অর্থনীতি আমাদের মুদ্রা কখন মূল্য হারাবে by আবু আহমেদ
মাঝেমধ্যে আমাদের মুদ্রা ‘টাকা’র ওপর চাপ আসে। চাপ আসে দুই দিক থেকে। এক. টাকা স্বাভাবিক গতিতে অন্য বড় কারেন্সি বা মুদ্রার বিপরীতে পড়তে চায়। অন্য কথায়, টাকা স্বাভাবিক নিয়মে রিজার্ভ মুদ্রার বিপরীতে মূল্য হারাতে চায়। আবার সব রিজার্ভ মুদ্রার বিপরীতে সমানভাবে মূল্য হারানোর প্রবণতায় ভোগে না—কখনো মার্কিন ডলারের, কখনো ইউরোপীয়দের ইউরোর, কখনো ব্রিটিশদের পাউন্ডের বিপরীতে মূল্য হারাতে চায়।
কোন মুদ্রার বিপরীতে টাকা কত মূল্য হারাবে বা মূল্য উদ্ধার করবে, সেটা নির্ভর করে ডলার-ইউরো-পাউন্ড-ইয়েনের পারস্পরিক ওঠানামার ওপরও। ইউরো ডলারের বিপরীতে তেজি হতে লাগলে অবশ্য বাংলাদেশকে বেশি একক টাকা দিয়ে ইউরোকে কিনতে হবে। দুই বছর আগে ব্রিটিশ পাউন্ড অতি তেজি ছিল, সেই পাউন্ডকে কিনতে হতো ১৩৫ টাকা দিয়ে। সেই অবস্থা কি আজকে আছে? মার্কিন ডলার কিন্তু টাকার বিরুদ্ধে তার মানকে ধরেই রেখেছে। এর অর্থ কী? এর অর্থ হলো, ডলার পাউন্ডের বিপরীতে আন্তর্জাতিক বাজারে তেজি হয়েছে, যার কারণে আমরা আগের তুলনায় কম একক টাকা দিয়ে পাউন্ড কিনতে পারি। মুদ্রার পারস্পরিক ওঠানামার পেছনে অনেক উপাদান কাজ করে, যার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা, অন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো মুদ্রার ভবিষ্যত্ ক্রয়ক্ষমতার ওপর লোকজনের বিশ্বাস।
অন্য একটি উপাদান হলো হঠাত্ করে কোনো মুদ্রার জন্য চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া। বিশ্ব আর্থিক দুর্যোগের সময় কিন্তু তুলনামূলকভাবে মার্কিন ডলারের চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল, সে জন্যই মূলত বাজারে পাউন্ড-ইউরোর বিপরীতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। আবার এক দেশ থেকে অন্য দেশে সম্পদ সরিয়ে নেওয়ার গতিটা যদি স্বাভাবিক হয়ে যায়, তখন ডলারের ওই উল্লম্ফন চাহিদাও কমে যেতে পারে, সেই অবস্থায় অন্যান্য বিষয় ঠিক থাকলে ব্রিটিশ পাউন্ডের মূল্য বাড়তেও পারে। মুদ্রা ব্যবসায়ীরা কোন মুদ্রার মূল্য কমবে, কোন মুদ্রার মূল্য বাড়বে ওই সব নিয়ে সর্বদাই জল্পনায় থাকেন। তাঁরা ভবিষ্যতের বাজারেও মুদ্রা বেচাকেনা করেন। ফলে আজকের দিনে মুদ্রাব্যবসাও একটা বড় ব্যবসা।
সত্তরের দশক-পূর্ব সময়ে মুদ্রাব্যবসা অত লাভজনক ছিল না। সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় সব অর্থনীতিই মুদ্রার বিনিময়, বাজারে আগের ফিক্সড-এক্সচেঞ্জ রেইট বা ধরাবাঁধা মূল্যে বিনিময় হারকে ত্যাগ করে, ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেইট বা ভাসমান বিনিময় হার গ্রহণ করে।
ফলে এখন বিশ্বের মুদ্রাগুলোর মান অতি পতন থেকে অতি বর্ধনও ঘটছে। ১৯৭১ পূর্ব পর্যন্ত মার্কিন ডলার ছিল স্বর্ণের সঙ্গে যুক্ত। যেদিন থেকে তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ঘোষণা করলেন, তাঁদের মুদ্রা ডলার আর স্বর্ণের সঙ্গে যুক্ত নয়, সেই দিন গ্লোবাল মুদ্রা বাজারে একটা প্রচণ্ড অবিশ্বাস এবং অনিশ্চয়তার ঢেউ লাগে। ওই স্বর্ণের সঙ্গে ডলারের সম্পর্ক ছেদ হলেও ডলারের বিপরীতে অন্য কোনো মুদ্রা গ্লোবাল লেনদেনে ডলারের স্থানকে সরাতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ ছিল, যুক্তরাষ্ট্র তখনো বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ উত্পাদন ও বাণিজ্যিক লেনদেনের অধিকারী ছিল। অন্যদিকে অন্য কোনো রিজার্ভ কারেন্সি স্বর্ণের সঙ্গে আগে থেকেই সম্পর্কিত ছিল না।
কেউ প্রশ্ন করতে পারে, বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তি-সামর্থ্য তো অনেক পরিবর্তন হচ্ছে। তাহলে শুধু চারটি মুদ্রা কেন রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে পরিগণিত হবে? এর উত্তর হলো, ডলার-পাউন্ড-ইয়েন এই মুদ্রাগুলো আগে থেকেই বিশ্বের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের লেনদেনে ব্যবহূত হয়ে আসছিল। শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ডলার এক নম্বরে উঠে এল যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষমতার জোরে এবং ডলারের বিপরীতে স্বর্ণের একটা সংযোগ ছিল বলে। আর ইউরো তো রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে বিশ্ব-লেনদেনে ব্যবহার হতে লাগল মাত্র ২০০০ সাল থেকে, একত্রে ১১টি ইউরোপীয় অর্থনীতির সমর্থনের জোরে। ইউরোর আগে ইতালির লিরা, ফ্রান্সের ফ্রাংক এসব মুদ্রাকে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে গণ্য করা হতো।
ইউরোর উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ওই সব মুদ্রা গ্লোবাল লেনদেনের দৃশ্যপট থেকে সরে যায়। ভবিষ্যতে আরও কোন কোন মুদ্রা রিজার্ভ মুদ্রা বা গ্লোবাল লেনদেনের মুদ্রা হয়, সেটা ভবিষ্যত্ই বলতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে ভারতের রুপি ও চীনের ইউয়ান বড় প্রার্থী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবসা, যেটা আইএমএফ কর্তৃক স্থাপিত ও তদারকিকৃত, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের পক্ষে। নব্য আর্থিক ধনীরা যত চেষ্টাই করুক না কেন ডলারের সমর্থকেরা তাদের জায়গা ছাড়তে নারাজ। আজও ডলার হলো সম্পদ ধারকের ক্ষেত্রে অতি কাঙ্ক্ষিত মুদ্রা। বিশ্ব লেনদেনের ৬৫-৬৮ শতাংশ ডলারেই সমাধা হচ্ছে। আর বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও প্রায় ওই পরিমাণ তাদের বৈদেশিক মুদ্রাকে ডলারে ধারণ করছে।
চীন-ভারত-ব্রাজিল তাদের মুদ্রাকে জাতে তুলতে চাইছে বটে, তবে রাস্তা অনেক দূর। এ জন্য তাদের আইএমএফ কাঠামোসহ বিশ্ব লেনদেনের কাঠামোয় সংস্কার আনতে হবে। এর সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের মুদ্রাগুলোকে পূর্ণাঙ্গভাবে কনভার্টেবল ঘোষণা করতে হবে। যতই এরা আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের মুদ্রাগুলোকে গ্রহণযোগ্য করাতে চাইবে, ততই নিজ দেশে তাদের একটা দায়িত্বশীল মুদ্রা ও আর্থিকনীতি গ্রহণ করতে হবে। আজকে যে কিছু কিছু আন্তর্জাতিক লেনদেন কানাডীয় ডলার, অস্ট্রেলীয় ডলার, চৈনিক ইউয়ানে হচ্ছে না তা নয়। তবে অতি সীমিত। একমাত্র চীনই আপাতত তাদের মুদ্রাকে লেনদেনে ব্যবহার করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
চীনের জন্য মার্কিন ডলার হলো শাঁখের করাত—উভয় দিকে কাটে। প্রায় সব বৈদেশিক সম্পদই চীন রেখেছে ডলারে। ফলে এই দেশ একদিকে ডলার পতনের ভয়ে কাঁপছে, অন্যদিকে তাড়াতাড়ি ডলার থেকে বের হতে চাইলে ডলারের মূল্য পড়ে নিজেরই ক্ষতি হবে। ফলে চীন বলছে, না, মার্কিন ডলার নয়, আন্তর্জাতিক লেনদেন ও সম্পদ ধারণের ক্ষেত্রে বড় মুদ্রাগুলোর সম্মিলন ঘটিয়ে নতুন মুদ্রা চালু করা হোক, যাতে করে এক মুদ্রা পড়লে অন্য মুদ্রা সম্পদের মূল্যকে রক্ষা করতে পারে। কিন্তু এই প্রস্তাবও অতি পুরোনো। সে রকম তো আইএমএফের নেতৃত্বে একটা মুদ্রা চালু আছে, যার নাম হলো ‘SDR’ (Special Drawing Rights)। কিন্তু এসডিআরের ব্যবহার অতি সীমিত। এর সীমিত করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের পলিসিই অনেকটা দায়ী।
যুক্তরাষ্ট্র কোনো দিন চাইবে না তাদের ডলার মুকুট হারাক, তাই সেটা স্বাভাবিক নিয়মে না হলে আসবে কৌশলে। তবে আজতক ডলারের মুকুট হারানোর কোনো কারণ দেখা যায়নি। ডলার দুর্বল হয়েছে সত্য, ডলারের জায়গা দখল করে নিচ্ছে ইউরো-ইউয়ান-রুপি এরা। কিন্তু অনেক দিন ধরেই ডলার ডলারই থাকবে, কোনো মুদ্রা তার ওপর উঠতে পারবে না।
এক নম্বরের মুদ্রার অবস্থান পাওয়ার জন্য এক নম্বরের অর্থনীতিও জরুরি। চীন এই ক্ষেত্রে একটা চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে বটে, তবে সেটা কত দ্রুত ডলারকে সিংহাসনচ্যুত করে ২০২৫ সালের পরই বলা যাবে, যখন পর্যন্ত অনেকের মতে চীনের অর্থনীতি হবে এক নম্বরের অর্থনীতি। তবে বিশ্ব কখনো একক মুদ্রা দ্বারা শাসিত হবে না। যেটা আমাদের জ্ঞান এখন পর্যন্ত বলে, বিশ্ব চলবে কয়েকটি মুদ্রায়, এর মধ্যে এশীয়দেরও এক বা একাধিক মুদ্রা থাকবে।
যা হোক, বাংলাদেশের কথায় ফিরে আসি। আমাদের মুদ্রা টাকাকে অবমূল্যায়ন করতে বলে সম্ভাব্য উপকারভোগীরা। অবমূল্যায়নের যে একটা খারাপ দিক আছে সেটা তাঁরা ভুলে যান। মুদ্রার মূল্য বৃদ্ধি পেলেও অনেক উপকার থাকতে পারে। অবস্থাটা হলো যেন চেষ্টা-তদবিরের। কিন্তু বিষয়টা সেভাবে দেখা উচিত নয়। আমাদের মুদ্রা এখন বাজারনির্ভর, অনেকটা এর মূল্য বাজার চাহিদা সরবরাহের সঙ্গে গতি রেখে ওঠানামা করছে। সেই অর্থে বাংলাদেশ ব্যাংক আর আগের মতো অবমূল্যায়ন আর উঠতি মূল্যায়ন কোনোটাই করে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের ওপর নজর রাখে বটে। কখনো প্রয়োজনে ডলার কেনে, কখনো বাড়তি ছাড়ে। কোনো বাজারই পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক নয়। সেই অর্থে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারও।
আমাদের অর্থনীতিকে এই পর্যন্ত ফ্লোটিং বা মুদ্রার ভাসমান বিনিময় হার ঠিকই কাজ করে যাচ্ছে। এই বাজারকে কোনো দিক থেকেই বড় ধাক্কা দেওয়া ঠিক হবে না। আর আমাদের মুদ্রার মূল্য আমাদের হাতে, এমন কোনো নীতি গ্রহণ করা বা চালিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না, যাতে করে টাকার মূল্য পড়ে যাওয়ার কারণ ঘটতে পারে। হঠাত্ বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা থেকে আমাদের টাকার মূল্যের পতন হবে না, বরং যেটা নিয়ে আমাদের মৃদু শঙ্কা সেটা হলো আমাদের অর্থনীতিতে সরকার কর্তৃক অতি বেশি ঋণ করা এবং অর্থনীতিতে বিনিয়োগের বন্ধ্যাত্বতা। এই দুইয়ের মিলন হলে টাকা মূল্য হারাতে পারে বইকি। সেই অবস্থায় আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে যাবে, দারিদ্র্য বিমোচনের গতি মন্থর হয়ে যাবে, বাড়তি কর্মক্ষম লোকেরা বেশি হারে বেকার থাকবে ইত্যাদি।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মুদ্রার বিপরীতে টাকা কত মূল্য হারাবে বা মূল্য উদ্ধার করবে, সেটা নির্ভর করে ডলার-ইউরো-পাউন্ড-ইয়েনের পারস্পরিক ওঠানামার ওপরও। ইউরো ডলারের বিপরীতে তেজি হতে লাগলে অবশ্য বাংলাদেশকে বেশি একক টাকা দিয়ে ইউরোকে কিনতে হবে। দুই বছর আগে ব্রিটিশ পাউন্ড অতি তেজি ছিল, সেই পাউন্ডকে কিনতে হতো ১৩৫ টাকা দিয়ে। সেই অবস্থা কি আজকে আছে? মার্কিন ডলার কিন্তু টাকার বিরুদ্ধে তার মানকে ধরেই রেখেছে। এর অর্থ কী? এর অর্থ হলো, ডলার পাউন্ডের বিপরীতে আন্তর্জাতিক বাজারে তেজি হয়েছে, যার কারণে আমরা আগের তুলনায় কম একক টাকা দিয়ে পাউন্ড কিনতে পারি। মুদ্রার পারস্পরিক ওঠানামার পেছনে অনেক উপাদান কাজ করে, যার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা, অন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো মুদ্রার ভবিষ্যত্ ক্রয়ক্ষমতার ওপর লোকজনের বিশ্বাস।
অন্য একটি উপাদান হলো হঠাত্ করে কোনো মুদ্রার জন্য চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া। বিশ্ব আর্থিক দুর্যোগের সময় কিন্তু তুলনামূলকভাবে মার্কিন ডলারের চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল, সে জন্যই মূলত বাজারে পাউন্ড-ইউরোর বিপরীতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। আবার এক দেশ থেকে অন্য দেশে সম্পদ সরিয়ে নেওয়ার গতিটা যদি স্বাভাবিক হয়ে যায়, তখন ডলারের ওই উল্লম্ফন চাহিদাও কমে যেতে পারে, সেই অবস্থায় অন্যান্য বিষয় ঠিক থাকলে ব্রিটিশ পাউন্ডের মূল্য বাড়তেও পারে। মুদ্রা ব্যবসায়ীরা কোন মুদ্রার মূল্য কমবে, কোন মুদ্রার মূল্য বাড়বে ওই সব নিয়ে সর্বদাই জল্পনায় থাকেন। তাঁরা ভবিষ্যতের বাজারেও মুদ্রা বেচাকেনা করেন। ফলে আজকের দিনে মুদ্রাব্যবসাও একটা বড় ব্যবসা।
সত্তরের দশক-পূর্ব সময়ে মুদ্রাব্যবসা অত লাভজনক ছিল না। সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় সব অর্থনীতিই মুদ্রার বিনিময়, বাজারে আগের ফিক্সড-এক্সচেঞ্জ রেইট বা ধরাবাঁধা মূল্যে বিনিময় হারকে ত্যাগ করে, ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেইট বা ভাসমান বিনিময় হার গ্রহণ করে।
ফলে এখন বিশ্বের মুদ্রাগুলোর মান অতি পতন থেকে অতি বর্ধনও ঘটছে। ১৯৭১ পূর্ব পর্যন্ত মার্কিন ডলার ছিল স্বর্ণের সঙ্গে যুক্ত। যেদিন থেকে তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ঘোষণা করলেন, তাঁদের মুদ্রা ডলার আর স্বর্ণের সঙ্গে যুক্ত নয়, সেই দিন গ্লোবাল মুদ্রা বাজারে একটা প্রচণ্ড অবিশ্বাস এবং অনিশ্চয়তার ঢেউ লাগে। ওই স্বর্ণের সঙ্গে ডলারের সম্পর্ক ছেদ হলেও ডলারের বিপরীতে অন্য কোনো মুদ্রা গ্লোবাল লেনদেনে ডলারের স্থানকে সরাতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ ছিল, যুক্তরাষ্ট্র তখনো বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ উত্পাদন ও বাণিজ্যিক লেনদেনের অধিকারী ছিল। অন্যদিকে অন্য কোনো রিজার্ভ কারেন্সি স্বর্ণের সঙ্গে আগে থেকেই সম্পর্কিত ছিল না।
কেউ প্রশ্ন করতে পারে, বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তি-সামর্থ্য তো অনেক পরিবর্তন হচ্ছে। তাহলে শুধু চারটি মুদ্রা কেন রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে পরিগণিত হবে? এর উত্তর হলো, ডলার-পাউন্ড-ইয়েন এই মুদ্রাগুলো আগে থেকেই বিশ্বের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের লেনদেনে ব্যবহূত হয়ে আসছিল। শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ডলার এক নম্বরে উঠে এল যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষমতার জোরে এবং ডলারের বিপরীতে স্বর্ণের একটা সংযোগ ছিল বলে। আর ইউরো তো রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে বিশ্ব-লেনদেনে ব্যবহার হতে লাগল মাত্র ২০০০ সাল থেকে, একত্রে ১১টি ইউরোপীয় অর্থনীতির সমর্থনের জোরে। ইউরোর আগে ইতালির লিরা, ফ্রান্সের ফ্রাংক এসব মুদ্রাকে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে গণ্য করা হতো।
ইউরোর উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ওই সব মুদ্রা গ্লোবাল লেনদেনের দৃশ্যপট থেকে সরে যায়। ভবিষ্যতে আরও কোন কোন মুদ্রা রিজার্ভ মুদ্রা বা গ্লোবাল লেনদেনের মুদ্রা হয়, সেটা ভবিষ্যত্ই বলতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে ভারতের রুপি ও চীনের ইউয়ান বড় প্রার্থী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবসা, যেটা আইএমএফ কর্তৃক স্থাপিত ও তদারকিকৃত, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের পক্ষে। নব্য আর্থিক ধনীরা যত চেষ্টাই করুক না কেন ডলারের সমর্থকেরা তাদের জায়গা ছাড়তে নারাজ। আজও ডলার হলো সম্পদ ধারকের ক্ষেত্রে অতি কাঙ্ক্ষিত মুদ্রা। বিশ্ব লেনদেনের ৬৫-৬৮ শতাংশ ডলারেই সমাধা হচ্ছে। আর বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও প্রায় ওই পরিমাণ তাদের বৈদেশিক মুদ্রাকে ডলারে ধারণ করছে।
চীন-ভারত-ব্রাজিল তাদের মুদ্রাকে জাতে তুলতে চাইছে বটে, তবে রাস্তা অনেক দূর। এ জন্য তাদের আইএমএফ কাঠামোসহ বিশ্ব লেনদেনের কাঠামোয় সংস্কার আনতে হবে। এর সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের মুদ্রাগুলোকে পূর্ণাঙ্গভাবে কনভার্টেবল ঘোষণা করতে হবে। যতই এরা আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের মুদ্রাগুলোকে গ্রহণযোগ্য করাতে চাইবে, ততই নিজ দেশে তাদের একটা দায়িত্বশীল মুদ্রা ও আর্থিকনীতি গ্রহণ করতে হবে। আজকে যে কিছু কিছু আন্তর্জাতিক লেনদেন কানাডীয় ডলার, অস্ট্রেলীয় ডলার, চৈনিক ইউয়ানে হচ্ছে না তা নয়। তবে অতি সীমিত। একমাত্র চীনই আপাতত তাদের মুদ্রাকে লেনদেনে ব্যবহার করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
চীনের জন্য মার্কিন ডলার হলো শাঁখের করাত—উভয় দিকে কাটে। প্রায় সব বৈদেশিক সম্পদই চীন রেখেছে ডলারে। ফলে এই দেশ একদিকে ডলার পতনের ভয়ে কাঁপছে, অন্যদিকে তাড়াতাড়ি ডলার থেকে বের হতে চাইলে ডলারের মূল্য পড়ে নিজেরই ক্ষতি হবে। ফলে চীন বলছে, না, মার্কিন ডলার নয়, আন্তর্জাতিক লেনদেন ও সম্পদ ধারণের ক্ষেত্রে বড় মুদ্রাগুলোর সম্মিলন ঘটিয়ে নতুন মুদ্রা চালু করা হোক, যাতে করে এক মুদ্রা পড়লে অন্য মুদ্রা সম্পদের মূল্যকে রক্ষা করতে পারে। কিন্তু এই প্রস্তাবও অতি পুরোনো। সে রকম তো আইএমএফের নেতৃত্বে একটা মুদ্রা চালু আছে, যার নাম হলো ‘SDR’ (Special Drawing Rights)। কিন্তু এসডিআরের ব্যবহার অতি সীমিত। এর সীমিত করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের পলিসিই অনেকটা দায়ী।
যুক্তরাষ্ট্র কোনো দিন চাইবে না তাদের ডলার মুকুট হারাক, তাই সেটা স্বাভাবিক নিয়মে না হলে আসবে কৌশলে। তবে আজতক ডলারের মুকুট হারানোর কোনো কারণ দেখা যায়নি। ডলার দুর্বল হয়েছে সত্য, ডলারের জায়গা দখল করে নিচ্ছে ইউরো-ইউয়ান-রুপি এরা। কিন্তু অনেক দিন ধরেই ডলার ডলারই থাকবে, কোনো মুদ্রা তার ওপর উঠতে পারবে না।
এক নম্বরের মুদ্রার অবস্থান পাওয়ার জন্য এক নম্বরের অর্থনীতিও জরুরি। চীন এই ক্ষেত্রে একটা চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে বটে, তবে সেটা কত দ্রুত ডলারকে সিংহাসনচ্যুত করে ২০২৫ সালের পরই বলা যাবে, যখন পর্যন্ত অনেকের মতে চীনের অর্থনীতি হবে এক নম্বরের অর্থনীতি। তবে বিশ্ব কখনো একক মুদ্রা দ্বারা শাসিত হবে না। যেটা আমাদের জ্ঞান এখন পর্যন্ত বলে, বিশ্ব চলবে কয়েকটি মুদ্রায়, এর মধ্যে এশীয়দেরও এক বা একাধিক মুদ্রা থাকবে।
যা হোক, বাংলাদেশের কথায় ফিরে আসি। আমাদের মুদ্রা টাকাকে অবমূল্যায়ন করতে বলে সম্ভাব্য উপকারভোগীরা। অবমূল্যায়নের যে একটা খারাপ দিক আছে সেটা তাঁরা ভুলে যান। মুদ্রার মূল্য বৃদ্ধি পেলেও অনেক উপকার থাকতে পারে। অবস্থাটা হলো যেন চেষ্টা-তদবিরের। কিন্তু বিষয়টা সেভাবে দেখা উচিত নয়। আমাদের মুদ্রা এখন বাজারনির্ভর, অনেকটা এর মূল্য বাজার চাহিদা সরবরাহের সঙ্গে গতি রেখে ওঠানামা করছে। সেই অর্থে বাংলাদেশ ব্যাংক আর আগের মতো অবমূল্যায়ন আর উঠতি মূল্যায়ন কোনোটাই করে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের ওপর নজর রাখে বটে। কখনো প্রয়োজনে ডলার কেনে, কখনো বাড়তি ছাড়ে। কোনো বাজারই পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক নয়। সেই অর্থে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারও।
আমাদের অর্থনীতিকে এই পর্যন্ত ফ্লোটিং বা মুদ্রার ভাসমান বিনিময় হার ঠিকই কাজ করে যাচ্ছে। এই বাজারকে কোনো দিক থেকেই বড় ধাক্কা দেওয়া ঠিক হবে না। আর আমাদের মুদ্রার মূল্য আমাদের হাতে, এমন কোনো নীতি গ্রহণ করা বা চালিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না, যাতে করে টাকার মূল্য পড়ে যাওয়ার কারণ ঘটতে পারে। হঠাত্ বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা থেকে আমাদের টাকার মূল্যের পতন হবে না, বরং যেটা নিয়ে আমাদের মৃদু শঙ্কা সেটা হলো আমাদের অর্থনীতিতে সরকার কর্তৃক অতি বেশি ঋণ করা এবং অর্থনীতিতে বিনিয়োগের বন্ধ্যাত্বতা। এই দুইয়ের মিলন হলে টাকা মূল্য হারাতে পারে বইকি। সেই অবস্থায় আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে যাবে, দারিদ্র্য বিমোচনের গতি মন্থর হয়ে যাবে, বাড়তি কর্মক্ষম লোকেরা বেশি হারে বেকার থাকবে ইত্যাদি।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments