ছুটি কী, কেন ও কাদের জন্য -জীবনযাপন by জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী
প্রথম প্রশ্নটারই জবাব দেওয়া যাক—ছুটি কী। নিয়মিত কাজ থেকে অব্যাহতি পেয়ে বা অব্যাহতি নিয়ে, নিয়মিত কাজের জায়গা থেকে অন্য কোথাও কটি দিন কাটানো, সহজভাবে ছুটি বলতে আমরা এ-ই বুঝি। এ দিক দিয়ে, স্থান পরিবর্তন ছুটির একটা শর্ত হয়ে দাঁড়ায়।
গত তিন দিনের ঈদের ছুটি সে জন্য আমার কাছে ছুটি ছিল না, যেহেতু আমি ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও যাইনি। ইচ্ছে ছিল না, বলা যাবে না, তবে যাওয়া হয়নি। এর একটা কারণ, আমার প্রবাসী এক ছেলে নিজেই ছুটি কাটাতে এসেছিল ঢাকায় তার পিত্রালয়ে। ওদের ছুটি আমার ছুটিকে কেড়ে নিয়েছে তা-ও বলতে চাই না। ওদের ছুটির মধ্য দিয়ে আমি এভাবে ছুটির স্বাদ গ্রহণ করেছি। তবে ছুটির সঙ্গে স্থান পরিবর্তন যে কতটা অবিচ্ছেদ্য, তার প্রমাণ, কয়েক লাখ বঙ্গসন্তানের পড়ি কি মরি করে ঢাকা শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়া, প্রয়োজনে ট্রেনের ছাদে চেপে হলেও বেরিয়ে যাওয়া।
কয়েক লাখ ঢাকাবাসীর এই গ্রামযাত্রা তবু নির্ভেজাল ছুটির নাম দাবি করতে পারে না। এই গ্রামযাত্রার প্রধান লক্ষ্য পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়া। নির্ভেজাল ছুটির পেছনে এ ধরনের কোনো লক্ষ্য থাকে না। একটাই লক্ষ্য থাকে, প্রকৃতির সঙ্গে মিলিত হওয়া। সে জন্যই কক্সবাজার, সে জন্যই বান্দরবান, সে জন্যই কুয়াকাটা এবং অবশ্যই সুন্দরবন। অনেক কিছুই নেই আমাদের বাংলাদেশে, আবার আছেও। এই মাত্র যে নামগুলো করলাম, এর প্রতিটি প্রকৃতির এক বিশেষ রূপ নিয়ে মানুষকে টানছে। লাখ লাখ না হলেও হাজার হাজার বঙ্গসন্তান এই ঈদের অবকাশে ছুটে গিয়েছে কক্সবাজারে, বান্দরবানে, কুয়াকাটায় ও সুন্দরবনে। সংবাদপত্র জানাচ্ছে, কক্সবাজারের কোনো হোটেল-মোটেলে একটি শয্যাও খালি ছিল না ঈদের ছুটিতে, সব আগে থেকেই ‘বুক’ হয়ে গিয়েছিল। এ থেকে পরিষ্কার হচ্ছে একটা বিষয়, বাংলাদেশের বাঙালিও এখন ছুটির মর্ম বুঝে নিয়েছে। ওপার বাংলার বাঙালিদের খ্যাতি আছে, ছুটি উপভোগের বেলায় ওরা আছে সবার আগে, আমরা, বাংলাদেশে, পিছিয়ে ছিলাম। পাহাড়-বন-সমুদ্র-উপকূল সবই ছিল, তবে পর্যটনের সুযোগ-সুবিধা বলতে যা বোঝায়, যাতায়াত-ব্যবস্থা, থাকা-খাওয়ার সুবিধা—এ সবের ঘাটতি ছিল। এ ক্ষেত্রে প্রচুর অগ্রগতি হয়েছে বিগত বছরগুলোতে। পর্যটন করপোরেশন যা করেছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেসরকারি উদ্যোগের ফসল—হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ। কক্সবাজারকে যদি ধরা হয় পর্যটনের জন্য বাংলাদেশের সর্বপ্রথম-সর্বপ্রধান আকর্ষণ, সেখানে সুযোগ-সুবিধার ব্যাপক সম্প্রসারণের পরও, চাহিদা মেটানোর মতো সেটা হয়নি। অর্থাত্ অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে যে বিকাশ ঘটেছে, তা এককথায় বিস্ময়কর। শ্রেণী, পরিবার, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তেরও বিকাশ ঘটেছে, কারণ পর্যটনের সঙ্গে সম্পর্ক আছে আর্থিক সংগতির।
এবার আসি দ্বিতীয় প্রশ্নটিতে—ছুটি কেন? যে কারণে দিনের বিশ্রাম, রাতের নিদ্রা, সেই একই কারণে সপ্তাহের পাঁচ বা ছয় দিনের শেষে সাপ্তাহিক ছুটি। বাইবেলে আছে, সৃষ্টিকর্তা ছয় দিনে তাঁর সৃষ্টির শেষে সপ্তম দিনে বিশ্রাম নিলেন। সে জন্য খ্রিষ্টান-জগতে রোববারের ছুটি স্যাবাটিক্যাল—অবশ্য পালনীয়। এ দেশে আমরাও শত বছরের অধিক কাল রোববারের ছুটিতে অভ্যস্ত ছিলাম। রোববারের জায়গা নিয়েছে শুক্রবার, বেশি দিনের কথা নয়। এখনো ছুটির দিন হিসেবে রোববারের দাবি ঘুরে ঘুরে আসছে। সরকার আছে দোটানায়, ইচ্ছে থাকলেও এগোতে পারছে না—পাছে ওরা কিছু বলে।
যারা যত বেশি কাজ করে, ছুটির প্রয়োজন তাদের তত বেশি। ছুটি শুধু বড়লোকের চিত্তবিনোদন নয়, ছুটি কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষেরও ন্যায্য অধিকার। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই সত্যটাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন—কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী ছুটি কাটানোর জায়গাগুলোয় সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশের সবার জন্য এই ভাবনা এ মুহূর্তে এক অবাস্তব স্বপ্নবিলাস মনে হতে পারে। তবে সীমিত পর্যায়ে আমরা এখন থেকেই কাজটা কেন শুরু করতে পারব না? আমাদের পর্যটন করপোরেশনকে এ জন্য ভেঙে গড়ার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। এ সংস্থা এ পর্যন্ত যা করেছে ও যাদের জন্য করেছে, সেটা এখন আর জরুরি কাজ নয়। বেসরকারি পর্যায়ে সে কাজের দায়িত্ব হয়তো অনেক বেশি যোগ্যতার সঙ্গে সম্পাদন করছে অন্যরা। যাদের জন্য প্রাইভেট সেক্টর কিছু করে না, তাদের জন্য কাজটি করবে সরকার। সরকারও করবে না, যত দিন না সরকারের বর্তমান ধনীবান্ধব চেহারা বদলাচ্ছে। দরিদ্রবান্ধব সরকার পেতে হলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে একজন বারাক ওবামার। বারাক ওবামা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার সংকল্প গ্রহণ করেছেন। এই সংকল্প বাস্তবায়নে তিনি প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়েছেন, কিন্তু সংকল্পে অটল আছেন এখন পর্যন্ত। এ দেশে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার যে ব্যবস্থা, সেটা এখনো ব্যবস্থা-পদবাচ্য হয়ে ওঠেনি। স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক দাবি পূরণেই যখন আমরা এত পিছিয়ে আছি, তখন সবার জন্য ছুটির বিনোদন-ব্যবস্থার কথা বলাও এক ধরনের বাতুলতা। তবু বলতে হবে।
ছুটি কেন-র কথা বলতে গিয়ে ছুটি কাদের জন্য—প্রসঙ্গটিও কীভাবে যেন এসে গিয়েছে। আবার ছুটি কেনর প্রসঙ্গে ফিরে যাই।
সরকারি কর্মসপ্তাহ কদিনের জন্য হবে, পাঁচ দিনের, সাড়ে পাঁচ দিনের, না ছয় দিনের—এই প্রশ্নে আমরা এ দেশে আজ পর্যন্ত এক দোলাচলের মধ্যে রয়েছি। দীর্ঘকাল আমরা অভ্যস্ত ছিলাম সাড়ে পাঁচ দিনের কর্মসপ্তাহে। শনিবারে অর্ধ দিবস, রোববারে পূর্ণ দিবস। কিছুদিন থেকে এ দেশে চালু রয়েছে শুক্রবার-শনিবার নিয়ে দুদিনের পূর্ণ দিবস ছুটি। বিশেষত ব্যবসায়ী মহলে এ নিয়ে রীতিমতো আপত্তি রয়েছে বলে আমার ধারণা। ব্যাংকিং মহলেও একই আপত্তি। সরকার একটি বিশেষ মহলের আপত্তিকে বরাবর প্রয়োজনের অধিক গুরুত্ব দিয়ে আসছে, যে কারণে শত বছরের পরীক্ষিত ব্যবস্থায় ফিরে যেতে পারছে না। পাঁচ দিনের কর্মসপ্তাহের পেছনে যত যুক্তিই থাক না কেন, একটি অনুন্নত দেশে এ এক বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়। সমাজতন্ত্রী চীনে ওরা কিছুদিন আগেও ছয় দিনে সপ্তাহ ও সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজের নিয়ম চালু রেখেছিল। অবশ্য বিগত বছরগুলোতে চীনের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে তাল রেখে সে ব্যবস্থার ইতি ঘটেছে কি না, আমার জানা নেই।
একদিকে পাঁচ দিনের কর্মসপ্তাহ, অন্যদিকে সরকারি ছুটির এক দীর্ঘ তালিকা, যা কোনো উন্নত দেশের তালিকার সঙ্গে মেলে না। দিনবদলের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে, সবকিছুই আগের মতো চলার এই ধারা মেলে না। আমাদের কর্মসংস্কৃতির পরিবর্তন ছাড়া দিনবদলের লাখো কথায় এক ছটাক লাভ হবে না।
আমার তৃতীয় প্রশ্ন—ছুটি কাদের জন্য, এর আংশিক উত্তর দেওয়া হয়ে গেছে। পল্লীসমাজে গৃহবধূরা বছরের একটা সময়ে ‘নাইওরে’ যেত—পিতৃগৃহে যেত। গৃহবধূদের জন্য এ ছিল ছুটির এক ধরনের সামাজিক এবং মানবিক ব্যবস্থা। শ্বশুরালয়ে গৃহবধূদের জন্য বরাদ্দ থাকে একটা ব্যস্ত জীবন, সেই জীবনে কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই। থাকলে ভালো হতো। যা-ই হোক, বছরে একবার, এক মাসের ছুটি নিয়ে পিতৃগৃহে বাসকে প্রকৃত অর্থে ছুটি বলা যায় কি না আমি নিশ্চিত নই। পিতৃগৃহ কক্সবাজার, বান্দরবান, কুয়াকাটা নয় আমরা জানি। তবু পিতৃগৃহ যদি অবকাশ দেয়, আনন্দ দেয়, স্বস্তি দেয়, একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দেয়, তাহলে নাইওরের এক মাস কেন ছুটি হবে না! ছেলেবেলায় দেখেছি, আমার মা প্রতি বর্ষাকালে এক মাসের জন্য নানিবাড়িতে যেতেন। নাইওর শব্দটি বোধহয় শ্রেণিগন্ধযুক্ত, কেবল কৃষকসমাজের ব্যাপার। মায়ের এই এক মাসকে কখনো নাইওর বলা হয়নি। তবে সাংসারিক দায়িত্ব পালন থেকে এক মাসের মুক্তি যে তিনি মনে-প্রাণে চাইতেন, আমার বালক বয়সেও আমি সেটা জানতাম।
সবারই ছুটি আছে, শুধু কৃষকের ছুটি নেই, তা-ই বা বলি কেমন করে। যখন মাঠের কাজ থাকে না, তখন যে কর্মবিরতি, প্রকৃতির নিয়মে, ঋতুর নিয়মে, সেটাই কৃষকের ছুটি। তবে সেটা আনন্দদায়ক ছুটি না-ও হতে পারে। সবই নির্ভর করে ফসলের প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তির ওপর। হেমন্তে আমন ধানের ফলন ভালো হলে বাংলাদেশের গ্রামেও একটা ছুটির হাওয়া বয়ে যেত। যাত্রা, পালাগানের মৌসুম শুরু হতো। দেশের একেক অঞ্চল একেক চেহারা নিত এই ফসল ঘরে তোলার ঋতু। ধানের দেশ হিসেবে খ্যাত বরিশালে এ সময় কৃষকের মুখে যে হাসি দেখা গিয়েছে, বরিশালবাসী সে কথা কখনো ভোলে না।
লং ভেকেশন। লম্বা ছুটির ব্যবস্থা বলবত্ ছিল দুটি জায়গায়—এক. উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে, দুই. উচ্চ আদালতে। অধ্যাপকেরা, বিচারপতিরা এই লম্বা ছুটিতে কী করেন, অন্যদের এ বিষয়ে কৌতূহল আছে। তাঁরা কি ঘুমান, না বই পড়েন, না বই লেখেন, না কেবলই মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেন, অতিরিক্ত পরিশ্রমের পর?
তাঁরা যা-ই করুন না কেন, তাঁদের জন্য একটা লম্বা ছুটির প্রয়োজন নিয়ে কেউ প্রশ্ন করেনি। সাংসদেরাও বছরে কয়েকবার লম্বা ছুটিতে যান। তবে তাঁদের এ ছুটি যে আসলে ছুটি নয়, আমাকে আশ্বস্ত করেছেন একজন সাংসদ। উমেদারদের জন্য তাঁদের দরজা খোলা রাখতে হয় মধ্যরাত পর্যন্ত, এটা জানার পর আশা করি কেউ ঈর্ষাবোধ করবেন না তাঁদের ঈর্ষণীয় সৌভাগ্য নিয়ে।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
গত তিন দিনের ঈদের ছুটি সে জন্য আমার কাছে ছুটি ছিল না, যেহেতু আমি ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও যাইনি। ইচ্ছে ছিল না, বলা যাবে না, তবে যাওয়া হয়নি। এর একটা কারণ, আমার প্রবাসী এক ছেলে নিজেই ছুটি কাটাতে এসেছিল ঢাকায় তার পিত্রালয়ে। ওদের ছুটি আমার ছুটিকে কেড়ে নিয়েছে তা-ও বলতে চাই না। ওদের ছুটির মধ্য দিয়ে আমি এভাবে ছুটির স্বাদ গ্রহণ করেছি। তবে ছুটির সঙ্গে স্থান পরিবর্তন যে কতটা অবিচ্ছেদ্য, তার প্রমাণ, কয়েক লাখ বঙ্গসন্তানের পড়ি কি মরি করে ঢাকা শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়া, প্রয়োজনে ট্রেনের ছাদে চেপে হলেও বেরিয়ে যাওয়া।
কয়েক লাখ ঢাকাবাসীর এই গ্রামযাত্রা তবু নির্ভেজাল ছুটির নাম দাবি করতে পারে না। এই গ্রামযাত্রার প্রধান লক্ষ্য পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়া। নির্ভেজাল ছুটির পেছনে এ ধরনের কোনো লক্ষ্য থাকে না। একটাই লক্ষ্য থাকে, প্রকৃতির সঙ্গে মিলিত হওয়া। সে জন্যই কক্সবাজার, সে জন্যই বান্দরবান, সে জন্যই কুয়াকাটা এবং অবশ্যই সুন্দরবন। অনেক কিছুই নেই আমাদের বাংলাদেশে, আবার আছেও। এই মাত্র যে নামগুলো করলাম, এর প্রতিটি প্রকৃতির এক বিশেষ রূপ নিয়ে মানুষকে টানছে। লাখ লাখ না হলেও হাজার হাজার বঙ্গসন্তান এই ঈদের অবকাশে ছুটে গিয়েছে কক্সবাজারে, বান্দরবানে, কুয়াকাটায় ও সুন্দরবনে। সংবাদপত্র জানাচ্ছে, কক্সবাজারের কোনো হোটেল-মোটেলে একটি শয্যাও খালি ছিল না ঈদের ছুটিতে, সব আগে থেকেই ‘বুক’ হয়ে গিয়েছিল। এ থেকে পরিষ্কার হচ্ছে একটা বিষয়, বাংলাদেশের বাঙালিও এখন ছুটির মর্ম বুঝে নিয়েছে। ওপার বাংলার বাঙালিদের খ্যাতি আছে, ছুটি উপভোগের বেলায় ওরা আছে সবার আগে, আমরা, বাংলাদেশে, পিছিয়ে ছিলাম। পাহাড়-বন-সমুদ্র-উপকূল সবই ছিল, তবে পর্যটনের সুযোগ-সুবিধা বলতে যা বোঝায়, যাতায়াত-ব্যবস্থা, থাকা-খাওয়ার সুবিধা—এ সবের ঘাটতি ছিল। এ ক্ষেত্রে প্রচুর অগ্রগতি হয়েছে বিগত বছরগুলোতে। পর্যটন করপোরেশন যা করেছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেসরকারি উদ্যোগের ফসল—হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ। কক্সবাজারকে যদি ধরা হয় পর্যটনের জন্য বাংলাদেশের সর্বপ্রথম-সর্বপ্রধান আকর্ষণ, সেখানে সুযোগ-সুবিধার ব্যাপক সম্প্রসারণের পরও, চাহিদা মেটানোর মতো সেটা হয়নি। অর্থাত্ অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে যে বিকাশ ঘটেছে, তা এককথায় বিস্ময়কর। শ্রেণী, পরিবার, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তেরও বিকাশ ঘটেছে, কারণ পর্যটনের সঙ্গে সম্পর্ক আছে আর্থিক সংগতির।
এবার আসি দ্বিতীয় প্রশ্নটিতে—ছুটি কেন? যে কারণে দিনের বিশ্রাম, রাতের নিদ্রা, সেই একই কারণে সপ্তাহের পাঁচ বা ছয় দিনের শেষে সাপ্তাহিক ছুটি। বাইবেলে আছে, সৃষ্টিকর্তা ছয় দিনে তাঁর সৃষ্টির শেষে সপ্তম দিনে বিশ্রাম নিলেন। সে জন্য খ্রিষ্টান-জগতে রোববারের ছুটি স্যাবাটিক্যাল—অবশ্য পালনীয়। এ দেশে আমরাও শত বছরের অধিক কাল রোববারের ছুটিতে অভ্যস্ত ছিলাম। রোববারের জায়গা নিয়েছে শুক্রবার, বেশি দিনের কথা নয়। এখনো ছুটির দিন হিসেবে রোববারের দাবি ঘুরে ঘুরে আসছে। সরকার আছে দোটানায়, ইচ্ছে থাকলেও এগোতে পারছে না—পাছে ওরা কিছু বলে।
যারা যত বেশি কাজ করে, ছুটির প্রয়োজন তাদের তত বেশি। ছুটি শুধু বড়লোকের চিত্তবিনোদন নয়, ছুটি কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষেরও ন্যায্য অধিকার। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই সত্যটাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন—কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী ছুটি কাটানোর জায়গাগুলোয় সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশের সবার জন্য এই ভাবনা এ মুহূর্তে এক অবাস্তব স্বপ্নবিলাস মনে হতে পারে। তবে সীমিত পর্যায়ে আমরা এখন থেকেই কাজটা কেন শুরু করতে পারব না? আমাদের পর্যটন করপোরেশনকে এ জন্য ভেঙে গড়ার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। এ সংস্থা এ পর্যন্ত যা করেছে ও যাদের জন্য করেছে, সেটা এখন আর জরুরি কাজ নয়। বেসরকারি পর্যায়ে সে কাজের দায়িত্ব হয়তো অনেক বেশি যোগ্যতার সঙ্গে সম্পাদন করছে অন্যরা। যাদের জন্য প্রাইভেট সেক্টর কিছু করে না, তাদের জন্য কাজটি করবে সরকার। সরকারও করবে না, যত দিন না সরকারের বর্তমান ধনীবান্ধব চেহারা বদলাচ্ছে। দরিদ্রবান্ধব সরকার পেতে হলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে একজন বারাক ওবামার। বারাক ওবামা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার সংকল্প গ্রহণ করেছেন। এই সংকল্প বাস্তবায়নে তিনি প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়েছেন, কিন্তু সংকল্পে অটল আছেন এখন পর্যন্ত। এ দেশে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার যে ব্যবস্থা, সেটা এখনো ব্যবস্থা-পদবাচ্য হয়ে ওঠেনি। স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক দাবি পূরণেই যখন আমরা এত পিছিয়ে আছি, তখন সবার জন্য ছুটির বিনোদন-ব্যবস্থার কথা বলাও এক ধরনের বাতুলতা। তবু বলতে হবে।
ছুটি কেন-র কথা বলতে গিয়ে ছুটি কাদের জন্য—প্রসঙ্গটিও কীভাবে যেন এসে গিয়েছে। আবার ছুটি কেনর প্রসঙ্গে ফিরে যাই।
সরকারি কর্মসপ্তাহ কদিনের জন্য হবে, পাঁচ দিনের, সাড়ে পাঁচ দিনের, না ছয় দিনের—এই প্রশ্নে আমরা এ দেশে আজ পর্যন্ত এক দোলাচলের মধ্যে রয়েছি। দীর্ঘকাল আমরা অভ্যস্ত ছিলাম সাড়ে পাঁচ দিনের কর্মসপ্তাহে। শনিবারে অর্ধ দিবস, রোববারে পূর্ণ দিবস। কিছুদিন থেকে এ দেশে চালু রয়েছে শুক্রবার-শনিবার নিয়ে দুদিনের পূর্ণ দিবস ছুটি। বিশেষত ব্যবসায়ী মহলে এ নিয়ে রীতিমতো আপত্তি রয়েছে বলে আমার ধারণা। ব্যাংকিং মহলেও একই আপত্তি। সরকার একটি বিশেষ মহলের আপত্তিকে বরাবর প্রয়োজনের অধিক গুরুত্ব দিয়ে আসছে, যে কারণে শত বছরের পরীক্ষিত ব্যবস্থায় ফিরে যেতে পারছে না। পাঁচ দিনের কর্মসপ্তাহের পেছনে যত যুক্তিই থাক না কেন, একটি অনুন্নত দেশে এ এক বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়। সমাজতন্ত্রী চীনে ওরা কিছুদিন আগেও ছয় দিনে সপ্তাহ ও সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজের নিয়ম চালু রেখেছিল। অবশ্য বিগত বছরগুলোতে চীনের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে তাল রেখে সে ব্যবস্থার ইতি ঘটেছে কি না, আমার জানা নেই।
একদিকে পাঁচ দিনের কর্মসপ্তাহ, অন্যদিকে সরকারি ছুটির এক দীর্ঘ তালিকা, যা কোনো উন্নত দেশের তালিকার সঙ্গে মেলে না। দিনবদলের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে, সবকিছুই আগের মতো চলার এই ধারা মেলে না। আমাদের কর্মসংস্কৃতির পরিবর্তন ছাড়া দিনবদলের লাখো কথায় এক ছটাক লাভ হবে না।
আমার তৃতীয় প্রশ্ন—ছুটি কাদের জন্য, এর আংশিক উত্তর দেওয়া হয়ে গেছে। পল্লীসমাজে গৃহবধূরা বছরের একটা সময়ে ‘নাইওরে’ যেত—পিতৃগৃহে যেত। গৃহবধূদের জন্য এ ছিল ছুটির এক ধরনের সামাজিক এবং মানবিক ব্যবস্থা। শ্বশুরালয়ে গৃহবধূদের জন্য বরাদ্দ থাকে একটা ব্যস্ত জীবন, সেই জীবনে কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই। থাকলে ভালো হতো। যা-ই হোক, বছরে একবার, এক মাসের ছুটি নিয়ে পিতৃগৃহে বাসকে প্রকৃত অর্থে ছুটি বলা যায় কি না আমি নিশ্চিত নই। পিতৃগৃহ কক্সবাজার, বান্দরবান, কুয়াকাটা নয় আমরা জানি। তবু পিতৃগৃহ যদি অবকাশ দেয়, আনন্দ দেয়, স্বস্তি দেয়, একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দেয়, তাহলে নাইওরের এক মাস কেন ছুটি হবে না! ছেলেবেলায় দেখেছি, আমার মা প্রতি বর্ষাকালে এক মাসের জন্য নানিবাড়িতে যেতেন। নাইওর শব্দটি বোধহয় শ্রেণিগন্ধযুক্ত, কেবল কৃষকসমাজের ব্যাপার। মায়ের এই এক মাসকে কখনো নাইওর বলা হয়নি। তবে সাংসারিক দায়িত্ব পালন থেকে এক মাসের মুক্তি যে তিনি মনে-প্রাণে চাইতেন, আমার বালক বয়সেও আমি সেটা জানতাম।
সবারই ছুটি আছে, শুধু কৃষকের ছুটি নেই, তা-ই বা বলি কেমন করে। যখন মাঠের কাজ থাকে না, তখন যে কর্মবিরতি, প্রকৃতির নিয়মে, ঋতুর নিয়মে, সেটাই কৃষকের ছুটি। তবে সেটা আনন্দদায়ক ছুটি না-ও হতে পারে। সবই নির্ভর করে ফসলের প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তির ওপর। হেমন্তে আমন ধানের ফলন ভালো হলে বাংলাদেশের গ্রামেও একটা ছুটির হাওয়া বয়ে যেত। যাত্রা, পালাগানের মৌসুম শুরু হতো। দেশের একেক অঞ্চল একেক চেহারা নিত এই ফসল ঘরে তোলার ঋতু। ধানের দেশ হিসেবে খ্যাত বরিশালে এ সময় কৃষকের মুখে যে হাসি দেখা গিয়েছে, বরিশালবাসী সে কথা কখনো ভোলে না।
লং ভেকেশন। লম্বা ছুটির ব্যবস্থা বলবত্ ছিল দুটি জায়গায়—এক. উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে, দুই. উচ্চ আদালতে। অধ্যাপকেরা, বিচারপতিরা এই লম্বা ছুটিতে কী করেন, অন্যদের এ বিষয়ে কৌতূহল আছে। তাঁরা কি ঘুমান, না বই পড়েন, না বই লেখেন, না কেবলই মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেন, অতিরিক্ত পরিশ্রমের পর?
তাঁরা যা-ই করুন না কেন, তাঁদের জন্য একটা লম্বা ছুটির প্রয়োজন নিয়ে কেউ প্রশ্ন করেনি। সাংসদেরাও বছরে কয়েকবার লম্বা ছুটিতে যান। তবে তাঁদের এ ছুটি যে আসলে ছুটি নয়, আমাকে আশ্বস্ত করেছেন একজন সাংসদ। উমেদারদের জন্য তাঁদের দরজা খোলা রাখতে হয় মধ্যরাত পর্যন্ত, এটা জানার পর আশা করি কেউ ঈর্ষাবোধ করবেন না তাঁদের ঈর্ষণীয় সৌভাগ্য নিয়ে।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments