হাটের চাঁদ -গদ্যকার্টুন by আনিসুল হক
ঢাকাবাসীর জন্য বিশাল খবর। পানির অভাবে আমরা আর মারা যাচ্ছি না। পানির সন্ধান পাওয়া গেছে।
আপনারা জানেন, ঢাকা শহরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। প্রতিবছর প্রায় ১০ ফুট করে এই পানি নেমে যায়। ১০ বছর পর ঢাকায় ডিপ টিউবওয়েলেও আমরা পানি পাব না। আর ঢাকার চারপাশের নদ-নদীর পানি আমরা এমনভাবেই দূষিত করে ফেলেছি যে তা শোধনেরও অযোগ্য হয়ে পড়েছে। আমাদের নদীগুলো দিয়ে পানি নয়, কালো রাসায়নিক একটা আধা তরল পদার্থ প্রবাহিত হয়। আর ঢাকা শহরের তো বটেই, সারা দেশের খাল, পুকুর, নিচু ভূমি ও জলাশয় আমরা বুজিয়ে ফেলছি। কাজেই খাবার পানি এই দেশে আর পাওয়া যাবে না।
ফলে ১০ বছর পর আমরা কী পান করব, এই দুশ্চিন্তায় আমাদের ঘুম হারাম হওয়ার দশা। অবশ্য কর্তৃপক্ষেরও ঘুম কমে গেছে, সেটা দুশ্চিন্তায় নয়, নতুন সম্ভাবনার আনন্দে। আমাদের ফসিল ওয়াটার কীভাবে তোলা যাবে মাটির অনেক গভীর থেকে, সে জন্য আমাদের দেশটাকে কয়েকটা ব্লকে ভাগ করে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে সেসব ব্লকের দায়িত্ব কীভাবে কোন শর্তে দেওয়া যাবে, আর তা থেকে কে কত ভাগ পাবে, উত্তোলিত পানি বিদেশে রপ্তানি হবে কি না, হলে কী শর্তে হবে—এই রকম নানা হিসাবনিকাশ নিয়ে তাঁদের চিত্তে মধুর তরঙ্গ খেলা করছে। তাঁরা পুলকিতই আছেন।
কিন্তু কবে আমাদের ভূগর্ভস্থ ফসিল ওয়াটার ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হবে, কবে সেটা বিদেশি কোম্পানি তুলবে, সেটা তুলতে গিয়ে দেশের জলসম্পদ পাচার রোধ কমিটি আবার হরতাল ডেকে বসবে কি না, এসব নিয়ে চিন্তামুক্ত হওয়া দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া যে আমরা বাঁচব না, সে তো জানা কথাই।
তো এখন পানি পাব কোথায়? ১০ বছর আগে কি আমরা অভিযোজিত হয়ে উট হয়ে যাব? আমাদের কুঁজ থাকবে, আমরা পানি ছাড়াই বেশ কয়েক দিন কাটিয়ে দিতে পারব? নাকি আমাদের বিশেষ অঙ্গ গজাবে, আমরা বাতাস থেকে জলীয় বাষ্প গ্রহণ করে আমাদের শরীরকে বাঁচিয়ে রাখব?
চিন্তাই যখন একমাত্র জিনিস, যা আমাদের ভাবনাজগেক ছিনতাই করে ফেলেছে, তখন সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান ঘটালেন ভারতীয় নভোবিজ্ঞানীরা, তাঁরা জানালেন, চাঁদে পানি পাওয়া গেছে।
ঢাকাবাসীর চিন্তা নেই, আমরা যদি আর কোথাও থেকে পানি না পাই, চাঁদের পানিই আমাদের ভরসা।
এক সুসংবাদই যখন আত্মস্থ করা কঠিন, তখন আরও একটা সুসংবাদ হাজির আমাদের সামনে। মঙ্গলগ্রহেও পানি পাওয়া গেছে।
দুই উপায়ে আমরা চাঁদ ও মঙ্গলগ্রহের পানি থেকে উপকৃত হতে পারি। এক. আমরা চাঁদ ও মঙ্গল থেকে বোতলজাত পানি আমদানি করে ঢাকাবাসীর প্রয়োজন মেটাব। দুই. চাঁদের পানিকে বিশ্লেষিত করলেই অক্সিজেন পাওয়া যাবে। কাজেই চাঁদে মানববসতি স্থাপিত হবে। আমরা সেখানে আমাদের জনশক্তি রপ্তানি করব। ঢাকার দুই কোটি মানুষকেই আমরা চাঁদে পাঠিয়ে দেব।
আমি জানি, এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আদম বেপারিরা আনন্দে লাফিয়ে উঠেছেন। ডাংকি হিসেবে আদমদের আমরা ইউরোপে, আমেরিকায়, মালয়েশিয়ায়, আন্দামানে নানা জায়গায় পাঠাতে পাঠাতে সব পুরোনো করে ফেলেছি। এবার পাঠানোর জন্য একটা নতুন জায়গা পাওয়া গেল। রকেটের চাকায় নিজেকে বেঁধে আমরা চাঁদের দেশে যাব।
আপনারা ভাবছেন এ অসম্ভব। মোটেও না।
চাঁদে সবার আগে নিল আর্মস্ট্রং নয়, বাঙালি গেছে।
নিল আর্মস্ট্রং চাঁদে নেমে দেখতে পেলেন একটা সুভেনির শপ বা স্মারকদ্রব্যের দোকান। সেখানে কাজ করছে একজন দোকানদার। নিল আর্মস্ট্রং অবাক হয়ে বললেন, ‘ভাই তুমি কী করছ?’
‘আমি চাঁদের ছবিওয়ালা উপহারসামগ্রী বিক্রি করছি।’ দোকানদার বলল।
নিল আর্মস্ট্রং বললেন, ‘তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ?’
‘বাংলাদেশ থেকে।’
‘কীভাবে?’
‘সে এক বিরাট হিস্ট্রি। তোমরা যখন চাঁদে মানবশূন্য নভোযান পরীক্ষামূলকভাবে পাঠাচ্ছিলে সেটার চাকায়... সে এক বিরাট দুঃখের কাহিনী...।’
নিল আর্মস্ট্রং একটা সুভেনির বা উপহারদ্রব্য কিনলেন। সেখানে লেখা, মেইড ইন চায়না। নিল আর্মস্ট্রং মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘তোমার দোকান কেমন চলছে?’
দোকানদার বলল, ‘না, ভালো না। আমার দোকানটা বাংলাদেশি, খদ্দের নানান দেশের। এর মধ্যে পাকিস্তানিগুলান আমার দোকান থেকে জিনিস নিয়ে গেছে, একটু পরে দাম পাঠিয়ে দেবে বলে সেই যে কেটে পড়েছে আজ কত দিন পার হয়ে গেল, দাম দেওয়ার নাম নাই।’
কাজেই আপনারা নিশ্চিত থাকুন, চাঁদে পানি পাওয়ার সুফল বাংলাদেশিরা ভালোভাবেই ভোগ করবে।
অতএব আর দুশ্চিন্তার কোনোই কারণ নাই, আসুন, আমরা বেশি করে পানি নষ্ট করি, আমাদের ভূগর্ভস্থ পানি পুরোটাই বিনষ্ট করে ফেলি, আমাদের নদ-নদী খাল-বিলের পানিকে চিরকালের মতো দূষিত করে ছাড়ি।
পানির অপর নাম জীবন, জীবন মানে আশা, কাজেই পানির অপর নাম আশা। হতাশ হবেন না।
(একটাই ভয়ের কথা আছে। আগামীকালই বিভিন্ন পত্রিকায় ও টেলিভিশন চ্যানেলে বিজ্ঞাপন বেরিয়ে যাবে, চাঁদে জমি কিনুন। রাজউক অনুমোদিত। বাইশ শতকের আবাসন। প্লট বিক্রি হচ্ছে। ঈদ উপলক্ষে ২০ পারসেন্ট ছাড়। একটা প্লট কিনলে একটা কালার টিভি ফ্রি। ‘চন্দ্রিমা সিটি’র জমির একটাই ভালো দিক, দুই বছরে দাম বাড়ে দিগ্বিদিক। টিভি বিজ্ঞাপনে কম্পিউটার গ্রাফিক্সে নির্মিত চাঁদে মানব বসতির ত্রিমাত্রিক ছবি দেখে দর্শকেরা নিশ্চিত প্রতারিত হবেন। রাজউক বিবৃতি দেবে, আমরা চাঁদের আবাসন প্রকল্প এখনো অনুমোদন দিইনি। যাঁরা যাঁরা ঠকবেন, দয়া করে নিজ দায়িত্বে ঠকবেন। আপনার হারানো টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব রাজউকের নয়।)
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আপনারা জানেন, ঢাকা শহরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। প্রতিবছর প্রায় ১০ ফুট করে এই পানি নেমে যায়। ১০ বছর পর ঢাকায় ডিপ টিউবওয়েলেও আমরা পানি পাব না। আর ঢাকার চারপাশের নদ-নদীর পানি আমরা এমনভাবেই দূষিত করে ফেলেছি যে তা শোধনেরও অযোগ্য হয়ে পড়েছে। আমাদের নদীগুলো দিয়ে পানি নয়, কালো রাসায়নিক একটা আধা তরল পদার্থ প্রবাহিত হয়। আর ঢাকা শহরের তো বটেই, সারা দেশের খাল, পুকুর, নিচু ভূমি ও জলাশয় আমরা বুজিয়ে ফেলছি। কাজেই খাবার পানি এই দেশে আর পাওয়া যাবে না।
ফলে ১০ বছর পর আমরা কী পান করব, এই দুশ্চিন্তায় আমাদের ঘুম হারাম হওয়ার দশা। অবশ্য কর্তৃপক্ষেরও ঘুম কমে গেছে, সেটা দুশ্চিন্তায় নয়, নতুন সম্ভাবনার আনন্দে। আমাদের ফসিল ওয়াটার কীভাবে তোলা যাবে মাটির অনেক গভীর থেকে, সে জন্য আমাদের দেশটাকে কয়েকটা ব্লকে ভাগ করে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে সেসব ব্লকের দায়িত্ব কীভাবে কোন শর্তে দেওয়া যাবে, আর তা থেকে কে কত ভাগ পাবে, উত্তোলিত পানি বিদেশে রপ্তানি হবে কি না, হলে কী শর্তে হবে—এই রকম নানা হিসাবনিকাশ নিয়ে তাঁদের চিত্তে মধুর তরঙ্গ খেলা করছে। তাঁরা পুলকিতই আছেন।
কিন্তু কবে আমাদের ভূগর্ভস্থ ফসিল ওয়াটার ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হবে, কবে সেটা বিদেশি কোম্পানি তুলবে, সেটা তুলতে গিয়ে দেশের জলসম্পদ পাচার রোধ কমিটি আবার হরতাল ডেকে বসবে কি না, এসব নিয়ে চিন্তামুক্ত হওয়া দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া যে আমরা বাঁচব না, সে তো জানা কথাই।
তো এখন পানি পাব কোথায়? ১০ বছর আগে কি আমরা অভিযোজিত হয়ে উট হয়ে যাব? আমাদের কুঁজ থাকবে, আমরা পানি ছাড়াই বেশ কয়েক দিন কাটিয়ে দিতে পারব? নাকি আমাদের বিশেষ অঙ্গ গজাবে, আমরা বাতাস থেকে জলীয় বাষ্প গ্রহণ করে আমাদের শরীরকে বাঁচিয়ে রাখব?
চিন্তাই যখন একমাত্র জিনিস, যা আমাদের ভাবনাজগেক ছিনতাই করে ফেলেছে, তখন সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান ঘটালেন ভারতীয় নভোবিজ্ঞানীরা, তাঁরা জানালেন, চাঁদে পানি পাওয়া গেছে।
ঢাকাবাসীর চিন্তা নেই, আমরা যদি আর কোথাও থেকে পানি না পাই, চাঁদের পানিই আমাদের ভরসা।
এক সুসংবাদই যখন আত্মস্থ করা কঠিন, তখন আরও একটা সুসংবাদ হাজির আমাদের সামনে। মঙ্গলগ্রহেও পানি পাওয়া গেছে।
দুই উপায়ে আমরা চাঁদ ও মঙ্গলগ্রহের পানি থেকে উপকৃত হতে পারি। এক. আমরা চাঁদ ও মঙ্গল থেকে বোতলজাত পানি আমদানি করে ঢাকাবাসীর প্রয়োজন মেটাব। দুই. চাঁদের পানিকে বিশ্লেষিত করলেই অক্সিজেন পাওয়া যাবে। কাজেই চাঁদে মানববসতি স্থাপিত হবে। আমরা সেখানে আমাদের জনশক্তি রপ্তানি করব। ঢাকার দুই কোটি মানুষকেই আমরা চাঁদে পাঠিয়ে দেব।
আমি জানি, এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আদম বেপারিরা আনন্দে লাফিয়ে উঠেছেন। ডাংকি হিসেবে আদমদের আমরা ইউরোপে, আমেরিকায়, মালয়েশিয়ায়, আন্দামানে নানা জায়গায় পাঠাতে পাঠাতে সব পুরোনো করে ফেলেছি। এবার পাঠানোর জন্য একটা নতুন জায়গা পাওয়া গেল। রকেটের চাকায় নিজেকে বেঁধে আমরা চাঁদের দেশে যাব।
আপনারা ভাবছেন এ অসম্ভব। মোটেও না।
চাঁদে সবার আগে নিল আর্মস্ট্রং নয়, বাঙালি গেছে।
নিল আর্মস্ট্রং চাঁদে নেমে দেখতে পেলেন একটা সুভেনির শপ বা স্মারকদ্রব্যের দোকান। সেখানে কাজ করছে একজন দোকানদার। নিল আর্মস্ট্রং অবাক হয়ে বললেন, ‘ভাই তুমি কী করছ?’
‘আমি চাঁদের ছবিওয়ালা উপহারসামগ্রী বিক্রি করছি।’ দোকানদার বলল।
নিল আর্মস্ট্রং বললেন, ‘তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ?’
‘বাংলাদেশ থেকে।’
‘কীভাবে?’
‘সে এক বিরাট হিস্ট্রি। তোমরা যখন চাঁদে মানবশূন্য নভোযান পরীক্ষামূলকভাবে পাঠাচ্ছিলে সেটার চাকায়... সে এক বিরাট দুঃখের কাহিনী...।’
নিল আর্মস্ট্রং একটা সুভেনির বা উপহারদ্রব্য কিনলেন। সেখানে লেখা, মেইড ইন চায়না। নিল আর্মস্ট্রং মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘তোমার দোকান কেমন চলছে?’
দোকানদার বলল, ‘না, ভালো না। আমার দোকানটা বাংলাদেশি, খদ্দের নানান দেশের। এর মধ্যে পাকিস্তানিগুলান আমার দোকান থেকে জিনিস নিয়ে গেছে, একটু পরে দাম পাঠিয়ে দেবে বলে সেই যে কেটে পড়েছে আজ কত দিন পার হয়ে গেল, দাম দেওয়ার নাম নাই।’
কাজেই আপনারা নিশ্চিত থাকুন, চাঁদে পানি পাওয়ার সুফল বাংলাদেশিরা ভালোভাবেই ভোগ করবে।
অতএব আর দুশ্চিন্তার কোনোই কারণ নাই, আসুন, আমরা বেশি করে পানি নষ্ট করি, আমাদের ভূগর্ভস্থ পানি পুরোটাই বিনষ্ট করে ফেলি, আমাদের নদ-নদী খাল-বিলের পানিকে চিরকালের মতো দূষিত করে ছাড়ি।
পানির অপর নাম জীবন, জীবন মানে আশা, কাজেই পানির অপর নাম আশা। হতাশ হবেন না।
(একটাই ভয়ের কথা আছে। আগামীকালই বিভিন্ন পত্রিকায় ও টেলিভিশন চ্যানেলে বিজ্ঞাপন বেরিয়ে যাবে, চাঁদে জমি কিনুন। রাজউক অনুমোদিত। বাইশ শতকের আবাসন। প্লট বিক্রি হচ্ছে। ঈদ উপলক্ষে ২০ পারসেন্ট ছাড়। একটা প্লট কিনলে একটা কালার টিভি ফ্রি। ‘চন্দ্রিমা সিটি’র জমির একটাই ভালো দিক, দুই বছরে দাম বাড়ে দিগ্বিদিক। টিভি বিজ্ঞাপনে কম্পিউটার গ্রাফিক্সে নির্মিত চাঁদে মানব বসতির ত্রিমাত্রিক ছবি দেখে দর্শকেরা নিশ্চিত প্রতারিত হবেন। রাজউক বিবৃতি দেবে, আমরা চাঁদের আবাসন প্রকল্প এখনো অনুমোদন দিইনি। যাঁরা যাঁরা ঠকবেন, দয়া করে নিজ দায়িত্বে ঠকবেন। আপনার হারানো টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব রাজউকের নয়।)
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments