পিএসসি-২০০৮: সহজ পাঠ by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী

গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালে বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলে প্রাকৃতিক জ্বালানি (বিজ্ঞানের অভিধানে হাইড্রোকার্বন) অনুসন্ধান এবং আবিষ্কৃত হলে উত্তোলনসংক্রান্ত একটি চুক্তিপত্র তৈরি করা হয়। এই চুক্তিপত্রেই তার নাম দেওয়া হয় ‘প্রোডাকশন শেয়ারিং কনট্রাক্ট’, যার সংক্ষিপ্ত নাম ‘পিএসসি-২০০৮’; যেটা এই লেখার শিরোনামের প্রথমাংশ এবং চুক্তিটির সহজ পাঠ এই লেখাটির বিষয়বস্তু। মূল চুক্তিপত্রটি এ-ফোর সাইজের ৭৩ পৃষ্ঠা এবং তাতে ৩৫টি অনুচ্ছেদ আছে এবং প্রতিটি অনুচ্ছেদে অনেক ধারা ও সেগুলোর অনেকটিরই উপধারা আছে, এই লেখায় চুক্তিপত্রটির আদ্যোপান্ত আলোচনা করা যাবে না। সে জন্য লিখতে হবে শতাধিক পৃষ্ঠার পুস্তক। লেখাটি অতি সংক্ষিপ্ত সহজ পাঠ এবং তাতেই চুক্তিপত্রটির অন্যায্য ও জনস্বার্থবিরোধী চরিত্র দিবালোকের মতো স্পষ্ট হবে এবং প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, এতে আপনার ক্ষোভ আর ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ যে ঘটবে, সেটি আমি নিশ্চিত।
জ্বালানির সংজ্ঞা
চুক্তিপত্রটিতে লিখিত জ্বালানির সংজ্ঞা একই ধরনের হলেও সম্পূর্ণ এক নয়, যা হওয়া সঠিক হতো এবং সেখানেই প্যাঁচটি। ‘অভীষ্ট লক্ষ্য’ শিরোনামের ২ অনুচ্ছেদের ১ ধারায় বলা আছে, এই চুক্তিপত্রের উদ্দেশ্য ‘পেট্রোলিয়াম’ অনুসন্ধান করা। ‘সংজ্ঞাসমূহ’ শিরোনামের ১ অনুচ্ছেদের ৬৪ ধারায় বলা আছে, ‘পেট্রোলিয়াম’ অর্থ ‘হাইড্রোকার্বন’, সেটা গ্যাসীয় কিংবা তরল কিংবা নিরেট অবস্থায় থাকতে পারে। একই অনুচ্ছেদের ৪৯ ধারায় বলা আছে, ‘তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস’ অর্থ মাইনাস ১৬১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে তরলীকৃত প্রধানত মিথেন গ্যাস। এখানে আমাদের জানা জরুরি, মিথেন গ্যাস একজাতীয় হাইড্রোকার্বন। গ্রামের বদ্ধ জলাশয়ের বাতাসে রাতে আচমকা যে আগুন জ্বলে ওঠে, যাকে আলেয়া বলি, সেটাই বাতাসের স্পর্শে জ্বলে ওঠা মিথেন গ্যাসের বুদ্বুদ। ‘প্রাকৃতিক গ্যাস’ শিরোনামের ১৫ অনুচ্ছেদের ৫ ধারার (গ) উপধারার অর্থ পেট্রোবাংলা অনুসন্ধানে পাওয়া প্রাকৃতিক গ্যাসের লভ্যাংশ পাবে। তাহলে কি সন্দেহ হয় না যে তরল হাইড্রোকার্বন, যার সহজ নাম পেট্রোলিয়াম, চুক্তির অন্তর্ভুক্ত কূপে পাওয়া গেলে বাংলাদেশ সেটা পাবে না? এই সন্দেহ আরও বেড়ে যায়, যদি ১ অনুচ্ছেদের ৫৮ ধারা পড়া যায়; যেখানে বলা আছে, ‘অয়েল অর্থাত্ তেল বলতে বোঝাবে তরল অবস্থায় হাইড্রোকার্বন, যার সাধারণ পরিচিতি অশোধিত তেল এবং যার অন্তর্ভুক্ত অশোধিত খনিজ তেল, অ্যাসফ্যাল্ট, ওজোকারাইট, বিটুমিন—কঠিন ও তরল উভয় অবস্থায়।’
ভাগাভাগি
প্রাকৃতিক গ্যাস শিরোনামের ১৫ অনুচ্ছেদের ৫ ধারার উল্লেখ এর আগে করেছি। এটি ভাগাভাগির অনুচ্ছেদ এবং গভীরভাবে লক্ষ করার বিষয়টি হচ্ছে অনুচ্ছেদটির শিরোনাম করা উচিত ছিল, ‘পেট্রোলিয়াম’, কিন্তু সেটা না করে লেখা হয়েছে ‘প্রাকৃতিক গ্যাস’। এর আগে বলেছি, চুক্তিপত্রে প্রাকৃতিক গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামের কী অর্থ বা সংজ্ঞা দেওয়া আছে। ১৫ অনুচ্ছেদের শিরোনাম ওই সংজ্ঞা দুটি ও ১৫ অনুচ্ছেদের ৫ ধারার ১ উপধারা একত্রে বিবেচনা করলে এই চাতুরিটি সহজেই ধরা পড়বে যে চুক্তিভুক্ত কূপে যত রকমই খনিজ পদার্থ পাওয়া যাক না কেন, বাংলাদেশ তার ভাগে পাবে কেবল প্রাকৃতিক গ্যাসের লভ্যাংশ। সেটির পরিমাণ কত? প্রশ্নটির উত্তরে প্রথমে পড়তে হবে ১৫ অনুচ্ছেদের ৫ ধারার ১ উপধারা, যার সংক্ষিপ্ত বঙ্গানুবাদ: ‘বিক্রয়যোগ্য প্রাকৃতিক গ্যাস তরলীকৃত অবস্থায় এই অনুচ্ছেদের ৪, ৫ ও ৬ ধারার সাপেক্ষে রপ্তানি করার অধিকার ঠিকাদার কোম্পানির থাকবে। এই গ্যাসের পরিমাণভুক্ত থাকবে (ক) ঠিকাদারের প্রাপ্য কস্ট রিকভারি অর্থাত্ বিনিময়কৃত খরচ বাবদ প্রাকৃতিক গ্যাস, (খ) ঠিকাদারের প্রাপ্য লাভের প্রাকৃতিক গ্যাস ও (গ) পেট্রোবাংলার লাভের প্রাকৃতিক গ্যাস।’ এর পর পড়তে হবে একই অনুচ্ছেদের একই ধারার ৪ উপধারা, যার সংক্ষিপ্ত বঙ্গানুবাদ: ‘যে ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা স্থানীয় চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় পাইপলাইন স্থাপন করবে, সে ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলার তার প্রাপ্য লাভের গ্যাস রাখার অধিকার থাকবে, তবে সেটার পরিমাণ কোনোক্রমেই বাজারজাত করা মোট গ্যাসের ২০ শতাংশের বেশি হবে না। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, লক্ষ করুন, উপরিউক্ত ভাগাভাগির ১ উপধারায় লাভের প্রাকৃতিক গ্যাস ঠিকাদার কোম্পানি ও পেট্রোবাংলার মধ্যে কে কী পরিমাণ পাবে, উল্লেখ করা হয়নি। তবে ৪ উপধারা পড়লে স্পষ্ট হয় যে উত্তোলিত প্রাকৃতিক গ্যাসের লাভের অংশে ঠিকাদার কোম্পানি ও পেট্রোবাংলা যথাক্রমে ৮০ শতাংশ ও ২০ শতাংশ পাবে।
গ্যাস রপ্তানি
চুক্তিপত্রটির ১৬ অনুচ্ছেদের শিরোনাম হচ্ছে ‘পাইপলাইন’। এই অনুচ্ছেদে বলা আছে, ঠিকাদার কোম্পানি চুক্তিকৃত কূপ এলাকা থেকে বাংলাদেশের উপযুক্ত এক কিংবা একাধিক স্থানে পেট্রোলিয়াম পরিবহনের জন্য এক কিংবা একাধিক পাইপলাইন নির্মাণ করতে পারবে, তবে তার খরচ ঠিকাদারের কস্ট রিকভারি হিসেবে গণ্য হবে এবং পাইপলাইনের মালিকানা পেট্রোবাংলার থাকবে। কিন্তু শুভঙ্করের ফাঁকিটি হচ্ছে পেট্রোবাংলা কেবল তার প্রাপ্য পেট্রোলিয়াম এবং সেটা এর আগে আলোচ্য চুক্তিপত্রের ধারা অনুযায়ী কেবল প্রাকৃতিক গ্যাস ওই পাইপলাইন মারফত পরিবহন করতে পারবে এবং তার খরচও ঠিকাদার কোম্পানির কস্ট রিকভারির সঙ্গে যোগ করা হবে। ১৫ অনুচ্ছেদের ৫ ধারার ৬ উপধারায় বলা আছে, ঠিকাদার কোম্পানি তার প্রাপ্য কস্ট রিকভারি গ্যাস ও লাভের গ্যাস খরিদের জন্য পেট্রোবাংলাকে সর্বপ্রথম প্রস্তাব দেবে, যার অর্থ পেট্রোবাংলা খরিদ না করলে ওই ৮০ শতাংশ গ্যাস ঠিকাদার কোম্পানি রপ্তানি করার সুযোগ পাবে। কিন্তু কখনই পেট্রোবাংলা সে গ্যাস খরিদ করতে সক্ষম হবে না। কারণ পেট্রোবাংলাকে সে ক্ষেত্রে সমুদ্রবক্ষের কূপ থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিজস্ব পাইপলাইন নির্মাণ করতে হবে, অথচ ঠিকাদার কোম্পানি কর্তৃক এর মধ্যে নির্মিত পাইপলাইন, যার খরচের ভার পেট্রোবাংলাকেই বহন করতে হবে এবং চুক্তিপত্রের ১৬ অনুচ্ছেদের ৬ ধারা অনুযায়ী পেট্রোবাংলাই সে পাইপলাইনের মালিক—সেটা ব্যবহার করা যাবে না। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আপনি কি জানেন, একটি সে রকম পাইপলাইন নির্মাণের খরচ হচ্ছে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার, যা গরিব বাংলাদেশের পক্ষে খরচ করা আদৌ সম্ভব নয়? তা ছাড়া বাংলাদেশের গ্যাস ব্যবহারের ক্ষমতা বিবেচনায় রেখে গ্যাস উত্তোলনের সীমা নির্দিষ্ট করা উচিত ছিল। কিন্তু আলোচ্য চুক্তিপত্রে সে রকম ধারা না থাকায় ঠিকাদার কোম্পানি দ্রুত গ্যাস তুলতে থাকবে এবং পেট্রোবাংলার পক্ষে সে অনুপাতে খরিদ করা ও খরচ করা সম্ভব হবে না। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গ্যাস উত্তোলনের চুক্তিগুলোতে গ্যাস উত্তোলনের সীমা সাড়ে পাঁচ শতাংশ নির্দিষ্ট রাখা আছে।
ন্যায্য উপায় কী
বর্তমান সরকারের উপলব্ধিতে আসতে হবে, ভোটবিপ্লব মারফত তারা ক্ষমতায় এসেছে এবং জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্য তারা দায়বদ্ধ। আলোচ্য চুক্তিটি তাদের তৈরি নয় এবং চুক্তিটির খুঁটিনাটি পরীক্ষা করা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিশন অবিলম্বে দ্রুত গঠন করতে হবে চুক্তিটি পর্যালোচনা করার জন্য। কমিশনের কাজ হবে চুক্তিটি কে বা কারা তৈরি করেছে, তার বা তাদের এবং পেট্রোবাংলার পক্ষে পদস্থ কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা। চুক্তিটির পক্ষে ও বিপক্ষে নাগরিকদের মধ্যে থেকে সাক্ষী আহ্বান করা। এর পর সাক্ষীদের বক্তব্যের ভিত্তিতে চুক্তিটি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন প্রদান। কমিশনের শুনানি প্রকাশ্যে হবে এবং প্রতিবেদনটিও প্রকাশ করতে হবে। সর্বশেষে প্রতিবেদনটি জাতীয় সংসদে আলোচনা করে সাংসদেরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন। গণতন্ত্র এক অর্থে যুক্তিশীলতা, এটি অস্বীকার করার পরিণতিতেই দেশে ফ্যাসিবাদ খুঁটি গাড়ার সুযোগ পায়—এটা ইতিহাসেরই শিক্ষা।
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী: অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট।

No comments

Powered by Blogger.