ভূমি জরিপ ঘোষণা সমস্যাকে আরও জটিল করবে -পার্বত্য চট্টগ্রাম by মঙ্গল কুমার চাকমা
৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন যে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ভূমি জরিপের পন্থা-পদ্ধতি ঠিক করা হবে এবং ১৫ অক্টোবর থেকে শুরু করে আগামী বছরের ১৫ মার্চের মধ্যে ভূমি জরিপ সম্পন্ন করা হবে (দ্য ডেইলি স্টার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০০৯)।
উল্লেখ্য, গত ১৯ জুলাই পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগলাভের পর আজ অবধি তিনি ভূমি কমিশনের আনুষ্ঠানিক সভা আহ্বান করেননি। ইতিমধ্যে তিনি গত ৩-৫ আগস্ট তিন পার্বত্য জেলা সফর করেন এবং জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে আহূত মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। সফরকালে কমিশনের কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই একতরফাভাবে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপের ঘোষণা দেন। গত ৭-৮ সেপ্টেম্বর তিনি আবারও রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে সফর করেন এবং দুই জেলায় খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের একদিনের নোটিশে আহূত যৌথ সভায় তিনি মতবিনিময় করেন। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে মতবিনিময় সভায় আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা ও সার্কেল চিফগণ উপস্থিত ছিলেন না। অথচ ভূমি কমিশনের কোনো আনুষ্ঠানিক সভার আয়োজন না করে কর্মকর্তাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ওই সভায় তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপের সময়সূচি আবারও ঘোষণা দেন। প্রাসঙ্গিকভাবেই ভূমি কমিশন চেয়ারম্যানের এই একতরফা ঘোষণা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা জাতীয় পর্যায়ে অভিজ্ঞ মহলের নানা সন্দেহ ও সংশয় দেখা দিয়েছে।
১৯৯৭ এর পার্বত্য চুুক্তির ‘ঘ’ খণ্ডের ২ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে ‘সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন এবং উপজাতীয় শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পর সরকার এই চুক্তি অনুযায়ী গঠিতব্য আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে যথাশিগগির পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপকাজ শুরু এবং যথাযথ যাচাইয়ের মাধ্যমে জায়গা-জমিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিকরত উপজাতীয় জনগণের ভূমি মালিকানা চূড়ান্ত করিয়া তাহাদের ভূমি রেকর্ডভুক্ত ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করিবেন।’
পার্বত্য চুুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান মহোদয় কোন উদ্দেশ্যে একতরফাভাবে ভূমি জরিপের কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন তা স্পষ্ট নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার অন্যতম একটি প্রধান দিক ভূমি সমস্যা। পার্বত্য চট্টগ্রামে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ এমনিতেই অত্যন্ত কম। চাষযোগ্য ধান্য জমির (‘এ’ শ্রেণীভুক্ত) পরিমাণ মাত্র ৩ দশমিক ১ শতাংশ, যা ৭৬ হাজার ৪৬৬ একর মাত্র। অধিকন্তু ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মিত হওয়ার ফলে ‘এ’ শ্রেণীভুক্ত আবাদি জমির ৪০ শতাংশ (৫৪ হাজার একর জমি) এই বাঁধের পানিতে তলিয়ে যায়। আবাদি জমির স্বল্পতার কারণে পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়নি কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজ করছে হাজারো ভূমিহীন পরিবার। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর আবাদযোগ্য জমি রয়েছে— সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রতারণামূলক অজুহাত দেখিয়ে ১৯৭৯ সাল থেকে পরবর্তী কয়েক বছরে দেশের সমতলে বিভিন্ন জেলা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয় চার লক্ষাধিক বহিরাগত লোক এবং বলপূর্বক তাদের বসতি দেওয়া হয় পাহাড়িদের ভোগ-দখলীয় ও রেকর্ডীয় জমির ওপর। এই সব বাঙালি সেটেলাররা প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে তাদের অনেক জমি বেদখল করে নেয়। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড।
২০০১ সালে জুনে তত্কালীন আওয়ামী লীগের সরকার (১৯৯৬-২০০১) ক্ষমতা হস্তান্তরের একদিন আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ জাতীয় সংসদে পাস করে। ওই আইন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সঙ্গে বিরোধাত্মক ১৯টি বিষয় রয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভূমি কমিশন আইন সংশোধনকল্পে গত ২৬ আগস্ট আঞ্চলিক পরিষদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরার সভাপতিত্বে ভূমি মন্ত্রণালয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় অনেকটা বিধি-বহির্ভূতভাবে তিন পার্বত্য জেলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদেরও ডাকা হয়। ওই সভায় আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক উত্থাপিত সংশোধনী প্রস্তাবের অনুকূলে মত দিলেও রাঙামাটি জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এসব সংশোধনীর চরম বিরোধিতা করতে থাকে। এক পর্যায়ে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই সভা স্থগিত করা হয়। উল্লেখ্য, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে জেলা পর্যায়ের কর্তকর্তাদের এ রকম মতামত নেওয়ার নজির অভূতপূর্ব। অধিকন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং হয়ে যাওয়ার পর এ রকম নতুন করে মতামত নেওয়াও যুক্তিসংগত ও সদিচ্ছাপ্রসূত হতে পারে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আশু করণীয় হচ্ছে পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক ২০০১ সালের ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন করা। গত ৩ ফেব্রুয়ারি আঞ্চলিক পরিষদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদারও এ বিষয়ে অনুকূল মত প্রকাশ করেন। বলাবাহুল্য, আইনের বিরোধাত্মক ধারাগুলো সংশোধন না করে ভূমি কমিশনের কাজ শুরু করলে ভূমি সমস্যা আরও জটিল থেকে জটিলতর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তাছাড়া এখনো ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণীত হয়নি। প্রয়োজনীয় জনবল ও পরিসম্পদসংবলিত কমিশনের কার্যালয় স্থাপিত হয়নি। অনেক দিন ধরে কমিশনের সচিবের পদ খালি রয়েছে। ২০০৬ সালে কমিশনের কর্মচারী নিয়োগের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও তা পরে বাতিল করা হয়। কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, পরিসম্পদ বরাদ্দ এবং কমিশনের জন্য কার্যালয় স্থাপন করা ইত্যাদি বিষয় এখনো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। এসব জরুরি বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ না নিয়ে কমিশনের চেয়ারম্যান মহোদয় পার্বত্য চুক্তি লঙ্ঘন করে কেন ভূমি জরিপের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তা বোধগম্য নয়।
পার্বত্য অঞ্চলের শাসনব্যবস্থা বরাবরই দেশের অপরাপর সমতল অঞ্চলের শাসনব্যবস্থা থেকে পৃথক। অনুরূপভাবে এ অঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনাও সমতল জেলাগুলো থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। পার্বত্য চট্টগ্রামে মূলত তিন ধরনের ভূমি রয়েছে। প্রথমত, বন্দোবস্তকৃত ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ভূমি, যা বেশির ভাগই ধান্য জমি। দ্বিতীয়ত, ভোগ-দখলীয় জমি, যা বেশির ভাগই বাস্তুভিটা, বাগান-বাগিচা ইত্যাদির ভূমি। তৃতীয়ত, রেকর্ডীয় বা ভোগ-দখলীয় কোনোটাই নয় এমন ভূমি, যা জুমভূমি নামে খ্যাত ও প্রথাগতভাবে সংশ্লিষ্ট মৌজা অধিবাসীদের সমষ্টিগত মালিকানাধীন। অর্থাত্ মৌজা এলাকায় অবস্থিত ভূমির মধ্যে ব্যক্তি নামে বন্দোবস্তকৃত বা ভোগ-দখলীয় ভূমি ব্যতীত অন্য সব ভূমিই মৌজাবাসীর। রাজা-হেডম্যান-কার্বারির নিয়ে গঠিত প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব ভূমি ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়ে থাকে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনব্যবস্থা ও ভূমি ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়ে এসেছে বিশেষ আইনের আওতায়। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের সংবিধানের আওতায় ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তির আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ শাসন কাঠামো এবং আলাদা ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রবর্তিত হয়েছে। এ শাসন কাঠামোতে সংশ্লিষ্ট আইন বা বিধানাবলি অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়, অঞ্চল পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলায় তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হয়েছে। পার্বত্য জেলা পরিষদের ওপর ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা কার্যাবলি অর্পণ করা হয়েছে। আঞ্চলিক পরিষদ তা তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থাপনা মূলত ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি, ১৯৯৮ সালের তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন (সংশোধন), ১৯৯৮ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ১৯৩৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম বাজার ফান্ড বিধিমালা প্রভৃতি বিশেষ আইন ও বিধিমালার মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। অধিকন্তু এই অঞ্চলে রয়েছে রাজা-হেডম্যান-কার্বারিদের নিয়ে ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনব্যবস্থা, যাঁরা সরাসরি ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত।
ভূমি কমিশন চেয়ারম্যান মহোদয় পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপের ঘোষণা দিয়েছেন, কিন্তু তিনি কীভাবে এবং কোন আইন বা বিধিমালা বলে ভূমি জরিপ করবেন? মনে রাখতে হবে যে দেশের সমতল জেলাগুলোতে বিদ্যমান সার্ভে আইন পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য নয়। ব্রিটিশ কর্তৃক প্রবর্তিত ১৮৭৫ সালের সার্ভে আইনও সে সময় ‘শাসনবহির্ভূত এলাকা’য় প্রয়োগ করা হয়নি। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের শাসনবহির্ভূত এলাকার মর্যাদা না থাকলেও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি এখনো বলবত্ রয়েছে এবং আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসংবলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে।
সরকার ১৯৮৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি খতিয়ান অধ্যাদেশ জারি করে। ওই অধ্যাদেশ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বিধায় কার্যকর হতে পারেনি। মূলত সমতল অঞ্চলে প্রচলিত আইন অনুসারে এটা প্রণীত হয়েছে। এতে রাজা-হেডম্যান-কার্বারিসংবলিত প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা রাখা ছিল না।
দেশের সমতল অঞ্চলে বন্দোবস্ত নয় এমন সব জমিই জেলা প্রশাসকের ১ নম্বর খতিয়ান বইয়ে ‘খাস’ জমি হিসেবে নিবন্ধিত থাকে, যার মালিক রাষ্ট্র। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে এ রকম খাসজমির কোনো অস্তিত্বই নেই।
সমতল অঞ্চলে যেসব জমি ‘খাসজমি’ হিসেবে বিবেচিত, সেসব জমি পার্বত্য চট্টগ্রামে হয় ব্যক্তির অধীন ভোগ-দখলীয় জমি নতুবা মৌজাবাসীর সমষ্টিগত মালিকানাধীন জুমভূমি হিসেবে বিবেচিত। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত এসব আইন, রীতি ও পদ্ধতিগুলো সক্রিয় ও কার্যকরভাবে বিবেচনায় নিতে হবে এবং এসব আইন, রীতি ও পদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য হয় দেশে প্রচলিত বিদ্যমান সার্ভে আইন সংশোধন করতে হবে, নতুবা পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য নতুন সার্ভে আইন প্রণয়ন করতে হবে। কিন্তু ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান মহোদয় যেভাবে তড়িঘড়ি করে একতরফা ঘোষণা দিয়েছেন তাতে এসব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, আইন, রীতি ও পদ্ধতি সক্রিয় বিবেচনায় নিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয় না। স্বাভাবিকভাবে এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা আরও জটিলতর হয়ে উঠবে।
ভূমি জরিপের অনেক উদ্দেশের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ভূমির ম্যাপিংসহ ভূমির মালিকানা ঠিক করা। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক আগে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি না করে এবং অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন ও প্রত্যাগত পাহাড়ি শরণার্থীদের তাদের জমি প্রত্যর্পণ না করে, সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক জায়গা-জমিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি ও ভূমির মালিকানা চূড়ান্তকরণের মাধ্যমে পাহাড়ি জনগণের ভূমি রেকর্ডভুক্ত ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত না করে কীভাবে ভূমি জরিপের মাধ্যমে ভূমির মালিকানা ঠিক করা হবে তা বোধগম্য নয়। ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান মহোদয় ‘গাড়ির আগে ঘোড়া’ জুড়ে না দিয়ে কার্যত ‘ঘোড়ার আগে গাড়ি’ জুড়ে দিতে যাচ্ছেন বলে প্রতীয়মান হয়।
এমতাবস্থায় পার্বত্যবাসী আশা করে যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের প্রস্তাব অনুসারে প্রথমেই ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ সংশোধন করা হোক। একই সঙ্গে পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দার মধ্য থেকে কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগদান ও কমিশনের জন্য পর্যাপ্ত পরিসম্পদ বরাদ্দ করে কমিশনের কার্যালয় শক্তিশালী ও সক্রিয় করা হোক। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক আগে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি এবং পাহাড়ি শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পর আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপকাজ শুরু করা হোক। এ লক্ষ্যে অচিরেই পাঁচ সদস্যকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের আনুষ্ঠানিক সভা আহ্বান করে গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক পদ্ধতিগতভাবেই প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ হোক, এটাই পার্বত্যবাসী আশা করে।
মঙ্গল কুমার চাকমা: তথ্য ও প্রচার সম্পাদক, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।
উল্লেখ্য, গত ১৯ জুলাই পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগলাভের পর আজ অবধি তিনি ভূমি কমিশনের আনুষ্ঠানিক সভা আহ্বান করেননি। ইতিমধ্যে তিনি গত ৩-৫ আগস্ট তিন পার্বত্য জেলা সফর করেন এবং জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে আহূত মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। সফরকালে কমিশনের কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই একতরফাভাবে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপের ঘোষণা দেন। গত ৭-৮ সেপ্টেম্বর তিনি আবারও রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে সফর করেন এবং দুই জেলায় খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের একদিনের নোটিশে আহূত যৌথ সভায় তিনি মতবিনিময় করেন। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে মতবিনিময় সভায় আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা ও সার্কেল চিফগণ উপস্থিত ছিলেন না। অথচ ভূমি কমিশনের কোনো আনুষ্ঠানিক সভার আয়োজন না করে কর্মকর্তাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ওই সভায় তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপের সময়সূচি আবারও ঘোষণা দেন। প্রাসঙ্গিকভাবেই ভূমি কমিশন চেয়ারম্যানের এই একতরফা ঘোষণা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা জাতীয় পর্যায়ে অভিজ্ঞ মহলের নানা সন্দেহ ও সংশয় দেখা দিয়েছে।
১৯৯৭ এর পার্বত্য চুুক্তির ‘ঘ’ খণ্ডের ২ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে ‘সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন এবং উপজাতীয় শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পর সরকার এই চুক্তি অনুযায়ী গঠিতব্য আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে যথাশিগগির পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপকাজ শুরু এবং যথাযথ যাচাইয়ের মাধ্যমে জায়গা-জমিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিকরত উপজাতীয় জনগণের ভূমি মালিকানা চূড়ান্ত করিয়া তাহাদের ভূমি রেকর্ডভুক্ত ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করিবেন।’
পার্বত্য চুুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান মহোদয় কোন উদ্দেশ্যে একতরফাভাবে ভূমি জরিপের কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন তা স্পষ্ট নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার অন্যতম একটি প্রধান দিক ভূমি সমস্যা। পার্বত্য চট্টগ্রামে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ এমনিতেই অত্যন্ত কম। চাষযোগ্য ধান্য জমির (‘এ’ শ্রেণীভুক্ত) পরিমাণ মাত্র ৩ দশমিক ১ শতাংশ, যা ৭৬ হাজার ৪৬৬ একর মাত্র। অধিকন্তু ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মিত হওয়ার ফলে ‘এ’ শ্রেণীভুক্ত আবাদি জমির ৪০ শতাংশ (৫৪ হাজার একর জমি) এই বাঁধের পানিতে তলিয়ে যায়। আবাদি জমির স্বল্পতার কারণে পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়নি কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজ করছে হাজারো ভূমিহীন পরিবার। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর আবাদযোগ্য জমি রয়েছে— সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রতারণামূলক অজুহাত দেখিয়ে ১৯৭৯ সাল থেকে পরবর্তী কয়েক বছরে দেশের সমতলে বিভিন্ন জেলা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয় চার লক্ষাধিক বহিরাগত লোক এবং বলপূর্বক তাদের বসতি দেওয়া হয় পাহাড়িদের ভোগ-দখলীয় ও রেকর্ডীয় জমির ওপর। এই সব বাঙালি সেটেলাররা প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে তাদের অনেক জমি বেদখল করে নেয়। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড।
২০০১ সালে জুনে তত্কালীন আওয়ামী লীগের সরকার (১৯৯৬-২০০১) ক্ষমতা হস্তান্তরের একদিন আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ জাতীয় সংসদে পাস করে। ওই আইন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সঙ্গে বিরোধাত্মক ১৯টি বিষয় রয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভূমি কমিশন আইন সংশোধনকল্পে গত ২৬ আগস্ট আঞ্চলিক পরিষদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরার সভাপতিত্বে ভূমি মন্ত্রণালয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় অনেকটা বিধি-বহির্ভূতভাবে তিন পার্বত্য জেলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদেরও ডাকা হয়। ওই সভায় আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক উত্থাপিত সংশোধনী প্রস্তাবের অনুকূলে মত দিলেও রাঙামাটি জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এসব সংশোধনীর চরম বিরোধিতা করতে থাকে। এক পর্যায়ে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই সভা স্থগিত করা হয়। উল্লেখ্য, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে জেলা পর্যায়ের কর্তকর্তাদের এ রকম মতামত নেওয়ার নজির অভূতপূর্ব। অধিকন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং হয়ে যাওয়ার পর এ রকম নতুন করে মতামত নেওয়াও যুক্তিসংগত ও সদিচ্ছাপ্রসূত হতে পারে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আশু করণীয় হচ্ছে পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক ২০০১ সালের ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন করা। গত ৩ ফেব্রুয়ারি আঞ্চলিক পরিষদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদারও এ বিষয়ে অনুকূল মত প্রকাশ করেন। বলাবাহুল্য, আইনের বিরোধাত্মক ধারাগুলো সংশোধন না করে ভূমি কমিশনের কাজ শুরু করলে ভূমি সমস্যা আরও জটিল থেকে জটিলতর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তাছাড়া এখনো ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণীত হয়নি। প্রয়োজনীয় জনবল ও পরিসম্পদসংবলিত কমিশনের কার্যালয় স্থাপিত হয়নি। অনেক দিন ধরে কমিশনের সচিবের পদ খালি রয়েছে। ২০০৬ সালে কমিশনের কর্মচারী নিয়োগের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও তা পরে বাতিল করা হয়। কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, পরিসম্পদ বরাদ্দ এবং কমিশনের জন্য কার্যালয় স্থাপন করা ইত্যাদি বিষয় এখনো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। এসব জরুরি বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ না নিয়ে কমিশনের চেয়ারম্যান মহোদয় পার্বত্য চুক্তি লঙ্ঘন করে কেন ভূমি জরিপের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তা বোধগম্য নয়।
পার্বত্য অঞ্চলের শাসনব্যবস্থা বরাবরই দেশের অপরাপর সমতল অঞ্চলের শাসনব্যবস্থা থেকে পৃথক। অনুরূপভাবে এ অঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনাও সমতল জেলাগুলো থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। পার্বত্য চট্টগ্রামে মূলত তিন ধরনের ভূমি রয়েছে। প্রথমত, বন্দোবস্তকৃত ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ভূমি, যা বেশির ভাগই ধান্য জমি। দ্বিতীয়ত, ভোগ-দখলীয় জমি, যা বেশির ভাগই বাস্তুভিটা, বাগান-বাগিচা ইত্যাদির ভূমি। তৃতীয়ত, রেকর্ডীয় বা ভোগ-দখলীয় কোনোটাই নয় এমন ভূমি, যা জুমভূমি নামে খ্যাত ও প্রথাগতভাবে সংশ্লিষ্ট মৌজা অধিবাসীদের সমষ্টিগত মালিকানাধীন। অর্থাত্ মৌজা এলাকায় অবস্থিত ভূমির মধ্যে ব্যক্তি নামে বন্দোবস্তকৃত বা ভোগ-দখলীয় ভূমি ব্যতীত অন্য সব ভূমিই মৌজাবাসীর। রাজা-হেডম্যান-কার্বারির নিয়ে গঠিত প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব ভূমি ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়ে থাকে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনব্যবস্থা ও ভূমি ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়ে এসেছে বিশেষ আইনের আওতায়। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের সংবিধানের আওতায় ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তির আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ শাসন কাঠামো এবং আলাদা ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রবর্তিত হয়েছে। এ শাসন কাঠামোতে সংশ্লিষ্ট আইন বা বিধানাবলি অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়, অঞ্চল পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলায় তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হয়েছে। পার্বত্য জেলা পরিষদের ওপর ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা কার্যাবলি অর্পণ করা হয়েছে। আঞ্চলিক পরিষদ তা তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থাপনা মূলত ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি, ১৯৯৮ সালের তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন (সংশোধন), ১৯৯৮ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ১৯৩৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম বাজার ফান্ড বিধিমালা প্রভৃতি বিশেষ আইন ও বিধিমালার মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। অধিকন্তু এই অঞ্চলে রয়েছে রাজা-হেডম্যান-কার্বারিদের নিয়ে ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনব্যবস্থা, যাঁরা সরাসরি ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত।
ভূমি কমিশন চেয়ারম্যান মহোদয় পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপের ঘোষণা দিয়েছেন, কিন্তু তিনি কীভাবে এবং কোন আইন বা বিধিমালা বলে ভূমি জরিপ করবেন? মনে রাখতে হবে যে দেশের সমতল জেলাগুলোতে বিদ্যমান সার্ভে আইন পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য নয়। ব্রিটিশ কর্তৃক প্রবর্তিত ১৮৭৫ সালের সার্ভে আইনও সে সময় ‘শাসনবহির্ভূত এলাকা’য় প্রয়োগ করা হয়নি। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের শাসনবহির্ভূত এলাকার মর্যাদা না থাকলেও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি এখনো বলবত্ রয়েছে এবং আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসংবলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে।
সরকার ১৯৮৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি খতিয়ান অধ্যাদেশ জারি করে। ওই অধ্যাদেশ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বিধায় কার্যকর হতে পারেনি। মূলত সমতল অঞ্চলে প্রচলিত আইন অনুসারে এটা প্রণীত হয়েছে। এতে রাজা-হেডম্যান-কার্বারিসংবলিত প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা রাখা ছিল না।
দেশের সমতল অঞ্চলে বন্দোবস্ত নয় এমন সব জমিই জেলা প্রশাসকের ১ নম্বর খতিয়ান বইয়ে ‘খাস’ জমি হিসেবে নিবন্ধিত থাকে, যার মালিক রাষ্ট্র। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে এ রকম খাসজমির কোনো অস্তিত্বই নেই।
সমতল অঞ্চলে যেসব জমি ‘খাসজমি’ হিসেবে বিবেচিত, সেসব জমি পার্বত্য চট্টগ্রামে হয় ব্যক্তির অধীন ভোগ-দখলীয় জমি নতুবা মৌজাবাসীর সমষ্টিগত মালিকানাধীন জুমভূমি হিসেবে বিবেচিত। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত এসব আইন, রীতি ও পদ্ধতিগুলো সক্রিয় ও কার্যকরভাবে বিবেচনায় নিতে হবে এবং এসব আইন, রীতি ও পদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য হয় দেশে প্রচলিত বিদ্যমান সার্ভে আইন সংশোধন করতে হবে, নতুবা পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য নতুন সার্ভে আইন প্রণয়ন করতে হবে। কিন্তু ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান মহোদয় যেভাবে তড়িঘড়ি করে একতরফা ঘোষণা দিয়েছেন তাতে এসব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, আইন, রীতি ও পদ্ধতি সক্রিয় বিবেচনায় নিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয় না। স্বাভাবিকভাবে এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা আরও জটিলতর হয়ে উঠবে।
ভূমি জরিপের অনেক উদ্দেশের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ভূমির ম্যাপিংসহ ভূমির মালিকানা ঠিক করা। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক আগে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি না করে এবং অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন ও প্রত্যাগত পাহাড়ি শরণার্থীদের তাদের জমি প্রত্যর্পণ না করে, সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক জায়গা-জমিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি ও ভূমির মালিকানা চূড়ান্তকরণের মাধ্যমে পাহাড়ি জনগণের ভূমি রেকর্ডভুক্ত ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত না করে কীভাবে ভূমি জরিপের মাধ্যমে ভূমির মালিকানা ঠিক করা হবে তা বোধগম্য নয়। ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান মহোদয় ‘গাড়ির আগে ঘোড়া’ জুড়ে না দিয়ে কার্যত ‘ঘোড়ার আগে গাড়ি’ জুড়ে দিতে যাচ্ছেন বলে প্রতীয়মান হয়।
এমতাবস্থায় পার্বত্যবাসী আশা করে যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের প্রস্তাব অনুসারে প্রথমেই ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ সংশোধন করা হোক। একই সঙ্গে পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দার মধ্য থেকে কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগদান ও কমিশনের জন্য পর্যাপ্ত পরিসম্পদ বরাদ্দ করে কমিশনের কার্যালয় শক্তিশালী ও সক্রিয় করা হোক। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক আগে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি এবং পাহাড়ি শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পর আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপকাজ শুরু করা হোক। এ লক্ষ্যে অচিরেই পাঁচ সদস্যকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের আনুষ্ঠানিক সভা আহ্বান করে গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক পদ্ধতিগতভাবেই প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ হোক, এটাই পার্বত্যবাসী আশা করে।
মঙ্গল কুমার চাকমা: তথ্য ও প্রচার সম্পাদক, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।
No comments