চিরদিনের ছুটির তরে -জন্মদিন by জোবাইদা নাসরীন
আজ ৩ আগস্ট তোমার জন্মদিন। আসে ফিরে দিনটি, কিন্তু ফেরো না যে তুমি। গত বছরের ২৬ ফ্রেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে (রাত ১২টায়) তুমি শেষবারের মতো একটি টিভি চ্যানেলে এসেছিলে সংবাদ পর্যালোচনা করতে। সে সময় কি তোমার একবারের জন্যও মনে হয়েছে, এর পরদিন তুমি নিজেই পত্রিকার পাতায় বসতি করবে? ঢাকা ক্লাবের পিকনিকে তোলা ছবি দেখার জন্য তোমার সে কি রাগারাগি! অস্থির হয়ে বারবার ফোন করে বললে, ‘তুই আমাকে কেন ছবি দিচ্ছিস না।’ কিন্তু স্বভাবে অত্যন্ত সুস্থির মানুষের সঙ্গে এতটা অস্থিরতা কীভাবে সে সময় যোগ হলো? তুমি কি বুঝতে পারোনি, এতটা অস্থিরতা যে তোমার সঙ্গে একেবারেই বেমানান। তুমি কি আসলেই বুঝতে পেরেছিলে, তুমি খুব তাড়াতাড়িই কাছের মানুষদের কাছে ছবির ফ্রেমেই বন্দী হয়ে যাচ্ছ?
ঋজুতা ছিল তোমার চরিত্রের এক ঈর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। মিতভাষী, অথচ প্রচণ্ড রসবোধ। যার কারণে অনেক তুখোড় বক্তাও তোমার মনোযোগী শ্রোতা হয়ে যেত। অসম্ভব এক ধৈর্যশীল শ্রোতা। নিজেকে শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখোনি। ধীর লয়ের মার্জিত অথচ প্রখর ধারালো তোমার যুক্তি, তত্ত্ব ও তথ্যবহুল।
জীবন থেকে চিরদিনের ছুটি নেওয়ার আগ পর্যন্ত ছিলে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রগতিশীল পত্রিকা সংবাদ-এর সম্পাদক। অর্থনীতির ছাত্র হয়েও তুমি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলে সাংবাদিকতাকে। দীর্ঘ ৪৭ বছর তুমি এই পত্রিকাটি আঁকড়ে থেকেছ, আগলে রেখেছ। দৈনিক সংবাদ পরিগণিত হয়েছিল সাংবাদিকতার প্রতিষ্ঠান হিসেবে। সেই প্রতিষ্ঠানেরই অলিখিত শিক্ষক ছিলে তুমি। আশির দশকে সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘দর্শক’ নামের লেখা নিয়মিত কলামটি এখনো অনেকের কাছেই তথ্যের ভাণ্ডার হিসেবে আছে।
এ কথা তো আমরা সবাই জানি, যিনি প্রদীপ ধরে রাখেন, তিনি আড়ালেই থাকেন। ব্যক্তিজীবনেও হয়তো তুমি তা-ই ছিলে, নিজ থেকে কখনো আলোর রশ্মিতে উদ্ভাসিত হতে চাওনি। সম্পদশালী জীবন ছিল না তোমার, কিন্তু আদর্শের মাপে, জীবনবোধের পরিমাপে তোমার জীবন ছিল অনেক বেশি সমৃদ্ধ।
নারীস্বাধীনতা এবং নারী-পুরুষের সম-অধিকারে বিশ্বাসী মানুষ জগৎ সংসারে খুব কম। সেই কমদের ভিড় ঠেলে তুমি নারীস্বাধীনতার আলোটি এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছ। এ বিষয়ে খুব বেশি বাতচিতের ধার ধারোনি, কাজের মধ্য দিয়েই তুমি নারীস্বাধীনতার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছ। যত দূর জানা যায়, দৈনিক সংবাদ-এর মধ্য দিয়েই এ দেশে নারী সাংবাদিকতার শক্ত বুনিয়াদ তৈরি হয়। শুধু এ দেশেই নয়, প্রায় সব দেশেই একজন নারীকে তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ করতে দরকার হয় পরিবেশের। ঘরে-বাইরে এ ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে তুমি ছিলে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
শুধু সংবাদই নয়, দীর্ঘদিন তোমার সম্পাদনায় বের হতো বাংলাদেশের আরেক প্রগতিশীল পত্রিকা সাপ্তাহিক একতা। কমিউনিস্ট পার্টির এ পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে তুমি ১৯৮২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছ। শিক্ষাজীবনে ছাত্র ইউনিয়ন এবং পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলে বেশ কিছু সময়। এ দেশে যে কজন সাংবাদিক অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জনমানুষের জন্য কলম ধরেছেন, তাঁদের মধ্যে তুমি ছিলে অগ্রগণ্য। ১৯৭১ সালে তোমার সম্পাদনায় বের হওয়া মুক্তিযুদ্ধ নামের পত্রিকাটি সে সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিদিনকার খবর সরবরাহ করত এবং উত্সাহ দিত।
শিশুদের তুমি অসম্ভব ভালোবাসতে। এ দেশে শিশু সংগঠন এমনিতেই কম। কেননা শিশু সংগঠন তৈরি করা সহজ নয়। তুমি সেই কঠিন কাজটি করতে পেরেছিলে এবং সেটি এখন পর্যন্ত টিকে আছে। শিশু সংগঠক হিসেবে তোমার পরিচিতি এ দেশের সবারই কম-বেশি জানা। খেলাঘর নামের শিশু সংগঠনটির একসময়ের নিউক্লিয়াস ছিলে তুমি। ছিলে খেলাঘরের সবার ভালোবাসার ‘ভাইয়া’। খেলাঘর ছেড়েছ অনেক আগে, সেই আশির দশকের প্রথম ভাগেই, অথচ এখন পর্যন্ত সব প্রজন্মের খেলাঘরের বন্ধু তোমাকে ‘ভাইয়া’ হিসেবেই জানে।
প্রকৃতির সঙ্গে তোমার ছিল এক বিনিময়হীন খেলা। প্রকৃতির রঙে সব সময় নিজেকে রাঙাতে, সাজাতে চাইতে। অর্কিড ছিল তোমার খুব পছন্দের। সময় ও সুযোগ পেলেই ফুল কিনতে। যেকোনো ফুলের প্রতিই ছিল তোমার অসম্ভব পক্ষপাতিত্ব। কোথাও গেলে সেখানকার গাছপালা, ফুল, লতা-পাতা দেখা ছিল তোমার সহজাত। বিভিন্ন গাছের নাম, ফুলের নাম অবলীলায় বলে দিতে পারতে তুমি। কাপড়চোপড়ে সদা ফিটফাট ছিলে। তুমি দোকান থেকে ইস্ত্রি করে আনা জামা পরার আগে আবারও ঘরে ইস্ত্রি করতে। তোমার আলমারিতে তোমার কাপড়চোপড় সবই আগের মতো আছে, কোথাও ধুলো নেই, নেই শুধু সেই তুমি।
গান খুব পছন্দ করতে তুমি। যেদিন চলে গেলে, সেদিনও কিনেছিলে কিছু গানের সিডি। শোনা আর হয়নি। তোমার অফিসে গেলে শুনতে পেতাম বেহালা কিংবা তবলার সিডি বাজছে খুব অল্প ভলিউমে। আর এরই মধ্যে তুমি কাজ করছ। মাঝেমধ্যে ঢাকা ক্লাব, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে গান শুনতে যেতে। গাড়ির মধ্যে রাখতে প্রিয় গানের সিডিগুলো।
২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে ফোনালাপের সময় বলেছ, ক্লান্ত তুমি, খুব ব্যস্ত ছিলে পুরোটা দিন। রাত ১১টার পর সারা জীবনের ছুটি মিলল। চিরকালের ছুটি। এরপর কাঠের ছোট্ট খাটে করে সেই রাতেই রওনা হয়েছ তোমার গ্রামে, ফিরে এসেছ ভোরে ঢাকায়, দুপুরে তোমার কর্মস্থল সংবাদ অফিস ঘুরে মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্টে। তারপর হাজারো মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর বিদায় নিয়ে সব ক্লান্তির ওপর ভর করে চলে গেলে চিরদিনের ছুটির তরে...
ঋজুতা ছিল তোমার চরিত্রের এক ঈর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। মিতভাষী, অথচ প্রচণ্ড রসবোধ। যার কারণে অনেক তুখোড় বক্তাও তোমার মনোযোগী শ্রোতা হয়ে যেত। অসম্ভব এক ধৈর্যশীল শ্রোতা। নিজেকে শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখোনি। ধীর লয়ের মার্জিত অথচ প্রখর ধারালো তোমার যুক্তি, তত্ত্ব ও তথ্যবহুল।
জীবন থেকে চিরদিনের ছুটি নেওয়ার আগ পর্যন্ত ছিলে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রগতিশীল পত্রিকা সংবাদ-এর সম্পাদক। অর্থনীতির ছাত্র হয়েও তুমি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলে সাংবাদিকতাকে। দীর্ঘ ৪৭ বছর তুমি এই পত্রিকাটি আঁকড়ে থেকেছ, আগলে রেখেছ। দৈনিক সংবাদ পরিগণিত হয়েছিল সাংবাদিকতার প্রতিষ্ঠান হিসেবে। সেই প্রতিষ্ঠানেরই অলিখিত শিক্ষক ছিলে তুমি। আশির দশকে সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘দর্শক’ নামের লেখা নিয়মিত কলামটি এখনো অনেকের কাছেই তথ্যের ভাণ্ডার হিসেবে আছে।
এ কথা তো আমরা সবাই জানি, যিনি প্রদীপ ধরে রাখেন, তিনি আড়ালেই থাকেন। ব্যক্তিজীবনেও হয়তো তুমি তা-ই ছিলে, নিজ থেকে কখনো আলোর রশ্মিতে উদ্ভাসিত হতে চাওনি। সম্পদশালী জীবন ছিল না তোমার, কিন্তু আদর্শের মাপে, জীবনবোধের পরিমাপে তোমার জীবন ছিল অনেক বেশি সমৃদ্ধ।
নারীস্বাধীনতা এবং নারী-পুরুষের সম-অধিকারে বিশ্বাসী মানুষ জগৎ সংসারে খুব কম। সেই কমদের ভিড় ঠেলে তুমি নারীস্বাধীনতার আলোটি এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছ। এ বিষয়ে খুব বেশি বাতচিতের ধার ধারোনি, কাজের মধ্য দিয়েই তুমি নারীস্বাধীনতার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছ। যত দূর জানা যায়, দৈনিক সংবাদ-এর মধ্য দিয়েই এ দেশে নারী সাংবাদিকতার শক্ত বুনিয়াদ তৈরি হয়। শুধু এ দেশেই নয়, প্রায় সব দেশেই একজন নারীকে তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ করতে দরকার হয় পরিবেশের। ঘরে-বাইরে এ ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে তুমি ছিলে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
শুধু সংবাদই নয়, দীর্ঘদিন তোমার সম্পাদনায় বের হতো বাংলাদেশের আরেক প্রগতিশীল পত্রিকা সাপ্তাহিক একতা। কমিউনিস্ট পার্টির এ পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে তুমি ১৯৮২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছ। শিক্ষাজীবনে ছাত্র ইউনিয়ন এবং পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলে বেশ কিছু সময়। এ দেশে যে কজন সাংবাদিক অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জনমানুষের জন্য কলম ধরেছেন, তাঁদের মধ্যে তুমি ছিলে অগ্রগণ্য। ১৯৭১ সালে তোমার সম্পাদনায় বের হওয়া মুক্তিযুদ্ধ নামের পত্রিকাটি সে সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিদিনকার খবর সরবরাহ করত এবং উত্সাহ দিত।
শিশুদের তুমি অসম্ভব ভালোবাসতে। এ দেশে শিশু সংগঠন এমনিতেই কম। কেননা শিশু সংগঠন তৈরি করা সহজ নয়। তুমি সেই কঠিন কাজটি করতে পেরেছিলে এবং সেটি এখন পর্যন্ত টিকে আছে। শিশু সংগঠক হিসেবে তোমার পরিচিতি এ দেশের সবারই কম-বেশি জানা। খেলাঘর নামের শিশু সংগঠনটির একসময়ের নিউক্লিয়াস ছিলে তুমি। ছিলে খেলাঘরের সবার ভালোবাসার ‘ভাইয়া’। খেলাঘর ছেড়েছ অনেক আগে, সেই আশির দশকের প্রথম ভাগেই, অথচ এখন পর্যন্ত সব প্রজন্মের খেলাঘরের বন্ধু তোমাকে ‘ভাইয়া’ হিসেবেই জানে।
প্রকৃতির সঙ্গে তোমার ছিল এক বিনিময়হীন খেলা। প্রকৃতির রঙে সব সময় নিজেকে রাঙাতে, সাজাতে চাইতে। অর্কিড ছিল তোমার খুব পছন্দের। সময় ও সুযোগ পেলেই ফুল কিনতে। যেকোনো ফুলের প্রতিই ছিল তোমার অসম্ভব পক্ষপাতিত্ব। কোথাও গেলে সেখানকার গাছপালা, ফুল, লতা-পাতা দেখা ছিল তোমার সহজাত। বিভিন্ন গাছের নাম, ফুলের নাম অবলীলায় বলে দিতে পারতে তুমি। কাপড়চোপড়ে সদা ফিটফাট ছিলে। তুমি দোকান থেকে ইস্ত্রি করে আনা জামা পরার আগে আবারও ঘরে ইস্ত্রি করতে। তোমার আলমারিতে তোমার কাপড়চোপড় সবই আগের মতো আছে, কোথাও ধুলো নেই, নেই শুধু সেই তুমি।
গান খুব পছন্দ করতে তুমি। যেদিন চলে গেলে, সেদিনও কিনেছিলে কিছু গানের সিডি। শোনা আর হয়নি। তোমার অফিসে গেলে শুনতে পেতাম বেহালা কিংবা তবলার সিডি বাজছে খুব অল্প ভলিউমে। আর এরই মধ্যে তুমি কাজ করছ। মাঝেমধ্যে ঢাকা ক্লাব, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে গান শুনতে যেতে। গাড়ির মধ্যে রাখতে প্রিয় গানের সিডিগুলো।
২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে ফোনালাপের সময় বলেছ, ক্লান্ত তুমি, খুব ব্যস্ত ছিলে পুরোটা দিন। রাত ১১টার পর সারা জীবনের ছুটি মিলল। চিরকালের ছুটি। এরপর কাঠের ছোট্ট খাটে করে সেই রাতেই রওনা হয়েছ তোমার গ্রামে, ফিরে এসেছ ভোরে ঢাকায়, দুপুরে তোমার কর্মস্থল সংবাদ অফিস ঘুরে মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্টে। তারপর হাজারো মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর বিদায় নিয়ে সব ক্লান্তির ওপর ভর করে চলে গেলে চিরদিনের ছুটির তরে...
No comments