় নিয়ে মানবতাবিরোধী কোর্ট মার্শাল-ব্যবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে আইন সংস্কারের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিলো তা মেধাহীনতা শুধু নয়, ক্ষমতাভোগী, ক্ষমতালোভী ও ক্ষমতার সুবিধাভোগী আইনবিদ ও রাজনীতিবিদদের ভবিষ্যত্ স্বার্থের নীলনকশায় পরাভূত হয়েছে।
জনাব খান ভারত, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সেনা আইনের পরিবর্তনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করে বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের মেধাহীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সুশীল সমাজ ও আইনবিদদের হীন স্বার্থান্ধতা, উপনিবেশপ্রিয়তা ও মেরুদণ্ডহীনতাকে দেশবাসীর সামনে তুলে অপরিসীম উপকার করেছেন।
বিডিআর বিদ্রোহের সুষ্ঠু বিচার আমাদের সবারই দাবি। জাতির অস্তিত্বের স্বার্থেই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন এবং তা দ্রুতই হওয়া উচিত। কিন্তু ঘৃণ্য অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হোক না কেন, প্রজাতন্ত্রের সব নাগরিকের মতো সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদেরও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। তাদের দিতে হবে আপিল করার সুযোগ। রাষ্ট্রের প্রতিটি পর্যায়ে মানবাধিকার সমুন্নত রাখা না হলে বাঙালি জাতির গণতন্ত্রের স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে।
msiddiquee@aol.com
মিজানুর রহমান খান ২৮ সেপ্টেম্বরের প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে ‘রাষ্টপতির রেফারেন্স ও সেকেলে সামরিক বিচার’ শীর্ষক সরল গরল নিবন্ধে যে ব্যাপক তথ্য-উপাত্ত, উদাহরণ ও উদ্বৃতির সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন, তাকে এককথায় চমত্কারই বলতে হয়। তিনি রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সের অপরিপক্বতা, এমিকাস কিউরিদের ঔপনিবেশিক আমলে চাপিয়ে দেওয়া সেনা আইনের যুগোপযোগিতা অনুধাবনের অক্ষমতা কিংবা জবরদস্তিমূলক কাঠামোর প্রতি আনুগত্য, বিডিআর আইনের অসম্পূর্ণতা, প্রজাতন্ত্রের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত কর্মচারীদের মানবাধিকারের প্রশ্ন তুলে পুরো সিস্টেমের অন্তর্নিহিত গলদকে যথার্থই পরস্ফুিট করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি ব্রিটিশ প্রণীত সেনা আইনের অমানবিক চরিত্র উদ্ঘাটন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘২৫০ বছরের পুরোনো সেনা আইনটির উত্স ছিল বিদ্রোহ দমন। ভারতবর্ষ ও দক্ষিণ আটলান্টিক সমুদ্রের দ্বীপ হেলেনার জন্য তা প্রযোজ্য ছিল। ইউরোপীয় ভাবধারায় প্রণীত আমাদের সেনা আইনের গায়ে ঔপনিবেশিক শাসনের গন্ধ তাই প্রকট।’ স্বাধীনতা অর্জন করলেও আমরা ঔপনিবেশিক আমলের চাপিয়ে দেওয়া আইনেই দেশ পরিচালনা করছি।
মিজানুর রহমান খান মূলত পিলখানা হত্যাকাণ্ডে দোষীদের বিচারের ক্ষেত্রে ‘প্রিন্সিপল অব ন্যাচারাল জাস্টিস’ বাস্তবায়নে রাষ্ট্র কতটুকু আন্তরিক, তার চিত্র উন্মোচন করতে গিয়ে বিদ্যমান মানবতাবিরোধী কোর্ট মার্শালের যুক্তিহীনতা তুলে ধরেছেন। কারণ, প্রচলিত সেনা আইনের আলোকে বিডিআর বিদ্রোহীদের বিচারের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টে অজ্ঞতায় পরিপূর্ণ রেফারেন্স পাঠিয়েছিলেন, যা ছিল পরস্পরবিরোধী। সেনা আইনে বিচার করা না গেলে সেনা আইনের ৫(২) ধারায় প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়ে মতামত চাওয়াটা সর্বতোভাবে দণ্ডবিধি সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচায়ক। তা ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট নিয়োজিত এমিকাস কিউরিরা কর্তৃক বিদ্যমান সেনা আইনের যুগ অনুপযোগিতা বিবেচনায় নিয়ে মানবতাবিরোধী কোর্ট মার্শাল-ব্যবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে আইন সংস্কারের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিলো তা মেধাহীনতা শুধু নয়, ক্ষমতাভোগী, ক্ষমতালোভী ও ক্ষমতার সুবিধাভোগী আইনবিদ ও রাজনীতিবিদদের ভবিষ্যত্ স্বার্থের নীলনকশায় পরাভূত হয়েছে।
জনাব খান ভারত, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সেনা আইনের পরিবর্তনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করে বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের মেধাহীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সুশীল সমাজ ও আইনবিদদের হীন স্বার্থান্ধতা, উপনিবেশপ্রিয়তা ও মেরুদণ্ডহীনতাকে দেশবাসীর সামনে তুলে অপরিসীম উপকার করেছেন।
বিডিআর বিদ্রোহের সুষ্ঠু বিচার আমাদের সবারই দাবি। জাতির অস্তিত্বের স্বার্থেই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন এবং তা দ্রুতই হওয়া উচিত। কিন্তু ঘৃণ্য অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হোক না কেন, প্রজাতন্ত্রের সব নাগরিকের মতো সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদেরও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। তাদের দিতে হবে আপিল করার সুযোগ। রাষ্ট্রের প্রতিটি পর্যায়ে মানবাধিকার সমুন্নত রাখা না হলে বাঙালি জাতির গণতন্ত্রের স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে।
msiddiquee@aol.com
No comments