বাংলাদেশকে ছড়িয়ে দিতে হবে বাংলাদেশে -যুক্তি তর্ক গল্প by আবুল মোমেন
সম্প্রতি জনপ্রিয় লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ঢাকা মহানগরের এক দুর্যোগময় করুণ চিত্র তুলে ধরে কলাম লিখেছিলেন প্রথম আলোয়। লেখাটি কাল্পনিক হলেও ঢাকাবাসী এবং ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন যে এ শোচনীয় বাস্তবতা অত্যাসন্ন, ক্ষেত্র বিশেষে তা এখনই সত্য। জাফর ইকবাল ছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিতই ঢাকা মহানগরের বর্তমান দুর্দশা এবং অদূর ভবিষ্যতের বিপর্যয় সম্পর্কে নানা রকম লেখা প্রকাশিত হচ্ছে।
ঢাকার দুর্দশা এবং সম্ভাব্য ভয়ানক পরিণতি নিয়ে তেমন দ্বিমত শোনা যায় না। সব সরকারই ঢাকাবাসী ও দেশবাসীকে আশ্বাস দেয়, আশার বাণী শোনায়। কিন্তু ঢাকার অগস্ত্যযাত্রা অব্যাহত থাকে, শেষের সে ভয়ঙ্কর দিন যেন কেবল কাছিয়েই আসছে।
আমি ঢাকাবাসী নই। নগর পরিকল্পনাবিদও নই। সে অর্থে এ নিয়ে বলার বোনাফাইড অধিকারী নই। কিন্তু রোগীর যখন নাভিশ্বাস ওঠে, তখন শুধু ডাক্তার-বদ্যিতে চলে না, এর-ওর কথাও কিছু শুনতে হয়। সেভাবেই দেশের একজন উদ্বিগ্ন নাগরিক হিসেবে কিছু বলা।
আমিও রাজধানী শহরের দুর্দশায় ভুক্তভোগী বইকি। তা ছাড়া রাজধানীই তো সারা দেশের সব নগরের প্রবণতা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। অথচ ঢাকার দৃষ্টান্ত কোনো নগরের জন্যই তো মঙ্গলজনক হবে না। তাই রাজধানী ঢাকা মহানগরকে বাঁচানো সবার স্বার্থেই প্রয়োজন।
মহানগর ঢাকার সংকট দ্রুত গভীর থেকে গভীরতর হওয়ার কারণ, এর অতিবিস্তার (overgrowth) ঠেকানো যাচ্ছে না। অতিবিস্তারের মূল কারণ, সারা দেশ থেকে অবিরত মানুষ ঢাকা নগরে ছুটে আসছে, আস্তানা গাড়ছে। নিজের গ্রাম, শহর, চাকরিস্থল ফেলে কেন মানুষ এভাবে ঢাকামুখী হয়ে পড়েছে, তারও আবার একটা মূল কারণ আছে। সারা দেশে কর্মসংস্থান ও জীবন বিকাশের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সংকুচিত হয়ে আসছে বলে মানুষ দেশের সম্পদ ও ক্ষমতার মূল কেন্দ্র রাজধানীতে ভিড় করছে।
সরকার রাজধানীতে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে সব সরকারি সিদ্ধান্ত যদি ঢাকায়ই নেওয়া হয় কিংবা সব সিদ্ধান্তের জন্য যদি ঢাকার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়, তাহলে ঢাকায় না থেকে মানুষের উপায় কী?
আমরা গণতন্ত্রের জন্য অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকার করেছি। কিন্তু ক্ষমতার বিকেন্দ্রায়ন করা সম্ভব হয়নি, সরকারের কর্তৃত্ব দিন দিন বরং একজায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়েছে। বিনিয়োগের সূত্রেই চাকরির সৃষ্টি হয়। কিন্তু বিনিয়োগ এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যাংকিং, বিপণন ও আনুষঙ্গিক সব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তের মালিকেরা ঢাকায় কেন্দ্রীভূত। ফলে সব উদ্যোক্তাকে ঢাকায় অফিস রাখতে হয় এবং বারবার ছোটাছুটির ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে অনেকেই শেষ পর্যন্ত অফিস, ব্যবসা এমনকি কল-কারখানা পর্যন্ত ঢাকায় স্থানান্তর করেছেন। চাকরিপ্রত্যাশীরাও জানেন, সম্ভাবনা যেটুকু আছে তা ঢাকায়ই। অতএব, তাঁদেরও ভিড় করতে হয় ঢাকায়।
সরকার, সম্পদ, ক্ষমতাকে ঘিরে তৈরি হয় অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিল্পচর্চা, ব্যবসা, প্রশাসন, পেশা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যদি উন্নতি করতে চান, তাহলে কপাল ঠুকে ঢাকায় এসে ভাগ্যান্বেষণই শ্রেয়। অন্যত্র এ সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। প্রায় নেই বললেই চলে।
সবকিছু, বিশেষত সম্পদ ও ক্ষমতা, একজায়গায় কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে একদিকে ভাগ্যান্বেষী মানুষ দলে দলে ঢাকায় ভিড় করছে, অন্যদিকে ঢাকায় থেকে যাঁরা ভাগ্যবান ভাবছেন নিজেদের, তাঁরা কিছুতেই ঢাকা ছাড়তে রাজি নন।
দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, ব্রিটিশ আমল থেকে আইন ছিল, শুনেছি আইনটি এখনো আছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ নিজ কর্মস্থলে পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকতে হবে। এভাবে শিক্ষিত অফিসারদের পরিবারের প্রভাবে অতীতে অনেক ছোট ছোট মহকুমা শহরকেও শিক্ষা ও সংস্কৃতির আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখা গেছে। কিন্তু আজকের দিনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তো বটেই, এমনকি অনেক নিম্নপর্যায়ের কর্মীও পরিবারকে ঢাকায় রাখে। মূল অজুহাত, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, বুড়ো মা-বাবার চিকিত্সা। হায়! অতীতে এঁরাই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে একেকটি অঞ্চলে সেরা সেরা স্কুল গড়ে তুলেছেন। কোথাও গান-বাজনার স্কুল গড়েছেন, কোথাও নাট্যশালা, কোথাও বা আস্ত স্টেডিয়াম এবং নিয়মিত খেলাধুলার চর্চা চালিয়ে গেছেন।
বিকেন্দ্রীকরণের রাজনীতি আর চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী করার ধুয়া তোলার পর পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু শুনেছি, চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা দাপ্তরিক কাজের অজুহাতে মাসের চার সপ্তাহের তিন সপ্তাহই ঢাকায় কাটান।
এভাবে প্রবাসী নিঃসঙ্গ অফিসার সপ্তাহান্তে ঢাকায় গিয়ে পরিবারের সান্নিধ্যের আর সুযোগ পেলে ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের তদবির করার জন্য কর্মস্থলে আকুলতায় কাটান সপ্তাহের কটি দিন। পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নতা, একজন মানুষের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা ছাড়াও নানা আর্থিক ও নৈতিক দুর্নীতিরও জন্ম দেয়। কিন্তু এ বিষয়গুলো ভাবার মতো কেউ নেই বলেই মনে হয়। দেশের দ্বিতীয় নগর চট্টগ্রামেই যখন এ অবস্থা, তখন অন্যান্য জেলা শহর ও উপজেলা শহরের কী অবস্থা, তা সহজেই অনুমেয়। এভাবে ঢাকাবাসের সুযোগ একবার যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা আর ঢাকা ছাড়ছেন না।
এদিকে বিভিন্ন ছোট-বড় শহরে যেসব কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী বড় হওয়ার ও সফল হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তারাও জানে যেকোনোভাবে তাদের ঢাকায় এসে ঠাঁই করে নিতে হবে। নয়তো স্বপ্ন সফল হবে না। আবার এসব ছোট-বড় শহরে যারা প্রতিভার ঝলক দেখাচ্ছে, সেই প্রতিভা ও সাফল্যই তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঢাকায়।
আজ হয়তো কৃতী খেলোয়াড় সাকিব বা মাশরাফিরা সুযোগ পেলেই নিজের ডেরা মাগুরা বা নড়াইলে ছুটে যান, কিন্তু বলে দেওয়া যায়, ইতিহাস তাঁদের স্থায়ী আবাস হিসেবে ঢাকাকেই নির্ধারণ করে দিয়েছে। এভাবে জাহিদ হাসান, আইয়ুব বাচ্চু, কবরীরা স্থায়ীভাবে ঢাকার বাসিন্দা হয়ে গেছেন।
অতীতে মানুষ অবসর নেওয়ার পর কিংবা বৃদ্ধ বয়সে নিজের পৈতৃক বাসভবন বা নিজের শহরে ফিরে আসতেন। এখন সন্তান কিংবা নাতি-নাতনির শিক্ষা আর নিজেদের চিকিত্সার দোহাই দিয়ে কেউই ঢাকা ছাড়তে নারাজ।
এভাবে চাকরিপ্রত্যাশী বেকার, অধিকতর সুযোগ ও লাভপ্রত্যাশী ব্যবসায়ী, চাকরিতে উন্নতিপ্রত্যাশী তদবিরকারী চাকুরে, সম্ভাবনাময় অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-গায়িকা, নৃত্যশিল্পী, উচ্চাভিলাষী রাজনীতিবিদ, মামলার জট থেকে মুক্তিকামী মাস্তান—সবাই মহানগরে আশ্রয় নিতে ছুটে আসছেন। একদিকে ছুটে আসা, আরেক দিকে ছাড়তে না চাওয়া নাছোড়বান্দা মানুষের ভিড়ে ঢাকা পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। লাফিয়ে বাড়ছে জনসংখ্যা। বাড়তে বাড়তে এখন ঢাকা প্রায় এক কোটি ২০ লাখ জন-অধ্যুষিত মেগাসিটি। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে বাড়ি, গাড়ি ও বস্তি। নদী, খাল, নালা ভরাট হয়ে যাচ্ছে, যেটুকু থাকছে তা মারাত্মক দূষণের শিকার। মাঠ, উঠান, খালি জায়গা থাকছে না। সর্বত্র হয় বাড়ি, নয়তো দোকান বা মল উঠছে। বাতাসে শিসা, কার্বন বেড়ে স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে পড়েছে। ঢাকায় একটু জমি, একটি ফ্ল্যাট, মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই পাওয়ার জন্য মানুষ মরিয়া হয়ে উঠেছে।
সব মিলিয়ে রাস্তায় যানজট অসহনীয়। নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো মুক্ত জায়গা নেই, বিশুদ্ধ পানির সংকট তীব্র, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। জলাবদ্ধতার সংকট বাড়ছে। শৈশব ও কৈশোর কাটছে বস্তুত কারাগারে, দূষিত আবহাওয়ায়, অপুষ্টিতে, অস্বাভাবিক বাস্তবতায়।
অথচ একটু সচেতন ও আন্তরিক হলে এ রকম ভয়াবহ পরিণতি হওয়ার কথা নয় ঢাকার। অন্য অনেক দেশের চেয়ে কৌশলগতভাবে খুবই সুবিধাজনক রাজধানী ঢাকার ভৌগোলিক অবস্থান। ঢাকা প্রায় দেশের মাঝখানে অবস্থিত। কেবল দ্রুতগামী রেলব্যবস্থা চালু করে ঢাকা থেকে দেশের ৬৪টি জেলা শহরের মধ্যে অন্তত ৪০টির সঙ্গে দুই ঘণ্টার কম সময়ে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব। আর ঢাকার আশপাশে অনেক টাউনশিপ গড়ে তোলা যায়। তাতে অযথা ঢাকার ওপর জনবসতির চাপ কমবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতায় এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে মহানগরের জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ফলে গত নির্বাচনে কলকাতায় লোকসভা ও বিধানসভার আসন কমানো হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, একইভাবে এই ছোট্ট দেশে রেল যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে ঢাকার সঙ্গে দুই ঘণ্টা দূরত্বের অনেক শহরে সরকারের অনেক মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তর স্থানান্তর করা যায়।
তৃতীয়ত, কর্মকর্তাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে সপরিবারে বসবাসের আইন বা নিয়মটি অবশ্যই প্রয়োগ করা দরকার। তাতে আবার দ্বিমুখী কাজ হবে—শিক্ষিত পদস্থ ক্ষমতাবান পরিবারের অবস্থান ঘটবে আবার তাঁদের সান্নিধ্য-সহযোগিতা পেয়ে স্থানীয় মেধাবী, প্রতিভাবান, সম্ভাবনাময় ব্যক্তি ও তরুণেরা নিজ নিজ শহরে থাকতে উত্সাহিত হবেন।
চতুর্থত, সরকার, ক্ষমতা, সম্পদ ও বিত্ত যদি দেশের বিভিন্ন শহরে বিকেন্দ্রিত হয়, তাহলে মানুষের অবস্থানও বিকেন্দ্রিত হবে। অর্থাত্ এভাবে সারা দেশে অনেক উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, সজীব, সৃষ্টিশীল নগরের উদ্ভব ঘটবে।
আজকে ঢাকা ক্ষমতা-সম্পদ ও তার পিছু নেওয়া মানুষের চাপে মুমূর্ষু অন্য শহরগুলো ক্ষমতা-সম্পদের ও সম্পন্ন মানুষের অভাবে শ্রীহীন ও মৃত্যুপথযাত্রী।
এককালের প্রাণবন্ত নগর-গঞ্জ-গাঁয়ে গিয়ে আপনি বুঝবেন, বাস্তবে বাংলাদেশের কী করুণ দশা চলছে।
ঢাকা একভাবে মরছে, সারা দেশ অন্যভাবে। বিজ্ঞাপনে শুনি, বাঁচতে হলে জানতে হবে। বটেই। জানতে তো হবেই। ঢাকার মরণ কামড় থেকে বাংলাদেশকে—তার সরকার, ক্ষমতা ও সম্পদ এবং পাগলপারা জনতাকে—বাঁচাতে হবে।
তারপর বাংলাদেশকে ছড়িয়ে দিতে হবে বাংলাদেশে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
ঢাকার দুর্দশা এবং সম্ভাব্য ভয়ানক পরিণতি নিয়ে তেমন দ্বিমত শোনা যায় না। সব সরকারই ঢাকাবাসী ও দেশবাসীকে আশ্বাস দেয়, আশার বাণী শোনায়। কিন্তু ঢাকার অগস্ত্যযাত্রা অব্যাহত থাকে, শেষের সে ভয়ঙ্কর দিন যেন কেবল কাছিয়েই আসছে।
আমি ঢাকাবাসী নই। নগর পরিকল্পনাবিদও নই। সে অর্থে এ নিয়ে বলার বোনাফাইড অধিকারী নই। কিন্তু রোগীর যখন নাভিশ্বাস ওঠে, তখন শুধু ডাক্তার-বদ্যিতে চলে না, এর-ওর কথাও কিছু শুনতে হয়। সেভাবেই দেশের একজন উদ্বিগ্ন নাগরিক হিসেবে কিছু বলা।
আমিও রাজধানী শহরের দুর্দশায় ভুক্তভোগী বইকি। তা ছাড়া রাজধানীই তো সারা দেশের সব নগরের প্রবণতা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। অথচ ঢাকার দৃষ্টান্ত কোনো নগরের জন্যই তো মঙ্গলজনক হবে না। তাই রাজধানী ঢাকা মহানগরকে বাঁচানো সবার স্বার্থেই প্রয়োজন।
মহানগর ঢাকার সংকট দ্রুত গভীর থেকে গভীরতর হওয়ার কারণ, এর অতিবিস্তার (overgrowth) ঠেকানো যাচ্ছে না। অতিবিস্তারের মূল কারণ, সারা দেশ থেকে অবিরত মানুষ ঢাকা নগরে ছুটে আসছে, আস্তানা গাড়ছে। নিজের গ্রাম, শহর, চাকরিস্থল ফেলে কেন মানুষ এভাবে ঢাকামুখী হয়ে পড়েছে, তারও আবার একটা মূল কারণ আছে। সারা দেশে কর্মসংস্থান ও জীবন বিকাশের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সংকুচিত হয়ে আসছে বলে মানুষ দেশের সম্পদ ও ক্ষমতার মূল কেন্দ্র রাজধানীতে ভিড় করছে।
সরকার রাজধানীতে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে সব সরকারি সিদ্ধান্ত যদি ঢাকায়ই নেওয়া হয় কিংবা সব সিদ্ধান্তের জন্য যদি ঢাকার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়, তাহলে ঢাকায় না থেকে মানুষের উপায় কী?
আমরা গণতন্ত্রের জন্য অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকার করেছি। কিন্তু ক্ষমতার বিকেন্দ্রায়ন করা সম্ভব হয়নি, সরকারের কর্তৃত্ব দিন দিন বরং একজায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়েছে। বিনিয়োগের সূত্রেই চাকরির সৃষ্টি হয়। কিন্তু বিনিয়োগ এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যাংকিং, বিপণন ও আনুষঙ্গিক সব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তের মালিকেরা ঢাকায় কেন্দ্রীভূত। ফলে সব উদ্যোক্তাকে ঢাকায় অফিস রাখতে হয় এবং বারবার ছোটাছুটির ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে অনেকেই শেষ পর্যন্ত অফিস, ব্যবসা এমনকি কল-কারখানা পর্যন্ত ঢাকায় স্থানান্তর করেছেন। চাকরিপ্রত্যাশীরাও জানেন, সম্ভাবনা যেটুকু আছে তা ঢাকায়ই। অতএব, তাঁদেরও ভিড় করতে হয় ঢাকায়।
সরকার, সম্পদ, ক্ষমতাকে ঘিরে তৈরি হয় অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিল্পচর্চা, ব্যবসা, প্রশাসন, পেশা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যদি উন্নতি করতে চান, তাহলে কপাল ঠুকে ঢাকায় এসে ভাগ্যান্বেষণই শ্রেয়। অন্যত্র এ সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। প্রায় নেই বললেই চলে।
সবকিছু, বিশেষত সম্পদ ও ক্ষমতা, একজায়গায় কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে একদিকে ভাগ্যান্বেষী মানুষ দলে দলে ঢাকায় ভিড় করছে, অন্যদিকে ঢাকায় থেকে যাঁরা ভাগ্যবান ভাবছেন নিজেদের, তাঁরা কিছুতেই ঢাকা ছাড়তে রাজি নন।
দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, ব্রিটিশ আমল থেকে আইন ছিল, শুনেছি আইনটি এখনো আছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ নিজ কর্মস্থলে পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকতে হবে। এভাবে শিক্ষিত অফিসারদের পরিবারের প্রভাবে অতীতে অনেক ছোট ছোট মহকুমা শহরকেও শিক্ষা ও সংস্কৃতির আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখা গেছে। কিন্তু আজকের দিনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তো বটেই, এমনকি অনেক নিম্নপর্যায়ের কর্মীও পরিবারকে ঢাকায় রাখে। মূল অজুহাত, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, বুড়ো মা-বাবার চিকিত্সা। হায়! অতীতে এঁরাই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে একেকটি অঞ্চলে সেরা সেরা স্কুল গড়ে তুলেছেন। কোথাও গান-বাজনার স্কুল গড়েছেন, কোথাও নাট্যশালা, কোথাও বা আস্ত স্টেডিয়াম এবং নিয়মিত খেলাধুলার চর্চা চালিয়ে গেছেন।
বিকেন্দ্রীকরণের রাজনীতি আর চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী করার ধুয়া তোলার পর পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু শুনেছি, চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা দাপ্তরিক কাজের অজুহাতে মাসের চার সপ্তাহের তিন সপ্তাহই ঢাকায় কাটান।
এভাবে প্রবাসী নিঃসঙ্গ অফিসার সপ্তাহান্তে ঢাকায় গিয়ে পরিবারের সান্নিধ্যের আর সুযোগ পেলে ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের তদবির করার জন্য কর্মস্থলে আকুলতায় কাটান সপ্তাহের কটি দিন। পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নতা, একজন মানুষের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা ছাড়াও নানা আর্থিক ও নৈতিক দুর্নীতিরও জন্ম দেয়। কিন্তু এ বিষয়গুলো ভাবার মতো কেউ নেই বলেই মনে হয়। দেশের দ্বিতীয় নগর চট্টগ্রামেই যখন এ অবস্থা, তখন অন্যান্য জেলা শহর ও উপজেলা শহরের কী অবস্থা, তা সহজেই অনুমেয়। এভাবে ঢাকাবাসের সুযোগ একবার যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা আর ঢাকা ছাড়ছেন না।
এদিকে বিভিন্ন ছোট-বড় শহরে যেসব কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী বড় হওয়ার ও সফল হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তারাও জানে যেকোনোভাবে তাদের ঢাকায় এসে ঠাঁই করে নিতে হবে। নয়তো স্বপ্ন সফল হবে না। আবার এসব ছোট-বড় শহরে যারা প্রতিভার ঝলক দেখাচ্ছে, সেই প্রতিভা ও সাফল্যই তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঢাকায়।
আজ হয়তো কৃতী খেলোয়াড় সাকিব বা মাশরাফিরা সুযোগ পেলেই নিজের ডেরা মাগুরা বা নড়াইলে ছুটে যান, কিন্তু বলে দেওয়া যায়, ইতিহাস তাঁদের স্থায়ী আবাস হিসেবে ঢাকাকেই নির্ধারণ করে দিয়েছে। এভাবে জাহিদ হাসান, আইয়ুব বাচ্চু, কবরীরা স্থায়ীভাবে ঢাকার বাসিন্দা হয়ে গেছেন।
অতীতে মানুষ অবসর নেওয়ার পর কিংবা বৃদ্ধ বয়সে নিজের পৈতৃক বাসভবন বা নিজের শহরে ফিরে আসতেন। এখন সন্তান কিংবা নাতি-নাতনির শিক্ষা আর নিজেদের চিকিত্সার দোহাই দিয়ে কেউই ঢাকা ছাড়তে নারাজ।
এভাবে চাকরিপ্রত্যাশী বেকার, অধিকতর সুযোগ ও লাভপ্রত্যাশী ব্যবসায়ী, চাকরিতে উন্নতিপ্রত্যাশী তদবিরকারী চাকুরে, সম্ভাবনাময় অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-গায়িকা, নৃত্যশিল্পী, উচ্চাভিলাষী রাজনীতিবিদ, মামলার জট থেকে মুক্তিকামী মাস্তান—সবাই মহানগরে আশ্রয় নিতে ছুটে আসছেন। একদিকে ছুটে আসা, আরেক দিকে ছাড়তে না চাওয়া নাছোড়বান্দা মানুষের ভিড়ে ঢাকা পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। লাফিয়ে বাড়ছে জনসংখ্যা। বাড়তে বাড়তে এখন ঢাকা প্রায় এক কোটি ২০ লাখ জন-অধ্যুষিত মেগাসিটি। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে বাড়ি, গাড়ি ও বস্তি। নদী, খাল, নালা ভরাট হয়ে যাচ্ছে, যেটুকু থাকছে তা মারাত্মক দূষণের শিকার। মাঠ, উঠান, খালি জায়গা থাকছে না। সর্বত্র হয় বাড়ি, নয়তো দোকান বা মল উঠছে। বাতাসে শিসা, কার্বন বেড়ে স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে পড়েছে। ঢাকায় একটু জমি, একটি ফ্ল্যাট, মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই পাওয়ার জন্য মানুষ মরিয়া হয়ে উঠেছে।
সব মিলিয়ে রাস্তায় যানজট অসহনীয়। নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো মুক্ত জায়গা নেই, বিশুদ্ধ পানির সংকট তীব্র, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। জলাবদ্ধতার সংকট বাড়ছে। শৈশব ও কৈশোর কাটছে বস্তুত কারাগারে, দূষিত আবহাওয়ায়, অপুষ্টিতে, অস্বাভাবিক বাস্তবতায়।
অথচ একটু সচেতন ও আন্তরিক হলে এ রকম ভয়াবহ পরিণতি হওয়ার কথা নয় ঢাকার। অন্য অনেক দেশের চেয়ে কৌশলগতভাবে খুবই সুবিধাজনক রাজধানী ঢাকার ভৌগোলিক অবস্থান। ঢাকা প্রায় দেশের মাঝখানে অবস্থিত। কেবল দ্রুতগামী রেলব্যবস্থা চালু করে ঢাকা থেকে দেশের ৬৪টি জেলা শহরের মধ্যে অন্তত ৪০টির সঙ্গে দুই ঘণ্টার কম সময়ে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব। আর ঢাকার আশপাশে অনেক টাউনশিপ গড়ে তোলা যায়। তাতে অযথা ঢাকার ওপর জনবসতির চাপ কমবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতায় এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে মহানগরের জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ফলে গত নির্বাচনে কলকাতায় লোকসভা ও বিধানসভার আসন কমানো হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, একইভাবে এই ছোট্ট দেশে রেল যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে ঢাকার সঙ্গে দুই ঘণ্টা দূরত্বের অনেক শহরে সরকারের অনেক মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তর স্থানান্তর করা যায়।
তৃতীয়ত, কর্মকর্তাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে সপরিবারে বসবাসের আইন বা নিয়মটি অবশ্যই প্রয়োগ করা দরকার। তাতে আবার দ্বিমুখী কাজ হবে—শিক্ষিত পদস্থ ক্ষমতাবান পরিবারের অবস্থান ঘটবে আবার তাঁদের সান্নিধ্য-সহযোগিতা পেয়ে স্থানীয় মেধাবী, প্রতিভাবান, সম্ভাবনাময় ব্যক্তি ও তরুণেরা নিজ নিজ শহরে থাকতে উত্সাহিত হবেন।
চতুর্থত, সরকার, ক্ষমতা, সম্পদ ও বিত্ত যদি দেশের বিভিন্ন শহরে বিকেন্দ্রিত হয়, তাহলে মানুষের অবস্থানও বিকেন্দ্রিত হবে। অর্থাত্ এভাবে সারা দেশে অনেক উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, সজীব, সৃষ্টিশীল নগরের উদ্ভব ঘটবে।
আজকে ঢাকা ক্ষমতা-সম্পদ ও তার পিছু নেওয়া মানুষের চাপে মুমূর্ষু অন্য শহরগুলো ক্ষমতা-সম্পদের ও সম্পন্ন মানুষের অভাবে শ্রীহীন ও মৃত্যুপথযাত্রী।
এককালের প্রাণবন্ত নগর-গঞ্জ-গাঁয়ে গিয়ে আপনি বুঝবেন, বাস্তবে বাংলাদেশের কী করুণ দশা চলছে।
ঢাকা একভাবে মরছে, সারা দেশ অন্যভাবে। বিজ্ঞাপনে শুনি, বাঁচতে হলে জানতে হবে। বটেই। জানতে তো হবেই। ঢাকার মরণ কামড় থেকে বাংলাদেশকে—তার সরকার, ক্ষমতা ও সম্পদ এবং পাগলপারা জনতাকে—বাঁচাতে হবে।
তারপর বাংলাদেশকে ছড়িয়ে দিতে হবে বাংলাদেশে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments