বর্গাচাষিদের ঋণ: একটি প্রয়োগ-পূর্ব পর্যালোচনা -কৃষি by সাজ্জাদ জহির
বাংলাদেশের কৃষিকে সঞ্চালিত করার উদ্দেশে কার্যকরী যে কোনো উদ্যোগকে স্বাগত জানানো প্রয়োজন। সহজ সুদে বর্গাচাষিদের ঋণ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগকে সেভাবেই বিবেচনা করা উচিত। তবে শুরুতেই এর কয়েকটি দিক সতর্কভাবে দেখা প্রয়োজন।
পুনঃঅর্থায়নের ভিত্তিতে ব্র্যাকের মাধ্যমে ৫০০ কোটি টাকার তহবিল থেকে বর্গাচাষিদের ঋণ বিতরণ করা হবে, যা ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষি খাতে সরকারি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রার পাঁচ শতাংশেরও কম। কেবল ৩৫টি জেলার ১৫০টি উপজেলায় এই ঋণ বিতরণ করা হবে এবং একে ক্ষুদ্রঋণ না বলে আভাসে ইঙ্গিতে ‘ব্যাংক ঋণ’ বলা হচ্ছে। ব্র্যাক বার্ষিক ভিত্তিতে পাঁচ শতাংশ সুদ বাংলাদেশ ব্যাংককে দেবে এবং ১০ শতাংশ সুদে বর্গাচাষিদের ঋণ দেওয়ার উল্লেখ রয়েছে। ফসল ওঠার আগে আদায়যোগ্য ঋণের ৩০ শতাংশ মাসিক কিস্তিতে এবং বাকি ৭০ শতাংশ ফসল ওঠার পর সমান দুটো মাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।
সমস্যা হলো, বর্গাচাষির কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষি বা পল্লীঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচিতে (সার্কুলার নং-৪) উল্লেখ রয়েছে, ‘ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক (যাদের জমির পরিমাণ ০.৪৯৪ একর থেকে ২.৪৭ একর) তথা বর্গাচাষিদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে।’ আরও উল্লেখ রয়েছে, বর্গাচাষি একজন প্রকৃত কৃষক, যিনি অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেন এবং তা যাচাইয়ের দুটো সম্ভাব্য পথ হলো: জমির মালিকের দেওয়া একটি প্রত্যয়নপত্র অথবা স্থানীয় এলাকার দায়িত্বশীল ও গণ্যমান্য ব্যক্তির কাছ থেকে সংগৃহীত প্রত্যয়নপত্র।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নীতিপর্যায়ে ‘বর্গাচাষি’ যেভাবে স্বীকৃত, বাংলাদেশে তেমনটি ঘটেনি। নীলচাষি ও আধিয়ারদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণে যেমন বর্গাচাষির ব্যানারে কোনো সমাজগোষ্ঠী একতাবদ্ধ হয়নি, একইভাবে জোত বিভাজনের প্রক্রিয়া ও কৃষিতে প্রতিবন্ধী রূপ বাণিজ্যিকীকরণের ফলে সমস্বার্থের অধিকারী ‘বর্গাচাষি’ নামের একক কোনো সামাজিক বা অর্থনৈতিক শ্রেণী এ দেশে দানা বাঁধতে পারেনি। তবে পরিসংখ্যানে এর উপস্থিতি যত্রতত্র। ২০০৮ সালের কৃষিশুমারি অনুযায়ী গ্রামীণ সব পরিবারের মাত্র ৫৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ কৃষি খামার, যাদের ৫৫ শতাংশ বর্গা চাষ করে। এসব বর্গাচাষির অধিকাংশই নিজেদের জমিও চাষ করেন।
ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি) পরিচালিত ২০০০ সালের দেশব্যাপী এক জরিপে দুই-তৃতীয়াংশ জরিপ করা গ্রামে বর্গা চাষের প্রাধান্য রয়েছে। এদের এক-তৃতীয়াংশে বছরব্যাপী সব মৌসুমি ফসলের ক্ষেত্রে বর্গা চাষ চালু আছে; প্রায় ৪২ শতাংশ গ্রামে শুধু ইরি বা বোরো ধানের সময় তা চালু আছে। কেবল ভাগ চাষে নয়, অর্ধেকেরও বেশি ক্ষেত্রে নগদ খাজনায় জমি বর্গা নেওয়া হয়। ইআরজির ওই জরিপের ফলাফল থেকে আরও জানা যায়, যেসব এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কৃষি কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, সেসব এলাকায় ভাগ চাষে জমি বর্গা নেওয়ার প্রথা বিলুপ্ত প্রায় এবং নগদ খাজনার ভিত্তিতে জমির ব্যবহার স্বত্বের লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব এলাকায় অনেক সময় তাই বন্ধকি ব্যবস্থা থেকে নগদ খাজনার পার্থক্য টানা দুরূহ। বাংলাদেশের চিংড়ি চাষাধীন দক্ষিণাঞ্চল ও আলু চাষাধীন এলাকায় (যেমন মুন্সিগঞ্জ) এমন নগদভিত্তিক লেনদেনের মাত্রার অধিক্য দেখা যায়।
বর্গাকেন্দ্রিক চুক্তি নিবন্ধীকরণের ব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই এবং এর বাস্তবসম্মত কারণও রয়েছে। এ অবস্থায় কে ঋণ পাওয়ার যোগ্য, তা কাগজে-কলমে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। স্থানীয় এলাকার দায়িত্বশীল ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে সংগৃহীত প্রত্যয়নপত্র গ্রহণের সুযোগ অযাচিত রাজনৈতিক প্রভাবের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়।
পত্রিকা মাধ্যমে আমরা জেনেছি, পরিবারপ্রধান এসএসসি পাস না হলেই কেবল ঋণ পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবেন। দরিদ্র পরিবার চিহ্নিত করতে বহু ক্ষেত্রে এ জাতীয় তথ্য ব্যবহার হয়। কিন্তু ইআরজির জরিপ থেকে জানা যায়, বর্গাচাষিদের মধ্যে এসএসসি পাসের হার যেখানে চার শতাংশ, অন্য গোষ্ঠীর (বর্গা নেন না) ক্ষেত্রে তা ৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং এ দুটোর ব্যবধান উল্লেখজনক নয়। তাই ‘এসএসসি পাস’ জাতীয় তথ্যের ভিত্তিতে যোগ্য ঋণগ্রহীতা বাছাই নির্ভরযোগ্য নয়, বরং এ জাতীয় মাপকাঠির ব্যবহার ভ্রান্তিকর। এসএসসি পাস করে যেন একজন বর্গাচাষি পাপ করে বসেছেন এবং তাই তাঁকে ঋণ দেওয়া হবে না! অথচ একজন শিক্ষিত কৃষক চাষের সঙ্গে জড়িত হলে অধিক দক্ষতার সঙ্গে ঋণের ব্যবহার করতে সক্ষম।
বর্গা চাষের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ পেলেও চাষিরা উত্পাদন বাড়াতে যথেষ্ট প্রণোদিত নাও হতে পারে। অতীতের মাঠ জরিপ থেকে আমরা জানি, সীমিত জমির লেনদেনের বাজারে অধিক ঋণ সরবরাহ ও চাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে জমির মালিকের প্রাপ্তি (খাজনা) বৃদ্ধি করে।
এটা অনস্বীকার্য, শহর ও বাণিজ্যকেন্দ্রিক ব্যাংকঋণ যে সুদে বিতরণ সম্ভব, তার চেয়ে অধিক হারে ক্ষুদ্রঋণের সুদ ধার্য করা আবশ্যিক। তবে সুদের হার প্রকাশে অনেক অস্বচ্ছতা দূর করা প্রয়োজন। ব্র্যাকের মাধ্যমে দেয় ঋণের সুদের হার নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। যদি ফ্ল্যাট রেটে ৫০ (বা ১০০) টাকা সুদ ধরে ছয় মাসে সুদ ও আসল আদায় হয়, সে ক্ষেত্রে কার্যকরী বাত্সরিক সুদের হার ১৬ শতাংশ (৩১ শতাংশ) হবে। এখনো পরিষ্কার নয়, কোন পথ ব্র্যাক নেবে।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বর্গাচাষিদের কাছে ঋণ পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন এমন একটি সংগঠন, যার দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক রয়েছে। নিঃসন্দেহে অন্য পাঁচটি সংগঠনের তুলনায় ব্র্যাকের কিছু বাড়তি যোগ্যতা রয়েছে, এটি ৩০ বছরের অধিককাল সেবাধর্মী কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এবং দেশব্যপী ক্ষুদ্রঋণ সরবরাহ করে। নতুন ঋণ কর্মসূচির সঙ্গে ব্র্যাকের সংশ্লিষ্টতার বড় সনদ সম্ভবত কৃষি সম্প্রসারণে ও কৃষিপণ্য বিপণনে এর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। ব্র্যাক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হাইব্রিড বীজ বিপণন করে এবং আন্তর্জাতিক বীজ কোম্পানির সহায়তায় দেশে-বিদেশে কৃষকদের সংগঠিত করে বিভিন্ন ফসল চাষে উন্নত মানের বীজ ব্যবহার সম্প্রসারণ করছে। এবং এই কাজে অনেক সময় ঋণ কর্মসূচিকে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা তহবিল জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে এবং বিগত বছরগুলোতে ‘দান’-এর পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় তাদের তহবিল সংগ্রহের খরচ বেড়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে সঞ্চয় সংগ্রহ আইনানুগ না করায় এসব সংস্থা অনেক ক্ষেত্রে উচ্চসুদে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এ অবস্থায় পাঁচ শতাংশ হারে ব্র্যাকের তহবিল প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে তাদের সুবিধাজনক অবস্থানে নেবে। এই তহবিল তৈরির ফলে তাদের (বর্গাচাষি) সদস্যরা অধিকতর ঋণ পাওয়ার বা ঋণ পুনর্তফসিল করার সুযোগ পাবে, যা অন্যান্য ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছিয়ে দেবে। প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য পিকেএসএফ পরিচালিত ঋণ কর্মসূচিও প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হবে। নতুন ঋণের সম্ভাব্য সুদের হার অধিকাংশ ক্ষুদ্রঋণের সুদের হারের চেয়ে কিছুটা কম। তবে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের সুদের হারের চেয়ে বেশি। যদি অর্থের বিনিময়ে ব্র্যাক ব্যাংকের কাছ থেকে গ্যারান্টি নেওয়া হয়, যা লভ্যাংশ থেকে সমন্বয় করা হবে, সমগ্র বিনিময়প্রক্রিয়ায় বর্তমান সংকটকালে ব্র্যাক পরিবার কিছুটা স্বস্তি পাবে।
উল্লেখ্য, ক্ষুদ্রঋণের বড় অংশ বহুদিন ধরে বর্গা-বাজারে ব্যবহূত হয়ে আসছে। তাই সহজ সুদে বর্গাচাষিদের ঋণ দিয়ে কৃষি উত্পাদনে বড় কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না। এমনকি সুষম বণ্টন অর্জনে তা ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেই তুলনায় প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র সব চাষির কাছে ঋণ পৌঁছে দেওয়া অধিকতর মঙ্গল আনার সম্ভাবনা রাখে। সংগত কারণেই নতুন ঋণ কর্মসূচির কার্যকারিতার ভিন্ন মাত্রা প্রয়োজন।
ক্ষুদ্রঋণকে বাদ দিলে বাংলাদেশের (সম্ভবত) সব বিশেষ ঋণ কর্মসূচি কোনো না কোনো প্রযুক্তি বিপণন প্রসারে সম্পূরক ভূমিকা রেখেছে। আশির দশকে টিউবওয়েল বসিয়ে সেচের দ্বারা উফশী ধানের আবাদ প্রসার থেকে শুরু করে বর্তমানে সৌর প্যানেল বিপণনে বিশেষ ঋণ কর্মসূচির ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রকল্প প্রণয়নে দুর্বলতার কারণে নব্বইয়ের দশকে সরকারি ব্যাংকের ঋণের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি সম্প্রসারণের অন্বয়-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। এমনকি বিশাল অঙ্কের প্রাথমিক তহবিলের মালিকানা অনেক ক্ষেত্রে অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এই অভিজ্ঞতার আলোকে ঋণ বিতরণের দ্বারা এক বা একাধিক কৃষিপ্রযুক্তি প্রসার এবং ঝুঁকি হ্রাসকারী পণ্য বিপণনকে অন্বয়ের লক্ষ্যে ব্র্যাককে বেছে নেওয়ার যৌক্তিকতা রয়েছে। এমনকি হতদরিদ্রদের বর্গা চাষে সম্পৃক্ত করে তাদের জীবন-জীবিকা উন্নত করার লক্ষ্যে এই ঋণ কর্মসূচি গ্রহণ করলেও অবাক হওয়ার ছিল না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন কর্মসূচি থেকে সুফল পাওয়ার জন্য আশু ভিত্তিতে কিছু কৃষিপ্রযুক্তি চিহ্নিত করে তার প্রসারে সম্পূরক ভূমিকায় এই ঋণকে দেখা প্রয়োজন। সম্ভব হলে এই কর্মসূচির আওতায় প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র ‘মালিক চাষি’দেরও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এতে বর্গাচাষি বাছাইয়ে অর্থ ও সময় অপচয় না করে নির্দিষ্ট প্রযুক্তির প্রসার অবলোকনের মাধ্যমে সফলতা নিশ্চিত করায় মনোনিবেশ করা যাবে। ঋণগ্রহীতা ও বিনিয়োগ খাত নির্বাচন যেন অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষমতার প্রভাবে দুষ্ট না হয়। নিঃসন্দেহে সহজ মূল্যে এই তহবিল প্রাপ্তি ব্র্যাককে বিভিন্নভাবে উপকৃত করবে। এর বিনিময়ে ব্র্যাকের কাছ থেকে পাওনাগুলো সুনিশ্চিত করা জরুরি।
(মূল নিবন্ধটি www.ergonline.org তে পাওয়া যাবে।)
সাজ্জাদ জহির: পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ।
sajjadzohir@yahoo.com
পুনঃঅর্থায়নের ভিত্তিতে ব্র্যাকের মাধ্যমে ৫০০ কোটি টাকার তহবিল থেকে বর্গাচাষিদের ঋণ বিতরণ করা হবে, যা ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষি খাতে সরকারি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রার পাঁচ শতাংশেরও কম। কেবল ৩৫টি জেলার ১৫০টি উপজেলায় এই ঋণ বিতরণ করা হবে এবং একে ক্ষুদ্রঋণ না বলে আভাসে ইঙ্গিতে ‘ব্যাংক ঋণ’ বলা হচ্ছে। ব্র্যাক বার্ষিক ভিত্তিতে পাঁচ শতাংশ সুদ বাংলাদেশ ব্যাংককে দেবে এবং ১০ শতাংশ সুদে বর্গাচাষিদের ঋণ দেওয়ার উল্লেখ রয়েছে। ফসল ওঠার আগে আদায়যোগ্য ঋণের ৩০ শতাংশ মাসিক কিস্তিতে এবং বাকি ৭০ শতাংশ ফসল ওঠার পর সমান দুটো মাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।
সমস্যা হলো, বর্গাচাষির কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষি বা পল্লীঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচিতে (সার্কুলার নং-৪) উল্লেখ রয়েছে, ‘ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক (যাদের জমির পরিমাণ ০.৪৯৪ একর থেকে ২.৪৭ একর) তথা বর্গাচাষিদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে।’ আরও উল্লেখ রয়েছে, বর্গাচাষি একজন প্রকৃত কৃষক, যিনি অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেন এবং তা যাচাইয়ের দুটো সম্ভাব্য পথ হলো: জমির মালিকের দেওয়া একটি প্রত্যয়নপত্র অথবা স্থানীয় এলাকার দায়িত্বশীল ও গণ্যমান্য ব্যক্তির কাছ থেকে সংগৃহীত প্রত্যয়নপত্র।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নীতিপর্যায়ে ‘বর্গাচাষি’ যেভাবে স্বীকৃত, বাংলাদেশে তেমনটি ঘটেনি। নীলচাষি ও আধিয়ারদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণে যেমন বর্গাচাষির ব্যানারে কোনো সমাজগোষ্ঠী একতাবদ্ধ হয়নি, একইভাবে জোত বিভাজনের প্রক্রিয়া ও কৃষিতে প্রতিবন্ধী রূপ বাণিজ্যিকীকরণের ফলে সমস্বার্থের অধিকারী ‘বর্গাচাষি’ নামের একক কোনো সামাজিক বা অর্থনৈতিক শ্রেণী এ দেশে দানা বাঁধতে পারেনি। তবে পরিসংখ্যানে এর উপস্থিতি যত্রতত্র। ২০০৮ সালের কৃষিশুমারি অনুযায়ী গ্রামীণ সব পরিবারের মাত্র ৫৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ কৃষি খামার, যাদের ৫৫ শতাংশ বর্গা চাষ করে। এসব বর্গাচাষির অধিকাংশই নিজেদের জমিও চাষ করেন।
ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি) পরিচালিত ২০০০ সালের দেশব্যাপী এক জরিপে দুই-তৃতীয়াংশ জরিপ করা গ্রামে বর্গা চাষের প্রাধান্য রয়েছে। এদের এক-তৃতীয়াংশে বছরব্যাপী সব মৌসুমি ফসলের ক্ষেত্রে বর্গা চাষ চালু আছে; প্রায় ৪২ শতাংশ গ্রামে শুধু ইরি বা বোরো ধানের সময় তা চালু আছে। কেবল ভাগ চাষে নয়, অর্ধেকেরও বেশি ক্ষেত্রে নগদ খাজনায় জমি বর্গা নেওয়া হয়। ইআরজির ওই জরিপের ফলাফল থেকে আরও জানা যায়, যেসব এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কৃষি কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, সেসব এলাকায় ভাগ চাষে জমি বর্গা নেওয়ার প্রথা বিলুপ্ত প্রায় এবং নগদ খাজনার ভিত্তিতে জমির ব্যবহার স্বত্বের লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব এলাকায় অনেক সময় তাই বন্ধকি ব্যবস্থা থেকে নগদ খাজনার পার্থক্য টানা দুরূহ। বাংলাদেশের চিংড়ি চাষাধীন দক্ষিণাঞ্চল ও আলু চাষাধীন এলাকায় (যেমন মুন্সিগঞ্জ) এমন নগদভিত্তিক লেনদেনের মাত্রার অধিক্য দেখা যায়।
বর্গাকেন্দ্রিক চুক্তি নিবন্ধীকরণের ব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই এবং এর বাস্তবসম্মত কারণও রয়েছে। এ অবস্থায় কে ঋণ পাওয়ার যোগ্য, তা কাগজে-কলমে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। স্থানীয় এলাকার দায়িত্বশীল ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে সংগৃহীত প্রত্যয়নপত্র গ্রহণের সুযোগ অযাচিত রাজনৈতিক প্রভাবের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়।
পত্রিকা মাধ্যমে আমরা জেনেছি, পরিবারপ্রধান এসএসসি পাস না হলেই কেবল ঋণ পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবেন। দরিদ্র পরিবার চিহ্নিত করতে বহু ক্ষেত্রে এ জাতীয় তথ্য ব্যবহার হয়। কিন্তু ইআরজির জরিপ থেকে জানা যায়, বর্গাচাষিদের মধ্যে এসএসসি পাসের হার যেখানে চার শতাংশ, অন্য গোষ্ঠীর (বর্গা নেন না) ক্ষেত্রে তা ৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং এ দুটোর ব্যবধান উল্লেখজনক নয়। তাই ‘এসএসসি পাস’ জাতীয় তথ্যের ভিত্তিতে যোগ্য ঋণগ্রহীতা বাছাই নির্ভরযোগ্য নয়, বরং এ জাতীয় মাপকাঠির ব্যবহার ভ্রান্তিকর। এসএসসি পাস করে যেন একজন বর্গাচাষি পাপ করে বসেছেন এবং তাই তাঁকে ঋণ দেওয়া হবে না! অথচ একজন শিক্ষিত কৃষক চাষের সঙ্গে জড়িত হলে অধিক দক্ষতার সঙ্গে ঋণের ব্যবহার করতে সক্ষম।
বর্গা চাষের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ পেলেও চাষিরা উত্পাদন বাড়াতে যথেষ্ট প্রণোদিত নাও হতে পারে। অতীতের মাঠ জরিপ থেকে আমরা জানি, সীমিত জমির লেনদেনের বাজারে অধিক ঋণ সরবরাহ ও চাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে জমির মালিকের প্রাপ্তি (খাজনা) বৃদ্ধি করে।
এটা অনস্বীকার্য, শহর ও বাণিজ্যকেন্দ্রিক ব্যাংকঋণ যে সুদে বিতরণ সম্ভব, তার চেয়ে অধিক হারে ক্ষুদ্রঋণের সুদ ধার্য করা আবশ্যিক। তবে সুদের হার প্রকাশে অনেক অস্বচ্ছতা দূর করা প্রয়োজন। ব্র্যাকের মাধ্যমে দেয় ঋণের সুদের হার নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। যদি ফ্ল্যাট রেটে ৫০ (বা ১০০) টাকা সুদ ধরে ছয় মাসে সুদ ও আসল আদায় হয়, সে ক্ষেত্রে কার্যকরী বাত্সরিক সুদের হার ১৬ শতাংশ (৩১ শতাংশ) হবে। এখনো পরিষ্কার নয়, কোন পথ ব্র্যাক নেবে।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বর্গাচাষিদের কাছে ঋণ পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন এমন একটি সংগঠন, যার দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক রয়েছে। নিঃসন্দেহে অন্য পাঁচটি সংগঠনের তুলনায় ব্র্যাকের কিছু বাড়তি যোগ্যতা রয়েছে, এটি ৩০ বছরের অধিককাল সেবাধর্মী কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এবং দেশব্যপী ক্ষুদ্রঋণ সরবরাহ করে। নতুন ঋণ কর্মসূচির সঙ্গে ব্র্যাকের সংশ্লিষ্টতার বড় সনদ সম্ভবত কৃষি সম্প্রসারণে ও কৃষিপণ্য বিপণনে এর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। ব্র্যাক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হাইব্রিড বীজ বিপণন করে এবং আন্তর্জাতিক বীজ কোম্পানির সহায়তায় দেশে-বিদেশে কৃষকদের সংগঠিত করে বিভিন্ন ফসল চাষে উন্নত মানের বীজ ব্যবহার সম্প্রসারণ করছে। এবং এই কাজে অনেক সময় ঋণ কর্মসূচিকে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা তহবিল জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে এবং বিগত বছরগুলোতে ‘দান’-এর পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় তাদের তহবিল সংগ্রহের খরচ বেড়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে সঞ্চয় সংগ্রহ আইনানুগ না করায় এসব সংস্থা অনেক ক্ষেত্রে উচ্চসুদে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এ অবস্থায় পাঁচ শতাংশ হারে ব্র্যাকের তহবিল প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে তাদের সুবিধাজনক অবস্থানে নেবে। এই তহবিল তৈরির ফলে তাদের (বর্গাচাষি) সদস্যরা অধিকতর ঋণ পাওয়ার বা ঋণ পুনর্তফসিল করার সুযোগ পাবে, যা অন্যান্য ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছিয়ে দেবে। প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য পিকেএসএফ পরিচালিত ঋণ কর্মসূচিও প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হবে। নতুন ঋণের সম্ভাব্য সুদের হার অধিকাংশ ক্ষুদ্রঋণের সুদের হারের চেয়ে কিছুটা কম। তবে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের সুদের হারের চেয়ে বেশি। যদি অর্থের বিনিময়ে ব্র্যাক ব্যাংকের কাছ থেকে গ্যারান্টি নেওয়া হয়, যা লভ্যাংশ থেকে সমন্বয় করা হবে, সমগ্র বিনিময়প্রক্রিয়ায় বর্তমান সংকটকালে ব্র্যাক পরিবার কিছুটা স্বস্তি পাবে।
উল্লেখ্য, ক্ষুদ্রঋণের বড় অংশ বহুদিন ধরে বর্গা-বাজারে ব্যবহূত হয়ে আসছে। তাই সহজ সুদে বর্গাচাষিদের ঋণ দিয়ে কৃষি উত্পাদনে বড় কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না। এমনকি সুষম বণ্টন অর্জনে তা ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেই তুলনায় প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র সব চাষির কাছে ঋণ পৌঁছে দেওয়া অধিকতর মঙ্গল আনার সম্ভাবনা রাখে। সংগত কারণেই নতুন ঋণ কর্মসূচির কার্যকারিতার ভিন্ন মাত্রা প্রয়োজন।
ক্ষুদ্রঋণকে বাদ দিলে বাংলাদেশের (সম্ভবত) সব বিশেষ ঋণ কর্মসূচি কোনো না কোনো প্রযুক্তি বিপণন প্রসারে সম্পূরক ভূমিকা রেখেছে। আশির দশকে টিউবওয়েল বসিয়ে সেচের দ্বারা উফশী ধানের আবাদ প্রসার থেকে শুরু করে বর্তমানে সৌর প্যানেল বিপণনে বিশেষ ঋণ কর্মসূচির ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রকল্প প্রণয়নে দুর্বলতার কারণে নব্বইয়ের দশকে সরকারি ব্যাংকের ঋণের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি সম্প্রসারণের অন্বয়-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। এমনকি বিশাল অঙ্কের প্রাথমিক তহবিলের মালিকানা অনেক ক্ষেত্রে অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এই অভিজ্ঞতার আলোকে ঋণ বিতরণের দ্বারা এক বা একাধিক কৃষিপ্রযুক্তি প্রসার এবং ঝুঁকি হ্রাসকারী পণ্য বিপণনকে অন্বয়ের লক্ষ্যে ব্র্যাককে বেছে নেওয়ার যৌক্তিকতা রয়েছে। এমনকি হতদরিদ্রদের বর্গা চাষে সম্পৃক্ত করে তাদের জীবন-জীবিকা উন্নত করার লক্ষ্যে এই ঋণ কর্মসূচি গ্রহণ করলেও অবাক হওয়ার ছিল না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন কর্মসূচি থেকে সুফল পাওয়ার জন্য আশু ভিত্তিতে কিছু কৃষিপ্রযুক্তি চিহ্নিত করে তার প্রসারে সম্পূরক ভূমিকায় এই ঋণকে দেখা প্রয়োজন। সম্ভব হলে এই কর্মসূচির আওতায় প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র ‘মালিক চাষি’দেরও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এতে বর্গাচাষি বাছাইয়ে অর্থ ও সময় অপচয় না করে নির্দিষ্ট প্রযুক্তির প্রসার অবলোকনের মাধ্যমে সফলতা নিশ্চিত করায় মনোনিবেশ করা যাবে। ঋণগ্রহীতা ও বিনিয়োগ খাত নির্বাচন যেন অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষমতার প্রভাবে দুষ্ট না হয়। নিঃসন্দেহে সহজ মূল্যে এই তহবিল প্রাপ্তি ব্র্যাককে বিভিন্নভাবে উপকৃত করবে। এর বিনিময়ে ব্র্যাকের কাছ থেকে পাওনাগুলো সুনিশ্চিত করা জরুরি।
(মূল নিবন্ধটি www.ergonline.org তে পাওয়া যাবে।)
সাজ্জাদ জহির: পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ।
sajjadzohir@yahoo.com
No comments