আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ও কমিটি গঠন নিয়ে কিঞ্চিত্ by সৈয়দ আবুল মকসুদ
কোনো দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের জাতীয় কাউন্সিল উৎসবমুখর পরিবেশে হলো কি না তা বিবেচ্য বিষয় নয়, যদিও আমাদের মিডিয়া উৎসবমুখরতাকেই বেশি মূল্য দেয়, কর্মমুখরতার চেয়ে। কাউন্সিলে দলের নীতি-আদর্শ ও কর্মকাণ্ড নিয়ে ছোটবড় নেতারা খোলামেলা আলোচনা ও নেতৃত্বের ভূমিকার চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারলেন কি না সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। দলীয় কাউন্সিল কোনো বউ-ভাতের অনুষ্ঠান নয়, জেয়াফত বা মেজবানিও নয়; সেখানে অংশগ্রহণকারীদের বিরিয়ানিটা খাসা হয়েছিল কি না, অথবা মাছ ভাজাটা মচমচে ছিল কি না, সেটা ধর্তব্যের বিষয় নয়। আসল ব্যাপার হলো, সেখানে দলের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কী বিতর্ক হলো। আরও বড় ব্যাপার, কাউন্সিলরদের ভোটে কোন নেতা বাদ পড়লেন, আর কারা পেলেন নতুন নেতৃত্ব।
পুঁজিবাদের সমর্থকেরা হাত নেড়ে জোর গলায় বলেন, সমাজতান্ত্রিক দেশে ‘গণতন্ত্র নাই’। কিন্তু সেসব দেশেও কমিউনিস্ট পার্টির যে কাউন্সিল হয়, তাতে যথেষ্টই গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ ও রীতিনীতির অনুশীলন হয়ে থাকে। অবশ্য স্তালিনের আমলের সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা আমরা বলব না। সে সময়টিও ছিল অন্য রকম। তার পরও অনেক দিন শীতল-যুদ্ধের সময়ের সমস্যা ছিল। অনেক কিছু জানা যায় নিকিতা খ্রুশ্চভের Khrushchev Remembers : The Last Testament (১৯৭৪) পড়লে। কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই কমিউনিস্ট পার্টির কাউন্সিলে নেতাদের সমালোচনা সহ্য করতে হয় এবং নতুন নেতা নির্বাচিত হন ভোটে।
রুশ দেশে সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে অথবা চিকিত্সার জন্য যাওয়ার সুযোগ আমার হয়নি, তবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর খবর আমি সামান্য রাখি। কয়েক বছর আগে কলকাতায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী), সংক্ষেপে সিপিএমের কাউন্সিল হয়েছিল। কেউ আমাকে আমন্ত্রণ করেনি, ওটা দেখতে আমি নিজের থেকেই কলকাতা গিয়েছিলাম। উৎসবমুখরতা আছে বটে, কিন্তু সে এক বিশাল আয়োজন। আলোচনা খোলামেলা। নেতারা অনেকে তাঁদের কাজের জন্য প্রশংসিত ও সমালোচিত হলেন। প্রত্যুত্তর বা কৈফিয়ত দিলেন অনেকে। ঠেলাঠেলির মধ্যে দূর থেকে সর্বভারতীয় অনেক নেতাকে দেখলাম। গণশক্তির সাংবাদিকদের কল্যাণে আলীমুদ্দিন স্ট্রিটে পার্টি অফিসে কাছে থেকেও দেখলাম কাউকে।
কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হয়ে গেল ‘বিপুল উদ্দীপনা’য় ও ‘উৎসবমুখর’ পরিবেশে। অন্যবার আমন্ত্রণপত্র পাই এবং যাই; এবার দাওয়াত পাইনি, তাই যাওয়াও হয়নি। কাগজ ও টিভি চ্যানেল থেকে যেটুকু জানলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ষষ্ঠবারের মতো সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন, সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, তিনি অনেক দিন থেকেই ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও দলের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করছিলেন। শেখ হাসিনা ও সৈয়দ আশরাফকে অভিনন্দন। দুটি বছর তাঁরা বাংলাদেশের অভূতপূর্ব জরুরি তুফানের মধ্যে আওয়ামী লীগের নৌকার দুই গলুইয়ে বসে তরীটিকে শুধু ডোবার হাত থেকেই যে রক্ষা করেছেন তা-ই নয়, বেশ দক্ষতার সঙ্গে তাকে ক্ষমতার ঘাটে ভিড়িয়েছেন। এ দুটি পদ তাঁদেরই প্রাপ্য। তাঁদের সাফল্য কামনা করি।
আওয়ামী লীগের বয়স আমার চেয়ে কম। মাত্র কয়েক দিন আগে তার ৬০ পুরো হলো। ছয় দশকে এই দল কয়েকবার ক্ষমতায় যায়, বেশির ভাগ সময় ছিল ক্ষমতার বাইরে। অর্থাৎ বিরোধী দলে থেকে জনগণকে নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। তবে দেখা গেছে, যখন ক্ষমতার বাইরে থাকে, তখন অনেক ভালো বিষয় নিয়ে ভাবে। নব্বইয়ের প্রথম দিকে যখন বেগম জিয়া ক্ষমতায়, তখন কয়েকজন বিখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা আমাকে বললেন দলটির একটি ইতিহাস লেখার জন্য। তার কিছুদিন আগে বাংলা একাডেমী আমার মওলানা ভাসানীর জীবনী বের করে। দেশের একটি প্রধান গণতান্ত্রিক দলের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস থাকা দরকার। আমি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে থাকি। শুধু দেশের মধ্যে নয়, কলকাতা, দিল্লি, লাহোর ও করাচির ১৯৪৯-৫০ সালের ইংরেজি ও উর্দু পত্রিকায় প্রকাশিত দলের জন্মের সংবাদগুলো দেখি। আওয়ামী লীগের নামকরণের ইতিহাসটা আজ হয়তো অনেকেই জানেন না। মুসলিম লীগ থেকেই এ দলের জন্ম, কিন্তু এটি মুসলিম লীগের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠন নয়। সেদিনের বাস্তবতায় নেতারা চেয়েছিলেন জনগণের মুসলিম লীগ গঠন করতে—জমিদার, জোতদার আর অভিজাতদের মুসলিম লীগ নয়। দল যেদিন আত্মপ্রকাশ করে, সেদিন ভারতের প্রধান ইংরেজি দৈনিকগুলো সাত-আট কলামব্যাপী শিরোনাম দেয়: ঢাকায় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে Jonogoner Muslim League formed.
প্রথম দিন নেতারা যথার্থভাবেই ‘জনগণের মুসলিম লীগ’ নাম ঠিক করেন, পরে মওলানা ভাসানী ও অন্যান্য নেতা নামকরণ করেন: ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’—অর্থ সেই একই—জনগণের মুসলিম লীগ। পরদিন ভারতের পত্রপত্রিকা অবশ্য লেখে Awami Muslim League.
ষাট বছরে ১৮ কি ২০ বার দলের কাউন্সিল হয়েছে। আগাগোড়া মোটামুটি জনগণের দলই ছিল। ষাটের দশকে কমলাপুর হোটেলের সামনে শামিয়ানা খাটিয়ে যে কাউন্সিল হয়েছে, তাতে দর্শক হিসেবে আমরা গেছি। একবার কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে যাই। কোনো চাকচিক্য থাকত না। কাউন্সিলে চাকচিক্য আসে স্বাধীনতার পরে। তখন আর শুধু জনগণের লীগ নেই দলটি—শাসকদেরও লীগ হয়ে গেছে, জাতীয় বুর্জোয়ারা সব হিড় হিড় করে আওয়ামী লীগে ঢুকে যাচ্ছে। কিন্তু তখনো নেতৃত্বটি ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতে, কোটিপতিদের হাতে নয়। স্বাধীনতার পর যে সম্মেলনে জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক হন, সেটিও কাছে থেকে দেখেছি। ২০০৩ সালের কাউন্সিলটির কমিটি গঠনের আমি প্রশংসা করে লিখেছিলাম। কিন্তু সেদিনের অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত বা মনোনীত যেসব নতুন নেতার প্রশংসা করেছিলাম, পরে তাঁদের তেমন প্রশংসনীয় ভূমিকা দেখিনি। সুতরাং এবারের নতুনদের প্রশংসা করতে দ্বিধা হচ্ছে। তবে তাঁদের স্বাগত জানাই।
দুটি বছর বাংলাদেশের রাজনীতিতে রোজকিয়ামত ঘটেছে, কোনো এক অপদেবতা সবকিছু তছনছ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও একটি গণতান্ত্রিক দলের কাউন্সিল কেন যথাসময়ে হয় না, সেটি একটি প্রশ্ন। নির্বাচন কমিশনের চাপ বা আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলে এখনো যে হতো, তাও নয়। এ প্রশ্নের জবাব একটাই: নেতৃত্বের কাছে কাউন্সিলের মূল্য কম। হলে হলো, না হলে না হলো; দল তো চলছেই। দলের কাউন্সিল অনুষ্ঠান হলো গাড়ির পুরোনো ইঞ্জিনকে ওভারহল করার মতো। দীর্ঘদিন গাড়ির ইঞ্জিনে হাত না দিলে যে দশা হয়, দলে কাউন্সিল করে নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত না করলে সেই অবস্থা হয়। দল আর ঠিকমতো চলে না। কিছু দূর গিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। ধাক্কাধাক্কি করে চালাতে হয়।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি বড় দল যখন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যায়, তখন তার কাজ দুটো: দলের গঠিত সরকার রাষ্ট্রের প্রশাসন চালায়, অন্যদিকে সরকারের বাইরে দলের নেতারা লক্ষ রাখেন, সরকার ঠিকঠাকমতো কাজ করছে কি না। অর্থাৎ দলের ভূমিকা বড়: জনগণের স্বার্থ দেখা এবং সরকারেরও স্বার্থ দেখা। সে জন্য সরকারপ্রধান ও দলীয় প্রধান একই ব্যক্তি না হওয়া কাম্য। দলের সাধারণ সম্পাদকের কোনোক্রমেই মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করা সংগত নয়।
আওয়ামী লীগ ভারতপন্থী দল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে কোনো শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। ভারতের প্রধান দলগুলো কীভাবে পরিচালিত হয়, তা থেকে শিখতে চান না তাঁরা। ওখানে দল আর মন্ত্রিসভা আলাদা—দলীয় প্রধান ও সরকারপ্রধান দুই ব্যক্তি। নিজের ভুল কেউ নিজে ধরতে পারে না। সরকারপ্রধানের অগ্রহণযোগ্য কাজের সমালোচনা করবেন দলের প্রধান। যেমন প্রধামন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ও মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের সমালোচনা করতেন মওলানা ভাসানী। অন্যদিকে সরকারপ্রধান দলের সভাপতি ও অন্য নেতাদের মন্দ কাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি হলে তা হয় না। সে জন্যই যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময় ভাসানী শেখ মুজিবকে মন্ত্রিত্ব অথবা সাধারণ সম্পাদকের পদ—দুটোর একটি বেছে নিতে বলেন। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন।
বহু মতের সংঘাত ও সমন্বয় সাধনই গণতন্ত্র। শীর্ষ নেতার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা নয় এবং তা যতই মহত্ হোক। এ কাজটি মওলানা ভাসানীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে। নিজের ভালো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে দলীয় রাজনীতির ক্ষতি করেছেন। দল দুর্বল হয়েছে, এক পর্যায়ে ভেঙে গেছে। প্রধান নেতাকে অন্য নেতার কথা শুনতে হবে। সবচেয়ে ছোট নেতা যদি সবচেয়ে দামি কথা বলেন, তা গ্রহণ করতে হবে। সেটাই গণতন্ত্র। শীর্ষ নেতাকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া গণতন্ত্র নয়, তাতে দল দুর্বল হয়। কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করার চেয়ে যদি দলের কাউন্সিলে তর্কাতর্কি এমনকি হাতাহাতি হয়, তাও ভালো।
দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষিত হয়েছে দিন পাঁচেক পরে। সেটাই বা হলো কেন? সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, ‘আমার সঙ্গে পরামর্শ করে এবং কাউন্সিলরদের সঙ্গে আলোচনা করে, তাঁদের মতামত নিয়ে’ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু তা গোপনে কেন? কয়েক দিন দেরি করায় অনেক নেতার উদ্বেগে হার্টফেল করার উপক্রম। আরও বলা হয়েছে, সভানেত্রীর আস্থাভাজনদেরই কমিটিতে নেওয়া হয়েছে। যাঁরা কম আস্থাভজন, তাঁরা বাদ পড়েছেন। বিশ্বস্ততা ও আস্থাভাজন কথা দুটি আপেক্ষিক। আজ যে আস্থাভাজন, কাল সে নাও থাকতে পারে। স্বামী-স্ত্রীতে ছাড়াছাড়ি হচ্ছে ৫০ বছর সংসার করার পর। পিতা-পুত্রে বিচ্ছেদ হচ্ছে। এক ফাল্গুনে মাধবকুণ্ডে জলপ্রপাতে গোসল করার সময় যে তার প্রিয়তমাকে বলেছে, ‘মন্টি, তোমাকে ছাড়া বাঁচব না,’ পরের ফাল্গুনে তাকে দেখা গেছে কক্সবাজার সৈকতে আরেক নারীর সঙ্গে হাওয়া খেতে। চিরকাল বিশ্বস্ত থাকে এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল না হলেও কম।
কবির জীবনদেবতা আর রাজনীতিতে দলীয় দেবতা দুই জিনিস। জীবনদেবতার উদ্দেশে কবি বলতে পারেন যে,
তব দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে।
নইলে কি আর পারব তোমার চরণ ছুঁতে।
কিন্তু রাজনীতিতে বড় সংগঠনের নেতাদের দলীয় দেবতার উদ্দেশে তেমনভাবে ভক্তি নিবেদন করা সম্ভব নয়। উচিৎও নয়।
কে বিশ্বাসী আর বিশ্বাসভাজন নন, তা সব সময় বোঝা সম্ভব নয়। ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশালে খন্দকার মোশতাকের রোল নম্বর ছিল ৪, তাঁর আগে ছিলেন মাত্র তিনজন: বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ও মনসুর আলী। বাকশালে তাজউদ্দীনের ঠাঁই না হলেও মোশতাক, তাহের ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেমরা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আস্থাভাজন হিসেবে যাঁদের জেলা গভর্নর বানিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশ পটপরিবর্তনের পরে বিএনপি প্রভৃতি দলে যোগ দেন।
এবার যাঁরা সংস্কারের নাম করে সেনাসমর্থিত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ভাব দিয়ে চলেছেন অথবা স্রেফ আত্মরক্ষার জন্য শেখ হাসিনার পরোক্ষ সমালোচনা করেছেন, তাঁদের চিরশত্রু মনে করা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়। পঁচাত্তরের ১৬ আগস্ট থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ডালিম-ফারুকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তাঁরা তো এখনো দলে রয়ে গেছেন। ব্যক্তিজীবনে যেমন, রাষ্ট্রীয় জীবনেও compromise and adjustment করেই চলতে হয়। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো নাকি পাপ; রাজনৈতিক নেতারাও মানুষ, তাঁদের ওপর বিশ্বাস হারানোও গুনাহ। সংস্কারপন্থীদের ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস না হারানোই সমীচীন।
আওয়ামী লীগে অগণতান্ত্রিক অসহিষ্ণুতা আগেও ছিল। প্রধান নেতার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণের খেসারত অনেকেই দিয়েছেন। ড. কামাল হোসেন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও আরও অনেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। আওয়ামী লীগে দ্বিমত পোষণের ঝুঁকি মারাত্মক। বাকশাল গঠনে ১০ ভাগ নেতারও সমর্থন ছিল কি না সন্দেহ। ৯০ ভাগ ভিন্নমত পোষণ করা সত্ত্বেও নীরবতা অবলম্বন করেন এই জন্য যে তাতে তাঁদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বরবাদ হতো। গলায় গামছা দিয়ে ‘সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত’ গ্রহণ করার নাম গণতন্ত্র নয়। বাকশাল গঠনের মূল্য শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকেই দিতে হয়েছে, অন্য কোনো দলকে নয়। বাকশাল গঠন নিয়ে সেদিন যদি সংসদে ও বাইরে বিতর্ক হতো, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হতো। বঙ্গবন্ধুও হয়তো নিহত হতেন না, দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র থাকত।
যে সংগঠনের সবাই একই জিনিস ভাবেন, সেখানে বহুজনকে নিয়ে কমিটি গঠনের দরকার কী? অন্ধভাবে নেতাকে সমর্থন দিয়ে গেলেই তো হলো। রাজনৈতিক দল ফুটবল টিমের মতো। শুধু ক্যাপ্টেন বিজয় অর্জন করতে পারেন না, সবাই মিলে ভালো না খেললে সফল হওয়া সম্ভব নয়। বিষয়টি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ভেবে দেখবেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
পুঁজিবাদের সমর্থকেরা হাত নেড়ে জোর গলায় বলেন, সমাজতান্ত্রিক দেশে ‘গণতন্ত্র নাই’। কিন্তু সেসব দেশেও কমিউনিস্ট পার্টির যে কাউন্সিল হয়, তাতে যথেষ্টই গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ ও রীতিনীতির অনুশীলন হয়ে থাকে। অবশ্য স্তালিনের আমলের সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা আমরা বলব না। সে সময়টিও ছিল অন্য রকম। তার পরও অনেক দিন শীতল-যুদ্ধের সময়ের সমস্যা ছিল। অনেক কিছু জানা যায় নিকিতা খ্রুশ্চভের Khrushchev Remembers : The Last Testament (১৯৭৪) পড়লে। কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই কমিউনিস্ট পার্টির কাউন্সিলে নেতাদের সমালোচনা সহ্য করতে হয় এবং নতুন নেতা নির্বাচিত হন ভোটে।
রুশ দেশে সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে অথবা চিকিত্সার জন্য যাওয়ার সুযোগ আমার হয়নি, তবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর খবর আমি সামান্য রাখি। কয়েক বছর আগে কলকাতায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী), সংক্ষেপে সিপিএমের কাউন্সিল হয়েছিল। কেউ আমাকে আমন্ত্রণ করেনি, ওটা দেখতে আমি নিজের থেকেই কলকাতা গিয়েছিলাম। উৎসবমুখরতা আছে বটে, কিন্তু সে এক বিশাল আয়োজন। আলোচনা খোলামেলা। নেতারা অনেকে তাঁদের কাজের জন্য প্রশংসিত ও সমালোচিত হলেন। প্রত্যুত্তর বা কৈফিয়ত দিলেন অনেকে। ঠেলাঠেলির মধ্যে দূর থেকে সর্বভারতীয় অনেক নেতাকে দেখলাম। গণশক্তির সাংবাদিকদের কল্যাণে আলীমুদ্দিন স্ট্রিটে পার্টি অফিসে কাছে থেকেও দেখলাম কাউকে।
কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হয়ে গেল ‘বিপুল উদ্দীপনা’য় ও ‘উৎসবমুখর’ পরিবেশে। অন্যবার আমন্ত্রণপত্র পাই এবং যাই; এবার দাওয়াত পাইনি, তাই যাওয়াও হয়নি। কাগজ ও টিভি চ্যানেল থেকে যেটুকু জানলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ষষ্ঠবারের মতো সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন, সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, তিনি অনেক দিন থেকেই ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও দলের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করছিলেন। শেখ হাসিনা ও সৈয়দ আশরাফকে অভিনন্দন। দুটি বছর তাঁরা বাংলাদেশের অভূতপূর্ব জরুরি তুফানের মধ্যে আওয়ামী লীগের নৌকার দুই গলুইয়ে বসে তরীটিকে শুধু ডোবার হাত থেকেই যে রক্ষা করেছেন তা-ই নয়, বেশ দক্ষতার সঙ্গে তাকে ক্ষমতার ঘাটে ভিড়িয়েছেন। এ দুটি পদ তাঁদেরই প্রাপ্য। তাঁদের সাফল্য কামনা করি।
আওয়ামী লীগের বয়স আমার চেয়ে কম। মাত্র কয়েক দিন আগে তার ৬০ পুরো হলো। ছয় দশকে এই দল কয়েকবার ক্ষমতায় যায়, বেশির ভাগ সময় ছিল ক্ষমতার বাইরে। অর্থাৎ বিরোধী দলে থেকে জনগণকে নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। তবে দেখা গেছে, যখন ক্ষমতার বাইরে থাকে, তখন অনেক ভালো বিষয় নিয়ে ভাবে। নব্বইয়ের প্রথম দিকে যখন বেগম জিয়া ক্ষমতায়, তখন কয়েকজন বিখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা আমাকে বললেন দলটির একটি ইতিহাস লেখার জন্য। তার কিছুদিন আগে বাংলা একাডেমী আমার মওলানা ভাসানীর জীবনী বের করে। দেশের একটি প্রধান গণতান্ত্রিক দলের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস থাকা দরকার। আমি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে থাকি। শুধু দেশের মধ্যে নয়, কলকাতা, দিল্লি, লাহোর ও করাচির ১৯৪৯-৫০ সালের ইংরেজি ও উর্দু পত্রিকায় প্রকাশিত দলের জন্মের সংবাদগুলো দেখি। আওয়ামী লীগের নামকরণের ইতিহাসটা আজ হয়তো অনেকেই জানেন না। মুসলিম লীগ থেকেই এ দলের জন্ম, কিন্তু এটি মুসলিম লীগের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠন নয়। সেদিনের বাস্তবতায় নেতারা চেয়েছিলেন জনগণের মুসলিম লীগ গঠন করতে—জমিদার, জোতদার আর অভিজাতদের মুসলিম লীগ নয়। দল যেদিন আত্মপ্রকাশ করে, সেদিন ভারতের প্রধান ইংরেজি দৈনিকগুলো সাত-আট কলামব্যাপী শিরোনাম দেয়: ঢাকায় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে Jonogoner Muslim League formed.
প্রথম দিন নেতারা যথার্থভাবেই ‘জনগণের মুসলিম লীগ’ নাম ঠিক করেন, পরে মওলানা ভাসানী ও অন্যান্য নেতা নামকরণ করেন: ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’—অর্থ সেই একই—জনগণের মুসলিম লীগ। পরদিন ভারতের পত্রপত্রিকা অবশ্য লেখে Awami Muslim League.
ষাট বছরে ১৮ কি ২০ বার দলের কাউন্সিল হয়েছে। আগাগোড়া মোটামুটি জনগণের দলই ছিল। ষাটের দশকে কমলাপুর হোটেলের সামনে শামিয়ানা খাটিয়ে যে কাউন্সিল হয়েছে, তাতে দর্শক হিসেবে আমরা গেছি। একবার কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে যাই। কোনো চাকচিক্য থাকত না। কাউন্সিলে চাকচিক্য আসে স্বাধীনতার পরে। তখন আর শুধু জনগণের লীগ নেই দলটি—শাসকদেরও লীগ হয়ে গেছে, জাতীয় বুর্জোয়ারা সব হিড় হিড় করে আওয়ামী লীগে ঢুকে যাচ্ছে। কিন্তু তখনো নেতৃত্বটি ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতে, কোটিপতিদের হাতে নয়। স্বাধীনতার পর যে সম্মেলনে জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক হন, সেটিও কাছে থেকে দেখেছি। ২০০৩ সালের কাউন্সিলটির কমিটি গঠনের আমি প্রশংসা করে লিখেছিলাম। কিন্তু সেদিনের অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত বা মনোনীত যেসব নতুন নেতার প্রশংসা করেছিলাম, পরে তাঁদের তেমন প্রশংসনীয় ভূমিকা দেখিনি। সুতরাং এবারের নতুনদের প্রশংসা করতে দ্বিধা হচ্ছে। তবে তাঁদের স্বাগত জানাই।
দুটি বছর বাংলাদেশের রাজনীতিতে রোজকিয়ামত ঘটেছে, কোনো এক অপদেবতা সবকিছু তছনছ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও একটি গণতান্ত্রিক দলের কাউন্সিল কেন যথাসময়ে হয় না, সেটি একটি প্রশ্ন। নির্বাচন কমিশনের চাপ বা আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলে এখনো যে হতো, তাও নয়। এ প্রশ্নের জবাব একটাই: নেতৃত্বের কাছে কাউন্সিলের মূল্য কম। হলে হলো, না হলে না হলো; দল তো চলছেই। দলের কাউন্সিল অনুষ্ঠান হলো গাড়ির পুরোনো ইঞ্জিনকে ওভারহল করার মতো। দীর্ঘদিন গাড়ির ইঞ্জিনে হাত না দিলে যে দশা হয়, দলে কাউন্সিল করে নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত না করলে সেই অবস্থা হয়। দল আর ঠিকমতো চলে না। কিছু দূর গিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। ধাক্কাধাক্কি করে চালাতে হয়।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি বড় দল যখন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যায়, তখন তার কাজ দুটো: দলের গঠিত সরকার রাষ্ট্রের প্রশাসন চালায়, অন্যদিকে সরকারের বাইরে দলের নেতারা লক্ষ রাখেন, সরকার ঠিকঠাকমতো কাজ করছে কি না। অর্থাৎ দলের ভূমিকা বড়: জনগণের স্বার্থ দেখা এবং সরকারেরও স্বার্থ দেখা। সে জন্য সরকারপ্রধান ও দলীয় প্রধান একই ব্যক্তি না হওয়া কাম্য। দলের সাধারণ সম্পাদকের কোনোক্রমেই মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করা সংগত নয়।
আওয়ামী লীগ ভারতপন্থী দল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে কোনো শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। ভারতের প্রধান দলগুলো কীভাবে পরিচালিত হয়, তা থেকে শিখতে চান না তাঁরা। ওখানে দল আর মন্ত্রিসভা আলাদা—দলীয় প্রধান ও সরকারপ্রধান দুই ব্যক্তি। নিজের ভুল কেউ নিজে ধরতে পারে না। সরকারপ্রধানের অগ্রহণযোগ্য কাজের সমালোচনা করবেন দলের প্রধান। যেমন প্রধামন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ও মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের সমালোচনা করতেন মওলানা ভাসানী। অন্যদিকে সরকারপ্রধান দলের সভাপতি ও অন্য নেতাদের মন্দ কাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি হলে তা হয় না। সে জন্যই যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময় ভাসানী শেখ মুজিবকে মন্ত্রিত্ব অথবা সাধারণ সম্পাদকের পদ—দুটোর একটি বেছে নিতে বলেন। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন।
বহু মতের সংঘাত ও সমন্বয় সাধনই গণতন্ত্র। শীর্ষ নেতার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা নয় এবং তা যতই মহত্ হোক। এ কাজটি মওলানা ভাসানীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে। নিজের ভালো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে দলীয় রাজনীতির ক্ষতি করেছেন। দল দুর্বল হয়েছে, এক পর্যায়ে ভেঙে গেছে। প্রধান নেতাকে অন্য নেতার কথা শুনতে হবে। সবচেয়ে ছোট নেতা যদি সবচেয়ে দামি কথা বলেন, তা গ্রহণ করতে হবে। সেটাই গণতন্ত্র। শীর্ষ নেতাকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া গণতন্ত্র নয়, তাতে দল দুর্বল হয়। কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করার চেয়ে যদি দলের কাউন্সিলে তর্কাতর্কি এমনকি হাতাহাতি হয়, তাও ভালো।
দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষিত হয়েছে দিন পাঁচেক পরে। সেটাই বা হলো কেন? সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, ‘আমার সঙ্গে পরামর্শ করে এবং কাউন্সিলরদের সঙ্গে আলোচনা করে, তাঁদের মতামত নিয়ে’ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু তা গোপনে কেন? কয়েক দিন দেরি করায় অনেক নেতার উদ্বেগে হার্টফেল করার উপক্রম। আরও বলা হয়েছে, সভানেত্রীর আস্থাভাজনদেরই কমিটিতে নেওয়া হয়েছে। যাঁরা কম আস্থাভজন, তাঁরা বাদ পড়েছেন। বিশ্বস্ততা ও আস্থাভাজন কথা দুটি আপেক্ষিক। আজ যে আস্থাভাজন, কাল সে নাও থাকতে পারে। স্বামী-স্ত্রীতে ছাড়াছাড়ি হচ্ছে ৫০ বছর সংসার করার পর। পিতা-পুত্রে বিচ্ছেদ হচ্ছে। এক ফাল্গুনে মাধবকুণ্ডে জলপ্রপাতে গোসল করার সময় যে তার প্রিয়তমাকে বলেছে, ‘মন্টি, তোমাকে ছাড়া বাঁচব না,’ পরের ফাল্গুনে তাকে দেখা গেছে কক্সবাজার সৈকতে আরেক নারীর সঙ্গে হাওয়া খেতে। চিরকাল বিশ্বস্ত থাকে এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল না হলেও কম।
কবির জীবনদেবতা আর রাজনীতিতে দলীয় দেবতা দুই জিনিস। জীবনদেবতার উদ্দেশে কবি বলতে পারেন যে,
তব দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে।
নইলে কি আর পারব তোমার চরণ ছুঁতে।
কিন্তু রাজনীতিতে বড় সংগঠনের নেতাদের দলীয় দেবতার উদ্দেশে তেমনভাবে ভক্তি নিবেদন করা সম্ভব নয়। উচিৎও নয়।
কে বিশ্বাসী আর বিশ্বাসভাজন নন, তা সব সময় বোঝা সম্ভব নয়। ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশালে খন্দকার মোশতাকের রোল নম্বর ছিল ৪, তাঁর আগে ছিলেন মাত্র তিনজন: বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ও মনসুর আলী। বাকশালে তাজউদ্দীনের ঠাঁই না হলেও মোশতাক, তাহের ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেমরা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আস্থাভাজন হিসেবে যাঁদের জেলা গভর্নর বানিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশ পটপরিবর্তনের পরে বিএনপি প্রভৃতি দলে যোগ দেন।
এবার যাঁরা সংস্কারের নাম করে সেনাসমর্থিত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ভাব দিয়ে চলেছেন অথবা স্রেফ আত্মরক্ষার জন্য শেখ হাসিনার পরোক্ষ সমালোচনা করেছেন, তাঁদের চিরশত্রু মনে করা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়। পঁচাত্তরের ১৬ আগস্ট থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ডালিম-ফারুকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তাঁরা তো এখনো দলে রয়ে গেছেন। ব্যক্তিজীবনে যেমন, রাষ্ট্রীয় জীবনেও compromise and adjustment করেই চলতে হয়। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো নাকি পাপ; রাজনৈতিক নেতারাও মানুষ, তাঁদের ওপর বিশ্বাস হারানোও গুনাহ। সংস্কারপন্থীদের ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস না হারানোই সমীচীন।
আওয়ামী লীগে অগণতান্ত্রিক অসহিষ্ণুতা আগেও ছিল। প্রধান নেতার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণের খেসারত অনেকেই দিয়েছেন। ড. কামাল হোসেন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও আরও অনেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। আওয়ামী লীগে দ্বিমত পোষণের ঝুঁকি মারাত্মক। বাকশাল গঠনে ১০ ভাগ নেতারও সমর্থন ছিল কি না সন্দেহ। ৯০ ভাগ ভিন্নমত পোষণ করা সত্ত্বেও নীরবতা অবলম্বন করেন এই জন্য যে তাতে তাঁদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বরবাদ হতো। গলায় গামছা দিয়ে ‘সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত’ গ্রহণ করার নাম গণতন্ত্র নয়। বাকশাল গঠনের মূল্য শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকেই দিতে হয়েছে, অন্য কোনো দলকে নয়। বাকশাল গঠন নিয়ে সেদিন যদি সংসদে ও বাইরে বিতর্ক হতো, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হতো। বঙ্গবন্ধুও হয়তো নিহত হতেন না, দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র থাকত।
যে সংগঠনের সবাই একই জিনিস ভাবেন, সেখানে বহুজনকে নিয়ে কমিটি গঠনের দরকার কী? অন্ধভাবে নেতাকে সমর্থন দিয়ে গেলেই তো হলো। রাজনৈতিক দল ফুটবল টিমের মতো। শুধু ক্যাপ্টেন বিজয় অর্জন করতে পারেন না, সবাই মিলে ভালো না খেললে সফল হওয়া সম্ভব নয়। বিষয়টি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ভেবে দেখবেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments