একজন সাধারণ ছেলের গল্প by রবিন সাইফুদ্দিন
নীরেন্দ্রনাথ
চক্রবর্তীর অমলকান্তির কথা মনে আছে? যে অমলকান্তি ক্ষান্ত বর্ষণ কাকডাকা
বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। তার বন্ধুরা কেউ ডাক্তার, কেউ
ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা উকিল হয়েছিল। কিন্তু অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
আজ, আমার দেখা এক অমলকান্তির কথা বলব। খুব বেশি কিছু না, তিনি শুধু ভালো
মানুষ আর উচ্চশিক্ষিত হতে চেয়েছেন। কবিতার ছাপাখানার অমলকান্তির বলয় থেকে
বেরোনো বাস্তবের অমলকান্তির চাওয়ার সঙ্গে প্রাপ্তির অমিল ঘটবে কি না তা
ভবিষ্যত্ই জানে।
আজকের অমলকান্তির নাম এমরান হোসেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় বহু দূরের এক দ্বীপ হাতিয়ার গণ-উন্নয়ন গ্রন্থাগারে। দেখি গভীর মনোযোগে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছেন। বেশ কথা জমল। কথার প্রসঙ্গ—দেশ, জাতিসত্তা, সংস্কৃতি, একটি অজপাড়া দ্বীপের অবহেলিত মানুষের দুঃখগাথা। হাতিয়ার দরিদ্র কিন্তু মেধাবীদের জন্য কিছু করার তাড়না তাঁর ভেতর। এলাকার সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটানোর জন্য কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কী করবেন তিনি একা? কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া আইলায় দুর্গতদের জন্য আরও ত্রাণ কিংবা সাহায্য কীভাবে ব্যবস্থা করা যায়। প্রয়োজনে তাদের ঘর তুলে দিতে নিজের কাঁধে বাঁশ-কাঠ তুলে নিতেও রাজি ছিলেন এমরান। কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মধ্যে যে বিশাল ফারাক তাও জানা ছিল তাঁর। তাই সম্ভব হলো না অনেক কিছু। প্রসঙ্গ পাল্টে এমরানের নিজের কথা জানতে চাই। ভীষণ অবাক হতে হলো তাঁর গল্প শুনে।
এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন এমরান। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অপেক্ষা। বাবার একটা ছোট্ট চায়ের দোকান ছিল। একসময় এমরানের নিত্যসঙ্গী ছিল চা, চিনি, চা পাতা, চামচ—এসব। বাবার সঙ্গে দোকানে চা বিক্রি করতেন। চায়ের টুংটাং আওয়াজ শুনতে শুনতে আকার আর বয়সের সঙ্গে বাড়তে থাকে তাঁর স্বপ্ন। কেবল নিজের চেষ্টায়, মায়ের সম্মতি আর বাবার অনুরাগে এমরান প্রাথমিক, মাধ্যমিক পাড়ি দিয়ে কলেজটাও পাড়ি দিলেন।
কোনো এক মফস্বলের চায়ের দোকান থেকে কত আয়ই বা হতো? এমরান স্কুলজীবন থেকে তাই বেছে নিলেন টিউশন। প্রতিদিনই রাত করে ফিরতে হতো বাড়িতে। অন্যের বাচ্চাদের পড়িয়ে তবেই তো নিজের পড়া। যা আয় হতো তা দিয়ে নিজের ভরণপোষণ, পড়ালেখার খরচ চালাত। সেই সামান্য আয়ের কিছু অংশ পরিবারেও দিতে হতো তাকে। একসময় বেশ জমিজমা ছিল। কিন্তু মেঘনা নদী অন্য অনেকের মতো তাদেরও সর্বস্বান্ত করে দিয়ে গেছে। এখন আর কিছুই নেই। থাকার জায়গাটুকুও না। এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের দেওয়া সামান্য এক টুকরা জায়গায় এমরানদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। তাও নদীর অন্য পারে। কিছুদিনের মধ্যেই এমরানদের হাতিয়া ছাড়তে হবে। তারপর কী হবে? কথায় কথায় এমরানের চোখের কোণে জল চিকচিক করে। সবে উচ্চমাধ্যমিক পাস করলেন। ভর্তি হতে হবে শহরের কোনো ভালো প্রতিষ্ঠানে। তাঁর যে অনেক কিছু করতে হবে, বড় হতে হবে। এমরানের ইচ্ছে, ঢাকা অথবা চট্টগ্রামের কোথাও ভর্তি হওয়ার। কিন্তু এমরান হতাশ। কেননা তাঁর এমন কেউ নেই যে তাঁকে সাময়িক আশ্রয় দেবে, সাহায্যের হাত বাড়াবে। কী করবেন তাহলে তিনি? আক্ষেপের সুরে এমরান জানান, ‘একজন সামান্য চায়ের দোকানদারের ছেলের কে-ই বা থাকবে? এলাকায় থাকতে কিছু ছাত্র পড়াতাম, যা-ই পেতাম তাতেই নিজের কোনোমতে চলত। এখন বাইরে গেলে কেমনে চলমু, কই যামু।’ বলতে বলতে ভেঙে পড়েন এমরান।
তাঁর সঙ্গে যেখানে বসে এসব কথা হচ্ছিল সেই গণ-উন্নয়ন গ্রন্থাগারের সমন্বয়কারী মো. নুর উদ্দিন বললেন, ‘এমরান প্রতিদিন বাড়ি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার সাইকেলে চেপে কলেজ করত, গ্রন্থাগারে আসত। পড়ালেখার প্রতি ওর আগ্রহ বেশ অবাক করার মতো। কিন্তু দারিদ্র্য তার সামনে প্রধান বাধা এখন।’ এমরানের সহজ স্বীকারোক্তি, বই কিনতে পারতেন না বলেই গ্রন্থাগারে প্রতিদিন পড়ে থাকতেন। কিন্তু এখন তাঁর কী হবে? অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে পথ চলতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। কিন্তু এখনো স্থির হতে পারেননি অর্থ আর আবাসন-সংকট কীভাবে মোকাবিলা করবেন।
যে যুবক অন্য অনেকের জন্য কিছু করতে চান কিংবা করে বেড়ান তাঁর নিজের বেলায়ই তিনি ব্যর্থ! প্রশ্ন করি নিজেকে, কে ব্যর্থ, এমরান ব্যর্থ নাকি আমরা? সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘প্রিয়তমাসু’র শেষ কটা লাইন মনে পড়ল, ‘আমি যেন সেই বাতিওয়ালা, সে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে/অথচ নিজের ঘরে নেই বাতি জ্বালার সামর্থ্য/নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার’। এমরানেরও তা-ই হলো। একসময় প্রতিদিন টিউশন করে বাড়ি ফিরতেন। অন্যের সন্তানের কাছে আলো বিলাতেন। আর এখন নিজেই আলোহীন হয়ে আছেন, আলোকিত হওয়ার অপেক্ষায়। তিনি জানেন না আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হবে কি না, নাকি এখানেই থমকে যাবে পড়ালেখার পথ। এখন শুধু নীরব অপেক্ষা।
আজকের অমলকান্তির নাম এমরান হোসেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় বহু দূরের এক দ্বীপ হাতিয়ার গণ-উন্নয়ন গ্রন্থাগারে। দেখি গভীর মনোযোগে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছেন। বেশ কথা জমল। কথার প্রসঙ্গ—দেশ, জাতিসত্তা, সংস্কৃতি, একটি অজপাড়া দ্বীপের অবহেলিত মানুষের দুঃখগাথা। হাতিয়ার দরিদ্র কিন্তু মেধাবীদের জন্য কিছু করার তাড়না তাঁর ভেতর। এলাকার সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটানোর জন্য কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কী করবেন তিনি একা? কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া আইলায় দুর্গতদের জন্য আরও ত্রাণ কিংবা সাহায্য কীভাবে ব্যবস্থা করা যায়। প্রয়োজনে তাদের ঘর তুলে দিতে নিজের কাঁধে বাঁশ-কাঠ তুলে নিতেও রাজি ছিলেন এমরান। কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মধ্যে যে বিশাল ফারাক তাও জানা ছিল তাঁর। তাই সম্ভব হলো না অনেক কিছু। প্রসঙ্গ পাল্টে এমরানের নিজের কথা জানতে চাই। ভীষণ অবাক হতে হলো তাঁর গল্প শুনে।
এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন এমরান। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অপেক্ষা। বাবার একটা ছোট্ট চায়ের দোকান ছিল। একসময় এমরানের নিত্যসঙ্গী ছিল চা, চিনি, চা পাতা, চামচ—এসব। বাবার সঙ্গে দোকানে চা বিক্রি করতেন। চায়ের টুংটাং আওয়াজ শুনতে শুনতে আকার আর বয়সের সঙ্গে বাড়তে থাকে তাঁর স্বপ্ন। কেবল নিজের চেষ্টায়, মায়ের সম্মতি আর বাবার অনুরাগে এমরান প্রাথমিক, মাধ্যমিক পাড়ি দিয়ে কলেজটাও পাড়ি দিলেন।
কোনো এক মফস্বলের চায়ের দোকান থেকে কত আয়ই বা হতো? এমরান স্কুলজীবন থেকে তাই বেছে নিলেন টিউশন। প্রতিদিনই রাত করে ফিরতে হতো বাড়িতে। অন্যের বাচ্চাদের পড়িয়ে তবেই তো নিজের পড়া। যা আয় হতো তা দিয়ে নিজের ভরণপোষণ, পড়ালেখার খরচ চালাত। সেই সামান্য আয়ের কিছু অংশ পরিবারেও দিতে হতো তাকে। একসময় বেশ জমিজমা ছিল। কিন্তু মেঘনা নদী অন্য অনেকের মতো তাদেরও সর্বস্বান্ত করে দিয়ে গেছে। এখন আর কিছুই নেই। থাকার জায়গাটুকুও না। এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের দেওয়া সামান্য এক টুকরা জায়গায় এমরানদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। তাও নদীর অন্য পারে। কিছুদিনের মধ্যেই এমরানদের হাতিয়া ছাড়তে হবে। তারপর কী হবে? কথায় কথায় এমরানের চোখের কোণে জল চিকচিক করে। সবে উচ্চমাধ্যমিক পাস করলেন। ভর্তি হতে হবে শহরের কোনো ভালো প্রতিষ্ঠানে। তাঁর যে অনেক কিছু করতে হবে, বড় হতে হবে। এমরানের ইচ্ছে, ঢাকা অথবা চট্টগ্রামের কোথাও ভর্তি হওয়ার। কিন্তু এমরান হতাশ। কেননা তাঁর এমন কেউ নেই যে তাঁকে সাময়িক আশ্রয় দেবে, সাহায্যের হাত বাড়াবে। কী করবেন তাহলে তিনি? আক্ষেপের সুরে এমরান জানান, ‘একজন সামান্য চায়ের দোকানদারের ছেলের কে-ই বা থাকবে? এলাকায় থাকতে কিছু ছাত্র পড়াতাম, যা-ই পেতাম তাতেই নিজের কোনোমতে চলত। এখন বাইরে গেলে কেমনে চলমু, কই যামু।’ বলতে বলতে ভেঙে পড়েন এমরান।
তাঁর সঙ্গে যেখানে বসে এসব কথা হচ্ছিল সেই গণ-উন্নয়ন গ্রন্থাগারের সমন্বয়কারী মো. নুর উদ্দিন বললেন, ‘এমরান প্রতিদিন বাড়ি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার সাইকেলে চেপে কলেজ করত, গ্রন্থাগারে আসত। পড়ালেখার প্রতি ওর আগ্রহ বেশ অবাক করার মতো। কিন্তু দারিদ্র্য তার সামনে প্রধান বাধা এখন।’ এমরানের সহজ স্বীকারোক্তি, বই কিনতে পারতেন না বলেই গ্রন্থাগারে প্রতিদিন পড়ে থাকতেন। কিন্তু এখন তাঁর কী হবে? অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে পথ চলতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। কিন্তু এখনো স্থির হতে পারেননি অর্থ আর আবাসন-সংকট কীভাবে মোকাবিলা করবেন।
যে যুবক অন্য অনেকের জন্য কিছু করতে চান কিংবা করে বেড়ান তাঁর নিজের বেলায়ই তিনি ব্যর্থ! প্রশ্ন করি নিজেকে, কে ব্যর্থ, এমরান ব্যর্থ নাকি আমরা? সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘প্রিয়তমাসু’র শেষ কটা লাইন মনে পড়ল, ‘আমি যেন সেই বাতিওয়ালা, সে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে/অথচ নিজের ঘরে নেই বাতি জ্বালার সামর্থ্য/নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার’। এমরানেরও তা-ই হলো। একসময় প্রতিদিন টিউশন করে বাড়ি ফিরতেন। অন্যের সন্তানের কাছে আলো বিলাতেন। আর এখন নিজেই আলোহীন হয়ে আছেন, আলোকিত হওয়ার অপেক্ষায়। তিনি জানেন না আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হবে কি না, নাকি এখানেই থমকে যাবে পড়ালেখার পথ। এখন শুধু নীরব অপেক্ষা।
No comments