আফগানিস্তানের চোরাবালিতে ওবামা by ফারুক চৌধুরী
মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামার পররাষ্ট্রনীতির একটি ঘোষিত লক্ষ্য। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই আফগানিস্তানে ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের পরাভূত করা এবং আফগানিস্তানে গণতন্ত্রের ভিত্তি রচনায় তাঁর আগ্রহকে বিচার করা যেতে পারে।
আফগানিস্তানে সমস্যার মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র যুগল পদক্ষেপ নিচ্ছে। তা হচ্ছে আফগানিস্তানে আরও ২১ হাজার সেনা পাঠানো এবং সে দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে উন্নততর প্রশিক্ষণ দেওয়া। কিন্তু তা সত্ত্বেও আফগানিস্তানে তালেবানরা শক্তি সঞ্চয় করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সেনাদের ওপর তীব্র থেকে তীব্রতর আঘাত হানছে। এ অবস্থায় সাধারণত যা ঘটে থাকে তা হলো এই যে ঘটনাস্থলে নিযুক্ত সেনাপতিরা আরও সেনা পাঠানোর সুপারিশ পাঠান, প্রেরিত রাষ্ট্রের জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, প্রেরণকারী রাষ্ট্রে বিরূপ জনমতের সৃষ্টি হয় এবং প্রেরণকারী রাষ্ট্র সমস্যার চোরাবালিতে ঘুরপাক খায়। তা আমরা অতীতে ভিয়েতনামে ও পূর্ব এশিয়ায় দেখেছি আর এখন প্রত্যক্ষ করছি ইরাকে। বর্তমানে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সেনাবাহিনীর সেনাপতি জেনারেল ম্যাকক্রিস্টেলের প্রতিক্রিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। তিনি বলেছেন, আফগানিস্তানে অবস্থার অবনতি হচ্ছে এবং অতিরিক্ত সেনা পাঠানোর কথাটি যে বিবেচনাধীন রয়েছে, তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ওবামাকে দ্রুতই একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোন পথে যাবেন তিনি?
এদিকে আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ হয়েছে, ভোট গণনা চলছে এবং সেপ্টেম্বরেই ফলাফল ঘোষিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রতিযোগিতায় এখন দুই প্রার্থীই এগিয়ে রয়েছেন। তাঁরা হলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এবং তাঁরই সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ। আংশিক গণনায় হামিদ কারজাই এগিয়ে রয়েছেন। কিন্তু তিনি প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৫০ ভাগ না পেলে, তাঁর সঙ্গে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর (অর্থাত্ আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর) আবার নির্বাচনে লড়তে হবে। এ তো গেল সরকারি হিসাবের কথা। কিন্তু এ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনের সময় হরেক রকমের কারচুপি আর অনিয়ম ঘটেছে এবং নির্বাচনে ছিল গ্রহণযোগ্য স্বচ্ছতার অভাব। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন ঘোষিত পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বী কি নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবেন? আফগানিস্তানের বহু উপজাতি ও গোষ্ঠীর ভোটারদের শ্রেণীবিভক্তি জটিল এবং তা সহজে বোধগম্য হওয়ার নয়। তা ছাড়া তাতে রয়েছে টাকা এবং ‘ওয়ার লর্ড’দের পেশিশক্তির খেলা। তাই নির্বাচন-উত্তর আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিলতর হয়ে যাবে না তো? নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রথম এবং প্রয়োজনীয় শর্ত। কিন্তু আফগানিস্তানে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, তা নির্বাচনের নামে প্রহসন বলে পরিগণিত হবে না তো? নির্বাচনের কারণে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থার হিতে বিপরীত না হয়ে যায়।
আফগানিস্তান ক্রমে ক্রমে প্রেসিডেন্ট ওবামার জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আফগানিস্তানে কী এমন নতুন ‘স্ট্রাটেজি’ তিনি অবলম্বন করতে পারেন, যা পূর্বপরীক্ষিত ‘স্ট্রাটেজি’ থেকে ভিন্নতর হবে?
তার একটি এই হতে পারে যে আফগানিস্তান সমস্যাকে সামরিক সমস্যা হিসেবে যাচাই না করে, তাকে প্রধানত আর্থসামাজিক সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করা এবং চটজলদি কোনো সমাধান না নিয়ে একটি সুচিন্তিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা, যাতে থাকবে কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রাধান্য। আফগানিস্তানের গ্রামপর্যায়ে কৃষি, মুরগি খামার ও পশুপালন ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের বিরাট একটি সম্ভাবনা রয়েছে। সম্ভাবনা রয়েছে সে দেশের ঐতিহ্যবাহী কার্পেটশিল্পে নতুন প্রাণসঞ্চার করার। প্রয়োজন রয়েছে স্থানীয় সংস্থাটির প্রতি লক্ষ্য রেখে শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিকায়নের এবং স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে একটি গ্রামীণ অবকাঠামো গড়ে তোলা। এবং এসবের সঙ্গে সঙ্গে পর্যায়ক্রমে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার, যা সে দেশের জনগণের মধ্যে একটি অনুকূল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। সামাজিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ অথবা অর্থসাহায্যে কার্পণ্য চলবে না, পরিত্যাগ করতে হবে ‘টু পাইস’ খরচ করে তার দ্বিগুণ কামাই করার পাশ্চাত্যের প্রবণতা।
সামাজিক ক্ষেত্রে সব বিনিয়োগই সরকারি ও বেসরকারি খাতে যুগপত্ভাবে প্রবাহিত করা যেতে পারে। এদিকে আফগানিস্তানের গ্রামীণ বিচারব্যবস্থাকে উন্নততর করার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। পাকিস্তানের সোয়াতে তালেবানদের প্রভাব বিস্তারের প্রধান একটি কারণ ছিল পাকিস্তান সরকারের নড়বড়ে, ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ বিচারব্যবস্থা, যার দুর্ভোগ সেই অঞ্চলের জনগণ পোহাচ্ছিল। তার সঙ্গে সঙ্গে আফগানিস্তানের সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর উন্নয়ন এবং আধুনিকায়নে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তার জন্য বিরাটাকার বিদেশি সামরিক উপস্থিতির প্রয়োজন নেই।
প্রেসিডেন্ট ওবামা যদি এই দৃষ্টিকোণ থেকে আফগানিস্তানের জটিল সমস্যাটি সমাধানে সচেষ্ট হন, তাহলে সেই হতভাগ্য দেশটিতে হয়তো বা শান্তি ও উন্নয়নের একটি পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে।
ফারুক চৌধুরী: কূটনীতিক। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব।
আফগানিস্তানে সমস্যার মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র যুগল পদক্ষেপ নিচ্ছে। তা হচ্ছে আফগানিস্তানে আরও ২১ হাজার সেনা পাঠানো এবং সে দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে উন্নততর প্রশিক্ষণ দেওয়া। কিন্তু তা সত্ত্বেও আফগানিস্তানে তালেবানরা শক্তি সঞ্চয় করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সেনাদের ওপর তীব্র থেকে তীব্রতর আঘাত হানছে। এ অবস্থায় সাধারণত যা ঘটে থাকে তা হলো এই যে ঘটনাস্থলে নিযুক্ত সেনাপতিরা আরও সেনা পাঠানোর সুপারিশ পাঠান, প্রেরিত রাষ্ট্রের জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, প্রেরণকারী রাষ্ট্রে বিরূপ জনমতের সৃষ্টি হয় এবং প্রেরণকারী রাষ্ট্র সমস্যার চোরাবালিতে ঘুরপাক খায়। তা আমরা অতীতে ভিয়েতনামে ও পূর্ব এশিয়ায় দেখেছি আর এখন প্রত্যক্ষ করছি ইরাকে। বর্তমানে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সেনাবাহিনীর সেনাপতি জেনারেল ম্যাকক্রিস্টেলের প্রতিক্রিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। তিনি বলেছেন, আফগানিস্তানে অবস্থার অবনতি হচ্ছে এবং অতিরিক্ত সেনা পাঠানোর কথাটি যে বিবেচনাধীন রয়েছে, তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ওবামাকে দ্রুতই একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোন পথে যাবেন তিনি?
এদিকে আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ হয়েছে, ভোট গণনা চলছে এবং সেপ্টেম্বরেই ফলাফল ঘোষিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রতিযোগিতায় এখন দুই প্রার্থীই এগিয়ে রয়েছেন। তাঁরা হলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এবং তাঁরই সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ। আংশিক গণনায় হামিদ কারজাই এগিয়ে রয়েছেন। কিন্তু তিনি প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৫০ ভাগ না পেলে, তাঁর সঙ্গে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর (অর্থাত্ আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর) আবার নির্বাচনে লড়তে হবে। এ তো গেল সরকারি হিসাবের কথা। কিন্তু এ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনের সময় হরেক রকমের কারচুপি আর অনিয়ম ঘটেছে এবং নির্বাচনে ছিল গ্রহণযোগ্য স্বচ্ছতার অভাব। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন ঘোষিত পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বী কি নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবেন? আফগানিস্তানের বহু উপজাতি ও গোষ্ঠীর ভোটারদের শ্রেণীবিভক্তি জটিল এবং তা সহজে বোধগম্য হওয়ার নয়। তা ছাড়া তাতে রয়েছে টাকা এবং ‘ওয়ার লর্ড’দের পেশিশক্তির খেলা। তাই নির্বাচন-উত্তর আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিলতর হয়ে যাবে না তো? নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রথম এবং প্রয়োজনীয় শর্ত। কিন্তু আফগানিস্তানে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, তা নির্বাচনের নামে প্রহসন বলে পরিগণিত হবে না তো? নির্বাচনের কারণে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থার হিতে বিপরীত না হয়ে যায়।
আফগানিস্তান ক্রমে ক্রমে প্রেসিডেন্ট ওবামার জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আফগানিস্তানে কী এমন নতুন ‘স্ট্রাটেজি’ তিনি অবলম্বন করতে পারেন, যা পূর্বপরীক্ষিত ‘স্ট্রাটেজি’ থেকে ভিন্নতর হবে?
তার একটি এই হতে পারে যে আফগানিস্তান সমস্যাকে সামরিক সমস্যা হিসেবে যাচাই না করে, তাকে প্রধানত আর্থসামাজিক সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করা এবং চটজলদি কোনো সমাধান না নিয়ে একটি সুচিন্তিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা, যাতে থাকবে কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রাধান্য। আফগানিস্তানের গ্রামপর্যায়ে কৃষি, মুরগি খামার ও পশুপালন ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের বিরাট একটি সম্ভাবনা রয়েছে। সম্ভাবনা রয়েছে সে দেশের ঐতিহ্যবাহী কার্পেটশিল্পে নতুন প্রাণসঞ্চার করার। প্রয়োজন রয়েছে স্থানীয় সংস্থাটির প্রতি লক্ষ্য রেখে শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিকায়নের এবং স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে একটি গ্রামীণ অবকাঠামো গড়ে তোলা। এবং এসবের সঙ্গে সঙ্গে পর্যায়ক্রমে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার, যা সে দেশের জনগণের মধ্যে একটি অনুকূল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। সামাজিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ অথবা অর্থসাহায্যে কার্পণ্য চলবে না, পরিত্যাগ করতে হবে ‘টু পাইস’ খরচ করে তার দ্বিগুণ কামাই করার পাশ্চাত্যের প্রবণতা।
সামাজিক ক্ষেত্রে সব বিনিয়োগই সরকারি ও বেসরকারি খাতে যুগপত্ভাবে প্রবাহিত করা যেতে পারে। এদিকে আফগানিস্তানের গ্রামীণ বিচারব্যবস্থাকে উন্নততর করার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। পাকিস্তানের সোয়াতে তালেবানদের প্রভাব বিস্তারের প্রধান একটি কারণ ছিল পাকিস্তান সরকারের নড়বড়ে, ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ বিচারব্যবস্থা, যার দুর্ভোগ সেই অঞ্চলের জনগণ পোহাচ্ছিল। তার সঙ্গে সঙ্গে আফগানিস্তানের সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর উন্নয়ন এবং আধুনিকায়নে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তার জন্য বিরাটাকার বিদেশি সামরিক উপস্থিতির প্রয়োজন নেই।
প্রেসিডেন্ট ওবামা যদি এই দৃষ্টিকোণ থেকে আফগানিস্তানের জটিল সমস্যাটি সমাধানে সচেষ্ট হন, তাহলে সেই হতভাগ্য দেশটিতে হয়তো বা শান্তি ও উন্নয়নের একটি পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে।
ফারুক চৌধুরী: কূটনীতিক। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব।
No comments