জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে কিছু কথা -শিক্ষাব্যবস্থা by মোহাম্মদ কায়কোবাদ
এ যাবত্ আমাদের দেশে ছয়টি শিক্ষা কমিশন/কমিটি গঠিত হলেও কোনো শিক্ষানীতিই যে কার্যকর হয়নি তা থেকে বলা যায় যে শিক্ষা কোনো আমলেই আমাদের দেশে অগ্রাধিকার পায়নি। ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ কথাটি আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কখনো বিশ্বাস করে না। কখনো কমিটি হয়েছে, কালক্ষেপণ হয়েছে কিন্তু নীতি হয়নি, কখনো নীতি হয়েছে কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। এবার একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এই বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসার।
বর্তমান শিক্ষা কমিশন ৩ মে থেকে ২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২৩টি সভা করেছে, ৫৬টি সংস্থা ও সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। এর মধ্যে চূড়ান্ত খসড়া সরকারের কাছে জমাও দেওয়া হয়েছে। সরকার তার প্রথম বছরও শেষ করেনি, সুতরাং এই নীতির কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য হাতে চার বছর সময় রয়েছে। শিক্ষানীতি প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষাবিদ ও অন্য সবাইকে অভিনন্দন জানাই। শিক্ষানীতি একটি দেশের জনসাধারণের আত্মিক, মানসিক এবং জীবনের উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপক বিষয়। অতি অল্প সময়ে এ রকম একটি পূর্ণাঙ্গ দলিলের খসড়া তৈরি নিঃসন্দেহে একটি দুরূহ কাজ। এই নীতি প্রণয়নে যাঁরা আন্তরিকভাবে, অঙ্গীকার নিয়ে, দেশপ্রেম নিয়ে, সাধারণ মানুষের জন্য ভালোবাসা নিয়ে মেধা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছেন তাঁদের ধন্যবাদ জানাই।
৯০ পৃষ্ঠার খসড়ায় সাধারণ মানুষের জীবিকার কথা বলা হয়েছে, ঝরে পড়া ছাত্রদের জীবিকার কথা বলা হয়েছে, উত্কর্ষ অর্জন সাপেক্ষে সাধারণ ছাত্রদের উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্তির পথের কথা বলা হয়েছে, যাতে যোগ্য কারও অগ্রগতির পথ বন্ধ হয়ে না যায়। শিক্ষার কোনো ক্ষেত্রের কথা বাদ যায়নি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, প্রকৌশল, চিকিত্সা, বৃত্তিমূলক, কারিগরি, বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যবসায়, কৃষি, আইন, নারী, ললিতকলা, ধর্ম, ক্রীড়া কিছুই নজর এড়ায়নি। গ্রন্থাগার, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন, শিক্ষার্থী ভর্তি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষকদের মর্যাদা, অধিকার, দায়িত্ব পালনকালে সন্ত্রাসীদের আক্রমণের লক্ষ্য হলে তার বিধান, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষাপ্রশাসন, অর্থায়ন কোনো কিছু বাদ যায়নি।
তবে সুপ্তভাবে এই শিক্ষানীতিতে নিশ্চয়তার সঙ্গে যা ধরে নেওয়া হয়েছে, তাহলো রাষ্ট্র ও প্রশাসনযন্ত্র এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য উঠে-পড়ে লাগবে। তবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। সরকার বদলেছে ঠিক কিন্তু একই মানসম্পন্ন দেশপ্রেমবিবর্জিত সমাজপতিরা, কর্মকর্তারা নানা পর্যায়ের নেতারা যদি এর বাস্তবায়নে থাকে তাহলে আমরা তিমিরেই থেকে যাব। এর যথার্থ বাস্তবায়নের জন্য সংস্থাগুলো সম্পর্কেও নির্দেশনা বা গাইডলাইন দিতে হবে। এ বিষয়গুলো নিয়ে কিছু প্রস্তাব নিচে দেওয়া হলো:
১. দীর্ঘদিন ধরে আমরা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কথা বলে আসছি যা তথ্যপ্রযুক্তির সুবাদে নিশ্চিত করা খুবই সহজ। যে কমিটি জাতীয় শিক্ষানীতির এত সুন্দর খসড়া চূড়ান্ত করেছে সন্দেহাতীতভাবে তার সদস্যরা আমাদের সমাজের অগ্রপথিক, নিবেদিতপ্রাণ জ্ঞান তাপস। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের বেশির ভাগের ওয়েব উপস্থিতি না থাকার ফলে এই নীতির প্রতি সাধারণ মানুষ যথাযথ আস্থা স্থাপনে ব্যর্থ হবে। অথচ তাদের ওয়েব উপস্থিতি থাকলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি শুধু আপ্তবাক্য হিসেবে উচ্চারিত হতো না, তা অনুশীলিতও হতো। জাতীয় পর্যায়ে যেকোনো রকম কমিটি কিংবা বিশেষজ্ঞ নির্বাচনে ওয়েব উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করলে স্বচ্ছতা যেমন নিশ্চিত হবে, ঠিক তেমনি তাদের কর্মবৃত্তান্তে সাধারণ মানুষ উজ্জীবিত বোধ করবে।
২. আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষা কীভাবে আমাদের জীবনধারাকে উন্নত করতে পারে, বেকারত্বের অভিশাপ থেকে দেশবাসী কীভাবে মুক্তি পেতে পারে, পৃথিবীতে আমরা একটি গর্বিত জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারব তা এই দলিলের একাধিক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা যে দেশ-কালের সীমানা ছাড়িয়ে মানবতার, সভ্যতার, সমাজের বিকাশে ভূমিকা রাখবে, জ্ঞান সৃষ্টি এবং সত্যানুসন্ধানে মানুষকে উত্সাহিত করবে তা পরিষ্কারভাবে কোথায়ও উচ্চারিত হয়নি। কিন্তু সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবদের শিক্ষানীতিতে এসব কথা থাকতেই হবে, আমরা যতই সমস্যাজর্জরিত থাকি না কেন।
৩. ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে এই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে সরকারকে জাতীয় উত্পাদনের ছয় শতাংশ বিনিয়োগ করতে হবে, যেখানে বর্তমানে আছে ২ দশমিক ২৭ শতাংশ। এমতাবস্থায় ব্যয়সাশ্রয়ীভাবে শিক্ষানীতির বাস্তবায়নে তথ্যপ্রযুক্তির মতো সর্বজনীন প্রযুক্তির দেশব্যাপী কার্যকর ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এই নীতি বাস্তবায়নে যত প্রশিক্ষিত, অভিজ্ঞ শিক্ষক আমাদের দরকার, তা এ মূহূর্তে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু যোগ্য, অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দিয়ে প্রতি শ্রেণীর প্রতি বিষয়ের ওপর কম্পিউটার এইডেড লার্নিং প্যাকেজ করে তা একাধিক টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে রুটিনমাফিক প্রচার করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের জন্য সমসুযোগ তৈরি করতে পারে। প্রতি স্কুলের একটি শ্রেণীকক্ষে একটি টিভি স্থাপন করলে ছাত্র ও শিক্ষক উভয়েই উপকৃত হতে পারে।
৪. স্কুল-কলেজের শিক্ষক নিয়োগে সরকারি কর্মকমিশনের অনুরূপ একটি কমিশন গঠন করার প্রস্তাবটি চমত্কার। গ্রামের স্কুল-কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অশিক্ষিত ক্ষমতাধর মানুষেরা দখল করেন, যাঁরা শিক্ষার উত্কর্ষ অর্জনে শিক্ষকদের কোনো রকম পরামর্শদানের যোগ্যতা রাখে না। নিয়োগবাণিজ্য এবং অর্থ আত্মসাতেই তাদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ। এর ফলে প্রায় ক্ষেত্রেই যোগ্য প্রার্থীরা শিক্ষকতার চাকরি পান না। এ কাজগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে কিংবা আঞ্চলিকভাবে করতে পারলে ব্যবস্থাপনা কমিটির ব্যাপক দুর্নীতিকে রোধ করা সম্ভব হবে। অবশ্য এ কথাও মনে রাখতে হবে যে শিক্ষাসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি অতিসমপ্রতি অভিমত প্রকাশ করেছে যে এই খাতটি অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত।
৫. নানা বিষয়েই, নানা ক্ষেত্রেই আমাদের নীতির অভাব নেই। তবুও কোনো ক্ষেত্রেই আমরা উত্কর্ষ অর্জন করছি না, দুর্নীতির রাহুগ্রাসে দেশটির ললাটে জুটেছে পাঁচবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার লজ্জা। এমতাবস্থায় শুধু নীতি প্রণয়নে যে কাজ হবে না তা বলাই বাহুল্য। শিক্ষার নেতৃত্বে যোগ্য নিবেদিতপ্রাণ লোকদের আনতে হবে, যাতে নীতি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়। ঠিক একইভাবে দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা কমিটির সদস্য হিসেবে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া উচিত। উদাহরণস্বরূপ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর সদস্য হতে দ্বিতীয় বিভাগে স্নাতক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর স্নাতকোত্তর পাস হতে হবে। একই ব্যক্তিকে কোনো অবস্থাতেই মাত্রাতিরিক্তসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে দেওয়া যাবে না।
৬. শিক্ষকদের বেতন কাঠামো এবং মর্যাদা নির্ধারণে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর অভিজ্ঞতা বিবেচনা করা যেতে পারে।
৭. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় উত্কর্ষ অর্জন করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে র্যাংকিং প্রথা চালু করার কথা বলা হয়েছে। এ ধারণাকে সমপ্রসারিত করে স্কুল-কলেজগুলোকে র্যাংক ও পুরস্কৃত করতে হবে।
৮. অধ্যায় ২১এ পরীক্ষা ও মূল্যায়ন সম্পর্কে বলা হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে আমাদের দেশে শুধুই মুখস্থ করে যে ভালো করা যায় তা আমরা জানি। পক্ষান্তরে স্যাট পরীক্ষাগুলোর কার্যকারিতাও আমরা জানি। লাখ লাখ ছাত্র যে প্রশ্নে পরীক্ষা দেবে. তার আয়োজনে আমাদের বিনিয়োগ আরও অনেক বেশি হওয়া উচিত। কেবল মানসম্পন্ন, সৃজনশীলতা উদ্বুদ্ধকারী প্রশ্নপত্রই আমাদের মুখস্থ নামের বিষবৃক্ষকে অপসারণ করতে পারে।
৯. স্কুল-কলেজগুলোর মধ্যে উত্কর্ষ অর্জনের সুস্থ প্রতিযোগিতাকে বেগবান করতে নানা রকম র্যাংকিং প্রথা ছাড়া সকল শ্রেণীতে সকল বিষয়ে উপজেলা পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত ঘটা করে অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতা আয়োজন করা উচিত। শুধু তা-ই নয়, আমাদের শিক্ষা বিশ্বমানের হচ্ছে কি না তা যাচাইয়ের জন্য সকল আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
১০. ক্রীড়া বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চারটি এবং সমপ্রতি ভারতে একটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এ রকম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অত্যুত্সাহী হয়ে যাবে। বরং চা, চামড়া, পাট কিংবা পোশাক শিল্পকে কেন্দ্র করে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে জাতীয় অগ্রগতিতে অধিকতর অবদান রাখা সম্ভব।
১১. শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম বিকশিত হবে এ কথাটি শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে যথার্থভাবেই উচ্চারিত হয়েছে। তবে প্রেম-ভালোবাসা এমনিতেই পল্লবিত হয় না এর পেছনে বেদনা, কষ্ট ত্যাগ থাকতে হয়। কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সামরিক বাহিনীতে চাকরি করা বাধ্যতামূলক। আমরা অন্তত আমাদের তরুণদের পাবলিক পরীক্ষার পর ফাঁকা সময়টিতে বয়স্ক শিক্ষার মতো কার্যক্রমে নিয়োজিত করতে পারি।
১২. কোরিয়া কাইস্ট নিয়ে গর্বিত, ইসরায়েল টেকনিয়ন নিয়ে, ইংল্যান্ড অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ নিয়ে, ভারত আইআইটি নিয়ে। আমরা একসময় আদমজী জুট মল নিয়ে গর্ব করতাম। এখন কী নিয়ে করব, যা আমাদের উত্সাহিত করবে, দেশ গঠনে আত্মবিশ্বাসী করে তু্লবে? আমাদের দেশে নানা সমস্যায় আমরা আক্রান্ত, তাও আবার চক্রাকারে নিয়মিতভাবে। যানজট, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খাদ্যাভাব আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। এমতাবস্থায় একটি সেন্টার অব এক্সিলেন্স প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যা নানা জাতীয় সমস্যা সমাধানে সরকারের থিংকট্যাংক হিসেবে কাজ করবে।
আমি আশা করি, সরকার যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষানীতিটিকে দ্রুতগতিতে বাস্তবায়ন করার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান শিক্ষা কমিশন ৩ মে থেকে ২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২৩টি সভা করেছে, ৫৬টি সংস্থা ও সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। এর মধ্যে চূড়ান্ত খসড়া সরকারের কাছে জমাও দেওয়া হয়েছে। সরকার তার প্রথম বছরও শেষ করেনি, সুতরাং এই নীতির কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য হাতে চার বছর সময় রয়েছে। শিক্ষানীতি প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষাবিদ ও অন্য সবাইকে অভিনন্দন জানাই। শিক্ষানীতি একটি দেশের জনসাধারণের আত্মিক, মানসিক এবং জীবনের উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপক বিষয়। অতি অল্প সময়ে এ রকম একটি পূর্ণাঙ্গ দলিলের খসড়া তৈরি নিঃসন্দেহে একটি দুরূহ কাজ। এই নীতি প্রণয়নে যাঁরা আন্তরিকভাবে, অঙ্গীকার নিয়ে, দেশপ্রেম নিয়ে, সাধারণ মানুষের জন্য ভালোবাসা নিয়ে মেধা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছেন তাঁদের ধন্যবাদ জানাই।
৯০ পৃষ্ঠার খসড়ায় সাধারণ মানুষের জীবিকার কথা বলা হয়েছে, ঝরে পড়া ছাত্রদের জীবিকার কথা বলা হয়েছে, উত্কর্ষ অর্জন সাপেক্ষে সাধারণ ছাত্রদের উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্তির পথের কথা বলা হয়েছে, যাতে যোগ্য কারও অগ্রগতির পথ বন্ধ হয়ে না যায়। শিক্ষার কোনো ক্ষেত্রের কথা বাদ যায়নি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, প্রকৌশল, চিকিত্সা, বৃত্তিমূলক, কারিগরি, বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যবসায়, কৃষি, আইন, নারী, ললিতকলা, ধর্ম, ক্রীড়া কিছুই নজর এড়ায়নি। গ্রন্থাগার, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন, শিক্ষার্থী ভর্তি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষকদের মর্যাদা, অধিকার, দায়িত্ব পালনকালে সন্ত্রাসীদের আক্রমণের লক্ষ্য হলে তার বিধান, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষাপ্রশাসন, অর্থায়ন কোনো কিছু বাদ যায়নি।
তবে সুপ্তভাবে এই শিক্ষানীতিতে নিশ্চয়তার সঙ্গে যা ধরে নেওয়া হয়েছে, তাহলো রাষ্ট্র ও প্রশাসনযন্ত্র এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য উঠে-পড়ে লাগবে। তবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। সরকার বদলেছে ঠিক কিন্তু একই মানসম্পন্ন দেশপ্রেমবিবর্জিত সমাজপতিরা, কর্মকর্তারা নানা পর্যায়ের নেতারা যদি এর বাস্তবায়নে থাকে তাহলে আমরা তিমিরেই থেকে যাব। এর যথার্থ বাস্তবায়নের জন্য সংস্থাগুলো সম্পর্কেও নির্দেশনা বা গাইডলাইন দিতে হবে। এ বিষয়গুলো নিয়ে কিছু প্রস্তাব নিচে দেওয়া হলো:
১. দীর্ঘদিন ধরে আমরা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কথা বলে আসছি যা তথ্যপ্রযুক্তির সুবাদে নিশ্চিত করা খুবই সহজ। যে কমিটি জাতীয় শিক্ষানীতির এত সুন্দর খসড়া চূড়ান্ত করেছে সন্দেহাতীতভাবে তার সদস্যরা আমাদের সমাজের অগ্রপথিক, নিবেদিতপ্রাণ জ্ঞান তাপস। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের বেশির ভাগের ওয়েব উপস্থিতি না থাকার ফলে এই নীতির প্রতি সাধারণ মানুষ যথাযথ আস্থা স্থাপনে ব্যর্থ হবে। অথচ তাদের ওয়েব উপস্থিতি থাকলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি শুধু আপ্তবাক্য হিসেবে উচ্চারিত হতো না, তা অনুশীলিতও হতো। জাতীয় পর্যায়ে যেকোনো রকম কমিটি কিংবা বিশেষজ্ঞ নির্বাচনে ওয়েব উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করলে স্বচ্ছতা যেমন নিশ্চিত হবে, ঠিক তেমনি তাদের কর্মবৃত্তান্তে সাধারণ মানুষ উজ্জীবিত বোধ করবে।
২. আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষা কীভাবে আমাদের জীবনধারাকে উন্নত করতে পারে, বেকারত্বের অভিশাপ থেকে দেশবাসী কীভাবে মুক্তি পেতে পারে, পৃথিবীতে আমরা একটি গর্বিত জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারব তা এই দলিলের একাধিক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা যে দেশ-কালের সীমানা ছাড়িয়ে মানবতার, সভ্যতার, সমাজের বিকাশে ভূমিকা রাখবে, জ্ঞান সৃষ্টি এবং সত্যানুসন্ধানে মানুষকে উত্সাহিত করবে তা পরিষ্কারভাবে কোথায়ও উচ্চারিত হয়নি। কিন্তু সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবদের শিক্ষানীতিতে এসব কথা থাকতেই হবে, আমরা যতই সমস্যাজর্জরিত থাকি না কেন।
৩. ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে এই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে সরকারকে জাতীয় উত্পাদনের ছয় শতাংশ বিনিয়োগ করতে হবে, যেখানে বর্তমানে আছে ২ দশমিক ২৭ শতাংশ। এমতাবস্থায় ব্যয়সাশ্রয়ীভাবে শিক্ষানীতির বাস্তবায়নে তথ্যপ্রযুক্তির মতো সর্বজনীন প্রযুক্তির দেশব্যাপী কার্যকর ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এই নীতি বাস্তবায়নে যত প্রশিক্ষিত, অভিজ্ঞ শিক্ষক আমাদের দরকার, তা এ মূহূর্তে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু যোগ্য, অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দিয়ে প্রতি শ্রেণীর প্রতি বিষয়ের ওপর কম্পিউটার এইডেড লার্নিং প্যাকেজ করে তা একাধিক টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে রুটিনমাফিক প্রচার করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের জন্য সমসুযোগ তৈরি করতে পারে। প্রতি স্কুলের একটি শ্রেণীকক্ষে একটি টিভি স্থাপন করলে ছাত্র ও শিক্ষক উভয়েই উপকৃত হতে পারে।
৪. স্কুল-কলেজের শিক্ষক নিয়োগে সরকারি কর্মকমিশনের অনুরূপ একটি কমিশন গঠন করার প্রস্তাবটি চমত্কার। গ্রামের স্কুল-কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অশিক্ষিত ক্ষমতাধর মানুষেরা দখল করেন, যাঁরা শিক্ষার উত্কর্ষ অর্জনে শিক্ষকদের কোনো রকম পরামর্শদানের যোগ্যতা রাখে না। নিয়োগবাণিজ্য এবং অর্থ আত্মসাতেই তাদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ। এর ফলে প্রায় ক্ষেত্রেই যোগ্য প্রার্থীরা শিক্ষকতার চাকরি পান না। এ কাজগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে কিংবা আঞ্চলিকভাবে করতে পারলে ব্যবস্থাপনা কমিটির ব্যাপক দুর্নীতিকে রোধ করা সম্ভব হবে। অবশ্য এ কথাও মনে রাখতে হবে যে শিক্ষাসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি অতিসমপ্রতি অভিমত প্রকাশ করেছে যে এই খাতটি অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত।
৫. নানা বিষয়েই, নানা ক্ষেত্রেই আমাদের নীতির অভাব নেই। তবুও কোনো ক্ষেত্রেই আমরা উত্কর্ষ অর্জন করছি না, দুর্নীতির রাহুগ্রাসে দেশটির ললাটে জুটেছে পাঁচবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার লজ্জা। এমতাবস্থায় শুধু নীতি প্রণয়নে যে কাজ হবে না তা বলাই বাহুল্য। শিক্ষার নেতৃত্বে যোগ্য নিবেদিতপ্রাণ লোকদের আনতে হবে, যাতে নীতি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়। ঠিক একইভাবে দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা কমিটির সদস্য হিসেবে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া উচিত। উদাহরণস্বরূপ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর সদস্য হতে দ্বিতীয় বিভাগে স্নাতক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর স্নাতকোত্তর পাস হতে হবে। একই ব্যক্তিকে কোনো অবস্থাতেই মাত্রাতিরিক্তসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে দেওয়া যাবে না।
৬. শিক্ষকদের বেতন কাঠামো এবং মর্যাদা নির্ধারণে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর অভিজ্ঞতা বিবেচনা করা যেতে পারে।
৭. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় উত্কর্ষ অর্জন করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে র্যাংকিং প্রথা চালু করার কথা বলা হয়েছে। এ ধারণাকে সমপ্রসারিত করে স্কুল-কলেজগুলোকে র্যাংক ও পুরস্কৃত করতে হবে।
৮. অধ্যায় ২১এ পরীক্ষা ও মূল্যায়ন সম্পর্কে বলা হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে আমাদের দেশে শুধুই মুখস্থ করে যে ভালো করা যায় তা আমরা জানি। পক্ষান্তরে স্যাট পরীক্ষাগুলোর কার্যকারিতাও আমরা জানি। লাখ লাখ ছাত্র যে প্রশ্নে পরীক্ষা দেবে. তার আয়োজনে আমাদের বিনিয়োগ আরও অনেক বেশি হওয়া উচিত। কেবল মানসম্পন্ন, সৃজনশীলতা উদ্বুদ্ধকারী প্রশ্নপত্রই আমাদের মুখস্থ নামের বিষবৃক্ষকে অপসারণ করতে পারে।
৯. স্কুল-কলেজগুলোর মধ্যে উত্কর্ষ অর্জনের সুস্থ প্রতিযোগিতাকে বেগবান করতে নানা রকম র্যাংকিং প্রথা ছাড়া সকল শ্রেণীতে সকল বিষয়ে উপজেলা পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত ঘটা করে অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতা আয়োজন করা উচিত। শুধু তা-ই নয়, আমাদের শিক্ষা বিশ্বমানের হচ্ছে কি না তা যাচাইয়ের জন্য সকল আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
১০. ক্রীড়া বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চারটি এবং সমপ্রতি ভারতে একটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এ রকম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অত্যুত্সাহী হয়ে যাবে। বরং চা, চামড়া, পাট কিংবা পোশাক শিল্পকে কেন্দ্র করে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে জাতীয় অগ্রগতিতে অধিকতর অবদান রাখা সম্ভব।
১১. শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম বিকশিত হবে এ কথাটি শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে যথার্থভাবেই উচ্চারিত হয়েছে। তবে প্রেম-ভালোবাসা এমনিতেই পল্লবিত হয় না এর পেছনে বেদনা, কষ্ট ত্যাগ থাকতে হয়। কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সামরিক বাহিনীতে চাকরি করা বাধ্যতামূলক। আমরা অন্তত আমাদের তরুণদের পাবলিক পরীক্ষার পর ফাঁকা সময়টিতে বয়স্ক শিক্ষার মতো কার্যক্রমে নিয়োজিত করতে পারি।
১২. কোরিয়া কাইস্ট নিয়ে গর্বিত, ইসরায়েল টেকনিয়ন নিয়ে, ইংল্যান্ড অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ নিয়ে, ভারত আইআইটি নিয়ে। আমরা একসময় আদমজী জুট মল নিয়ে গর্ব করতাম। এখন কী নিয়ে করব, যা আমাদের উত্সাহিত করবে, দেশ গঠনে আত্মবিশ্বাসী করে তু্লবে? আমাদের দেশে নানা সমস্যায় আমরা আক্রান্ত, তাও আবার চক্রাকারে নিয়মিতভাবে। যানজট, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খাদ্যাভাব আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। এমতাবস্থায় একটি সেন্টার অব এক্সিলেন্স প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যা নানা জাতীয় সমস্যা সমাধানে সরকারের থিংকট্যাংক হিসেবে কাজ করবে।
আমি আশা করি, সরকার যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষানীতিটিকে দ্রুতগতিতে বাস্তবায়ন করার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments